Wednesday, September 7, 2016

ছোটবেলার হিজিবিজি ৩

ষষ্ঠীর সকাল থেকে ঢাক বাজতো না বোধহয় । বাজলেও আমার মনে নেই। জেনারেটার এর লোকজন এসে আলো লাগাত । তাপস , মানকে গৌরহরি ওরা কেমন ওই বয়েসেই দুটো তার জোড়া দিয়ে আলো জ্বালিয়ে দিতে পারত । ফটকে ওর দাদুর ঢাকের সাথে কাঁসি বাজাত । কিন্তু ব্যাটা যা নাচত না । অক্ষয়কুমারের মতন নাচতে পারত । আমি অরিত রন্টি বুয়া (পিসি ফিসি না, আমার এক দিদির ছেলে) একবার লুকিয়ে নাচতে গেছিলাম , ধরা পড়ে "কান ধরে তুমি নিয়ে চল" হয়ে গেছিলো । -_- যাকগে । বড়পুকুরে ছোটদের নামা বারণ ছিল একা একা কিন্তু সঙ্গে বড় কেউ থাকলে নামা যেত । ঘাটের সিঁড়ি কতদূর চলে গেছে জানার খুব ইচ্ছে হতো । ওর তলাতেই পাতালপুরী? সোনার কাঠি পকেটে ছিলো না কিন্তু ডুব দেবার সাধ হত ভারী । সিঁড়ি ধরে পা ছুঁড়তাম আর একবার অরিত এক ধাক্কা মেরেছিল কি নিয়ে একটা লড়াই হয়েছিল তাই , আমিও নাকানি চোবানি খেয়ে সাঁতার এবং ডুব দুটোই শিখে গেলাম । ধাক্কা জরুরী , ভালবেসেই হোক কি খারাপবেসেই হোক ।
বড়পুকুর এপাড় ওপাড় করতে পারা মানে তুমি হ্যায় ব্যাক্তি । আমি পারতাম না কিন্তু পাড়ার ছেলেরা নারকেল, তাল গাছ থেকে ঝাঁপ মারতে পারত। আমার বাড়ির সব কটা ছেলেই ইঙ্কলুডিং মি , ন্যাদোশ , কেউ পারবে না আমি জানি , অত ভয় দেখালে আর কি করে হবে -_- ।
পুকুরের পারের কৃষ্ণচুড়া গাছটায় যে ফল হত তা দিয়ে খেলা হত, কার মুণ্ডু কাটা পড়বে ।
সপ্তমীর দিন সকালে কলাবউ চান হবে তার আগে ঘট ডুবানো হবে । সক্কাল বেলা ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভাঙবে , কনরকমে ব্রাশ করে (বা না করে ) জামা বদলে ( এটা মাস্ট , পূজোর কাছে বাসী জামা প্যান্ট গেলে ঘাড়ধাক্কা খাওয়া মাস্ট) দৌড় দিতাম । মূল যে পুরোহিত সে তো আমাদের বাড়ির ফিক্সড পুরোহিত , লক্ষ্মী সরস্বতী কালী সব পূজোয় সেই আসবে তার কাছ থেকে গল্প শুনবো , কেমন করে আমাদের বাড়ির কালীপূজোর দিন ডাকাত আসতে গিয়ে নাকাল হয়েছিলো ডাকাতেরা ( তখন অত কূট প্রশ্ন মাথায় আসত না , নিজের নাকাল হবার গল্প কেন কেউ বলবে বা ইত্যাদি, আমি গল্প শুনেই দেখতে পেতাম একটা নৌকা করে দামোদর দিয়ে লাল ফেট্টি বাঁধা ডাকাত আসছে ) যাইহোক তাকে আমরা সব্বাই নাম মাধঅবো বলে ডাকতাম , আসল নাম অন্য , কিন্তু কেন কি জানি আমরা ওই বলি এখনও মানে আমারা যারা ছোট ছিলাম এখন ধেড়ে হয়ে গেছি ।
