Tuesday, September 12, 2017

জানি দেখা হবে

গল্প আর প্রেম দুইই ইজ নট মাই কাপ অফ টি। আমি যা দেখি তাই লিখি টাইপ কথক। তা খাচ্ছিলো তাঁতী তাঁত বুনে কাল হলো তার এঁড়ে গরু কিনে, আমার সেই দশা, আজ পোকা নড়লো এই দুই কঠিন জিনিস ছুঁয়ে দেখার। দেওয়ালে দিচ্ছিলাম না, কারনন এ আমি পরে পড়ে মনে হয়েছিলো খুব খাজা লেখা। তো এক গ্রুপে ভয়ে ভয়ে টাঙানোর পর একজন এটা বলল
" মেয়েদের শাড়ী হাজার রকম হয়, কোনটা চকচকে, কোনটা খসখসে, কোনটা নরম।তোর লেখাটা মলমলের শাড়ীর মত। বিয়ে বাড়ি পরবনা কিন্তু সারাবছরের সঙ্গী করব।"
তাই দিলাম।
****************************
পাতলা নাক, ছিপছিপে ভ্রু, অল্প ফোলা ঠোঁটে সুন্দরী সুলভ উদাসীনতা মাখিয়ে মেয়েটা একমনে কিছু একটা পড়ছিলো ফোনে। ঘাড় পাক করে চুলের গোছাকে, জানলা দিয়ে উড়ে আসা হাওয়ার থেকে সামলাচ্ছে একটা হাত। বুবাই ভীড়ে ধাক্কা খেতে খেতে এগোচ্ছিলো মেয়েটার সামনে গিয়ে ফ্রিজ শট দিয়ে দিলো। ও দাদা সামনে এগোনকে স্রেফ গড়িয়াহাটের পুজোর গুঁতোর মতো উড়িয়ে। কলেজে আজ একটা জরুরী প্র‍্যাক্টিক্যাল আছে ওর, নাহলে এই সময় অফিস ভীড় গুঁতিয়ে ও বাসে চড়ার বান্দাই না। হাঁ করে তাকিয়ে ছিলো বুবাই, মেয়ে দেখলেই হাঁ করবে এমন না, ওর কলেজ কিছু রিয়াধের শহরে না যে মেয়ে দেখতে পায়না, কিন্তু এ মেয়েটা চোখ দুটো খুন করতে যাওয়া লোককেও রামপ্রসাদী গাইয়ে দিতে পারে। ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে টের পেলো কেউ তাকিয়ে আছে, সেই পাগলা চোখ তুলে আলগোছে দেখে ফের পড়ায় ডুব দিলো মেয়েটা। কলেজের স্টপ এলো, চলে গেলো, তিনিটে স্টপ পরে বুবাই নামলো তার পিছু পিছু।
রাস্তা ঘাটে পিছু নেওয়া চোখের দৃষ্টিতে অভ্যস্ত মুনাই। ও জানে কোন চোখ শরীর চাটে কোন চোখ স্তুতি। বাসে জানলার ধারটা পেয়ে নিশ্চিন্ত ছিলো যাক আজ আর ব্যাগএর ঢাল দিয়ে কাউকে আটকাতে হবেনা। পাপনের একটা মেসেজ, হুঁ হাঁ করে কাটালো, এ সম্পর্কটা বোঝা হয়ে গেছে ও নিজেও জানে তবু আটকাতে পারছে কই। ওদিকে বাড়িতেও আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ধুত্তোর, বলে একটা গল্প পড়া শুরু করলো। ফেসবুকের অনেক কটা পেজে দিব্যি গল্প থাকে ভালো ভালো। তখনই টের পেলো ছেলেটা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। একবার তাকিয়ে দেখলোও, ভারী ক্যাবলা তো বা খুবই নির্লজ্জ তাও তাকিয়ে আছে। এমন পাগল পাগল করে তাকিয়ে আছেই বা কেন। ওই একনজর তাকাতেই মুনাইএর বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো যে, পাগলাটে ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি ওই ছেলেটার হাত ধরতে। এমন হয় নাকি! ধ্যার। আজকাল প্রেমেই ভরসা চলে যাচ্ছে আর প্রথম দর্শন প্রেমের মতো স্কুল লেভেলের প্রেম! আরে এ তো ফলো করতে আরম্ভ করেছে, নাকি এখানেই নামার ছিলো ছেলেটার?
