Sunday, January 28, 2018

লাল পাহাড়ের দেশে




শালের গোড়ায় বসেছিলাম, রোদ এসে পড়েছে, মাঘের রোদ, জ্বালায় ভালোই, তবে প্রেমের শুরুর মতো এখনো জ্বলুনি শুরু হয়নি তেমন। লোক নেই কোনো আমরা ছাড়া। আসার কথা ছিলো চারজনের, এসেছি দুজনে। কেয়ারটেকার ছেলেটা একটু আগে চলে গেছে রাতে দেশী মুরগী বানাবে। "মেয়েদের চক্করে এক্ষুনি পড়ুনি বাবু, আমি শিলদা কলেজে পড়তে জিএস ছিলুম, কত ছেলের যে কেরিয়ার ডুম হয়ে গেলো এই মেয়েদের চক্করে পড়ে। মেয়েগুলো তো বিয়ে সেই বাপ মা এর দেখে দেওয়া, দেখতে শুনতে ভালো, চাকরি করে ভালো এমন ছেলেকেই বিয়ে করবে। অল্পবয়স তোমাদের বলে দিচ্ছি তাই"। বলে গেছে আমাদের। 
কি ভেবেছে কে জানে, দুজন ছেলে ঘুরতে এসেছে মানে নির্ঘাত দাগা খেয়েছে, দিওয়ানা হয়ে গেছে। ট্রেন ধরেছি সেই সাত সকালে। শালিমার থেকে। শালিমার স্টেশনটা মজার। একটা মাত্র চায়ের স্টল আর দুখানা প্ল্যাটফর্ম, তাতে একটা দুরন্ত আর একটা আরণ্যক দাঁড়িয়ে। লোকজন নেই, পরিষ্কার একটা ল্যাদখোর স্টেশন। ট্রেনে ভীড়ও ননেই তেমন। ট্রেনে বসে বসে দেখছি কেমন মাটির স্ট্রেকচার বদলে বদলে যাচ্ছে, মাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে আর গাছ গুলো বলছে আমি আছি তো এখনো।






ওদিকে ট্রেনে তখন এক রুমাল ওলা বকুনি খাচ্ছে, কেন আগের দিন সে টাকা নেয়নি আর আজ মনেও করায়নি। রুমালওলা জানাচ্ছে ও জানে মাস্টারমশাই ঠিক মনে রেখে দেবে। যাক বাতাসে বিশ্বাসের অক্সিজেন এখনো মেলে। সেদিনই এক বন্ধুর সাথে তর্ক হচ্ছিলো, বিশ্বাস করা ভালো না ভালো না নিয়ে। আমি অসহায় ভাবে স্বীকার করেছিলাম আমি ভালো খারাপ জানিনা আমি অবিশ্বাস করতে পারিনা, কারন আমার বুদ্ধির পরিমাপটাই কম, অ যোগ করতে যে টুকু মাথা খাটাতে হয় তা আমার নাই।

এই গেস্ট হাউসের ব্যবস্থা দিব্যি ছিমছাম, শাল পাতা পরিষ্কার করছে একজন, ঝাঁটা দিয়ে, ওইদিকে, কয়েকজন মিস্ত্রী কাজ করছে। কেয়ারটেকার ছেলেটা বেরিয়ে যেতে আমরাও বেরোলাম, টোটো ডাকা হয়েছে। এখানে নাকি এক অতি প্রাচীন ভয়ানক জাগ্রত মন্দির আছে যা অবশ্য দর্শনযোগ্য। মন্দির যদি খুব পুরোনো হয় তা দেখতে আমি খারাপবাসিনা, বেশ কাজ টাজ দেখা গেলো, সে মমন্দির সিসিটিভির মতো জেগে থাকা হোক কি দারোয়ানের ঝিমুনির মতো হোক আমার যায় আসে না।
মন্দিরে যেতেই দেখি সকলে পাত টাত সাজিয়ে বসেছে খেতে, খিদে পায়নি বলব না তবে মন্দিরে নিরামিষ হয় কিনা আমার আবার দীক্ষা আছে নিরামিষ খেতে নেই, তাই খুব একটা উৎসাহ দেখাইনা। বাইরে থাকতে অবশ্য প্রতি বৃহস্পতি বার সাঁই মন্দিরে গিয়ে প্রসাদ প্যাক করে নিয়ে আসতাম, রাঁধার ভয়ে। আর বাড়ি ফিরে একটা অমলেট বানিয়ে দিব্যি, সেসব খাওয়া যেত। কিন্তু বসে খেলে তো আর তা হবে না। তাও বন্ধুটাই জিজ্ঞেস করেছে এখানে কি ভোগ খাওয়া হচ্ছে অমনি পুরোহিত বলে দুজন? আচ্ছা যাও যাও বসে যাও ওখানে, আর দুজনের একশো টাকা দাও। থতমত খেয়ে টাকা দিয়ে ফেলে বসে বসে ভাবছি, এরপর গিয়ে আবার খেতে হবে, শালারা খিচুড়ি লাবড়া খাওয়াবে একটা ডিম অব্দি দেবে না নির্ঘাত। নাহ শুরুতে একটা ভালো পোলাও দিলো, আহা কষা মাংস দিলে জমে যেত রে। তারপরেই খিচুরি, লাবড়া আর আলুপোস্ত। আলুপোস্ত দিয়ে খিচুড়ি!! কত কি জানার কত কি দেখার বাকি! খিদে পেয়েছিলো বটে, তাছাড়া ভবঘুরেদের এতো খুঁতখুঁতে হলে চলেও না, কিন্তু স্রেফ এই বিস্বাদ খিচুড়ি আমি খেতে পারবোই না। নাড়াচাড়া করছি খাবার নিয়ে, পাশে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বসে ছিলেন। চিনি না, জানি না, তিনি হঠাৎ ওই আমার খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া দেখে বললেন, 'খেতে কষ্ট হচ্ছে না বাবা? মাছ দেবে, আমার নাতিটাও এমন, খাবার খুঁটবে খালি। নাও ওই যে মাছ এসে গেছে, খেচুরি টুক খেয়ে নাও দিকি।' এই যে রাস্তায় নামলেই সারা দুনিয়ার লোকে আমার সঙ্গ দেয় খেয়াল নেয় তারপরেও বাড়ি থেকে কেন চিন্তা করে কে জানে!

গনগনি হলো শিলাইবতী নদীর খাত, লাল পাথুরে মাটিতে অদ্ভুত এক খোয়াই তৈরী করেছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বেশীর ভাগ জায়গা থেকেই নীল আকাশ চোখে পড়ে না আবহাওয়াগত কারণেই। এখানে আকাশ দিব্যি নীল, নীচে লাল নদীখাতে গড়ে ওঠা ছবি, আর খাদের উপর ঘেরা সবুজ গাছের সারি। এ জায়গাটা বলে মিনিয়েচার অফ গ্র‍্যান্ড ক্যানিয়ন অফ এরিজোনা। তা বলার দরকার নেই , হয়ত ক্যানিয়ন বলাটা বাড়াবাড়িই কিন্তু সত্যিই বড় সুন্দর। হাঁ করে করে দেখতে হয় লাল, সাদা সবুজ, নীল এর চমৎকার একটা কম্বিনেশন। শিলাইবতী নদীতে চান করছে দেখি অনেকে। রোদে গরমে ঘেমে উঠেছি ততক্ষণে, খুব ইচ্ছে করছিলো জলে নেমে ঝাঁপাই জুড়তে। গামছাটা আনলে নেমেও যেতাম হয়তো, তার বদলে দু চারটে শিং নেড়ে তেড়ে আসা গোমাতাকে সাবধানে কাটিয়ে, নদীর ধার ধরে ধরে একটা পাথরে বসলাম। একটা লোক মাছ ধরছে, ছোট্ট একটা মাছ ধরা নৌকা নিয়ে, লগি দিয়ে ব্যালান্স করতে করতে। ক্রমে রোদ যখন মাথা টাথা ধরিয়ে দিলো, উঠে খাদটার অন্যদিকে গেলাম। এদিকটাও ভারী চমৎকার। মাথার উপর পাথুরে ছাদের আড়াল। কতকগুলো বাচ্ছা দেখি হাঁকডাক করে হাজির, কি না তাদের ছবি তুলে দিতে হবে। 'কি রে ব্যাটা পড়াশোনা, ইস্কুল নাই এখানে ফুক্কুড়ি করছিস? '
'কোন ইস্কুলে পড়েছ তুমি হ্যাঁ? ছাব্বিশে জানুয়ারি ইস্কুল থাকে?'
অতএব হার মানতেই হয়, তাদের ছবি তোলা হলো, দাদা তুলবে ছবি আর বোন কি বসে থাকবে? ব্যাস তিনিও এলেন, দাদার হাত ধরে ঝুলতে ঝুলতে।










ক্রমে অমন মাথা ফাটিয়ে দেওয়া সূর্যের তাপও কমে আসে, লাল পাথরে সুর্যাস্তের ছবিটা বেড়ে লাগছে। জামা প্যান্টুল অনেক আগেই ধুলোময় হয়ে গেছে, খাদ ধরে উপরে উঠে এসে দেখি কাজু, দেবদারু গাছের ফাঁকে লাল সূর্যটা হেব্বি একটা পোজ দিয়ে বলছে আমি চল্লুম বাপু আজকের মতো খেলা শেষ।