মা জ্যেঠিমারা কেউ শাঁখ বাজাচ্ছে ,কেউ জলের ঝারি টা দিয়ে জল ফেলছে আর দাদারা বোমগাছ বাঁধতে ব্যস্ত । শব্দদূষন নিয়ে অত চিন্তা করিনি , কড়াকড়িও ছিলো না খুব । দিনে রাতে যখনই আরতি বা কলাবউ চান বা ওরকম কিছু হবে একটা করে গাছ ্বোম বাঁধা , একসাথে আটটা না বারোটা ধুম দাম করে ফাটবে । বেশ আওয়াজ হয় । পিলে চমকানো টাইপ আর যে কানে হাত চাপা দেবে তাকে বাকিরা দুয়ো দেবে । পিলে চমকালেও , ছেলে ছোকরারা কানে হাত চাপা দিত না। লুজ বোমও হত সেগুলো ফাটাতে এক্সেস পাওয়া মানে বড় হয়ে গেছি । মনে আছে আমি ক্লাস সেভেনে না এইটে পেয়েছিলাম , কি হাবভাবটাই না নিয়ে ছিলাম।
ঘটডুবানো আর কলাবউ চান এর পর ঘরে গিয়ে খেয়ে দেয়ে আবার পুজোর কাছে । আমরা একটা খেলা খেলতাম , লে ম্যান বলে , দু দল থাকবে একজন এক পায়ে গিয়ে ওপারের লোককে ছুঁয়ে দিলে আউট । মানে কাবাডির মত । আর খেলতাম চোর পুলিশ । পুলিশ হতে কেউ রাজি হত না , কারন চোরের জীবন অনেক রোমাঞ্চকর। সে যে কোন নিয়ম ভেঙ্গে যে কারোর পিছনে শেল্টার নিতে পারত , কিন্তু পুলিশ তো নিয়ম ভাঙ্গে না । তাই লটারি করে মারামারি করে চোর পুলিশ ঠিক হত । আরও একটা কারন ছিল , চোর এর গুলি করার স্কোপ অনেক বেশী , সে যাকে পারে গুলি করে , পুলিশ পারে না ফলে ক্যাপ ফাটাতে কম পারে ।
দুপুরবেলায় মা এর একটু ঘুম লাগবেই , এবং মা এর লাগবে না শুধু কাকিমাদের জ্যাঠিমাদেরও লাগবে এবং আমরা তো ফ্রি । সুতরাং বিছানায় বন্দি । আমাদের কোড ছিল, নাম ধরে ডাকলে তো বকুনি এবং মা শুধু না মা এর কাঁচা ঘুম বরবাদ এর শাস্তি হিসেবে বিকেলেও আটকে দিতে পারে তাই কুহু (কোকিলের ডাকটা ইজি কিনা) করে ডাক দেওয়া হত । বেজায় বেশী বুদ্ধি ছিল তাই বুঝিনি , মা এরা বুঝেও পাত্তা দিত না । অমন কাঁচা হরবোলার ডাক ধরতে না পারার কোনও কারন থাকতে পারে নাকি । কোনো কোনো দিন বাকিরাও ঘুমিয়ে পড়ত। আমার চোখে আর ঘুম আসত না , আমি উঠে পড়তাম । পুরনো বাড়ির পিছন দিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতাম । ঝুপ্সি হয়ে থাকত এক এক জায়গা , আমার মন খারাপ করত আমি আবার এসে মা এর কাছে শুয়ে পড়তাম ।
সন্ধ্যে হত , আলো জ্বলে উঠত । একরাশ ফুল দিয়ে সাজানো হত বিকেল থেকেই , আর বেলপাতার মালা গাঁথা হত । ওই দূরে হটে যেত অন্ধকার।যে জায়গা গুলো পেরোতে অন্যসময় বুক শুকিয়ে যেত , বীর এর ন্যায় এগিয়ে যেতাম সেসব জায়গায় ।
বাজি পোড়ান হত চারদিনই । ছাদের থেকে দেখতাম উঠে একটু রাত হলে , সিনেমা চালানো হত । আমাদের টিভিটা বাইরে বের করে দেওয়া হত । কিন্তু কি সিনেমা চলত আমার মনে নেই । আমি ঘুমিয়ে পরতাম -_- । অষ্টমীর দিন সকাল সকাল উঠতে হবে বলে বাজি পোড়ানোর পরেই আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হত।

