Saturday, March 5, 2022

চাঁদ দেখতে চন্দ্রাহতরা

কোথাও বেড়াতে গেলে আমার এনার্জি যাতা লেভেলের হয়ে যায়। কাল অনেক রাত অব্দি বাইরে বসে থাকার পরেও আজ দিব্যি সাত সকালে উঠে তৈরী। সাত সকাল মানে অবশ্য তেমন কিছুও না, জেলেরা মাছ আনছে এমন সকাল। মেঘলা হয়ে আছে চারদিকটা, মাঝে মাঝেই টুপটাপ বৃষ্টি। একটু পরেই রম্ভা বেরিয়ে যাবো। যাওয়ার আগে ছোট্ট শান্ত সমুদ্রপাড়ের জনপদটা ঘুরে ঘুরে দেখে নিচ্ছি যতটা পারি। একটা ছোট্ট দোকানে খুব করে সকালের জলখাবার খেয়েছি কলাপাতায়।  ধোসা আর ঘুগনি, অদ্ভুত কম্বো! কতরকম খাওয়া যে আছে দুনিয়ায়। যা জানিনা তাইই অদ্ভুত লাগে। আমি যেমন, মুড়ি যে কোনো তরকারি দিয়ে তরিবৎ করে খাই, মাছের ঝোল দিয়েও, ডাল দিয়েও, যে খায়না সে ভাববে আজব কম্বো! 
অটোতে করে চলেছি, গাড়িতে ভাড়া বেশী হত, আমাদের এবারে বাজেট কাটছাঁটের ব্যপার আছে। অটোতে লম্বা ফাঁকা রাস্তা পাড়ি দিতেও মন্দ লাগেনা কিন্তু। খালি আওয়াজ খানা দিচ্ছে হানা এই যা। গোপালপুর থেকে রম্ভার রাস্তাট ভারী মনোরম। একটু দূরে ছোট ছোট নীল পাহাড়, রাস্তার পাশেই চাষের ক্ষেত, সবুজ হয়ে আছে। হাঁ করা ছেলে আমি, হাঁ করে এত রঙ, এত তরতাজা চারদিক দেখতে দেখতেই রাস্তা ফুরোয় আমার। তারাতারিনী মন্দির হয়ে তারপর রম্ভা যাবো৷ ভক্তি আমার নেই, কিন্তু মন্দির, মসজিদ, চার্চ এসব ভারী ইন্টারেস্টিং জায়গা। মানুষ দেখা তো আছেই, পুরোনো মন্দির গুলোয় যা অপূর্ব কারুকাজ থাকে আমাদের এখনকার লোকেদের দিলে ছড়িয়ে লাট করবে। এইতো সেদিন রাজস্থানের দিলোয়ারা মন্দিরে দেখি মন্দির পুনরুদ্ধারের অংশে পুরোনোর পাশে নতুনটা খুবই নিম্নমানের কাজ! যাকগে সে কথা থাক। তারাতারিনী মন্দির চড়তে গেলে হাজারটা সিঁড়ি ভাঙতে হয় অথবা রোপওয়ে চড়তে হয়। তা কোভিডের কারনে রোপওয়ে বন্ধ। 

অনেকগুলো সিঁড়ি পেরিয়ে একটা চাতালে পৌঁছে দেখি অনেকদূর অব্দি নীচটা দেখা যাচ্ছে, মেঘের জন্য ঈষৎ ঘোলাটে হলেও গাছপালা, পাহাড় থেকে দূরের নদী আর সমতলভূমি দেখতে চমৎকার লাগে।কতরকম লোক উঠছে, ছোট ছেলে থেকে হাঁফ ধরা বুড়ো বুড়ি সবাই৷ পুন্যের লোভ না ভক্তি জানিনা, এই মনের জোর বাড়ানো ওষুধটা মন্দ কি যাদের কাজ হয়। আমার যেমন হয় না, কিন্তু আমার আবার অন্য জিনিসে কাজ হয়, ওই মন্দিরের কাজ দেখবো, পুরোনো দেওয়ালের গায়ে দিলে কেমন রোমাঞ্চ হয়। মাঝে মাঝে টাটকা দই আর কারি পাতা দেওয়া জল নিয়ে মেয়েরা বসে আছে।  