আরো অন্ধকার হতে আমরা রওনা দিলাম। দুপাশে জঙ্গলের থেকে ঝিঁ ঝিঁ আওয়াজ আর হঠাৎ চমকে দেওয়া গাড়ির আলো ছাড়া শব্দ নেই, জন নেই। এই অন্ধকার নৈঃশব্দ্য ভেদ করে আমরা দুজন বকবক করতে করতে, বেসুরো হেঁড়ে গলায় গাইতে গাইতে যাচ্ছি। তারপর এক সময় বকবক থামিয়ে দুজনেই স্রেফ নিজের সঙ্গে চলতে শুরু করলাম কখন। আসলে এই নৈঃশব্দ্য এই নির্জন অন্ধকার তো মেলে না সবসময়, নিজের সাথে অন্ধকার জড়িয়ে হাঁটাই বা কোথায় হয়।

তারপর রাস্তার মাঝে এক জায়গায় খাবার হোটেল পাওয়া গেলো। হোটেলের বৌদিও অবাক হয়েছে বেশ। হোটেল কাম বাড়ি, দরমার বেড়া দেওয়া কিন্তু তকতকে। চা, পিঁয়াজি খেয়ে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে এগোলাম ফের। আর হাঁটা না, হাত দেখিয়ে একটা মোটর ভ্যান থামিয়ে উঠলাম। ফাঁকা মোটর ভ্যানে হাওয়াতে এতক্ষণের না টের পাওয়া ঠান্ডাটা ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের উপর। শীত তাড়াতেই গল্প জুড়লাম। কাকা আমাদের গেস্ট হাউস অব্দি ছেড়ে দেবে, আমলাতোড়া পেরিয়ে বেশ খানিক্টা গেলে গেস্ট হাউস। এই ভ্যানগুলোর দাম ছাপ্পান্ন হাজারটাকা। কাকা টাকা জমাচ্ছে এরকম একটা ভ্যান কিনবে। তারপর তো নিজেই আলু লোড করবে, না হলে খাটনি বেশী লাভ কম হয় খালি। সব জায়গায় সেই একই গল্প দেখি, হয় ভ্যান নয় বাড়ি কালকের জন্য ভেবে আজকের দিনটাকে আখমাড়াই। অবশ্য ঠিকই আছে, স্বপ্ন আর আশা এই না থাকলে থাকেই বা কি।

বন্ধুটার পেট খারাপ হয়েছে। ওকে বললাম, ভাই তুই যা ফিরে আমি একটা রাউন্ড হেঁটে তারপর আসছি। কুয়াশার পাতলা চাদর নেমেছে, আকাশে আধভাঙ্গা চাঁদ, আশেপাশের বাড়ির লোকে ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা কে জানে তবে সাড়াশব্দহীন। একা একা হাঁটছিলাম, রাস্তা দিয়ে। ভাগ্যিস আমি রোজ থাকিনা এখানে। এমন ঘুমিয়ে পড়া সন্ধ্যে আমার রোজ রোজ কিছুতেই ভালো লাগতো না এ আমি নিশ্চিত। আসলে আমি ওই আড্ডা হইচই জীবনও খারাপবাসি না। মাঝে মাঝে দম বন্ধ লাগে বটে সাজানো গোছানো কাজে কথায়, আমি পালাই তখন। ভীড়ের আড়ালে, নিজের সাথে একটু আর আমাদের এই সভ্যতার উপেক্ষার আড়ালে মুচকি হাসি নিয়ে আমাদের কন্ট্রোল করা প্রকৃতির সঙ্গে খানিক সময় কাটালেই আবার কিছুদিন ফ্ল্যাটের দাম, বাজারদর, ব্যালান্স শীট, ক্লায়েন্ট কল, পিওয়ান, সইয়ে নেওয়া যায়....এই শাল, কাজুগাছের বন, রাঙামাটি, খোয়াই এর ঢাল, ট্রেন থেকে এক ঝলকে দেখা ফুলের ক্ষেত,অচেনা মানুষ এর যত্ন এই সবে পকেট বোঝাই রইলো.....হালকা হলেই বেরোতে হবে আবার,অন্য কোথাও.....

Sunday, January 7, 2018

জলে জঙ্গলে(শেষ পর্ব)

পাখির কিচমিচ আর পেছনের পল্টনের 'ওই যে দেখা যাচ্ছে ঘর, এবার চলা শেষ', ছাপিয়ে আরেকটা আওয়াজ পাচ্ছিলাম, চেনা গম্ভীর আওয়াজ, সমুদ্রের গর্জন। ডাবল বেডরুম ভাড়া করেছিলাম, তাদের অ্যাটাচ বাথ্রুম নাই জানা গেল। রাগী ভদ্রমহিলা তো পারলে আইল্যান্ড ডুবিয়ে দেয়, অবশ্য ওনার রাগ পুরোপুরি অযৌক্তিক তাও না। আমাদের না হয় শয়নং যত্রতত্র ভাব, বাচ্ছা মহিলা সমেত এ অবস্থায় ভালো লাগার কথাও না। সই সাবুদ করে, ব্যাগ রেখেই সমুদ্রের জলে। না, চান এখানে করা যায় না, কারন যেখানে সেখানে গাছের গুঁড়ি,মূল থাকতে পারে, সমুদ্র এগিয়ে আসছে। তবু সমুদ্র পাড়ে এসে কি জল না ছুঁয়ে থাকা যায়? 




সমুদ্রের গর্জন আছে কিন্ত বেলাভূমি শান্ত। লোক নেই জন নেই, একধারে জঙ্গল আরেকধারে সমুদ্র, আর একটা ভার্জিন বিচ। 'কেবল পেটে বড় ভুখ না খেলে নাই কোনো সুখ'। সেই কোন ভোরে বেরিয়েছি, খাওয়া হয় নাই প্রায় কিছুই, অল্প কেক বিস্কুট ছাড়া। কেয়ারটেকার ছেলেটার নাম শঙ্কর, আহা মিলটা দেখুন, ভিতরকণিকা হলো গিয়ে ওড়িশার অ্যামাজন আর সেখানে এক দ্বীপে বাস করে শঙ্কর। যাকগে আপনারা আমায় খিস্তি দেবার আগে খাবারটা খেয়েনিই বরং। রাঁধে বেজায় ভালো ছেলেগুলো (আরো দু তিনজন আছে),অবশ্য খিদেও পেয়েছিলো। এখানে খাবারের আলাদা কোনো জায়গা নেই বলেই মনে হয় খাবার দাবার ইনক্লুডেড থাকে এদের ঘরভাড়ার সাথে। খেয়ে দেয়ে আমরা আর বসলাম না, চারটে বাজে, সুতরাং আর খানিকক্ষণ আলো পাবো। সেই অনাঘ্রাতা সমুদ্রতীর ধরে হাঁটছি, বালিতে থেবড়ে বসছি জলের ভয় না করেই, কে জানে আবার কবে পাবো এমন ঝকঝকে সমুদ্রপাড়। সূর্য ক্রমে নেমে আসছে, ওই দূরে একটা বালিয়াড়ি টাইপ, কি জানি কি করে এরকম মরুভূমির মতো বালিয়াড়ি তৈরী হলো। বালিয়াড়ির গা ঘেঁষে একটা একলা মরে যাওয়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রর অপেক্ষায়। কবে যেন ও একবার ছোঁয়া পেয়েছিলো সমুদ্রের, সব পাতা ঝরে গেছে কবেই, তবু কিসের বিশ্বাসে কে জানে এখনো অপেক্ষায় রয়েছে।




এতো নিস্তব্ধতা লাস্ট শুনেছিলাম সিকিমে, চুপ করে থাকলে সমুদ্র ক্রমে বুকের মধ্যেই ঢুকে যায়। ওহ না পুরো ফাঁকানা, আমরা ছাড়া দুটো কুকুর আছে। সৌরভটা কুকুরপ্রেমী, দুটোকে একটু আস্কারা দিতেই লুটোপুটি খেয়ে প্যান্টুল কামড়ে একাকার করলো, এদিকে আমি নিরাপদ দূরত্বে। ওব্বাবা নিরাপদ বলে কোনো শব্দ হয়ই না আসলে, পিছন থেকে এক মক্কেল এসে গরুর মতো ঢুঁ দিয়ে গেলো হঠাৎ। ওদিকে সূর্যর রঙ বদলে গেছে, টকটকে লাল হয়ে আসছে ক্রমে। একটা গোটা সমুদ্র, একটা মস্ত সূর্য, কিছু নেড়া গাছ, আর কিছু সবুজ গাছ এর মালিক হয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি। লক্ষ্যশূন্য লক্ষ বাসনাহীন হয়ে যাচ্ছি। 









আরে একটা কাঁকড়াছানা খাবি খাচ্ছে না? ভালোবাসা মায়া দয়া এসবই আমার খুব কম, আমি একজন স্বার্থপর নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ তাও কাঁকড়াছানাটা দেখে একটু মনে হলো বেচারা বোধহয় জোয়ারের টানে শক্ত বালিতে এসে পড়েছে আর পৌঁছতে পারছে না। সেটাকে একটু জল অব্দি এগিয়ে দেওয়া গেলো। আসলে খেলা আর কি। 




