Sunday, September 24, 2017

পুজো - তৃতীয়া

'যাদবপুর থানার সামনে, দশ মিনিটে পৌঁছে যাবো। একটু দাঁড়া, রাগ করিসনা প্লিজ'।
তৃতীয়ার সন্ধ্যে কে বলবে! গড়িহাটের মোড়ে পুলিশ নিয়ন্ত্রিত ভীড়। আমিও সে ভীড়ের অংশীদার। নাহ দাঁড়িয়ে থাকতে খারাপ আমার লাগছে না সত্যি। পুজোর গন্ধ মাখা ভীড় দেখতে মন্দ লাগছে না। চা এর দোকানের খদ্দের আজ পুলিশ বেশী। ট্রাফিক সামলাবার ফাঁকে ফাঁকে গলা ভিজিয়ে যাচ্ছে। এক প্যাকেট মেরি বিস্কুট (মারি বিস্কিট শব্দবন্ধটা চা এর দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা ঋকানন্দ মহারাজের না)। লুঙ্গি, খালি গা, কাঁধে গামছা একজন চা খেয়ে মুখ টুখ কুঁচকে বল্লো কি রে পুজো কি তোরও শুরু নাকি, চিনি দে চিনি দে, শাল্লা মিষ্টি ছাড়া চা বানাচ্ছে!
ওদিকে চা এর দোকানের পাশে দোসার স্টল জমজমাট। একটা মহিলা খুব চেঁচাচ্ছে ফোনের ওপাড়ে থাকা কাউকে, বরই হবে, 'কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই তোমার এখানে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি আমি, কখন আসবে.... '। বাবার কাঁধে চড়ে একটা ক্ষুদে বড় বড় চোখে সব দেখতে দেখতে একডালিয়ার দিকে এগোচ্ছে। কিছু জিনিস বদলায় না।
আমার পাশে এক মহিলাও অপেক্ষা করছে। আমার ফোনে কথা শুনেই হোক কি কটকটে হলুদ রঙের টিশার্ট দেখেই হোক আমার দিকে তাকিয়ে দেখলো দুবার, আমিও দেখলাম, দেখার জিনিস না দেখা অপরাধ। একদল কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়ে হই হই করে এগোচ্ছে দেখি। কালো শাড়ি স্লিভ্লেস মেয়েকে তার বন্ধু বলছে, 'উফফ একডালিয়া তো হিলিয়ে দিলি রে'। মেয়েটা চটাস করে চাঁটা লাগালো সঙ্গে সঙ্গে, মেয়েটা ছেলেটা সহ পুরো দলটা হেসে উঠলো। পুজো এসে গেছে।
আমার কলেজ বেলার দিন গুলো মনে পড়ছিলো, একসাথে একদঙ্গল বেরিয়ে নিজেদের মধ্যে খিল্লি, লোকজনকে আওয়াজ, ঝাড়ি...বড় হয়ে গেছি, বা বুড়ো হয়ত। সেই পুরো কলেজের টিমটাই কোলকাতায় আছে এক দুজন বাদ দিলে তাও একসাথে বেরোনো হয়না আর হবেও না। শরতকালের মেঘের মতো সম্পর্ক বুনে বুনেই কেটে যায় দিন।
মনখারাপটা তাড়াতে জোর করে ফোনে খোঁজ নিলাম, বাকি মক্কেলরা কই। তারা আরেকপ্রান্তে তখন। বোঝো! যাক কদমকদম এগোনো যাক।
একডালিয়া আগের বছরের প্যান্ডেলটা কপি পেষ্ট করে দিয়েছে, একটা পিপিটি বানিয়ে প্রজেক্টরে ফেলেওও দিতে পারতো আরো কম এফোর্ট।
হিন্দুস্থান পার্কের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, বোর হচ্ছিনা, বন্ধুরা আড্ডা প্লাস সামনে বেশ মানে বেশ ইন্টারেস্টিং চালচিত্র আরকি। কাঁধখাবলা একটা জামা অনেক মামনিই পরে ঘোরাঘুরি করছে দেখছি, এক বন্ধু জানালো একে নাকি বলে কোল্ড শোল্ডার। হ্যাঁ রে ভাই এ যদি কোল্ড হয় হট শোল্ডারে তো প্যান্ডেল গলে যাবে রে। 