দশ টাকা বিশটাকা গ্লাস, বললেই ঘোল বানিয়ে দেবে। লোভ হচ্ছিল খুব, কিন্তু বাতিকও তো কম না, মানে জল নিয়ে। আসলে সেই একবার ধর্মতলায় লেবুর জল খেয়ে প্রান যায় যায় অবস্থা হয়েছিল  সেই থেকেই আমার অচেনা জল টপ করে খেতে ভয় লাগে। মন্দিরের গায়ের কাজ চমৎকার। কত দেবি দেভী, যক্ষিনীদের মূর্তি, কিছু চিনি কিছু চিনিনা। বাঁদরের উৎপাত ভয়ানক। পান্ডাদের চেহারা বেশ পালোয়ান সুলভ। মন্দিরে গিয়ে পুজো না দিয়ে  স্রেফ কাজ দেখলে কেমন অপছন্দের চোখে তাকায়। ঘুরে ঘুরে এক একটা প্যানেলের কাজ দেখছিলাম, তখনকার দিনের পুরুষমূর্তিদের স্ট্রাকচার কিঞ্চিৎ মেয়েদের মত, নারী পুরুষ বিভাজন চিহ্ন দেখে করতে হয়। এদিকে কালের নিয়মে নাক ইত্যাদি অংশ খসে গেছে, আর আমার মূর্তি সম্পর্কে পড়াশোনাও কম, ফলে আরোই চিনতে অসুবিধে হচ্ছে পূর্ব পরিচিত কাঠামো না হলে। কিন্তু খুঁজে খুঁজে মিলিয়ে এটা চন্ডী ওটা বিষ্ণু এরকম বের করতে পারলে বেশ আনন্দ পাওয়া যায়। 
মন্দিরের পিছন দিকটায় স্বাভাবিকভাবেই লোক কম, পাহাড় কেটে চওড়া রাস্তা হচ্ছে ও দিকটায়, দূরে ঋষিকুল্যা নদী দেখা যাচ্ছে। পাহাড় কাটলে আমার বেজায় দুঃখ হয়। পাহাড় নিজেই একটা জ্যান্ত জিনিস তায় কত প্রাণী, কত গাছ, কত ইতিহাসের আবাস। এত উন্নতি মানুষ রাখবে কোথায় কে জানে! মন্দিরের বাইরে খোদাই করাএকটা মূর্তির উপর একটা গোদা হনুমান বসে বসে আধখানা নারকেলের মালা কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে, আর তার পাশে একটা হেংলু মত ছানা হনুমান প্রানপন তাকিয়ে আছে, যদি ওকে একটু দেওয়া হয়। গোদাটা পাত্তা না দিয়ে খেয়েই চলেছে, শেষে ছোটটা গোদাটার গায়ে গুঁড়ো গুঁড়ো পড়া নারকেল গুলো তুলেই খাচ্ছে আবার তাকাচ্ছে এতে যদি মায়া হয়। অতই সোজা হে, গুঁড়ো খেয়েই আমাদের যাপন চলে মায়া আর লাগে কই কারো! আরেকপাশে আরেকটা ছোট বাঁদর মন খারাপ করে বসে, যেন সাতসকালে ওকে ইস্কুলে যেতে বলা হয়েছে আর ও যেতে চায়ইই না। 