একপাটি ছোটদের চটি পড়ে আছে, ঢেউ এর টানে চলে এসেছে কবে মনে হয়। এই জগত প্রপঞ্চময় আমি মানি, এইযে একলা গাছ, একপাটি চটি, ভাঙা ডাল এরা সবাই কথা বলে নিজেদের মধ্যে আমরা সে ভাষা পড়তে পারিনা। এই চটিটা মন খারাপ করছে না আনন্দ পাচ্ছে কে জানে।
"ওই পিছনের জঙ্গলটায় যাবি?" সৌরভের ডাকে সম্বিৎ ফেরে। হ্যাঁ হ্যাঁ চল। ওয়াচটাওয়ার বলে যে দোতলা বাড়িটা আছে তার পিছন দিয়েই একটা শুঁড়ি পথ চলে গেছে। মানুষ যাতায়াত করে তারমানে, খুব চাপের রাস্তা হবে না। কিন্তু এ জঙ্গলে বুনো শূয়োর, হায়না, শজারু আছে শুনেছি, তেনারা বৈকালিক ভ্রমনে বেরোলেই চিত্তির। সূর্য ডুবে গেলেও আলো এখনো আছে, পাখিদের কিচমিচ শোনা যাচ্ছে, জঙ্গুলে গন্ধ। এক জায়গায় গিয়ে রাস্তাটা শেষ হয়ে গেলো। আরো যাওয়াই যায়, তবে সে রাস্তাটা একটু বেশীই জঙ্গুলে হয়ে যাবে, ওদিকে আলো কমে আসছে দ্রুত। তাই ফিরেই এলাম দুজন, জঙ্গল ভালোবাসি, কিন্তু এ ভালোবাসা অনেকটা ওই ভার্চুয়াল ভালোবাসার মতো। জঙ্গলকে চিনে, জেনে তার বিছুটিপাতা বা পচা পাতার সংস্পর্শ গায়ে নিয়ে ভালোবাসা না, তাই জঙ্গল কি বলে আমরা বুঝবো এমন সাধ্য নেই, তাই জন্যই ফিরে যাওয়া উচিত।

ফিরে এসে সেই বেলাভূমি ধরে ফের হাঁটছি। চাঁদ উঠে গেছে তখন, আকাশ ভরে তারা। ষষ্ঠীর চাঁদে এতো জোর থাকে? দূরে গাছেদের মাথা ঢেকে কুয়াশা নেমে আসছে সীবিচে, কোন আদিম রাত নেমে এসেছে গহীরমাথায়। চুপ করে করে থাকা গাছ গুলো কত কি বলছে আমি শুনতে পারছি না বুঝতে পারছি না, দীর্ঘদিনের মনুষ্য সভ্যতা আমাদের প্রকৃতি থেকে কেড়ে নিয়েছে ক্রমেই, আমরা অনর্থক বাজে বকে বকে প্রকৃতির কথা শুনতে পাইনা আর। সব কিছুর একটা নিয়ম থাকে, যেমন সন্ধ্যে হলে পড়তে বসতে হয়, অফিস এর সময় অফিসে থাকতে হয়, তেমনই, এই সময়টা চুপ করে থাকতে হয়। এই এক আকাশ ভরা তারা, চাঁদের আলো, চিকচিকে বালি, সমুদ্রের গর্জন, গাছেদের মাথা নাড়া এসব কিছুই তোমায় বুকে ভরে নিতে গেলে মুখ বুজিয়ে থাকতে হবে। এই গাছ, এই সমুদ্র, চাঁদের আলো কবে থেকে এইখানে রয়েছে, যেন আমরা অনধিকারচর্চা করে ফেলছি ওদের মাঝে, ফিরতে লাগলাম।

হোটেলের কাছে এসে দেখি sos পাঠানোর মতো করে কে যেন টর্চের আলো ফেলছে আমাদের দিকে। আমরাও ফেললাম। দেখি হোটেলের ছেলেটা, শঙ্কর, জঙ্গল থেকে হায়েনারা বেরোয় তাই আমাদের দূরে যেতে নিষেধ করছে। তাছাড়া চা-টা খেতেও ডাক দিচ্ছে আর কি। চা খেয়ে হোটেল এরিয়াটা ঘুরে দেখতে গিয়ে দেখি দুটো ছেলে রান্না বসিয়েছে, বদরু আর কামাল, মুর্শিদাবাদ এর ছেলে, রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে এসেছে। কড়াইতে সোয়াবিন হচ্ছে দেখে বললাম আরে সমুদ্রে এতো মাছ ধরে খাও না কেন হে, বলে দূর ধরতে পারিনা, ওরা (শঙ্কর এন্ড টিম) তো ওদের সাথেই খেতে বলে, কিন্তু রোজ রোজ অমন খাওয়া যায় নাকি, পয়সা নেয় না ওরা আবার।খুব বেশী বয়স না, একজনের বিয়ে হয়ে গেছে, মেয়ের ছবি দেখালো, তিনমাস বাড়ি যায়নি এবার যাবে, যাবেই। 
পিছনের জঙ্গলে সৌরভ একবার টর্চ ফেলে দেখালো, যেখানে টর্চের আলো শেষ সেখান থেকেই সেখান থেকেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমরা আবার সমুদ্রের ধারে হাঁটা মারলাম, কুকুরটা পাহারা দেবার মত করে করে আসছে, আমরা থামলে সেও থামছে, ব্যাটা মানুষ ভালবাসে খুব। কিন্তু আমি তো কুকুর ভালোবাসিনা, জোর করা ব্যাপারটাই অপছন্দের আমার, সে যে কোনো কিছুই হোক, ভালোবাসাও জোর করে দিতে এলে বিরক্তি হয়।

রাতেও পেল্লায় খাওয়া দাওয়া করালো শঙ্কর। তারপর গল্প শুরু করলো, ডুবুরিরর ট্রেনিং নিয়েছে সেই গল্প। ট্রেনিং এর কঠিন দিনগুলোর কথা, জলের নীচের কথা বলতে বলতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো ওর, ভালোবাসার কাজ পেলে যা হয়। আবার ভোর তিনটেয় উঠবে সে, আমাদের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দেবে, ভবানী বলেছে সাতটায় বেরোবে। কোনো আলাবেজার নেই ছেলেটার মুখে, দিব্যি হাসতে হাসতে জানালো, কম ঘুমোলে ওর কোনোই অসুবিধে হয় না। রোজ বুকডন দেয় ও আশী একশোটা, দিব্যি আছে। সুখ শান্তি আসলেই সহজ ব্যাপার, চাইলেই দিব্যি পকেটে নিয়ে ঘোরা যায়, আমরা চাইতেই জানিনা।

সকালে নাকি অনেক শুশুক আসে, ছটায় উঠে পড়েছিলাম তাই। নাহ শুশুক দেখতে পাইনি। কিন্তু একটা চমৎকার সূর্য সকাল বেলা চান টান সেরে সমুদ্র থেকে টুপ করে উঠে আড়মোড়া ছাড়লো, তারপর কাজে লেগে গেলো কেমন তাই দেখা হলো। মরা কচ্ছপের খোলা পড়ে আছে একটা বালির উপর, কাল দেখিনি আজ দেখলাম। কাল রাতে কেউ একজন বেরিয়েছিলেন, বালিতে পায়ের আর ক্ষুরের দাগ আঁকা, কুকুর না অবশ্যই। 



ব্রেকফাস্ট করে সকলের বেরোতে সেই সাড়ে সাতটা ভেজেই গেলো। গাছে গাছে টিয়া, মাছরাঙা, কাঠঠোকরা দের আড্ডা বসে গেছে। "কিরে কি খবর, আজ কি প্ল্যান? আজ ভাবছি ওপাড়ায় গিয়ে একটু ছানবিন করে আসবো। ওবেলা কন্সার্ট আছে আসছিস তো"।


নৌকা ধুয়ে মুছে রেখেছিলো ভবানীর সহকারী মাঝি। সকালের নরম রোদ মেখে মেখে চলতে বড় ভালো লাগছিলো। আমাদের ট্রেন সাড়ে তিনটের ধৌলি ওটা ধরতে না পারলে মুশকিল কাল আবার অফিস আছে। বোটে ওই বাঙালী পরিবারের যেই লোকটা সবচেয়ে বেশী লাফালাফি করছিলো তার সাথে আলাপ হয়ে গেলো। ভালো লোক, হুল্লোড়ে আসলে। পঁচিশে ডিসেম্বরের কেক খাওয়া হল। আমাদের বললেন ছেড়ে দেবেন ভদ্রক অব্দি। অচেনা অজানা দুটো ছেলেকে ফস করে গাড়িতে তুলে নিতে চাওয়া মোটেও সবাই করে না। এদের উপরেই আমরা কাল কি বিরক্ত হচ্ছিলাম, জঙ্গলে লাফালাফি করছিলো বলে। আসলে শুধু সাদায় কালোয় তো কেউ হয় না। যাই হোক আমরা ধন্যবাদ দিয়ে জানালাম দরকার নেই, আমরা চলে যাবো। জয়নগর ঘাটে এসে, পানিবাবু আমাদের উপর ঠান্ডা পানি ঢেলে দিলো প্রায়। বলল, চাঁদবালী পৌঁছে দেবে দুশ টাকা লাগবে। যেই বললাম তুমি তো আগে বলোনি অম্নি খারাপ ব্যবহার করলো। আমাদেরও রাগ ধরে গেলো, বেশ যাবোই না, আর যেভাবেই যাই তোমার সাথে না।

