Sunday, January 28, 2018

লাল পাহাড়ের দেশে




শালের গোড়ায় বসেছিলাম, রোদ এসে পড়েছে, মাঘের রোদ, জ্বালায় ভালোই, তবে প্রেমের শুরুর মতো এখনো জ্বলুনি শুরু হয়নি তেমন। লোক নেই কোনো আমরা ছাড়া। আসার কথা ছিলো চারজনের, এসেছি দুজনে। কেয়ারটেকার ছেলেটা একটু আগে চলে গেছে রাতে দেশী মুরগী বানাবে। "মেয়েদের চক্করে এক্ষুনি পড়ুনি বাবু, আমি শিলদা কলেজে পড়তে জিএস ছিলুম, কত ছেলের যে কেরিয়ার ডুম হয়ে গেলো এই মেয়েদের চক্করে পড়ে। মেয়েগুলো তো বিয়ে সেই বাপ মা এর দেখে দেওয়া, দেখতে শুনতে ভালো, চাকরি করে ভালো এমন ছেলেকেই বিয়ে করবে। অল্পবয়স তোমাদের বলে দিচ্ছি তাই"। বলে গেছে আমাদের। 
কি ভেবেছে কে জানে, দুজন ছেলে ঘুরতে এসেছে মানে নির্ঘাত দাগা খেয়েছে, দিওয়ানা হয়ে গেছে। ট্রেন ধরেছি সেই সাত সকালে। শালিমার থেকে। শালিমার স্টেশনটা মজার। একটা মাত্র চায়ের স্টল আর দুখানা প্ল্যাটফর্ম, তাতে একটা দুরন্ত আর একটা আরণ্যক দাঁড়িয়ে। লোকজন নেই, পরিষ্কার একটা ল্যাদখোর স্টেশন। ট্রেনে ভীড়ও ননেই তেমন। ট্রেনে বসে বসে দেখছি কেমন মাটির স্ট্রেকচার বদলে বদলে যাচ্ছে, মাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে আর গাছ গুলো বলছে আমি আছি তো এখনো।






ওদিকে ট্রেনে তখন এক রুমাল ওলা বকুনি খাচ্ছে, কেন আগের দিন সে টাকা নেয়নি আর আজ মনেও করায়নি। রুমালওলা জানাচ্ছে ও জানে মাস্টারমশাই ঠিক মনে রেখে দেবে। যাক বাতাসে বিশ্বাসের অক্সিজেন এখনো মেলে। সেদিনই এক বন্ধুর সাথে তর্ক হচ্ছিলো, বিশ্বাস করা ভালো না ভালো না নিয়ে। আমি অসহায় ভাবে স্বীকার করেছিলাম আমি ভালো খারাপ জানিনা আমি অবিশ্বাস করতে পারিনা, কারন আমার বুদ্ধির পরিমাপটাই কম, অ যোগ করতে যে টুকু মাথা খাটাতে হয় তা আমার নাই।