নামার সময় একটা মোটাসোটা প্রৌঢ়কে দেখি ঘেমে নেয়ে অস্থির, হাত ধরে দুটো স্টেপ তুললাম। স্ট্রোক হয়ে গেছে কিনা কে জানে! তবু উঠতেই হবে! নামার পথে লোভ ভয়ের থেকে বেশী হল, টকটক পান্তা স্বাদের ওই দই এর ঘোল খেলুম এক চুমুক। রম্ভায় পৌঁছে ঘরে ঢুকে  দেখি নারকেল গাছের পর্দা চিল্কাকে দেখতে দিচ্ছে না।  ম্যানেজারকে বিস্তর অনুরোধ করে ঘর বদল হল, চান করে কাঁকড়াও খাওয়া হল। যদিও আহামরি কিছু না। পূর্ব ভারতের আতিথেয়তা শিল্পের উন্নতি সাধন খুব দরকারি। হিমাচলের প্রতিটা সরকারি হোটেলের স্টাফদের ব্যবহার খুব ভালো ছিল এখানে যেন দায়সারা ভাব সবার মধ্যে। আজ নৌকা চড়ব না আমরা, কাল যাবো আজ এমনিই বসে থাকবো জলের ধারে, রাতে জ্যোৎস্নায় ধোওয়া পাহাড় হ্রদ দেখবো এই আশায় এসেছি, যদিও আজও আকাশের মুখ ভার। জেটিতে হরেক লোকের আনাগোনা তখন, একটা অল্পবয়সী পরিবার এসেছে, ছেলে মেয়ে দুটো অল্প বয়সেই বাপ মা হয়েছে, ছানাটাও ক্ষুদে। লোকটা, ছেলেই বলা যায়, ছেলেকে সামলাবে না বউকে না শালীর আবদারে পোজ দিয়ে ছবি তুলবে সে নিয়ে নাজেহাল হচ্ছে। খানিক বাদে একটা বড় দল এলো, ক্যাচোরম্যাচোর করে একাকার। কতগুলো নৌকা এলো গেলো, কত গুলো পরিযায়ী পাখি একমনে খাবার খুঁজে গেল। ক্রমে সন্ধ্যে হয়ে এলো, পাহাড় গুলো জমাট ছায়ার মতো হল, জলে সেই ছায়া ঘনিয়ে এলো।  
সন্ধ্যে থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে ফের টুপটাপ করে। ঢাকা বারান্দায় বসে চায়ের কাপ হাতে ঝুপ্সি অন্ধকারে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম কখন ব্যাটা থামবে আর জ্যোৎস্না দেখতে পাবো। একটা বড় পরিসরে, চাঁদের আলোয় কখনো কেউ ডুব দিলে তার হয়ে গেল, সারাজীবন বুকের মধ্যে খানিকটা জায়গা বালি বালি জ্যোৎস্না হয়ে যাবে। ভিতর থেকে তাড়া খাবে সবসময়ে, কিন্তু কিসের তা সে জানবে না, টের পাবে না কেন এই অস্থিরতা। তারপর আবার কোনো নিস্তব্ধ চাঁদের আলোয় স্নান করে টের পাবে তার আসল পাওয়ার জায়গা কোনটা, কিসে তার শান্তি। তারপর? তারপর আবার ভুলে গিয়ে খোঁজ লাগাবে।
চাঁদ বেরোলো,  মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে। দূরে চিল্কা আর সংলগ্ন বেঁটেখাটো পাহাড়, গাছপালায় চাঁদের আলোয় অপার্থিব রূপ নিয়েছে। ভালো বোঝা যায় না কেন, কিন্তু এসব সময়টা মনে হয় আমি যেন এখানে অনাহুত, এরা সবাই কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে আমায় দেখেই চুপ, কিংবা এখনো বলছে আমার কানে যাচ্ছে না। আমি পাহাড়, জল, গাছ, বাতাস সবেতেই প্রাণ খুঁজে পাই, আমার কাছে এরা কেউই প্রাণহীন না।