ঘটনা হলো, ওইখান থেকে চাঁদবালী প্রায় এগারো-বারো কিলোমিটার। রাগের মাথায় না বলে তো দিয়েছি। ঘড়িতে বাজছে এদিকে বারোটা কুড়ি। ধৌলি সাড়ে তিনটে, ভদ্রক থেকে চাঁদবালী পৌঁছতে লেগেছিলো দু ঘন্টা। মানে একটার মধ্যে পৌঁছতেই হবে। হনহন করে খানিক হেঁটে এগিয়ে যাবার পর দেখি একটা বাইক আসছে। লিফট চাইলাম। বাচ্ছা ছেলে, আমাদের দুজনকে নিতে গিয়ে প্রায় কাত হয়ে যাচ্ছিলো। যাইহোক সে আমাদের যেখানে পৌঁছে দিলো সেখান থেকে রাজকনিকার অটো মেলে, তা সেটাও রেগুলার না, মাঝে মাঝে আসে, এখন উপায়? 
দাঁড়িয়ে আছি, ঘড়ির কাটা বারোটা চল্লিশ। এমন সময় মরুভূমিতে উটের মতো, শীতকালের নলেন গুড়ের মতো, গরমের শরবতের মতো দেখি আমাদের বোটের সঙ্গীরা। ওনারা নিজেদের গাড়ি চালিয়ে ফিরছেন। আমাদের বললেন 'আরে তোমাদের খুঁজলাম আমরা, চলো, ভদ্রক অব্দি তো যাবো না রাস্তা খুব খারাপ, কালকেই টের পেয়েছি আমরা জাজপুর হয়ে চাঁদিপুর যাবো, যাইহোক তোমাদের রাজকনিকায় ছেড়ে দিচ্ছি।' ধড়ে প্রাণ এলো। রাজকনিকায় অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে এলাম। সত্যি মানুষের কোথায় যে কোন পাওয়া জমে থাকে কে বলতে পারে। অবশ্য এ আমি বহুবার দেখেছি, রাস্তায় নামলেই দেখি, পথে প্রান্তরে লোকেরা সাহায্য করতেই প্রস্তুত বরং। খারাপ কি পাইনি? পেয়েছি কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এখনো মানুষ টিকে আছে এই ভালোবাসাগুলোর জন্যই। 
রাজকণিকায় অটো ভর্তি না হলে তো ছাড়বে না, বললাম চলো ভাই আমরা পুরো ভাড়া দিয়ে দেবো সবার। চাঁদবালীতে পৌঁছে দেখি একটা বাস ছাড়বো ছাড়বো করছে। সৌরভ ছুটলো সুলভ শৌচাগার আমি ছানাপোড়া কিনতে, আহা ও জিনিস মিস করলে ট্রেন ছাড়ার থেকেও বেশী পাপ হবে। 
বাস ছাড়লো, একটা কুড়ি, ধৌলি আধঘন্টা লেট দেখাচ্ছে, যাক তাহলে আরামসে পৌঁছে যাবো, চাপ নেই। 'আছে আছে আমাদের টেলিপ্যাথির জোর আছে'। কিন্তু ওই there are many slips between cup and the lips.... মফস্বলের বাস, সে নিজের মর্জিতে চলে। হয়ত দূরে কোনো বাড়ি থেকে বৌটি বাপের বাড়ি থেকে ফিরছে, সকলে আসছি আসবে ইত্যাদির পালা মেটানো অব্দি বাস অপেক্ষা করবে। তাই সেসব সেরে বাস যখন নামালো তখন বাজে চারটে, আর আমরা ওখান থেকে অটো ধরে স্টেশনে এলাম চারটে দশ। ধৌলি মিনিট দশেক আগেই বিদায় নিয়েছে!

যা গেছে তা যাক বলে চটপট মোবাইলে দেখা শুরু করলাম নেক্সট প্ল্যান কি। খড়গপুর চলে যাওয়া যায় একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন আছে, অথবা নেক্সট এক্সপ্রেস ট্রেন যেটা আসবে সাড়ে ছটা না পৌনে সাতটায় সেটার জন্য অপেক্ষা করা যায়। কি করবি? চল খরগপুর অব্দি এগিয়ে যাই, অন্তত অনেকটাই এগিয়ে যাবো আর ওখান থেকে অপশনও অনেক পাবো। আর এক্সপ্রেসটা যদি ঝোলায় তো পথে হয়ে যাবো। যদিও প্যাসেঞ্জার ট্রেন, তাও, কি বলিস? সুতরাং ঝটপট টিকিট কাটা হলো (খড়গপুর তক, অজ্ঞার কারনে হাওড়া অব্দি দিলো না), এক নম্বরে দাঁড়িয়েই আছে ট্রেন, রাইট টাইম যদিও চারটে কিন্তু ইন্ডিয়ারেলইনফো বলছে কুড়ি মিনিট লেটেই ছাড়ে। দৌড়াদৌড়ি করে যাও হলো, ইঞ্জিন বদলাচ্ছেরে, সৌরভ তুই ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে গেটের মুখেই থাক, আমি একটু হালকা হয়ে আসি, ছানাপোড়ার চক্করে যাওয়া হয়নি কিনা।
তা অত দৌড় ঝাঁপের দরকার ছিলো না, ট্রেন ছাড়লো পাঁচটায়। পাক্কা এক ঘন্টা লেট প্রথমেই। এটার পৌঁছনার সময় আট্টায়, সাড়ে আটটায় এক্সপ্রেস ট্রেনটা পৌঁছনোর কথা খড়গপুর। দেখা যাক। তেমন হলে টিকিট না কেটেই ট্রেনে উঠতে হবে এবং ফাইন দিয়ে নিতে হবে। অবশ্য অমরাবতী এক ঘন্টা লেট দেখাচ্ছে। সাব্বাশ পাগলা। আমরা তাড়াহুড়ো করে উঠেছিলাম একদম শেষ কামরায়। কদলী কদলী করে একবার একটা লোক ছাড়া আর কাউকে দেখলাম না খাবার বিক্রী করতে। হ্যাঁ একটা লোক ছিলো বটে, জ্যান্ত দেশী মুরগী নিয়ে, কিন্তু ইয়ে কাঁচাই খেয়ে নেবার মতো খিদে পায়নি কিনা। সৌরভ এদিকে লম্বা হয়ে ঘুম দিচ্ছে আরামসে। আমি খিদের চোটে কাওয়ালি গাইছিলাম, 'কচুবনে হেগে গেলো কালো কুকুরে'। সৌরভ আঁতকে ধড়মড় করে উঠে বলল, কি হয়েছে হ্যাঁ ভাই, অবরোধ না অ্যাক্সিডেন্ট, কারা চেঁচাচ্ছে হ্যাঁ। নাহ কলিকালে গুনীর কদর নেই মশাই, আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম, ওরে খেয়াল করেছিস কি, পুরো কামরা খালি? খাকি আমরাই পড়ে আছি? টিনটিন এর মতো আমাদের রেখে ট্রেন এগিয়ে যাবে না তো? 
সুতরাং আমরা এক এক করে কামরা এগোতে থাকলাম, কারন প্রতি স্টেশনে এক মিনিট করে থামছে ট্রেন। আর ফেরিওয়ালা যতক্ষণ না দেখবো আমরা থামবো না। শেষে একটা কামরা থেকে নামতে যাবো দেখি এক মুড়িওলা আসছে!! আরে এসো এসো, মুড়ি চা খেয়ে ঘড়িতে আর স্টেশনে মিলিয়ে দেখি ট্রেন সেই এক ঘন্টা লেটেই ছুটছে। আচমকা মোহন সিরিজের গল্পের মতো কোথা হইতে কি হইয়া গেলো, খরগপুরের আগের স্টেশন থেকে এমন এলো মাত্র চল্লিশ মিনিট লেটে পৌঁছে দিলো। বাহ বাহ কেয়াবাত। ওদিকে অমরাবতী তখনও আড়াই ঘন্টা লেটে। সুতরাং লাস্ট মেদিনীপুর লোকালই ভরসা।