হিন্দুস্থান পার্কের মন্ডপটা ভালো বেশ ভালো, খালি একটা চর্মনগরীর পাশ দিয়ে গেলে যেমন ফিল আসে তেমন আসছিলো, আরএসএস কে খবর দিলে ব্যান করে দেবে। বালিগঞ্জ কালচারাল এর ঠাকুর গুলো বেশ মডেল সুলভ, মানে ইয়ে ব্যাপার আছে একটা বেশ। বিশদে বলা কাজের কথা হবেনা, দিনকাল ভালোনা। লেকের রাস্তার আল্পনাটা সত্যি বড় ভালো হয়েছে।
আমরা খুব হাঁটতে পারি, আড্ডা দিতে দিতে হাঁটতে আমাদের আলাবেজার নাই। টিউবওয়েল এ জল, দেশপ্রিয় থেকে হেঁটে ঢাকুরিয়া যাবো ভিতরটা দিয়ে, এই রাস্তায় ভীড় নেই, ফুলের গন্ধ, গাছের গন্ধ রাতের গন্ধ মেখে পড়ে থাকা রাস্তা। একা একা জানলার ধারে বসে আছেন একজন বয়স্ক লোক। তাঁর পুজো নেই। চোখে মুখে অদ্ভুত বিষাদ, নির্লিপ্তি মেখে চেয়ে, সে চোখের দিকে তাকাতে ভয় করে, যৌবনের শেষ দেখতে পেয়ে বুকের ভিতর শিরশির করে, দ্রুত পা চালাই।
ক্রমে রাত বাড়ে, ট্যাক্সিওয়ালা ডিকির উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, তৃতীয়ার রাত চতুর্থীর দিকে এগোয়। মানুষের ভীড় খুব কিছু কমে না, পঁচানব্বই এর পল্লীর সামনে এক বাবা এক হাতে তার মেয়েকে ধরে গল্প শোনাতে শোনাতে এগোচ্ছে, দৌড়ে রাস্তা পার হবার সময় একটু আগে ঝগড়া করে এগিয়ে যাওয়া মেয়েটা একবার পিছিয়ে এসে ছেলেটার হাত আঁকড়ে ধরে দৌড় দেয়, দুটো যুবক কোনোদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের হাত দুটো শক্ত করে ধরে এগোচ্ছে আইস্ক্রীম এর গাড়িটার দিকে।
একটা ফাঁকা গাড়ি ফিরছে, 'কোথায় যাবে ভাই?' দরাদরি করে উঠে বসলাম। একটু বেশীই নিলো কি করা যাবে, পুজোর বাজার বলে কথা, নিকগে। বকরবকর করতে করতে এগোচ্ছি, পুজোয় একদিনও ছুটি নেই, মালিকের সাথে ঝগড়া করে ছেড়েই দেবে কাজ বলছে। বললাম দুম করে ছেড়ো না হে, তিনটে বাচ্ছা, মা বাবা পুজোর সময় কেস খাবে। বলল আরে না ভাই কথা বলে রেখেছি এক জায়গায়। ভাল্লাগে বলো? মেয়েটা রোজ জিজ্ঞেস করে বাবা কবে ছুটি তোমার, ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যবেনা? আমি হাসলাম, আমি জানি এ যাতনা, তৃতীয়ার দিন ঠাকুর দেখতে তো আর সাধে বেরোইনি, আইটি খাদানে কাজ করা শ্রমিকদেরও একই হাল কিনা। কাঁধ চাপড়ে বললাম ঠিক আছে ভাই হয়ে যাবে, মাথা গরম করে লাভ আছে। পুজো আয় পুজো যায়, লাল জামা নীল জামা গায়।
মোড় থেকে হাঁটছি, রাস্তায় আলো, কুকুর এক দুটো ওলা আর আমি হেঁটে যাচ্ছি। আজ কেন কে জানে কুকুরেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত আমায় খুব একটা ধমকাচ্ছেনা। একা একা দুটোর সময় ফাঁকা রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে ভারী অদ্ভুত লাগে, ফাঁকি দেওয়ার নেশার মতো তীব্র আকর্ষনের। আকাশের দিকে তাকালাম একবার, হাল্কা একটা আলো ছড়িয়ে আছে....এই পথ চলাতেই তো আনন্দ, পুজোর আনন্দ বাঁচার আনন্দ। উৎসব।

Thursday, September 21, 2017

মহালয়া