মনে হয় এদের ভাষা শিখে উঠতে পারিনি এখনো তাই বুঝতে পারছিনা। মেঘের কারনে চাঁদের আলো ব্যহত হচ্ছে ঠিকই, তাছাড়া বৃষ্টিতে ছাদটা খুবই ভয়ানক কাদাকাদা হয়ে আছে। পূর্ব ভারতের সরকারী প্রপার্টি, তাই এদের ছাদ তকতকে রাখার দায় নেই আর কি! রাতে খেতে গিয়ে সে এক চিত্তির, উড়িষ্যায় এসেছি ডালমা খাবো মেনুতে থাকলে সেটাই স্বাভাবিক। তা বাবুরা ডালমা বানাতে যা সময় নিলেন, ফ্রায়েড রাইস চিলিচিকেন নেমে যেত। সময়টা বৃথা যায়নি অবশ্য। এক ভদ্রলোক বাইক চালিয়ে ব্যঙ্গালোর থেকে আসছেন, কত অনামা গ্রামে ঢুঁ মেরেছেন,কত ডিট্যুর করেছেন সেসব শুনছিলাম। আর্লি রিটায়ারনেন্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শুনলেই ভাল্লাগে এসব। সকালে চিল্কাতে বোটিং করা হিবে ইনি আমাদের অনুরোধ করলেন ওনাকেও সাথে নিতে, একার জন্য খরচটা বেশী হয়ে যেত। বেশ তো আপত্তির কিছু নেই আমাদেরও। 
বোটিং এর সঙ্গী আরো একটি কাপল জুটে গেল। ভালোই তো ভাগাভাগি হবে খরচ। হালকা ভয় ছিল, এরা কিরকম লোক হবেন, "অ্যাই বাবু লেজ খাবি", কিংবা " হ্যাঁ বাবলাদা, দারুণ, বিউটিফুল  জায়গা বুঝলে, কাল হেব্বি মাছ খেয়েছি, রাতে একটু চলেছে বুঝলে তো...." এরকম লোক হলেই চিত্তির। খুব উচ্চকিত উচ্ছ্বাস বরদাস্ত হয় না। যাক সৌভাগ্যক্রমে এঁরা সেরকম নন। অবশ্য রম্ভা তো তেমন পপুলার ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন নয়, ফলে ওই ভীড়টা কমই। মাঝির পেট্রল বাঁধা, যতটা ঘোরানোর কথা ততটাই ঘোরাবে। তবে কাঞ্চনমূল্য ধরে দিলে তেমন পূজার ত্রুটি মাফ হয়ে যায়, জল থেকেও পেট্রল উৎপাদিত হয়। সেই কোনকালে কোন সাহেব এসে হ্রদের মাঝে ঘর তুলেছিল, স্রেফ সকালে ব্রেকফাস্ট খাবে বলে ভাবলে ভারী অবাক লাগে। অবশ্য শখ শৌখিনতার সাথে  প্রাচুর্য্যর যোগ আছে তো বটেই। সাহেব শৌখিন ছিলেন বটে। হ্রদের ধার ঘেঁষে থাকা বেঁটে খাটো পাহাড়ে হরেক পাখির আনাগোনা, ময়ূর, মাছরাঙা, পানকৌড়ি আরো অনেক মাইগ্রেটরি বার্ড। বাঁদরও আছে। কেউ কাউকে বিরক্ত করছেনা, নিজের মত মাছ, কিংবা পোকা কিংবা ফল খুঁজছে খাচ্ছে। মাইগ্রেটরি বার্ডদের ভয়ানক আশ্চর্য লাগে। বছর বছর একই রাস্তা ধরে কেমন আসে। সাংঘাতিক স্মৃতিশক্তি বটে। আচ্ছা এই যে চলার পথে আমাদের দেখে, গাছেদের ডালে বসে, কত নতুন পাখিদের সাথে আলাপ হয় এসবও মনে রাখে? পরের বছর এসে খুঁজবে আমায়? 