এই গেস্ট হাউসের ব্যবস্থা দিব্যি ছিমছাম, শাল পাতা পরিষ্কার করছে একজন, ঝাঁটা দিয়ে, ওইদিকে, কয়েকজন মিস্ত্রী কাজ করছে। কেয়ারটেকার ছেলেটা বেরিয়ে যেতে আমরাও বেরোলাম, টোটো ডাকা হয়েছে। এখানে নাকি এক অতি প্রাচীন ভয়ানক জাগ্রত মন্দির আছে যা অবশ্য দর্শনযোগ্য। মন্দির যদি খুব পুরোনো হয় তা দেখতে আমি খারাপবাসিনা, বেশ কাজ টাজ দেখা গেলো, সে মমন্দির সিসিটিভির মতো জেগে থাকা হোক কি দারোয়ানের ঝিমুনির মতো হোক আমার যায় আসে না।
মন্দিরে যেতেই দেখি সকলে পাত টাত সাজিয়ে বসেছে খেতে, খিদে পায়নি বলব না তবে মন্দিরে নিরামিষ হয় কিনা আমার আবার দীক্ষা আছে নিরামিষ খেতে নেই, তাই খুব একটা উৎসাহ দেখাইনা। বাইরে থাকতে অবশ্য প্রতি বৃহস্পতি বার সাঁই মন্দিরে গিয়ে প্রসাদ প্যাক করে নিয়ে আসতাম, রাঁধার ভয়ে। আর বাড়ি ফিরে একটা অমলেট বানিয়ে দিব্যি, সেসব খাওয়া যেত। কিন্তু বসে খেলে তো আর তা হবে না। তাও বন্ধুটাই জিজ্ঞেস করেছে এখানে কি ভোগ খাওয়া হচ্ছে অমনি পুরোহিত বলে দুজন? আচ্ছা যাও যাও বসে যাও ওখানে, আর দুজনের একশো টাকা দাও। থতমত খেয়ে টাকা দিয়ে ফেলে বসে বসে ভাবছি, এরপর গিয়ে আবার খেতে হবে, শালারা খিচুড়ি লাবড়া খাওয়াবে একটা ডিম অব্দি দেবে না নির্ঘাত। নাহ শুরুতে একটা ভালো পোলাও দিলো, আহা কষা মাংস দিলে জমে যেত রে। তারপরেই খিচুরি, লাবড়া আর আলুপোস্ত। আলুপোস্ত দিয়ে খিচুড়ি!! কত কি জানার কত কি দেখার বাকি! খিদে পেয়েছিলো বটে, তাছাড়া ভবঘুরেদের এতো খুঁতখুঁতে হলে চলেও না, কিন্তু স্রেফ এই বিস্বাদ খিচুড়ি আমি খেতে পারবোই না। নাড়াচাড়া করছি খাবার নিয়ে, পাশে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বসে ছিলেন। চিনি না, জানি না, তিনি হঠাৎ ওই আমার খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া দেখে বললেন, 'খেতে কষ্ট হচ্ছে না বাবা? মাছ দেবে, আমার নাতিটাও এমন, খাবার খুঁটবে খালি। নাও ওই যে মাছ এসে গেছে, খেচুরি টুক খেয়ে নাও দিকি।' এই যে রাস্তায় নামলেই সারা দুনিয়ার লোকে আমার সঙ্গ দেয় খেয়াল নেয় তারপরেও বাড়ি থেকে কেন চিন্তা করে কে জানে!

গনগনি হলো শিলাইবতী নদীর খাত, লাল পাথুরে মাটিতে অদ্ভুত এক খোয়াই তৈরী করেছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বেশীর ভাগ জায়গা থেকেই নীল আকাশ চোখে পড়ে না আবহাওয়াগত কারণেই। এখানে আকাশ দিব্যি নীল, নীচে লাল নদীখাতে গড়ে ওঠা ছবি, আর খাদের উপর ঘেরা সবুজ গাছের সারি। এ জায়গাটা বলে মিনিয়েচার অফ গ্র‍্যান্ড ক্যানিয়ন অফ এরিজোনা। তা বলার দরকার নেই , হয়ত ক্যানিয়ন বলাটা বাড়াবাড়িই কিন্তু সত্যিই বড় সুন্দর। হাঁ করে করে দেখতে হয় লাল, সাদা সবুজ, নীল এর চমৎকার একটা কম্বিনেশন। শিলাইবতী নদীতে চান করছে দেখি অনেকে। রোদে গরমে ঘেমে উঠেছি ততক্ষণে, খুব ইচ্ছে করছিলো জলে নেমে ঝাঁপাই জুড়তে। গামছাটা আনলে নেমেও যেতাম হয়তো, তার বদলে দু চারটে শিং নেড়ে তেড়ে আসা গোমাতাকে সাবধানে কাটিয়ে, নদীর ধার ধরে ধরে একটা পাথরে বসলাম। একটা লোক মাছ ধরছে, ছোট্ট একটা মাছ ধরা নৌকা নিয়ে, লগি দিয়ে ব্যালান্স করতে করতে। ক্রমে রোদ যখন মাথা টাথা ধরিয়ে দিলো, উঠে খাদটার অন্যদিকে গেলাম। এদিকটাও ভারী চমৎকার। মাথার উপর পাথুরে ছাদের আড়াল। কতকগুলো বাচ্ছা দেখি হাঁকডাক করে হাজির, কি না তাদের ছবি তুলে দিতে হবে। 'কি রে ব্যাটা পড়াশোনা, ইস্কুল নাই এখানে ফুক্কুড়ি করছিস? '
'কোন ইস্কুলে পড়েছ তুমি হ্যাঁ? ছাব্বিশে জানুয়ারি ইস্কুল থাকে?'
অতএব হার মানতেই হয়, তাদের ছবি তোলা হলো, দাদা তুলবে ছবি আর বোন কি বসে থাকবে? ব্যাস তিনিও এলেন, দাদার হাত ধরে ঝুলতে ঝুলতে।










ক্রমে অমন মাথা ফাটিয়ে দেওয়া সূর্যের তাপও কমে আসে, লাল পাথরে সুর্যাস্তের ছবিটা বেড়ে লাগছে। জামা প্যান্টুল অনেক আগেই ধুলোময় হয়ে গেছে, খাদ ধরে উপরে উঠে এসে দেখি কাজু, দেবদারু গাছের ফাঁকে লাল সূর্যটা হেব্বি একটা পোজ দিয়ে বলছে আমি চল্লুম বাপু আজকের মতো খেলা শেষ।