 এটাকে বোধহয় পুজোর লেখা বলা যায় না সে অর্থে । মহালয়ার দুপুর রাতে বাড়ি ফিরে ভোর বেলা উঠি আমি আজো , এদিকে নাস্তিক কিন্তু চারটেয় রেডিওতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র চাই , পাশের ঘরে গিয়ে । ভোরের দিকটা একটু গা শিরশির করে এ সময়টা , চাদর টানার বদলে মাএর আঁচল টা টেনে গুটিশুটি মেরে এ বয়সেও আমি মহালয়া শুনি ( আজ্ঞে হ্যাঁ , ওই শুদ্ধ মহিষাসুরমর্দিনী আমি কখনই বলিনি ) । তারপর উঠে টিভির মহালয়াটা দেখতে দেখতে বোর হচ্ছি , কি রে বাবা এতো নাচ কেন যুদ্ধে গেলে কেউ নাচে? মারামারি হোক কি তর্ক সবেতেই নাচছে মহা মুশকিল । অন্যবার এ সময় মহালয়ার সকালের আলো ফুটে যায় এবারে দেখি মেঘলা আকাশ । সকাল বেলা মেঘলা আকাশ আমার এম্নিই দু চোখের বিষ মহালয়ার দিন হলে কিরম রাগটা ধরে!!
ফের ঘুমিয়ে উঠে দেখি তখনো মেঘলা দিন , চোখ খুলছে না সাকুল্যে ঘন্টা দুই ঘুমিয়েছি , অফিস যেতে হবে । 
চুল কেটে আসি বরং মাথা ম্যাসাজ করে দেবে একটু হলেও এই ম্যাজম্যাজ ভাবটা কমবে । এক গাদা তেল দিয়ে দিলো মাথায় ররতন দা , আরে লাগাও , ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল , পুজোয়র আগে একটু স্টাইল করবে তবে না মেয়েরা লাইন দেবে ! বোঝো!! তেল মেখে কে কবে স্টাইল করেছে , এমন জ্যাব্জ্যাবে করে তাও! কিন্তু সেলুনে নাপিতের সাথে তক্কো করা আর কোনো মেয়েকে বলা তোমায় ভালো লাগছে না , একই রকম দুঃসাহসী কাজ আর আমি ভীতু মানুষ ।
মা এর কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছি একটু আরাম করে দাও মাথাটায় , চুল টেনে দাও । আমার মাথায় নাকি ছাগল ছাগল গন্ধ তাই দিতেই চায় না ভদ্রমহিলা ! দু চার মিনিট পেয়েছি জোরজুলুম করে তাও। আজ আর গাড়ি নেবো না । শালা ঘুমে মাথা বুকে ঠেকে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই , কাকে ঠুকে দেবো কেস । বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখি আকাশ কালো করে মেঘ, বৃষ্টি এলো বলে ।
বাসে উঠতে উঠে বৃষ্টি শুরু , কে বলে এটা শরৎকাল , ওই যে একজনের ছাতা উল্টালো , ফাঁকা জানলার ধার । ইকো পার্কের ওই তাজমহল থেকে পিরামিডের কি সব বানাচ্ছে , না না আমি দোষ দিচ্ছি না , হতেই পারে এই নকল তাজমহল থেকেই কত জনের সাধ পুরন হবে । কিন্তু আমাদের কি চিন্তা ভাবনা এতোই দৈন্য হয়ে যাচ্ছে একটা নতুন স্থাপত্য আর ভাবতেই পারিনা! একটা লোক লুঙ্গিটা মাথা অব্দি মুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় । কাশ ফুল গুলো নেতিয়ে গেলো , গরুগুলো গরুর মতো ভিজছে পিলারটার গাঁ ঘেঁষে ।
আমার কি হলো আমি নেমে পড়লাম বাস থেকে সেই হুল্লাট বৃষ্টির মধ্যেই । আমি ছাতাই নিইনা আর এক্সট্রা জামা প্যান্ট , এরপর এসিতে ঢুকবো জানি জ্বর হতে পারে কিন্তু এই ফাঁকা রাস্তা অঝোর বৃষ্টি এমন টানতে লাগলো । বাসের লোকগুলো কেমন ঘাবড়ে গেছে , এতোক্ষন একটা পাগল ওদের সাথে মিশে বসে ছিলো ভেবেই হয়তো ! 