Thursday, September 1, 2016

ছোটবেলার হিজিবিজি 2



অনেকের পরের পার্ট শুনতে ইচ্ছে হলো তাই তাই পরের কিস্তি লিখতে বসলুম।

মহালয়া তো চলে এলো। ভাবলে অবাক লাগে এত্ত গাছ পালা চারদিকে ছিলো কিন্তু একটাও শিউলি গাছ ছিলো না। শিউলি গাছ ছিলো স্কুলে, হস্টেলে থাকতে সকাল বেলা পড়া পড়া খেলতাম যখন দেখতাম গাছের তলাটা সাদা আর হলুদের কম্বিনেশনে ছেয়ে গেছে। কিন্তু কোনো পল্লী বা শহুরে বালা সে ফুল আমায় দেবার যুগ্যি মনে করেনি কখনওই। যাকগে কৈশোর না আমার ছোটবেলার কথা হচ্ছিলো। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার থেকে আমাদের টিভিতে দেখানো মহালয়া নিয়ে বেশী উৎসাহ থাকত। তখন কালার টিভি এসে গেছে, রংচঙে যুদ্ধ দেখতে ভারী ভালোলাগত। মেজজ্যেঠু আবার চারটের সময় উঠবেই আর চালাবেই। সত্যি বলতে কি, আমি এই বয়েসেও মহালয়া শুনতে বসলে একটা করে নতুন গান আবিষ্কার করি। যাই হোক ওই রেডিওর মহালয়া নিয়ে আমাদের একদমই উৎসাহ ছিলো না তাই শুনতামও না। আমাদের মানে আমার এক কাকা থাকত হিন্দমোটরে, সেই খুড়তুতো ভাই, দিদিরা আমার বয়েসী ছিলো তারা আসত, তারপর দিদিভাই মানে সব থেকে বড় দিদির ছেলে মেয়েরাও আমার বয়েসি তারাও আসত। এছাড়া আমার দিদি তো আছেই। পাড়ার ছেলেদের সাথে বিকেলে মাঠে যা খেলা হতো অন্যসময় তেমন বন্ধুত্ব ছিলো না। তার একটা কারন তারা বেজায় শক্তপোক্ত ছিলো, আমি প্যাংলা দুর্বল সে লড়াইতে হেরে ঘরে ফিরতাম। তাছাড়া আর একটা কারন ছিলো গ্রামের দিকে লোকজনের মুখের ভাষা অত রেস্ট্রিক্টেড ছিলো না। তারা ওই বয়েসেই অনায়াসে খিস্তি দিতো আমিও সে জিনিস শিখে বাড়িতে বলে বেশ অভূতপূর্ব অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম বলে বেশ মনে আছে। ফুলদিদি কলেজ থেকে ফিরে আমার জন্য আনা সন্দেশটা অব্দি লুকিয়ে দিতে পারেনি :'( । ছোড়দি মানে আমার দিদি পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো। সেবার যখন মা ওকে ঘরে খাটের পায়ার সাথে বেঁধে রেখেছিলো কে বাবুজিকে ডেকে এনেছিলো হ্যাঁ, এই শর্মাই তো নাকি। কোন আক্কেলে তুই মাকে বলতে গেলি " ম্যা ম্যা বাবু না **** বলেছে "!! যাকগে সে শোধ আমি নিয়েছিলাম এক খাবলা চুল তুলে এনে। সে অন্য প্রসঙ্গ। যা বলছিলাম, তা আশেপাশের ছেলেপুলেদের সাথে পূজোর সময় খেলার কোনো মানা ছিলো না। খালি মারামারি না করলেই হলো। মারামারি মূলত আমার ভাগনের সাথেই হতো অবশ্য। ঠিক বেছে বেছে যে সোজা প্যাঁকাটি টা আমি তুলে আনবো ব্যালেন্স করে আঙুলের ডগায় নিয়ে ঘুরবো বলে সেইটিই ওনার চাই। না পেলেই চিলচিৎকার করবে। ও আবার কি! আর আমি বাড়ির ছেলে ওরা নাকি কুটুম মানুষ ওদের দিয়ে দেওয়াই উচিতকর্ম। কই মামাবাড়ি আমি যখন যাই পাপুদা যখন বাজি ফাটায় আর আমায় বলে তুই বাচ্ছা ওদিকে গিয়ে দাঁড়া তখন তো কারোর উচিতকর্ম এর কথা মনে পরেনা। হুহ।