বাসস্ট্যান্ডের ভীড়, রিকশার হর্ন এড়িয়ে এগোয় মেয়েটা, বুবাই পিছন পিছন।।খুব রিস্কি খুব অবাস্তব ন্যাকা একটা কাজ করছে বুবাই নিজেও জানে কিন্তু কি করবে, ওর উপায় নেই, সেটাও টের পাচ্ছে।
এবার একটা এস্পার ওস্পার করতেই হয় তো। ছেলেটা তো রীতিমত পিছু ধাওয়া করছে। প্যাঁ পোঁ হর্ন, চতুর্দিকে এতো লোকের মাঝে কিই বা আর হবে, মুনাই ঘুরে দাঁড়ালো। অবিশ্রান্ত লোকের মাঝে স্থির হওয়াও মুশকিল। ছেলেটা থতমত খেয়ে গেছে কিন্তু, কিন্তু, এ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ওর এরকম বুক কেঁপে উঠছে কেন বার বার। মুনাই, মুনাই এটা দুহাজার সতেরো সাল তুই চব্বিশ বছরের মেয়ে এরকম বোকা বোকা কাজ এখন আর মানায় না। কড়কে দে ছেলেটাকে।
এইরে কেস করেছে, এবার নিশ্চয়ই মার খাওয়াবে মেয়েটা। সত্যিই তো বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। এরকমভাবে অপরিচিত একজন মেয়েকে ফলো করাটা ঠিক হয়নি। বুবাই ঘাবড়ে গেলো একটু। কিন্তু ও তো ছিঁচকে চোর না, দাঁড়িয়েই রইলো। কি হবে অপমান করবে মারবে যাই হোক, হোকগে। আবার সেই হাইওয়েতে বাইক ছোটানোর মতো পাগলা চোখ নিয়ে তাকালো মেয়েটা।
-আপনি কি কিছু বলবেন? তখন থেকে ফলো করছেন দেখছি।
বৈশাখের গরমে অনেকদূর হেঁটে তালু শুকিয়ে কাঠ যখন সে সময়, কাঁসার গ্লাসে জল খেতে দিলে যেমন হয় তেমন অবস্থা এখন বুবাইএর। এমনিতে ও লাজুক স্বভাবের, মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব আছে গ্রুপে কিন্তু আলাদা করে কারোর সাথেই কথা বলা, ইয়ার্কি ঠাট্টার বাইরে, হয়ে ওঠেনি। অদ্ভুত সাহস এসে গেলো কেমন। অধিক শোকে পাথরের পরের স্টেজ আর কি, অধিক চাপে পদার্থে ট্রান্সফরমেশন।
"না মানে, তোমার মানে আপনার চোখ দুটোয় বড্ড মায়া। হাসবেননা খিল্লি করবেন না প্লিজ, আমি, আমি এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারনে নিজেও ঘেঁটে গেছি। "
- ও তাই? আচ্ছা জানলাম। এবার? মুনাই কঠিন নিরাসক্ত হয়ে বলতেই ছেলেটার মুখটা নিভে গেলো। কষ্ট হচ্ছে কেন মুনাই এর এ আবার কি। ধুত্তোর নিকুচি। ঘুরে হাঁটা দিলো সে।
হঠাৎ সব হাওয়া থেমে গেলে কি হয়, এই ভীড় রাস্তা এমন নির্জন হয়ে যায় কি করে, পিচের রাস্তায় এমন পিছল হয়ে যায় কি করে। বুবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কতক্ষণ।
পাশের ফলওলার তার ছোট মেয়েটাকে এনে রেখেছে, ক্ষুদেটার চোখে এখন সারা দুনিয়ার ভালোবাসা আর বিস্ময়। সারাদিন সে দেখে কত লোক আসে তাদের ছোট্ট ঠেলাগাড়ি দোকানে, তার বাবা তাকে একটা আম ধরিয়ে দিয়েছে, গুটগুট করে এগিয়ে আসে, 'রো মত, ইয়ে লো ম্যাঙ্গো', বুবাই হাসে ফ্যাকাশে। আকাশে মেঘ ভেসে আসছে।
নাম জানা নেই, ঠিকানা বিহীন এ শহরে প্রেম খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। আজকাল সোশ্যাল নেটওয়ার্কও পারেনা। তাছাড়া একে প্রেম বলা যায় নাকি, চেনা নেই জানা নেই স্রেফ চোখটা জানে। দিন কাটে, চাকরি, ভাত, দিনযাপন। মেয়েটা হারিয়েই যায় তার মায়া মায়া চোখ নিয়ে।
ছেলেটাকে কি খুব বেশী কড়া করে বলা হয়ে গেছিলো? চায়নি তো কিছুই, জোরও ছিলো না, অমন তাচ্ছিল্য না করলেই হতো হয়ত। কিন্তু অমন হুট করে কিছু বলা যায়। কি প্রোপোজ করার ছিরি! ভারী রাগ হচ্ছে, আর কিছু বলল না কেন, অমন মুচরে যাওয়া মুখ নিয়ে রয়ে গেলো। আর একদিনও এলো না ও রাস্তায়। মুনাই কত দিন বাসে উঠে দেখেছে, হুহ নির্ঘাত ওই মেয়েদের সাথে ছ্যাবলামো করে বেড়ানো ছেলে। কিন্তু ওই এলোমেলো চুল, অভিমানী নিভে যাওয়া মুখটা তাড়া করে যে। আর আসবেইনা?