একটা লোকও নেই , মাঝে মাঝে সাঁইসাঁই করে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে , আমি ছপাত ছপাত করে এগোচ্ছি প্যন্টটা আর গুটিয়ে লাভ নেই । শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভিজে অফিসে ঢুকে দেখি অফিসে আজ রঙের এলা । সব মামনি রা শাড়ি আর খোকাবাবুরা পাঞ্জাবি পরে ঘুর ঘুর করছে । যাক কোথাও তো মহালয়া ফ্লেভার আছে অন্তত ।
রাতের ক্যাবে আমি মোবাইল ডেটা অন করি না , কানে গান গুঁজি না , গল্প করি ক্যাব ড্রাইভারের সাথে । আজ আড্ডা হচ্ছে রেড এফেম না মির্চি কে বেশী জনপ্রিয় তাই নিয়ে । পুজোয় আমার কদিন ছুটি জেনে সে বলল পুজোর চারদিন সেও আর গাড়ি বের করবে না । বল্লাম কেন ভীড়? বলে না না বন্ধুবান্ধব্দের সাথে ঘুরবো মজা করবো সারাবছর কাজ করলে হয় । ছেলেটা খুবই ছোট দেখে মনে হয় , আপনিটা চালানো গেলো না , বললাম বয়স কত কুড়ি? হেসে ঘাড় নাড়ে । পড়াশোনা করলে না? "বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না , , আর টানতে পারতো না , তার চেয়ে বললাম একটা গাড়ি কিনে দাও" । দিব্যি সহজ সুরে বলল । আমি নেগেতিভ কথা ভালোবাসিনা , যারা স্বপ্ন মেখে উৎসাহ নিয়ে জীবন হাঁটে তাদের ভালোবাসি বড় । এই হয়নি সে হয়নির বদলে এই হয়েছে সেই হয়েছে শুনতে ভালোলাগে আমার ।
সকালের যে রোদটা ওঠেনি বলে পুজো পুজো মনে হচ্ছিলো না সে রোদ টা এই মাঝ্রাতে উঠে গেলো যখন স্বপ্ন স্বপ্ন চোখে রহমান বলছিলো , "সারারাত , সকাল দুপুর গাড়ি চালায় আর বিকেলে ঘুমায় , দিব্যি আছি ভাই বুঝলে , নিজের মতো , রাতের অফিস ডিউটির টাকা বাবাকে দিই আর সকালের টা আমার হাত খরচা তেলের খরচা । পুজোয় ভাই আসবে দিল্লী থেকে , আমার যমজ ভাই কিন্ত ও পড়াশোনা করে । চারদিন ঘুরে বেরিয়ে ঠাকুর দেখে তারপর আবার শুরু । ভালো থাকবেন স্যার । "
তুমিও ভালো থাকো রহমান । পুজোর আনন্দ নিয়ে , নাছোড়বান্দা অপরাজিত হয়ে ।

Sunday, September 17, 2017

ঠিকানাহীন চিঠি

একজন এর চিঠির খাতা আমার হাতে এসে পড়েছিলো , চিঠির প্রাপক  প্রেরক আমি না তার খাতা থেকে টুকে দিলাম
*********************************************************************************************************************
চিঠি - এক