ওই মেদিনীপুর লোকালে রাত পৌনে বারোটায় বসে বসেই পুরো জার্নিটা চোখের সামনে ঝালিয়ে নিলাম একবার, তিনদিন স্নান নেই, কোথাও তেলচিটে বালিশ চাদর দিয়ে ঢাকা হোটেল তো কোথাও কমন বাথ্রুম ওলা হোটেল, অপরিচিত লোকের বাইকে নির্জন সন্ধ্যেবেলা অজানা গন্তব্যে যাচ্ছি কখনো, কখনো অপরিচিত কেউ লিফট দিচ্ছে, ঝড়ে বেগে বাইকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কেউ আবার আবছা অন্ধকারে কাঠের উনোনের ধারে বসে ডুবুরির গল্প শোনাচ্ছে কেউ, মসৃন বালিতে প্রথম পায়ের ছাপ আঁকছি কোথাও কখনো খিদেতে কোঁ কোঁ করছি.....সব মিলিয়ে যে মশলামুড়িটা মাখা হয়েছে আমতেল দিয়ে তার সুবাসে একটুও টায়ার্ড লাগছে না, এখনো হা হা করে হাসছি, ঠ্যাং টানছি আর, আর স্বপ্ন মাখা চোখে পরের বেরোনোর প্ল্যান করছি।



Wednesday, January 3, 2018

জলে- জঙ্গলে (দ্বিতীয় পর্ব)

সাড়ে পাঁচটা শীতকালে মানে মাঝরাত। পানিবাবু ওই সময়টায় নদীর ঘাটে যেতে বলেছে!! কাল অনেক ধস্তাধস্তি করে সাড়ে চার হাজার প্লাস দেড়শো অটো ভাড়াতে রফা হয়েছে, শেয়ারিং এ অবশ্যই। দেবাশিষবাবু বলেছিলেন, সাড়ে তিন চব্বিশ ঘন্টার বোট এবং অবশ্যই শেয়ারিং ছিলো না। যাকগে কি আর করা। কাল রাতে ওই অন্ধকার অন্ধকার রাস্তা, অচেনা মোটরবাইকে এবড়োখেবড়ো রাস্তায় কুয়াশামাখা মাঠ আর হঠাৎ উদয় হওয়া ফাঁকা অটোর উত্তেজনা শেষে ফিরে সকাল পাঁচটায় ঠান্ডা স্নান করার সাহস নেওয়ার জায়গা ছিলো না। সুতরাং ঝপাঝপ ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে দেখি লজের ছেলেটা থেকে রাস্তার নেড়িটা সব্বাই তখনো ঘুমে। একটা চায়ের দোকান খুলেছে, আর সেখানে ওই বদ বাবুনি বোটওলা দাঁড়িয়ে। এই হতভাগা কাল আমাদের দশ হাজারের রেট দিয়েছিলো। ব্যাটাকে দেখেই ব্রাহ্মণীতে চোবানোর মন হয়েছিলো। ক্রমে আকাশ ফরসা হলো, ওড়িশা ট্যুরিজম এর হোটেল থেকে সেজে গুজে লোক আসতে লাগলো। এক মক্কেল তার মধ্যে দেখি লং কোট আর মাথায় লাল টুপি পরে, হাতে দস্তানা লাগিয়ে এসেছে। এবার ঘটনা হলো এরকম কার্টুন সকাল সকাল দেখলে মুখের মাসল গুলো এমনিই ব্যায়াম করা শুরু করে, কটকট করে তাকিয়ে পাশের বুড়োমতো লোকটাকে বললেন, 'নিউ জেনারেশন ইজ হোপলেস'। 
বোট এলো, বোট ছাড়লো। এটা যাবে খোলা ঘাট, ওর সওয়ারী তোলার আছে, পানিবাবু এর সাথেই আমাদের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ওখানে আমাদের জন্য অটো থাকবে, সেই অটো নিয়ে যাবে ডাংমল। ডাং এবং মল দুটোকেই ঢুকিয়েছে কেন নামে? এটা কি ইয়ে করার জায়গা? 
দুজন মাত্র নৌকায়, আর আছে দুই মাঝি। এখনো রোদ ওঠেনি, কুয়াশা কুয়াশা ভোর। এক পাড়ে দূরে তালগাছ, জেলেদের গ্রাম, খেজুর গাছ আর অন্য পাড়ে কিছু ঝোপ জঙ্গল। দেখেই বোঝা যায় এদিকে মানুষের পা পড়ে না। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এড়িয়ে সেই না পুরোনো হওয়া ছবিটা দেখছি হাঁ করে, টুকটুকে লাল থেকে হলুদ হয়ে যাওয়া সুর্য, জলে ছায়া ফেলেছে। আমাদের নৌকা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে জল কেটে।সকালের ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে ডাঙায়, একজন লোক এক ঝুড়ি কাঠ না কি নিয়ে মাথায় হনহন করে এগিয়ে আসছে হনহন করে। একজন সাইকেল এর হ্যান্ডেলে কি সব জিনিস নিয়ে এগিয়ে চলেছে আল ধরে ধরে। একটা বাচ্ছা তার মা এর হাত ধরে এই সক্কাল সক্কাল কোথায় যাচ্ছে কে জানে? 




একটা গোঁত খেয়ে ব্রাহ্মণী ছেড়ে বৈতরণীতে ঢুকলাম। এবার আর দু পাশে কোনো জনবসতি নেই। সকাল সকাল বৈতরণী পেরিয়ে যাচ্ছি, এই মাঝিই যমদূত নয় তো রে? নাহ কাল রাতে স্রেফ ছানা পোড়াটাই অন্তত আর শ খানেক মেরে আসা দরকার ছিলো। বৈতরণী পেরিয়ে গেলাম এদিকে ওপারেতে যদি দরদিয়া কেউ না পাই? যে কাবাব, মিষ্টির ব্যবস্থা রাখবে?

পানিবাবু ফোন করেছে, কোথায় আছি জানতে। সাড়ে সাতটা বাজে প্রায়। আমি প্রায় বলে ফেলতে যাচ্ছিলাম, জলের মধ্যে, সামলে নিয়ে মাঝিকে দিলাম। সে কি সব কথা বলে আমাদের যা বলল তাতে বুঝলাম ওর জয়নগরের ঘাটে লোক তোলার আছে, তাই আমাদের ওখানেই নামাবে, আমাদের এমনি নৌকা পেরিয়ে খোলা ঘাটে যেতে হবে। পড়েছি যবনের হাতে যখন যা বলবে তাই সই। এতক্ষণ ছিলাম ফাঁকা নৌকায় দুজন এবার একটা খেয়া নৌকায়। দলে দলে লোক উঠেই চলল, বাইক নিয়ে, বস্তা নিয়ে। আমি একজনের বাইকের উপর জুত করে বসে নিলাম। বেশ একটা গদির উপর তক্তপোশ ব্যাপার, নৌকার উপর বাইক, তার উপর আমি।

খোলা ঘাটে নামার আগে আগে দেখি লোকজন উত্তেজিত হয়ে দূরে কি দেখাচ্ছে। তাকিয়ে দেখি এক কুমীর সকাল সকাল রোদ খেতে ভেসে উঠেছে। বেশ বেশ, কিন্তু আমাদের তো কুমীরের পিঠে যাওয়ার কথা না তা কই হে লোক কই। বলতে বলতে এক বাইক থেকে দেখি একজন ডাকছে। বাইকে নিয়ে যাবে? অটো নাকি আমাদের দেরী দেখে চলে গেছে। তাই ও এখন বাইকে করে পৌঁছে দেবে। বাইকে দুজন কোনো মতে বসেছি কি না বসেছি টের পেলাম এটা আসলে বাইক না, উড়ন্ত চাকি! হু হু করে বাইক তিনজন সওয়ারি আর দু খানা ঝুলন্ত ব্যাগ (তিনজন বসে বলে ভুঁড়ি রাখার জায়গা নেই, ব্যাকপ্যাক গুলো নিয়ে বসতে পাবো এমন আশাটা বেশী হয়ে গেলো না?) কে উড়িয়ে নিয়ে গেলো।

ডাংমল আসলে রিসার্চ সেন্টার। কুমীর নিয়ে গবেষণা কেন্দ্র ইত্যাদি আছে। কাগজপাতি দেখিয়ে এন্ট্রি নিলাম। আমাদের গাইড ভবানী, না না ভীম টাইপ চেহারা না, রোগা পটকা লোক, আমাদের বলল মিউজিয়াম দেখো আসছি। মিউজিয়াম খানা খারাপ না, বাইশ ফুট লম্বা কুমিরের স্কেলিটন আছে, তাছাড়া বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের মাথার খুলি, ফরম্যান্টেড সরীসৃপ ইত্যাদি যেমন থাকে। তবে আমার লাজের জিনিস যেটা ছিলো সেটা হলো পাখির ছবি। পাখি আমি চিনিনা মোটেও, তাই যখনই পাখি দেখি খালি খাবি খাই কী পাখি কী পাখি করে। মিউজিয়ামের ঠিক বাইরেই খাঁচার মধ্যে এক বিরাট পাইথন। শীতকালে ব্যাটা না ঘুমিয়ে নড়াচড়া করছে কেন কে জানে! একটা জ্যান্ত মুরগী এক কোনে বসে আছে, পাইথনের খাবার হবে বলে। চোখের সামনে মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে এ জিনিস সইতে পারা বেশ চাপের বটে। মুরগীতো অত পাত্তা দিচ্ছে না, দিব্যি এক কোনে বসে আছে, ছটপটানি নেই। পড়বো পড়বো ভয়, পড়লে কিছু নয় টাইপ কেস আরকি। অজগরটা এদিক সেদিক ঘুরছে আসতে আসতে, মাঝে মাঝে চেরা জিভ বের করে করে টের পেতে চাইছে আশেপাশের আওয়াজ। অজগরের গায়ের নকশাগুলো কিন্তু দেখার মতো।
ভবানী এসেছে দেখে এগিয়ে গেলাম। ও বাবা, ওদিকে ওটা কি হচ্ছে? একটা টোটোয় পিছনের সিটে এক ভদ্রমহিলা আর তার ছানা, সামান্য মানে খুবই সামান্য দুটো বড় ট্রলি, একটা ব্যাকপ্যাক, একটা থলে ব্যাগ ওই পিছনেই ফিট করতে চাইছিলেন ভদ্রলোক। তা একটা ট্রলি থেকে ধূলোমাটি ছানার গায়ে লেগে গেছে এই হলো অপরাধ। 
"করছ টা কি হ্যাঁ, দেখোনা ওর গায়ে মাটি লেগে যাচ্ছে"?
ভদ্রলোক দুর্বল গলায় কি একটা বলতে গেলেন, ভদ্রমহিলা থামিয়ে দিলেন।
ওরে বাবা ওরে সৌরভ, ইনিই আমাদের সহযাত্রী হবেন রে।
সৌরভ এমনিতেই শান্ত মানুষ, কাল থেকে এতো গেছোদাদাপনায়, ও যৎপরোনাস্তি আহত তাতে এই শক্তিশেল, বেচারা খুব মিয়োনো গলায় জবাব দিলো, 'হ্যাঁ ভাই'!