তারপর? তারপর দিন আসে দিন যায়, বৃষ্টিতে কোলকাতা ভাসে, গরমে হাঁসফাস করে, ভীড়ের চাপে ধুঁকতে থাকে। নতুন রূপকথা আর জন্মায় না। দুহাজার সতেরোতে লাভ এট ফার্স্ট সাইট এর গল্প শুনে নিউটাউনের কমপ্লেক্স হাসিতে ফেটে পড়ে। জিও সিম পার্টনার বদলে দেয় মুহূর্তের ছোঁয়ায়।
তবুও এ শহরেই গরমে কৃষ্ণচূড়া ফোটে, ব্যারিকেড আটকানো রাস্তায় পুলিশ গলি রাস্তা দেখিয়ে দেয় একজোড়া তরুণ তরুণীকে, বুড়ো মানুষটাকে রাস্তা পার করে দেয় ইংলিশ মিডিয়মে পড়া যুবতী, মাকে টিচার্স ডে তে নিজের পকেটমানি বাঁচিয়ে লিপ্সটিক কিনে দেয় বছর আষ্টেকের বিচ্ছু যে আগের রাতেই মা এর কথা না শুনে মার খেয়েছে। তাই এই শহরেই রূপকথা জন্ম নেয় আচম্বিতে। বইমেলায় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই খুঁজছিলো বুবাই, ইতিহাসে ডুব দিয়েছে সে আজকাল। ধূলোর স্তুপ, মেঝেয় ডাঁই করে রাখা বইগুল ভারী অযত্নে, ভারী কাচের চশমা এঁটে উবু হয়ে বসে বই খুঁজছে, মুখ তুলে তাকায় হঠাৎ সবুজ কুর্তিতে সেই চোখ। এতোদিন পরে! চিনতে পারার প্রশ্নই নেই ও তরফে। এবারে আর সাহস হয়না এগিয়ে গিয়ে বলে। সেদিনের ছেলেমানুষির জন্য মাঝে মাঝে হাসিই পায় তার, কিন্তু ভুলতে পারলো কই!
মুনাই এলোমেলো ঘুরছিলো বইমেলায়, পাপনের সাথে ব্রেকাপের পর একা একা বইমেলায় আসতে ইচ্ছে করতো না, জোর করে এনেছে বন্ধুরা এবার। তাও ওদের থেকে আলাদা হয়েই গেছে, লেখকদের সাথে সেল্ফি আর অটোগ্রাফ ওর ভালোলাগেনা। পুরোনো বই নেই এবার তেমন, শশাঙ্ক বইটা পাওয়া যায় নাকি বলে ঢুঁ মারতে ঢুকেছিলো! সেই ছেলেটানা? নাহ ভুল হবার না, দোমড়ানো আহত মুখটা গোপনে ভালোবাসতে শুরু করেছে কবে নিজেই জানে না। খালি মনে হয় একবার দেখা পেলে পাগলাটাকে আর ওরকম কষ্ট পেয়ে পালাতে দেবেনা। দেখা হবে আশা ছিলোনা বলেই হুট করে দেখতে পেয়ে খুব ধাক্কা খেয়েছে, ছেলেটাও দেখেছে। এগিয়ে যাবে? যদি সেদিনের অপমানের বদলা নেয়? যদি আবার সেই আগের মতোই সম্পর্ক ক্রমে বোঝা হয়ে যায়? কই ছেলেটা তো এগোচ্ছে না তবে কি ভুলে গেছে?
মৃতের শহরে আলো জ্বলতে শুরু করেছে, অলৌকিক বাতাসটা বইমেলার ভ্যাপসা গরম মুছে দিচ্ছে তখন। দুজোড়া চোখ এগিয়ে গেছে কয়েকবর্ষ আলোকমাইল, পা জোড়া এগোবার অপেক্ষায় তখন।

No comments:

Post a Comment