নেই সম্পর্কের চিঠির আবার সম্মোধন কি। তাই সোজাসুজি শুরু করলাম কেমন? জানি প্রথম লাইনটা পড়েই ভাববে আহ এতো ঘ্যাম নিয়ে কেউ চিঠি লেখে ইত্যাদি। বুঝলে সমস্যাটা সেখানেই। এই যে না বুঝতে পারার সমস্যা। আচ্ছা উদাহরণ দিই? পেটুক মানুষ খাবারের উদাহরণ টাই হোক নাকি? গুড় আর নারকেলের কম্বিনেশন যে অমন একটা অমৃত টাইপ ব্যাপার হয় সে কি করে বের করা গেছিলো কে জানে কিন্তু ওই পাক দেওয়াটাই আসল বুঝলে। তোমার জগৎ আর আমার জগৎ ভয়ানক ভয়ানক আলাদা। আমার মধ্যবিত্ত বারান্দায় কুমড়োর দানা শুকোতে থাকে, আমার স্টিলের থালায় ভাত, আমার মুড়ির কাঁসি এসব নিয়ে আমি কুঁকড়ে থাকিনা সত্যিই কিন্তু প্রেম যেই বাস্তবে আসে এরা যেন বলে ওঠে আলাদা, ভয়ানক আলাদা, মিলবে না। তুমি সেদিন প্রেম আর ভালোবাসার তফাৎ নিয়ে জিজ্ঞেস করছিলে। অত আমি বুঝি না বুঝলে, আমার মা আর বাবা রোজ রোজ ঝগড়া করে করে বয়সে এসে এক সাথে বিকেলের চা খাওয়াটা প্রেম না ভালোবাসা আমি জানিনা। এই ধরো গাছের জগৎ আর মাটির জগৎ আলাদা কি করে ওদের প্রথম সংকোচ কাটে কে জানে, আবার মরুভূমির ক্যাকটাসের সাথে কি সুন্দরবনের মাটির মিলবে। তার চেয়ে বরং এই দূরটাই ভালো। গল্প শোনাবো তোমায় মনে মনে রোজ, যে গল্পগুলো সামনে বসে শোনালে নির্ঘাত হাই তুলবে। এই যে ভীড় জ্যামে দাঁড়িয়ে সুমন গাইছে, 'যতবার তুমি জননী হয়েছ ততবার আমি পিতা' আর আমি জানলার কাচ টাচ তুলে তোমার সঙ্গে শুনছি এইই ভালো না? না না ভীড় বাসে কোনোরকমে এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়েও 'তবু আজো আমি রাজি, চাপা ঠোঁটে কথা ফোটে' শুনতে শুনতে আমি একা হয়ে যাই। তোমায় বোঝাতে পারবোনা, হেসে উঠবে কিংবা বিরক্ত হবে সব কিছুর অবয়ব না থাকাই ভালো।
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় দেখি মেঘ করে এসেছে, রাস্তা গাছ পালা সব্বাই অপেক্ষা করছে কখন বৃষ্টি নামবে, তারপর সেই হাওয়াটা দিলো জানো। তুমি জানোনা বোধহয় ওই হাওয়াটা, বৃষ্টি আসার আগেই আসবে, বেশী জোরে আসলে আর বৃষ্টি হয়না আবার একদম না এলেও হয়না, ওই প্রেমের আবেগটার মতো। একটু চাল ওচাল হলেই ডুব দেওয়া প্রেম, নইলে নির্ভর বন্ধু।
আর আর... আরো কিছু গোলমাল হলে? পুরো লছমনঝোলা কেস।