আজ দুপুরেই ট্রেন ফেরার। কিন্তু ট্রেনটার আপডেট পাচ্ছিনা অনেক্ষন থেকে। বিজয়ওয়ারা ঢকেনি এখনো সেটাই দেখিয়ে চলেছে। স্টেশনে গেলে বোঝা যাবে। আপাতত টামপারা লেক যাই। আজ ভারী রোদ ঝলমলে দিন। এতোই বেশী টাম্পারায় বোটিং করার কথা ভাবা যাচ্ছে না। কিন্তু হ্রদটা ভারী সুন্দর। নীল আকাশ, গাছাপালা ঘেরা হ্রদ, দূরে একটা ঘাটে স্নান করছে কিছু যুবক লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে। আমারও স্নান করতে ইচ্ছে হচ্ছিল এমন টলটলে জলে কিন্তু ট্রেনটার কী হল খোঁজ নেওয়া দরকার।
স্টেশনে এসে মাথায় হাত পরে গেল। চেন্নাইতে বন্যা হয়েছে,  অনেক কটা ট্রেনের ট্র‍্যাক জলের তলায়, আমাদের ট্রেন কোথায় কেউ জানে না। হ্যাঁ বেরিয়েছে যখন হাওড়া যাবে তবে সেটা কাল না পরশু কেউ জানে না! কাল ভোরের মধ্যে না পৌঁছলে আমাদের চলবে না। একজনকে উজিয়ে যেতে হবে আরো দুশ কিলোমিটার সেখান থেকেই। আর একান্তই না হলে সকালের মধ্যে, তাতে যদি একজন অন্তত অফিস করতে পারে। উপায় কি? এখন আর কোনো ট্রেন নেই। কাছাকাছি বড় স্টেশন ভুবনেশ্বর। খোঁজ লাগানো শুরু হল গাড়ির,যদি ভুবনেশ্বর অব্দি চলে যাই তাহলে কত টাকা লাগবে, কতক্ষন লাগবে? সেখান থেকে ট্রেন পেয়ে যাবো অনেক বা বাস। পরের একটি ঘন্টা চলল আত্মীয়দের থেকে (ময়ূরাক্ষীর এক মাম থাকেন এদিকেই),  ইন্টারনেট থেকে পাওয়া নাম্বারে, আমাদের ড্রপ করে গেল যে গাড়ি তাকে ফোন করে খোঁজ নেওয়া। আজ বিয়ের দিন বলে সমস্ত গাড়ি বুকড,কিছুই পাওয়া গেল না। একজন বলল যদিও পাঠাচ্ছে, খানিক বাদে সেও বলল হবে না! আমি ওলা,  এমএমটি এসবও দেখেছি কিচ্ছু নেই এখানে। ব্রহ্মপুরে সার্ভিস নেই!  শেষে স্থির হল, চলো বাস স্ট্যান্ডে যাই। কোনো বাস ধরে ভুবনেশ্বর যাই। এ জায়গা একটেরে ছোট্ট স্টেশন হলেও ভুনবনেশ্বর না, অন্তত সেখান থেকে কিছু না কিছু মিলবেই৷ যে অটো ধরে ফের স্টেশন থেকে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছি সে কথা শুনে কিছু বুঝেছে মনে হয়। বলল, কেন এখান থেকেই সোজা কোলকাতার বাস যায় তো, ওতেই চলে যান, আবার ভুবনেশ্বর ইত্যাদি করার দরকার কি?

এরপর হল সংগ্রামের ইতিহাস। বাপরে বাপ, সে কি মারাত্মক জায়গা ব্রহ্মপুর বাস স্ট্যান্ড। বিশ বাইশ  বছর আগের হাওড়া বা ধর্মতলা বাস স্ট্যান্ড মনে আছে কারো? সেরকম ভয়ানক জায়গা, অজস্র দালাল, কোন বাস কখন ছাড়বে কোনো প্রপার কাউন্টার নেই। সরকারি কাউন্টার মাছি ওড়ানোর ভঙ্গীতে আমাদের তাড়িয়ে বলল আজ আর কোনো বাস নেই। আর কোনো সাহায্য মিলবে না মুখ করেই বলল। ফের গেলাম বেসরকারি বাস ছাড়ছে যেখান থেকে সেখানে। একটা লোক যার সর্বাঙ্গ থেকে দেশী মদের গন্ধ ভেসে আসছে এই বিকেলবেলাতেই, সে আমাদের খুব অ্যাসিওর করছে যে এই বাস ভুবনেশ্বর অব্দি যাবে ঠিকই, কিন্তু সে দায়িত্ব নিয়ে