Thursday, September 1, 2022

পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা (৫)

লাদাখের গল্পটা বলব কোনো এক সময়।ব্যপারটা হয়েছিল লাদাখ থেকে ফেরার পর৷ দুচোখে খালি ওই নীল আকাশ,বিস্তীর্ন মালভূমি পাহাড় আর ছোট ছোট গ্রাম, শান্ত জীবন থেকে ফেরার পর পটল বেগুন ক্রেডিট ডেবিটের জীবনে থিতু হওয়া যাচ্ছিল না কিছুতেই। নেমতন্ন খেতে যাচ্ছি, অফিস যাচ্ছি কিছুতেই স্বাদ পাচ্ছিনা যেন। তারপর আমাদের মফস্বলের নিম, শিমূল গাছে ঘেরা ঘরে গিয়ে খানিক বসা গেল। এক জায়গার ফেলে আসা বন্ধুদের ভুলতে বালক যেমন ক্রমে নতুন জায়গায় আবিষ্কারের নেশায় মাতে তেমনই আমিও বর্ষার ছোটনাগপুর এর বর্ষায় সবুজ হওয়া প্রকৃতিতে ডুব দিচ্ছিলাম। মানে আলাদা করে কিছু করতে হয়নি, চারপাশে সবুজ প্রলেপ দিচ্ছিল নিজে থেকেই। সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেলে বারান্দায় গিয়ে দেখি চারটে কাঠঠোকরা এসে মাটি থেকেই পোকা খুঁটে খাচ্ছে, কাঠবিড়ালির ছানা দুটো বড় হয়েছে খানিক, মুড়ির নেশাও হয়েছে। পাঁচিল পেরোতে গিয়ে ধুপ করে  একটা বিড়াল পড়ে গেল কাকের ডানার ঝাপটা খেয়ে! বিড়ালটা অমনি চারপাশ চট করে দেখে নিল, স্বাভাবিক! বিড়ালদের ঠেকে ওর আর মান ইজ্জত থাকবে কিছু! তারপর একদিন দুড়ুম করে বেরিয়ে পরা হল। সেদিন আবার ভ্যাপসা গুমোট গরম, বাড়িতে গোল হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কেউ কিচ্ছু করবে না কিন্তু ঘরে বসে থাকার মতো স্থিতিশীল হলাম আর কই। 

এখানে একটা সুবিধে আছে, ঘন্টা খানেক ঘন্টা দুয়েকের ড্রাইভে ছোট ছোট সুন্দর সব জায়গা মেলে। আশেপাশে সেসব বেশীরভাগ জায়গা আমাদের ঘোরা, খুঁজেপেতে একটা জায়গা বের করা গেল। স্টেশনের কাছে চার্চের গায়ে রোদ এসে পড়ছে তখন, আমরা পুরোনো ওভারব্রিজ পেরোচ্ছি যখন। এবারের ড্রাইভটায় আলাদা রোমাঞ্চ আছে, আমার গাড়ির স্টিয়ারিং জ্যাম হয়ে গেছে। এখানে আসার সময়েই দেখেছি, কিন্তু তখন সারাতে দেবার সময় ছিলনা, ফলে এখন আমায় একটা টার্ণ নিতে হলে, মাসল গজিয়ে যাচ্ছে আর কি। ইঁটের উপর কাচের বয়াম রাখা দোকানটায় খুব মিষ্টি দেওয়া চা আর সুজির বিস্কুট খেয়ে দেহে মনে বল ফিরিয়ে নিতে হল এক ঘন্টার রাস্তাতেও। দামোদর পেরিয়ে খানিক এগোনোর পর ফস করে গুগল ঠাকুমা বললে, ডাইনে মোর, হাঁচড়পাঁচড় করে গাড়ি ঘুরিয়ে এগোতেই দেখি বর্ষার জল পেয়ে সবুজ রঙে সেজে গুজে গাছ গুলো রাস্তার অপর পারের গাছেদের সাথে প্রেম করছে খুব। চারপাশের মাঠঘাট সবুজে সবুজ হয়ে আছে। গ্রামের মধ্যে খুব সরু একটা রাস্তা। একপাল গরু ছাগল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক বুড়ো। সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা। মেশিনে ধান ঝাড়ছে মেয়ে পুরুষের দল। খানিক দূরে বিহারিনাথ পাহাড় দেখা গেল,  খেজুর গাছের পাশ দিয়ে।