কোলকাতা শহরে রাত দেখেছ? উৎসবের রাত না এমনি রাত। বোধহয় দেখোনি, আসলে কোলকাতার রাত গুলো মেল শভিনিস্ট তোমার ভাষায়। ওই সময় রাস্তায় লুঙ্গি বা হাফপ্যান্ট পরে খালি গায় রেডিও শোনে পান বিড়ির দোকানের লোকটা। ফাঁকা রাস্তায় ফোন কানে কোনো সদ্য প্রেমে পড়া ছেলে, আমার মতো ফেক প্রেমিক না, বেশ চোখ মুখ উজ্জ্বল হওয়া কথা বলতে বলতে স্বপ্ন মাখা প্রেমিক। তোমার ভাষায় তো আমি নিজেকে ছাড়া কাউকে কিছুকেই ভালোবাসিনা। না না কথা শোনাচ্ছিনা অ্যাক্সেপ্ট করছি কেবল। বেশী বেশী ইংরাজি শব্দ ঢুকে যাচ্ছে না? আচ্ছা পরের বার খেয়াল রাখবোখন, এবার শোনো যা বলছিলাম। সেই রাতের রাস্তায় দুর্দান্ত ভাবে ছুটে চলা বাইককে খুব ভয়ানক খিস্তি মারে ড্রাইভার সে এমন টাইপ তোমার সামনে সে কথা ভেবে লিখলেও লজ্জা লাগবে। রিক্সাওলা গান চালাতে চালাতে যাবে, হেঁকে হেঁকে আদিরসাত্মক চুটকি বলবে চা ওলা তার বন্ধু কোনো সব্জিওলাকে। হ্যাঁ মাঝ্রাতেও সবজি বিক্রি হয় জানো, কাদের জন্য আমার দেখা হয়নি কখনো। একটাও মেয়ে দেখিনা আমি রাস্তায় সময়, এমনকি বাইকের পিছনেও না। শুধু মেয়েরা দখল করে নেয় এরকম কোনো সময় চব্বিশ ঘন্টার কখনো?
বেশী লম্বা হয়ে গেলো না? ধ্যুত এর চেয়েও বেশী বকবক করি আমি তোমার সাথে।
ভালো থেকো বোলেগা নেহি ন্যাকামো বলবে, ইয়ে একখান উত্তর দেবে নাকি? নীল খাম টাম চাইনা এমনি রুল্টানা খাতার পাতায় লিখলেও পড়ে নেবো।

**********************************************************************************************************************
চিঠি - দুই

**************************
কি করছো বলো দেখি? ব্যস্ত ব্যস্ত? সারাদিন কী এতো ব্যস্ত থাকো বলোতো, খালি নিজেকে ভোলাতে তা জানো? তোমার রান্না করার ছল, নিত্যনতুন সিনেমা সব আমার ভারী চেনা, আমিও ভুলিয়ে রাখি কিনা নিজেকে। হরেকমাল পাঁচটাকায়। মাঝে মাঝে ভয়ানক ডিপ্রেসিভ চিন্তা আসে জানো, এই যে নিজেকে নিত্য নতুন জিনিস দিয়ে ভুলিয়ে রাখি কেন? মানে এই নাম যশ আহার মৈথুন এর কি মানে আছে? কেন করছি এসব দিনগত পাপক্ষয়? আসলে ইমেজের ভয় বোধহয়, লোকে কি বলবে? চাকরিটা দুম করে ছেড়ে দিলে। বাউণ্ডুলে হবার সাহস তো সবার হয়না। ভয় পেওনা, আমি সে ভোঁতা মনখারাপের গর্তে ফের পড়বো না। তোমায় বলা হয়নি না? আমার সব মন খারাপ আমি পাহাড়ের কুয়াশায় গাছের ফাঁকে মিলিয়ে দিয়েছি। আমায় টের পেতে দেয়নি কি করে তারা নিয়ে নিয়েছে কিন্তু নিয়ে নিয়েছে তাই সেই অকারণ বিষাদ আমায় ছুঁতে পারেনা আর জানো?