ডাংমল থেকে বোট ছাড়বে, হাওলাকোঠি যাবে, পরের দিন ফের আমাদের নিয়ে আসবে। বোট যাবে দুপাশের ম্যানগ্রোভ, কুমীর, হরিন, বাঁদর, পাখিদের সঙ্গে নিয়ে। আমাদের হাওলাকুঠীতেই বুকিং আছে আর এই হাওলাকুঠী যেখানে সেই বিচটার নাম গহীরমাথা। অলিভ টার্টলরা এইখানে আসে ফেব্রুয়ারিতে ডিম পাড়তে। তখন ওখানে ট্যুরিষ্ট যাওয়া মানা। এই জীবজন্তুদের কান্ড কারখানা বেশ চমকে দেওয়ার মতো। ভাবো কোথায় সেই সুদূর কোস্টা রিকা বিচ সেখানে ডিম দেওয়া উপযুক্ত বোধ করলো না, বাঁধো গাঁঠরি চলো মুসাফির করে ওনারা প্রেগন্যান্ট কচ্ছপেরা মিলে চলে এলেন বঙ্গোপসাগর এর কোলে। একবার এসে ভালো।লাগলো ব্যাস বংশ পরম্পরায় আঁতুরঘর বানিয়ে নিলেন। কতটুকুই বা রাস্তা, 'সব রাস্তায় পাথর আছে ' গাইতে গাইতে চললেন। বোটে আরেকদল উঠলো, জনা আষ্টেক লোক, তিনটে ফ্যামিলি। বোটের ছাদে জুত করে বসেছি দেখি সব কালিয়া কালিয়া করে চেঁচিয়ে উঠলো। ব্যাপার বোঝা গেলো, কালিয়া একটা কুমীর, আমাদের ভবানীর কথায় বয়স একশো। এবার লোনাজলের কুমীর খুব বেশী হলে সত্তর অব্দি বাঁচে, যাই হোক উনিশ ফুটের কুমীরটা কিন্তু সম্ভ্রম জাগায়।


ওই আটজনের দলে একটা লোকের এনার্জি পেল্লায়, আমার থেকেও হেঁড়ে বেসুরো গলায় গান গাইলো আর নাচলো প্রায় সারা রাস্তা। ডাংমল ঘাট থেকে একটু দূরেই একটা পাখি দেখার জায়গা আছে। বেসিক্যালি জঙ্গল দেখার ওয়াচ টাওয়ার। সিমেন্টের না, লোহার পাত দেওয়া, ফলে উপরে উঠে বেশ স্কাইওয়াক টাইপ ফিল হচ্ছিলো বটে। এইসব জায়গায় এতো ক্যালোরব্যালোর ভালো লাগে না, তাছাড়া সুন্দরী মহিলা জগঝম্প করলেও নিয়ম মতে ছাড় দেওয়া যেত কিন্তু তা যখন না, এই জঙ্গলে এসে নিয়ম না মানা লোকজন নেওয়া যায় না মশাই। পাশের বোটে এক দল তরুণী ও একটি তরুন পাশ করার সময় আমাদের থেকে জল চাইলো।
"হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়, এই তো, আরে আস্তে করো বোটটা", রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেলো, আমরা গ্যালারিতে গ্যাঁট হয়ে বসে বসে দেখে নিলাম, সবাই জল দিলো ও পেলো কিনা।


বাঁক ঘুরতেই আরিব্বাসরে, কুমীর কুমীর। বেশ প্রমান সাইজের। তারপর থেকে কত অজস্র কুমীর যে দেখলাম, ছোট বড়, ন, মেজো, রাঙা। এরা খাল কেটে কুমীর এতো এনেছে না দেখলে বিশ্বাসই হয়না মশাই! একেকটা তো দেখে বড় ব্যঙাচি বোধ হয়। ক্রমে রোদ চড়া হতে থাকে, লোকজনের উৎসাহে ভাটা পড়ে। খালি দুই মাথা খারাপ ছেলে নৌকার ছাদে বসে থাকে, পাশ দিয়ে দিয়ে ছবির মতো শান্ত গ্রাম, জঙ্গল, কাদায় শুয়ে রোদ পোহানো কুমীর, গাছে ধ্যানী বক পেরিয়ে পেরিয়ে যায়। ছবির মতো শান্ত গ্রাম বললাম বটে কিন্তু সে কেবল দূর থেকেই। আসলে ঠিক জীবন যেমন আনপ্রেডিক্টেবল তেমনই আনপ্রেডিক্টেবল যাপন এখানে। ওইযে নদীর চড়ে একটা মস্ত কুমীর শুয়ে আছে, একটু দূরেই দুটো ছোট ছেলে মে এক পাল ছাগল চড়াতে এনেছে। ভয় এখানে বিলাসিতা।












শালারা বোট করেছে এদিকে টয়লেটটা হাফ ঘেরা। খেয়াল না করে ম্যালা জল খেয়ে নেওয়ার ফল, নড়তে অব্দি পারছিনা। কি করব বোটে তিনটে বৌদি (রাগী ভদ্রমহিলাকে বৌদি বলার ভরসাও হচ্ছে না মশাই), একটা কিশোরী বা যুবতী (ইয়ে মেয়েদের বয়স আন্দাজ করা সাধু সন্ন্যাসীদের কাজ না মশাই), তাদের সামনে ওই হাপ ইউরিনালে যাওয়াটা ঠিক ইয়ে মানে...
হাওলাকোঠীতে নামলাম যখন দুটোর কাঁটা পেরিয়ে গেছে, এখান থেকে দু-আড়াই কিলোমিটার হাঁটতে হবে। পুরো দলটাকে এগোতে দিয়ে, একটু হালকা হয়ে এগোনো যায়।। কিন্তু আমার সঙ্গী ছোকরার মনের জোর নাকি প্রবল, তিনি বললেন আরে চল চলে যাবো ঠিক। বেশ তবে তাই হোক। কিন্তু হাপ কিলোমিটার চলার পর বোঝা গেলো এ বোঝা বইবার শক্তি আমাদের দেন নাই প্রভু। ঝড়ের বেগে এগিয়েছি, পুরো পল্টন অনেক দূরে, তাই ম্যানগ্রোভ দের একটু সমৃদ্ধ করার চান্স নিতেই হলো। রাস্তাটা খুবই সুন্দর। নিঝুম, শান্ত। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে পাখির কিচমিচ ছাড়া বুনো নিঃশব্দতা টের পাওয়া যায়। পিছনের দল আমাদের দরা অব্দি আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম, বুকের মধ্যে পুরে নিলাম হারিয়ে যাওয়া শান্ত পৃথিবী।

(ক্রমশ)
আগের পর্ব এইখানে

Tuesday, January 2, 2018

জলে-জঙ্গলে(প্রথম পর্ব)

পঁচিশে ডিসেম্বর যে সোমবার সেটা খেয়াল হলো ডিসেম্বরের দশ তারিখ নাগাদ। লাস্ট বেড়াতে গেছি সেইই লখনৌ মানে হলো গিয়ে অগাস্ট মাসে। মন পালাই পালাই করছে। সৌরভটার মাথার পোকাও খানিকটা আমার মতোই উড়ুক্কু অতএব শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল। পঁচিশের ছুটিতে বুকিং নেই কিচ্ছু নেই কিন্তু বেড়াতে যাবোই। এবার কথা হলো কোথায় যাবো? পালামৌ যাওয়া হয়নি, সেটা যাওয়া যায়, এছাড়া কাছাকাছির মধ্যে পুরুলিয়া যাওয়া যায়, চাঁদিপুর যাওয়া যায়। আর? যাই হোক কোথাও একটা যাবো ভেবে আরো এক সপ্তা পার। কিছুই জায়গা ঠিক নাই,কোথায় যাবো তাও জানিনা খালি জানি যাবো। আঠারো, মানে সোমবার, অফিস করতে করতে হঠাৎ মনে হলো মানস বা শিলং এর ডাউকি/ লিভিংরুট ব্রিজ টা ঘুরে আসা যাক নাকি? সৌরভকে অফিসের ফাঁকে ফোন, ওব্বাবা ফেরার টিকিট দেখি এগারো তলার বাসিন্দা! সৌরভ বলল দার্জিলিং যাবি? তেনার সাড়ে ছয়। আচ্ছা তাহলে বেতলা বা রাঁচী বা চাঁদিপুর বা পুরুলিয়া এই চারটের একটায় যাবো।