বিহারিনাথ মন্দির দেখার প্ল্যান ছিল না আমাদের, আমাদের ইচ্ছে ছিল পাহাড়ে চড়ার। বর্ষাকালে এ পাহাড়ে কেউ চড়ে না মনে হয়। ট্রেইলটাও জঙ্গল অধিকার করে নিয়েছে প্রায়। ঝোপ ঠেলে তাও খানিক দূর এগোলাম। অদ্ভুত চুপচাপ চারদিক। ঝিঁঝির ডাক আর পাখির ডাক ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। আর জঙ্গলের নিজস্ব শব্দ। আরো খানিক গিয়ে মনে হল নাহ কাজটা হঠকারী হয়ে যাচ্ছে। সাপখোপ কতটা কি আছে এ জঙ্গলে জানিনা, আমাদের চোখও কংক্রীটে থেকে থেকে দেখতে ভুলে গেছে, সাপ দেখলেও চিনতে পারবোনা।  তার চেয়েও বড় কথা কোনো খারাপ মানুষ থাকলে তাকেও আটকানো যাবে না কারন আর কেউইই আশপাশে নেই। উচিত ছিল নীচের থেকে কাউকে সঙ্গে আনা। কাউকে চিনতে গেলে তার সাথে সময় কাটাতে হয়, এমন হাপবেলার ঘোরায় ছোঁয়া যায় স্পর্শ পাওয়া যায়না। যাকগে, উঠতেই হবে এমন পন করে বেরোইনি। ফের আসবো কখনো। নীচে নেমে অশ্বত্থের ছায়ায় খানিক বসা গেল৷ একটা ছোট্ট মিষ্টির দোকান সামনেই। বারকোশে স্তুপ করে রাখা জিলিপিতে মাছি ঘুরছে।ডেকচিতে রসগোল্লা, পান্তুয়া আর ল্যাংচা রাখা৷ আরেকটা বারকোশে বোঁদের লাড্ডু। দোকানি গরম গরম কচুরি ভেজে দিচ্ছে। মন্দিরটায় ভালোই লোক আসে দেখছি। 

দুটো উপায় হয়, এক যে পথে এসেছি সে পথেই ফেরা, অথবা সামনে এগিয়ে যাওয়া। ঘর থেকে বেরিয়েছে যে,  সহজে সে কি ফিরতে চায়! তাছাড়া সামনের দিকটার রাস্তাটাও তো জানা হবে না। সুতরাং খুব গায়ের জোরে স্টিয়ারিং ঘোরানো হল, আর সামনের সরু রাস্তাটায় এগোনো গেলো। দু পাশেই পাহাড়, লোক তেমন নেই। একটা মস্ত বোঝা চাপিয়ে একটা লড়ঝড়ে বাইকে একটা লোক গেল। আরো খানিক এগোলে, গঙ্গাজলঘাটির জঙ্গল, এই জঙ্গলে আগে এসেছি, ভারী ভালো লাগে। মেজিয়া পেরোলে একটা ধু ধু ফাঁকা মাঠের মাঝে কলেজ একখানা! সে কলেজের মজা ভারী! কলেজ কম্পাউন্ডের মধ্যে বয়েজ হস্টেল আর কম্পাউন্ড এর বাইরে মেয়েদের হস্টেল! আশ্চর্য জায়গা বটে।  কলেজ থেকে খানিক এগোলে ড্যামটা। শাল ইত্যাদি গাছের পাশেই। ছোট্ট একটা অতিথিনিবাসও আছে। এমন চমৎকার জায়গায় কলেজ হলে যা হয় আর কি, ছেলেএ মেয়ে গুলো চলে এসেছে বেশ কয়েকজন, জোড়ায় বা দলে। এর মধ্যেই একটা প্রি ওয়েডিং ভিডিও হচ্ছে। প্রি ওয়েডিং ভিডিও দেখতে আমাদের ভারী উৎসাহ। এই বিকট গরমে চকচকে জামা পরা ছেলে মেয়ে দুটো নানা ভঙ্গীতে হেঁটে বসে কসরত করে দেখাচ্ছে আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা ফটোগ্রাফার বেঁকেচুরে খুব ভিডিও বানাচ্ছে। গাঁয়ের দিকে বলে নীল লাল ধোঁয়া নেই, কিন্তু মজা পেতে চাইলে কমতি নেই। এত গরমে লোকজন বলতে এই কটাই, মাথা খারাপ না হলে এমন গরমে ড্যামে আর কেইই বা আসবে! 