তো মহালয়ার সময় যেটা দেখানো হত টিভিতে সেটা আবার ষষ্ঠী বা সপ্তমীর দিন দেখানো হত। অসুরের ওই ডায়লগ আর হাসিটা আমি ওর মধ্যে তুলে ফেলতাম। আমাদের অসুরের উপর বেশী শ্রদ্ধা ছিলো মনে হয়, গায়ের সবুজ রংটার জন্য কি? নইলে আমরা যখন নিজেদের মহালয়া করতাম ওই টিভির মতো অসুরের পার্টটা করার জন্য এমন লড়াই হবে কেন? আমাদের চার জনের মূল যে দলটা ছিলো তাতে মেয়ে কেউ ছিলোনা বলেই বোধহয়, আর সে বয়েসে নিজের পুরুষত্ব সম্পর্কে আমরা চার জনেই বেশ সচেতন ছিলাম দেবত্ব লাভেরর জন্যও সে বিসর্জন দিতে নারাজ ছিলাম। মহালয়ার পরেও স্কুল খোলা থাকত কিন্তু সে খালি সময় নষ্ট করা। আমি তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কাকারা আর দিদিরা কবে আসবে। চতুর্থীর রাতেই সব জড়ো হতো। মামাতো দাদা দিদি আর মাসতুতো দাদারাও আসতো কিন্তু ওরা ঢের বড় ছিলো তাই তাদের আমার তাদের নিয়ে কোনোরকম উৎসাহই ছিলো না। ওরা বোকার মতন না খেলে দিনরাত গান শুনতো আর আড্ডা মারতো। আমাদের ওদিকে ঘেঁষতে অব্দি দিতোনা। আমরাও থোড়ি পাত্তা দিতাম। মা মাসি জ্যাঠি দিদিদের আলাদা দল ছিলো ওদিকেও যেতাম না কি বকতে পারে বাবা। বাবা কাকারা কোথায় থাকত কে জানে এমনিতেই বাবাই এর সাথে আমার যোগাযোগ ওই রাতের বেলা গরম রসগোল্লায় আর সকাল বেলা আপিস যাবার সময় বাবাই এর পাত থেকে এক গাল খাওয়ায় ও একখানা করে লাল নোট ( দু টাকার নোট, পাঁচ টাকার নোট দিতে গেলেও আমি দুটাকাটাই নিতাম ওই লালের মোহে!!) পাওয়ায়। পূজোর সময় সে ভদ্রলোককে দরকার পড়তো খালি ক্যাপ ফুরিয়ে গেলে। এমনিতে ওই চতুর্থী বা পঞ্চমীর দিন মেজদাদা বন্দুক ক্যাপ সব এনে দিতো কিন্তু সে তো কেমন করে জানি এক দিনের মধ্যেই নেই হয়ে যেত।

ঠাকুরের গায়ে গর্জনতেল মাখানো আর ডাকের সাজ হতো পঞ্চমীর দিন। চোখ আঁকাও ওইদিন রাতেই হতো বোধহয়, তারপর তো ঘিরে দেওয়া হত বোধনের আগে দেখতে দেওয়া হত না। কিন্তু ওই যে ফিনিশিং টাচটা দেওয়া হত ওই সময় আমরা সবাই হাঁ করে বসে থাকতাম আর আমাদের এক্সপার্ট কমেন্ট দিতাম। এবারের অসুরটা কেমন রোগাটে হয়েছেনা? ক্লাবের ঠাকুরের ময়ূর টা দেখেছিস যেন সব পালক ঝড়ে যাবে এক্ষুনি। আর সাপটা আমাদের ঠাকুরেরই সেরা। সিংহটা বেশী ভালো হয়েছে না ইঁদুর সে নিয়ে আমাদের খুব গন্ডগোল হতো। কেন জানিনা দুগগা ঠাকরুন ছোটদের কাছে তেমন ইয়ে পেতেন না তার অস্ত্র শস্ত্র বরং বেশী আকর্ষণীয় ছিলো। একবার মহালয়াতে হেমা মালিনী দুর্গা হয়েছিলো, আমাদের জ্বলে গিয়েছিলো দেখে। মানে এটা একটা কথা হলো হ্যাঁ সারাক্ষণ নেচে যাবে সে আবার কি। একটা যুদ্ধ নেই ভালো গল্পো নেই ভালো!! যত্তসব!! এর চেয়ে সেই যেবার কুমিরে মহিষাসুরের বাবা না কাকা কাকে টেনে নিয়ে গেছিলো সে বরং ঢের ভালো হয়েছিলো। এরকম সব কর্মব্যস্ত ভাবেই পঞ্চমীর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামত। বড়দের অত্যাচারে অত্যাচারিত আমরা ঝুলন্ত হয়ে ( মানে হেঁটে স্বেচ্ছায় তো আর যেতাম না ) ঘরে ফিরতাম