শুক্রবার দুপুর বেলা দুজনে ফাইনাল করলাম , চাঁদিপুরই যাই চল।

শুক্রবার বিকেলে ফাইনাল হলো আমরা দুজনেই যাচ্ছি আর কেউ না (একবার কথা হয়েছিলো সকালে সৌরভের কোনো এক বন্ধু যেতে পারে) এবং গাড়িতে না ট্রেনে, আনরিজার্ভড কম্পার্টমেন্টে।

শুক্রবার সাতটায় সৌরভ তিনটে লিংক দিলো ফেসবুকে, দেবাশিষ বাবু বলে এক ভদ্রলোক ভিতরকণিকার একটা বিচ গহীরমাথা সম্পর্কে জানিয়েছেন। লিংক পড়ে কনফার্মড আমরা এখানেই যাচ্ছি ব্যাস। এ পুরো মনের মতো জায়গা। বেশ কথা। সার্চ করতে গিয়ে দেখলাম একটা ঘর একদিনের জন্য ফাঁকা আছে বটে। দুজনের কথা বার্তা এবং বুকিং কনফার্মড, সাড়ে দশটায় সৌরভ গিয়ে প্রিন্টাউট। বের করে আনলো। এখনো জানিনা কাল কোথায় থাকবো।

ধৌলি ছটায় ছাড়ে, টিকিট কাটতে হবে সুতরাং পাঁচটায় অন্তত পৌঁছতেই হবে। কাল ওই সব উত্তেজনায় সন্ধ্যেবেলা আর ব্যাগ গোছানো হয়নি, রাতে ব্যাগ গুছিয়ে শুতে শুতেই ওঠার সময় হয়ে গেলো। হাওড়া স্টেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছি, 'কিরে কোথাকার টিকিট কাটবো? ভদ্রক না কটক?' 'আচ্ছা ভদ্রকই কাটা যাক'।

অসংরক্ষিত কামরায় আগে চড়িনি। খুব ভয়ানক কিছু হবে এমন ধারনাই ছিলো, তাও দাঁড়াতে পেয়ে গেলাম দেখি। ট্রেন ছাড়লো, ক্রমে গুঁতোগুঁতি বাড়লো একটু পরে সৌরভ বিড়বিড় করে বলল দেখি, ওর পাশের লোকটা যে নাকি এতোক্ষণ নাক খুঁটছিলো সে ওর সামনের হ্যান্ডেলটা ধরে দাঁড়িয়েছে আয়েশ করে, ফলে ওকে নিজের পায়ের উপর ভরসা করেই দাঁড়াতে হচ্ছে। একটু পরে ওই থিকথিকে ভীড়ের মধ্যেই অদ্ভুত কায়দায় চপ সিঙ্গারা বেচতে শুরু করলো। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যাগে, আর ব্যাগ হলো গিয়ে তাকে। কিন্তু কাউকে বার বার ফিরিয়ে দেওয়া কি ঠিক? একবার খাইনি, দুবারের বার? বা তিনবারের বার? ভীষ্ম কি অম্বাকে ফিরিয়ে দিয়ে ভালো করেছিলো? সুতরাং আমরাও এক প্লেট নিয়েই নিলাম, দুখানা ভেজিটেবল চপ আর এক খানা সিঙ্গারা।

বাস্তায় এসে আমাদের সামনের দুটো সিট ফাঁকা হলো, ভদ্রক আরো ঘন্টা দেড়েক। চপ শিঙাড়া, জল সব খাওয়া শেষ, বসার জায়গা পেয়েছি আর কি চাই, সুতরাং চোখ দুটোকে একটু আরাম কর বাবা বলাই যায়। কিছুক্ষন পর উঠে শুনলাম আমি নাকি পাশে একবার দাঙ্গা লেগে যাওয়ার উপক্রমেও উঠিনি দেখে সৌরভ একটু চিন্তায় পড়ে গেছিলো, সকাল সকাল চপ খেয়ে মৃত শিরোনামটা কি খুব সম্মানজনক মরা হ্যাঁ?

অসংরক্ষিত কামরা থেকে নামাটাই একটা অ্যাডভেঞ্চার। দরজা অব্দি টাইট ফিট, তবু চপ শিঙারা গলেছে মানে আমরাও গলতে পারবো আশা নিয়ে যাচ্ছি। "এক মহিলা চেঁচালেন একটু সোজা হয়ে দাঁড়ান, বেরোবো তো নাকি?"

- "নিন সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। বেরোন দেখি"।

ভদ্রমহিলার মুখখানা দেখার সাধ হয়েছিলো ওই সময়। যা হোক অদৃশ্য শিং দিয়ে পথ ফাঁক করে নেমেও গেলাম। পরিচ্ছন্ন, ছোট স্টেশন। স্টেশন রোডটা আর পাঁচটা মফস্বলের স্টেশন রোডের মতোই, খালি, খোলা নর্দমা বা পাঁকের পাহাড় নেই, গিজগিজে ভীড়ও নেই। এখান থেকে অটো ধরে বাইপাস গিয়ে বাস ধরে চাঁদবালী বা ট্রেকারে করে চাঁদবালী। তা ট্রেকার ভাড়া খুব বেশী না হওয়ায় আমরা চা বিস্কুট খেয়ে ট্রেকারে জুত করে বসে কেক খাচ্ছি। লোক হলেই ট্রেকার ছাড়বে। ক্রমে সব কেক শেষ হয়ে গেলো লোক আর এলো না কেউ। নেমে যাবো, বসে বসে কেক খেয়ে নেমে যাওয়াটা খুব ভালো দেখাবে না অবশ্য। লোকটা আশ্বাস দিলো হবে লোক হবে। বলতে বলতে সত্যিই লোক হতে লাগলো, আর এতো হতে লাগলো সেটাও বেশ চাপের হয়ে দাঁড়ালো। ড্রাইভারের পাশে এক খানা সিট কিন্তু দুই সিটের মাঝে একটা আসন পাতা। ওটা একটু চাপের হয়ে যাবে ভেবে আমরা সামনে বসিনি। ম্যাজিক গাড়ির মাঝের খোপে যে চার চার আটজন বসাবে কি করে জানবো! পিছনে আরো চার। বেশ বেশ।

গাড়ি ছাড়লো, 'ওই আসন তলে' থেকে সহসা গান বেজে উঠলো। উড়িয়া গান, গানে বলছে যেন মনে হলো, বিড়ি নিলি মিছি মিছি। মিছি মিছি কেন কেউ বিড়ি চাইবে কে জানে! এরপরে একটা গান শুনতে পেলাম মাটি মাটি করে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে স্লোগান গান হয়ে এখানে আসছে!! কি জানি বাওয়া কত কিছুই হয়। এরপরেই বোঝা গেলো গানের মহিমা। রাস্তা অত্যন্ত খারাপ, কাজ চলছে, কথা বলতে গিয়ে মুখ ফাঁক করলেই, ঢোঁক গেলার সাথে কাদা গোলা গেলা হয়ে যাচ্ছে। মোবাইল বের করে টাওয়ার দেখতে গেলাম দেখি মোবাইলের স্ক্রীনটা ধূলাগড় হয়ে গেলো।

মানুষ ও ধুলো বোঝাই রাস্তা বিপজ্জনক ভাবে হঠাৎ খাড়া ব্রিজে ওঠার সময় ভাবছি এই কুমড়ো গড়ান গড়ালাম বুঝি।

খানিক পরে সব সয়ে যায়, যে কোনো কষ্ট বা আনন্দ। তাই জন্যেই বোধহয় নিরবচ্ছিন্ন কষ্টে বা আনন্দে যারা থাকে তাদের দুটোর একটা বোধও তৈরী হয় না। বাইরের দিকে চোখ মেলতেই মন ভালো হয়ে গেলো। ফসল কেটে নেওয়া হয়েছে। মাঠ ফাঁকা, টলটলে জল ভরা পুকুর, নারকেল গাছ দিয়ে ঘেরা। এখনো এখানে পাকা মাথারা ঢুকে পড়েনি তাই তাদের উর্বর বুদ্ধিতে পুকুর পাড়ের গাছ কেটে সিমেন্টের বাঁধ দেয়নি। দুটো বাচ্ছা মেয়ে কি একটা খেতে খেতে পুকুর পাড়ে বসে গল্প করছে, পাশে এঁটো বাসনের স্তুপ। মাজতে এনেছে হয়তো তার আগে দুই বন্ধুর আলাপ চলছে। রোদের তাত আছে বৈকি কিন্তু হাওয়াটাও দিচ্ছে ভালো তাই ভালোই লাগছে রোদটা। চাঁদবালী পৌঁছলাম দুটো বেজে গেছে। ফরেস্ট রেস্ট হাউসটা কোনদিকে? একজন রাস্তা দেখাতে এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। একটা থানা সামনে, একজন পুলিশ রোদ পোহাচ্ছে দাঁড়িয়ে। ওনাকেই জিজ্ঞেস করলাম ফরেস্ট রেস্ট হাউস কোথায়? বললেন ওখানে গিয়ে কি করবে আচ্ছা দাঁড়াও একজনের নাম্বার দিচ্ছি ফোন করে কথা বলে নাও। বলে নিজেই ফোন করে দিলেন, উড়িয়া ভাষায় কথাবার্তা থেকে যা বুঝলাম তার নাম বাবনি, আর থানার সামনে একটা পাতলা আর একজন মোটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে । সে বোটওলা। এসে আমাদের বলে কিনা দশ হাজার পড়বে!!