কাছেই একটা ছোট্ট পাহাড় আছে, টিলাও বলা চলে। টিলার থেকে ছোট পাহাড় শুনতে বেশী ভালো আর কি।  রাস্তায় একঝাঁক ছেলে মেয়ে দেখছিলাম, স্কুল ছুটি হয়েছে। বিহারিনাথ যাবার পথে বা এখানে আসার পথে যে কটা ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম পেরোলাম, সে একেবারেই বইতে পড়া গ্রামের মতোই রিমোট বলা যায়। পশুপালন আর টুকটাক চাষ এইই করে সব। ভাগ্যিস এদেশে এখনো ফ্রিতে পড়ানো হয়, বই দেওয়া হয় সাইকেল দেওয়া হয়! পড়াশোনা করতেই হবে সব্বাইকে সত্যি বলতে আমি সে ধারনায় বিশ্বাসী না। কলেজের স্টুডেন্ট দের পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখে চমকে যেতে হয়, কেউ লেখে সশস্ত্র বিপ্লবীর নাম মহাত্মা গান্ধী কেউ লেখে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেছিলেন "master the sujjasen" (হল কালেকশনে যেমন শুনেছে আর কি)।  সামান্য চিন্তা ভাবনা বা জানার ইচ্ছে থাকলেও কেউ এসব লেখেনা। যে কোনো কাজ করতে গেলেই একটা গ্রাজুয়েট ডিগ্রি চাই এই চাহিদায় কিছু সময়,  অর্থ, এনার্জি আমরা নষ্ট করে চলেছি। আন এম্পলয়বেল রিসোর্স বানিয়ে তাদের জম্বি বানিয়ে ফায়দা তুলে চলেছে রাজনৈতিক নেতারা। কিন্তু সে তো কলেজে, স্কুলটা সবারই দরকার। শুধু পড়াশোনার জন্য তো না, একসাথে খেলা, ছুটে বেড়ানো, টিফিন ভাগ করে খাওয়া। আর কেউ যদি এর মধ্যে ভালোবেসে পড়াশোনাটা করে ফেলে, তবে তো কথাই নেই। কোন কথায় কোন কথা বকে ফেললাম। এ আসলে ঠিক ভ্রমন কাহিনী না, এখানে গেলে ওইটা দেখা যাবে,  বা ওই জিনিস গুলো অবশ্য দেখার এরকম কিছুই বলতে বসিনি। আমি রাস্তায় বেরোলেই খুশ। লাল বুনো ফুলে সাজা কিশোরী গাছ দেখলে, কিংবা শালপাতায় দেওয়া সস্তার কোনো খাবার, সবই আমায় আনন্দ দেয়, সেই আনন্দ পেতেই আমার চলা।
দুপুর হয়ে গেছে, আশ্রমের গেট বন্ধ হয়ে যায়। তাও এসেছি টুকটুক করে, টিলাটার মাথায় ওঠা যায় যদি। আশ্রমটা টিলার গোড়াতেই। কোন ঠাকুর, বা গুরুর আশ্রম জানিনা, জানতে চাইও না। উপরটা উঠতে পেলেই হল। উপর থেকে দূরের ড্যামটা দেখা যাচ্ছে। এই বিশ্রী ভ্যাপসা গরমে আর কোনো লোক জন নেই এই দুপুরে, খালি দুটো ঘুঘু পাখি বেলগাছটায় বসে ডেকে চলেছে। আশ্রমটা দেখতে ভারী চমৎকার, জাঁকজমক নেই, ফুলের গাছ আছে অনেক। ভিতরটা ঢুকে দেখার শখ হল, ইতস্তত করে ঢুকতে দেখি দুপুরের খাবার দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় কিছু বাচ্ছাদের। আর সম্ভবতঃ এদের দীক্ষা নেওয়া একটা পরিবারও বসেছে দেখছি এক পাশে। এইসব আশ্রমে কী নিয়ম হয় জানিনা, টাকা দিয়েই ভোগ খেতে হয় নির্ঘাত। স্বাভাবিকভাবেই উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছি, বেরিয়ে যাই নাকি? এমন সময় আশ্রমের এক কর্মী, "সেবা করবে তো,  বসে যাও বসে যাও" বলে আমাদের পাত পেতে দিলো। নির্ঘাত আমাদের ওই পরিবারটার কেউ ভেবেছে। হ্যাহ হ্যাহ হ্যাহ। ভালোই হয়েছে, খিদেও পেয়েছে বটে। বিয়েবাড়িতে  ফাঁকি দিয়ে ঢুকে খেয়ে নেওয়ার মতোই উত্তেজনা বোধ করছিলাম। শালপাতায়, ভাত শাকভাজা,শুক্তো পড়তে না পড়তেই আমিও হাত বাড়িয়েছি। একজন তাড়াতাড়ি বললেন, গীতাপাঠ না শেষ হওয়া অব্দি খাবেন না! শাকভাজাটা ততক্ষনে মুকে চলে গেছে। আরাম করে ভাত, শাকভাজা,  শুক্তো, ডাল, ছানার কোপ্তা, চাটনি পাঁপড়,  পায়েস মিষ্টি খেয়ে সুড়ুৎ করে কেটে পড়েছি। এ তল্লাটে আবার অনেকদিন আসা যাবে না! 
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়েই একটা ছোট্ট টিকটিকি উঠেছিল গাড়ির চালে, সে কিছুতেই নামবে না, নিয়ে চলো না, আমিও বেড়াতে যাবো বলে গাড়ির চাল আঁকড়ে শুয়েছিল। পাহাড়, ড্যাম সব ঘুরে টুরে,এই আশ্রমেই মনে হয় ওর ভালো লেগেছে। টুকটুক করে লেজ নেড়ে নেমে গেল। সন্ন্যাসী টিকটিকি!  অবশ্য এই আশ্রমিকদের আমার অবাক লাগে, নিজের সংসার ছেড়ে আরেক সংসারেই তো পড়ে আছে, সেই তো ভাঁড়ারের চাবি, রসগোল্লার হিসেব, পায়েস কেমন হয়েছের খোঁজ! কার কিসে আনন্দ কেই বা বলতে পারে!