আরেকটা বাসেতুলে দেবে। মানে তুলে দেবেনা, ফোন নাম্বার দেবে। তাকে কাটানো কি সোজা, না মশাই যাবো না বলে হেঁকে ডেকে খোঁজ নিতে গেলাম ডিরেক্ট বাস আছে কিনা, আছে একটি কিন্তু সাড়ে পাঁচটায় ছাড়বে আর কিছু নেই। ব্রহ্মপুরের সার্ভিসের ওপর অতটাও ভরসা আর নেই ওই একটি বাসের ভরসায় থাকবো, এদিকে রেডবাসে দেখছি ভুবনেশ্বর থেকে ভলভোর আর দুটি টিকিটই আছে। ভুবনেশ্বর কতক্ষনে পৌঁছবে তাও বুঝছিনা, টিকিট কেটে পৌঁছতে না পারলে? শেষমেশ যা হবে হোক,একটা ভুবনেশ্বরগামী বাসেই উঠলাম, ততক্ষনে আরো অনেকটা সময় চলে গেছে এক এজেন্ট থেকে অন্য এজেন্ট ছোটাছুটি করতে। তারা আমাদের একটা প্রায় ছেড়ে যাওয়া বাসে বসিয়ে দিল। স্লিপার কোচ, কিন্তু আমরা বসে যাওয়ার সিট পেয়েছি। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, অল্প আলো ছায়ায় দেখছি কেউ নিজের জুতো মাথার পাশে রেখে আরামে ঘুম দিতে যাচ্ছে স্লিপার সিটে, কেউ বা জুতো রাখছে জলের বোতলের খোপে। আমাদের দেশে সাধারন পরিচ্ছন্নতা বোধের একটু অভাব আছে। খানিক এমপ্যাথির অভাবও, ওইখানে কেউ জলের বোতল রাখতে পারে ভাবার দরকার কি! আমার হলেই হল। বাস ঘন্টা দুই চলার পর টয়লেট যাওয়ার একান্তই দরকার পরল, বারংবার কন্ডাকটরকে বলে যা বুঝলাম, ওদের ইচ্ছে যেখানে হবে সেখানেই থামাবে। মুখের উপর হ্যাঁ হ্যাঁ থামাচ্ছি বলাটা ওদের এক মিথ্যে বুলি। আরো জ্ঞন্টাখানেক পর যেখানে থামালো, সেটা একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। এর আগে বড় বড় কিছু ধাবা পেরিয়ে এসেছি। মেয়েরা কোথায় যাবে ভাবার দরকার নেই! বাকি যাদের সে সুবিধে আছে তাদের ওই সামান্য রাস্তার ধারেই কাজ সারতে হল।  সাড়ে চার ঘন্টা না পৌঁনে পাঁচ ঘন্টা নাগাদ যখন পৌঁছলাম ভুবনেশ্বর একটাই চিন্তা, ট্রেন তো সব ভরা দেখাচ্ছে, বাসেও কি জায়গা পাবো না?

বাস স্ট্যান্ডের প্রায় প্রতিটা কোলকাতা গামী বাসে খোঁজ করে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে নাহ, জায়গা নেই। কেউ কেউ অফার করল  মেঝেতে বসে যাবার জন্য৷ একটা বাস পেলাম যার কেবিনে দুটো জায়গা হতে পারে। কেবিনে বসে সারারাত যাওয়া? একা হলে হয়ত ভাবতাম না, কিন্তু ময়ূরাক্ষীর পক্ষে একটু বেশীই চাপের হয়ে যাবে। কিন্তু আমি সৌভাগ্যবান ময়ূরাক্ষী আমার আজীবনের  ট্রাভেল পার্টনার বলে। আমাদের কাছে উপায় তখন ভুবনেশ্বর হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালে বাস বা কিছু ধরে যাওয়া অথবা এই বাসে কেবিনের সিটে বসে যাওয়া। ভাবার উপায় বেশী ছিল না সিট ভর্তি হয়ে যাচ্ছে, হ্যাঁ কেবিনের সিটের জন্যেও ময়ূরাক্ষী সম্মতি জানাতেই টিকিট নিয়ে নেওয়া হল। পুরো দামই পড়েছিল। লাস্ট খেয়েছি ব্রহ্মপুর স্টেশনে, ট্রেনে খাবো বলে আনা আলুর পরোটা, মাঝের সময়টা বাস ধরতে পারার তাড়নায় খিদের কথা ভাবার ফুরসত হয়নি।