চিঠি লেখাটাও একটা নেশা বুঝলে, আমার হাজারটা খেলার, নেশার একটা অংশ আর কি। তোমায় লিখি, তুমি পড়ে মুচকি হাসো, ভ্রু কোঁচকাও বা ঘাবড়ে যাও তিনটেই আমি দেখতে পাই। কিন্তু অত চাপ নিও না, আমায় তো চেনো তুমি, দাবী নিয়ে সামনে দাঁড়ানোর মতো চওড়া বুক যে আমার নেই।
ঢাক বাজছে, নীল আকাশে মেঘ গুলো নানান আকার নিচ্ছে, ভগবান মানিনা কিন্তু উৎসব মানি, উৎসব আসছে। অনেক রাত্তিরে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়েছ কখনো? দ্বাদশীর চাঁদে অল্প অল্প করে বইতে থাকা হাওয়া, চাঁদের ছায়া জলে পড়ে, তিরতির করে কাঁপতে থাকে সমুদ্রের জল, বাতাস না ওই চাঁদের আলো কার জন্য কাঁপছে কে বলতে পারে কিন্তু সবটুকু মিলিয়ে বড় ভালো লাগে। তেমনই ঠিক কি জন্য ভালো লাগে জানিনা কিন্তু মাঝে মাঝে সব কিছু বড় ভালো লাগে জানো, ওই যে এক গলা সস্তার মদ খেয়ে নাচতে নাচতে বিশ্বকর্মা পুজো উদযাপন করা লোক গুলো আর চড়া দামে ডান্স ফ্লোর কিনে সেখানে উদ্দাম নাচা তরুণ তরুণী, ভীড় রাস্তায় বিরক্তি নিয়ে বসে থাকা ছেলেটার কাঁধে মেয়েটা মাথা রাখার পর হাসি ফুটে ওঠা ছেলেটা, ফোকলা হাসি নিয়ে ওই বুড়িটা, শোক জরা সব কিছুকে হারিয়ে জীবনকে আলিঙ্গন করা, সব কিছুই বড় ভালো লাগে।
জানো তোমাদের বাড়ির পাশের যে গাছটা আছে, যেখানে সেই পাখিটা এসে বসে মাঝে মাঝে আমার তার সাথেও কথা হয়, গাছেরা অনেক জানে কিন্তু বলে না সে তোমায় বলেছি আগেই ঘ্যানঘেনে প্রেমিক টাইপ চিঠি মনে হচ্ছে নাকি? আসলে এই উৎসবের মরশুমে প্রতিদিনের নতুন করে বেঁচে থাকায় তোমায় খুঁজি জানো, হাত ধরতে চাইনা হাত ছেড়ে দিলে কানা গলিতে ঘুরপাক, বরফ পড়া তীব্র শীতের রাত বড় বেশি তাড়া করবে। আর আমি তো আমায় চিনি, বড় পিচ্ছিল হাত, তুমি পারবে না ধরে রাখতে, বরং ধরার ফলেই হুমড়ি খাবে আরো বেশী। মানুষ তো হাত ধরে ভরসা পেতে যে হাত খালি অনিশ্চয়তা দেবে সে হাত বাড়ানোও তো ঠিক না। তাই ঘাবড়ে যেও না।
যা বলছিলাম, এই যে চারিদিকে এতো জীবন সবই বড় ভালো লাগে মাঝে মাঝে কিন্তু মাঝে মাঝে সব কিছু থেকে পালাতে ইচ্ছে করে, মাইকের ওই 'ম্যায় তো তন্দুরি মুরগি হুঁ ইয়ার, কাটকালে মুঝে অ্যালকোহোল সে' যেন বড় বেশী সবখানে, এতো কিছু কেন চাইছে লোকে, আমার দমবন্ধ লাগে। পালাতে না পেরে তোমার কাছে যাই, তোমার কাছ থেকে পালাতে পারলে একদিন সব ছেড়েও পালাতে পারবো জানি।
কিন্তু পালাতেই কি চাই, জন যে ঘরে বসত করে কে জানে! এভাবেই পৌঁছে যাবো একদিন হয়তো কোথাও বা একটা নদীর ধারে কিংবা পাহাড়ে পাইন গাছের গোড়ায় সাড়ে তিনহাত জায়গা পেয়ে যাবো।
ভালো থাকো, চিঠিটা শীতকালের ভোরে লেপ ছেড়ে যাওয়ার মতো খারাপ হলো, পরের বার একটা গরমের বিকেলের হাওয়ায় ভরা চিঠি দেবো ঠিক