আমাদের তো শুনেই চোয়াল ঝুলে গেছে। বলে কি রে! বললাম দাদা দুজন কলেজ স্টুডেন্ট এসেছি তা দশহাজার টাকা চোখেই দেখিনি কখনো! ডিএফও কে ফোন করা হলো, বুকিং ইনফর্মেশন থেকে। তিনি একজনের নাম্বার দিলেন। সে বলল আচ্ছা আমি আসছি। খানিক পরে বলে তোমরা তো অনেকের সাথে কথা বলে ফেলেছো, আমি জানিনা কি করতে পারি, আচ্ছা দেখছি। আপাতত তোমরা মাইতি লজে গিয়ে তো জায়গা পাও কিনা। বেশ চলো কোথায় মাইতি লজ। বুঝতে পারছিনা এখান থেকে রাজনগর গিয়ে গুপ্তি চলে যাবো কিনা। কারন ফেসবুকের ওই পোস্টে গুপ্তি থেকেই লঞ্চ এর কথা বলা ছিলো। ওটিডিসির অরণ্যনিবাসে ঠিকঠাক ইনফর্মেশন দিলো না কিছুই। সরকারী লঞ্চ ছাড়ে না? মহা মুশকিল তো। এরকম করলে লোক যাবে কি করে রে বাবা। মাইতি লজটাই বা কোথায়? একটা হোটেল তৈরী হচ্ছে টাইপ, সূরজ লজ সেখানে ঢুকে দেখি একতলাটায় কোনে সিসিটিভির নজরদারী চলছে মানে ইয়ে কেউ দেখার নেই যদিও, এদিকে পাশে কল থেকে টপটপ করে জল পড়ছে, রেজিস্টার খাতা একটা টেবিলে পড়ে আছে। মানে টিপিক্যাল লজ কিন্তু সিসিটিভি আছে, পলতা পাতা কিনে ক্যাশমেমো চাওয়ার ব্যাপার আর কি। বাইরে বেরিয়ে আসছি হোটেলের ছেলেটা আসছে দেখি, বললাম ঘর টর আছে? সে দেখালো ঘর একখানা। ঘর দেখে মনে হলো "হোটেল ডিল্যাক্স" নাম হওয়া উচিত ছিলো। যাকগে আমাদের আর কি, বেসিনে না তাকালেই হবে দাঁত মাজার সময়। যাহোক একটা বেডশীট চেয়ে নিলাম। ঢাকা থাক সব কিছু।

ছোট্ট জনপদ। বাস স্ট্যান্ডে মিষ্টির দোকান, সুলভ শৌচাগার ফলের দোকান সবই আছে কিন্তু চোখ বোলালেই বোঝা যায় এটা সেই পুরোনো বছর কুড়ির আগেকার গ্রাম। একটাই ভাতের দোকান বা রেস্টুরেন্ট। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সস্তাও বেশ। এবার যদি গড়াতে যাই তাহলে আর উঠতে পারবো না, পাশ দিয়ে ব্রাহ্মণী নদী বইছে, ছোট মাছ ধরা নৌকা। শান্ত দুপুর, শীতের রোদ পড়ে আসছে দ্রুত। দু চারখানা দোকানে খোঁজ নিলাম, এখানে মিষ্টি পান খায় না কেউ সব চুন জর্দা দেওয়া কড়ক পান। রাস্তার পাশেই ছোট্ট গ্রাম, সাইকেল ট্রাক বাইক যাচ্ছে একটা দুটো। দূরে একটা ব্রিজ দেখা যাচ্ছে.... টুকটুক করে হাঁটাছি সেদিকেই। আচ্ছা আমাদের দেশের মানুষের সৌন্দর্য বোধ এত কম কেন? এতো জায়গা তবু বাড়ি করেছে এতটুকু জায়গা না ছেড়ে, এক চিলতে বাগান এর জায়গা না রেখে। আসলে আমরা মনের দিক থেকেও খুব গরীব মনে হয়। বট গাছের নীচে একটা বাঁধানো বেদী, চুপ করে বসে দেখছি সূর্য ঢলছে। ব্রিজটা অনেক দূর যাওয়া যাবে না।

সন্ধ্যেবেলা ফের গেলাম পানিবাবুর কাছে, কিছুতেই বলছে না কত লাগবে, কাল কখন আসতে হবে। খালি বলছে হয়ে যাবে আজব তো! সন্ধ্যেবেলা কিছুই করার নেই, স্থানীয় লোকজন চা এর দোকানে ভীড় করেছে এই অব্দি। ব্রিজটা টানছে খুব। অন্ধকার হয়ে গেছে, চাঁদও উঠে গেছে, ব্রাহ্মণী নদীতে কুয়াশা নেমেছে, ব্রিজটা থেকে খুব মায়াবী লাগবে না? একটা সাইকেল আছে পানিবাবুর কাছে, কিন্তু টর্চ নিয়ে সৌরভকে নিয়ে এই রাস্তায় আমি চালাতে পারবো বলে মনে হয়না। অপারেশন এর পর এমনিই একটু দুর্বল হয়ে গেছি। ওই তো একটা বাইক যাচ্ছে, "ও দাদা, নিয়ে যাবে একটু ব্রাহ্মণী অব্দি? "

বাইক এর আওয়াজ ছাপিয়ে, ভাঙা রাস্তায় নাচন কোঁদন উপেক্ষা করে আলাপ চালিয়ে গেলাম, ছেলেটার নাম অশোক, আমাদের বলল জয়নগর ঘাট থেকে বোট নিলে কম পড়বে।

"তোমার চেনা বোটওলা আছে কেউ? নিয়ে চলো না, কথা বলিয়ে দাও একবার?"

ব্রিজটা বেশ লম্বা, ব্রিজ পেরিয়ে ডানদিকের একটা মেঠো রাস্তা ধরলো। বাইক এর আলো শেষ হচ্ছে যেখানে তারপর থেকে একটা জমাট অন্ধকার যেন থাবা মেরে বসে আছে। বাইকের আওয়াজ ছাড়া কোথাও কোনো আওয়াজ নেই, কোনো লোক নেই। ওহ না ভুল বললাম হাওয়ার আওয়াজ আছে। হঠাৎ একটা লোক দেখা গেলো সাইকেলে, অশোক জিজ্ঞেস করলো তাকে কোনো এক বোটওলার কথা। উড়িয়া বাংলার প্রায় কাছাকাছি বলে খানিক বোঝা যায়, খুব স্পষ্ট না হলেও। আরে বাঁ পাশে একটা ঝুপড়ি মতো ঘরও দেখা যাচ্ছে তো। সেখান থেকেও একটা লোক বেরিয়ে এলো। নিজেদের মধ্যে বোট নিয়েই আলোচনা করছে। যা বোঝা গেলো কাল রবিবার বোট পাওয়া মুশকিল তাছাড়া আমরা যাচ্ছি সেই হাওলাকুঠি সেখানে রাতে বোট রাখতে হবে তাই কেউ রাজী না তেমন। ওদিকে ঝুপড়ির আবছা আলোয় অন্ধকারটা চোখ সইতে চারিদিকটা নজর করতে পারা যায়। ফসল কাটা ক্ষেতে কুয়াশা মাখা, দূরে ব্রাহ্মণী নদীর চড়া, আশেপাশে কিছু অপরিচিত লোক। আমাদের শহুরে মধ্যবিত্ত মন যাদের সন্দেহ করছে, আসলে বিনা স্বার্থে কেউ সাহায্য করছে এ জিনিস আমাদের রোজকার জীবন থেকে উবে গেছে কিনা।

লোকটা আমাদের মেন রাস্তা অব্দি ছেড়ে দিলো, একটু এগোলে একটা হনুমান মন্দির।মন্দির ডাঁয়ে রেখে এগোচ্ছি হেঁটে হেঁটে। অটো পাবো কিনা জানিনা, দূর আছে চাঁদবালী। এখানেও রাস্তার কাজ চলছে আলো জ্বেলে। ওই তো একটা অটো। যাক হাঁটতে হবে না।





(ক্রমশ)