আরো অন্ধকার হতে আমরা রওনা দিলাম। দুপাশে জঙ্গলের থেকে ঝিঁ ঝিঁ আওয়াজ আর হঠাৎ চমকে দেওয়া গাড়ির আলো ছাড়া শব্দ নেই, জন নেই। এই অন্ধকার নৈঃশব্দ্য ভেদ করে আমরা দুজন বকবক করতে করতে, বেসুরো হেঁড়ে গলায় গাইতে গাইতে যাচ্ছি। তারপর এক সময় বকবক থামিয়ে দুজনেই স্রেফ নিজের সঙ্গে চলতে শুরু করলাম কখন। আসলে এই নৈঃশব্দ্য এই নির্জন অন্ধকার তো মেলে না সবসময়, নিজের সাথে অন্ধকার জড়িয়ে হাঁটাই বা কোথায় হয়।

তারপর রাস্তার মাঝে এক জায়গায় খাবার হোটেল পাওয়া গেলো। হোটেলের বৌদিও অবাক হয়েছে বেশ। হোটেল কাম বাড়ি, দরমার বেড়া দেওয়া কিন্তু তকতকে। চা, পিঁয়াজি খেয়ে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে এগোলাম ফের। আর হাঁটা না, হাত দেখিয়ে একটা মোটর ভ্যান থামিয়ে উঠলাম। ফাঁকা মোটর ভ্যানে হাওয়াতে এতক্ষণের না টের পাওয়া ঠান্ডাটা ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের উপর। শীত তাড়াতেই গল্প জুড়লাম। কাকা আমাদের গেস্ট হাউস অব্দি ছেড়ে দেবে, আমলাতোড়া পেরিয়ে বেশ খানিক্টা গেলে গেস্ট হাউস। এই ভ্যানগুলোর দাম ছাপ্পান্ন হাজারটাকা। কাকা টাকা জমাচ্ছে এরকম একটা ভ্যান কিনবে। তারপর তো নিজেই আলু লোড করবে, না হলে খাটনি বেশী লাভ কম হয় খালি। সব জায়গায় সেই একই গল্প দেখি, হয় ভ্যান নয় বাড়ি কালকের জন্য ভেবে আজকের দিনটাকে আখমাড়াই। অবশ্য ঠিকই আছে, স্বপ্ন আর আশা এই না থাকলে থাকেই বা কি।

বন্ধুটার পেট খারাপ হয়েছে। ওকে বললাম, ভাই তুই যা ফিরে আমি একটা রাউন্ড হেঁটে তারপর আসছি। কুয়াশার পাতলা চাদর নেমেছে, আকাশে আধভাঙ্গা চাঁদ, আশেপাশের বাড়ির লোকে ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা কে জানে তবে সাড়াশব্দহীন। একা একা হাঁটছিলাম, রাস্তা দিয়ে। ভাগ্যিস আমি রোজ থাকিনা এখানে। এমন ঘুমিয়ে পড়া সন্ধ্যে আমার রোজ রোজ কিছুতেই ভালো লাগতো না এ আমি নিশ্চিত। আসলে আমি ওই আড্ডা হইচই জীবনও খারাপবাসি না। মাঝে মাঝে দম বন্ধ লাগে বটে সাজানো গোছানো কাজে কথায়, আমি পালাই তখন। ভীড়ের আড়ালে, নিজের সাথে একটু আর আমাদের এই সভ্যতার উপেক্ষার আড়ালে মুচকি হাসি নিয়ে আমাদের কন্ট্রোল করা প্রকৃতির সঙ্গে খানিক সময় কাটালেই আবার কিছুদিন ফ্ল্যাটের দাম, বাজারদর, ব্যালান্স শীট, ক্লায়েন্ট কল, পিওয়ান, সইয়ে নেওয়া যায়....এই শাল, কাজুগাছের বন, রাঙামাটি, খোয়াই এর ঢাল, ট্রেন থেকে এক ঝলকে দেখা ফুলের ক্ষেত,অচেনা মানুষ এর যত্ন এই সবে পকেট বোঝাই রইলো.....হালকা হলেই বেরোতে হবে আবার,অন্য কোথাও.....

2 comments:

  1. খুব ভালো লাগল, প্রদীপ্ত। এই জায়গাটা ঠিক কোথায় গো?

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংকিউ কুন্তলাদি । এটা গড়বেতা স্টেশন থেকে ভ্যানে করে যেতে হয় ।

      Delete