আর এ বাস কোথাও খাবার জন্য থামবেও না। তড়িঘড়ি কিছু শুকনো খাবার আনাগেল। তারপর শুরু হল বিচিত্র ভ্রমন। আরো তিনটি ছেলেও উঠেছিল কেবিনে, অল্পবয়সী খেটে খাওয়া ছেলে বোঝা যায়৷ তাছাড়া কেবিনে ড্রাইভার, খালাসী আর কন্ডাকটর।  বাস খানিক এগোতেই, মহানন্দা ব্রিজ। যে চাঁদ দেখার জন্য এতো ছুটোছুটি,  সেই চাঁদে ভেসে যাচ্ছে মহানন্দা নদী। আধঘন্টা চলা যায় এমন সিটে সারারাত পারি জমানো আমরা সব ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। ক্রমে শহর ছেড়ে হাইওয়ে ধরে এগোতে লাগলো বাস। রাত বাড়লো, মাঝখানে পেরিয়ে যাওয়া জনপদ, শহর ক্রমে ঘুমন্ত হল। মূল বাসের মধ্যে এসির আরামে বাকিরাও ঘুমোচ্ছে। খানিকবাদে কন্ডাকটর চলে গেল, তারও একখানা শোওয়ার জায়গা আছে। কেমন আমাদের দিল না দেখলি বলে আমরা খুব লোভী চোখে দেখলাম। খালাসী চাপড় মেরে মেরে সাউন্ড বক্স চালালো। নব্বই এর যে গান একদম চলেনি, সে গানগুলোই এদের এত পছন্দ কেন কে জানে! 

ডিট্যুর করে ড্রাইভার খাবার তুলে নিল এক ফাঁকে, রুটি,  পনিরের তরকারি। খালাসী রোল করে করে খাইয়ে দিল ড্রাইভারকে। ময়ূরাক্ষীকে বললাম দেখে নে রে, খিদে পেলে একটা চিপ্স দিলে হবে না লম্বা সফরে বেরোবো যখন। এর আগে টোলে কিচ্ছু দেয়নি এরা, আমরা ডেলি বাস ইত্যাদি বলে এখন দেখলাম বাংলায় ঢোকার  আগে ড্রাইভার বদলে গেল,  মানে একজন মাঝরাস্তায় উঠে এলো আর একজন নেমে গেল। এমনকি ফাস্ট্যাগ অব্দি বেরিয়ে এলো, আর বাসের বোর্ড,  যাতে লেখা থাকে কোথায় যাচ্ছে সেটাও বদলে গেল। এত কিছু জানাই যেত না কখনো বাসে ঘুমিয়ে থাকলে! এও একবার হল্ট দিয়েছিল, কিন্তু কোনো দোকানে না, স্রেফ রাস্তার উপর। আবার সেই একই অবস্থা মেয়েরা কোনো রকমে বাসের পিছনে আড়াল খুঁজতে গেল, ছেলেদের লজ্জা পাওয়ার অধিকারও নেই, গাছের এক ধারে দাঁড়লে অন্য ধারে আরেকজন দাঁড়িয়ে যায়। আমি পশ্চিমবঙ্গে,  হিমাচলে বাসে ট্রাভেল করেছি লম্বা লম্বা, এরকম অসভ্যতা উড়িষ্যাতেই দেখলাম। ধাবাতে দাঁড়াতে কী হয়? নাকি রাস্তা আমাদের জন্মগত ডাস্টবিন, শৌচাগার সব এ ধারনা এ রাজ্যে বেশীই? হাইওয়ে ঘুমোয়না। ড্রাইভারের ঠিক পিছন থেকে রাস্তা দেখতে দেখতে আর নিজেদের মধ্যে তামাশা করতে করতে দেখলাম অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে গেছি কখন। আসলেই কঠিন সময়গুলোয় অসুবিধের দিকে ফোকাস রাখলে জার্নি আরো আনকম্ফোর্টেবল হয়ে যায়। 

ভোরবেলা বাবুঘাটে এসে ভাঁড়ে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে যে আরামটা পেয়েছিলাম বলার না। সত্যি বলতে কাল রাতেও ভাবিনি এরিকম ভাবে সত্যিই পৌঁছে যাবো, কিন্তু দিব্যি গেলাম যখন দেখলাম সারারাত ঠায় বসে থেকে এসে আবার অফিস করতে করতে মেসেজ করছি, পরের বার পাহাড় যাবো বুঝলি?