Friday, July 31, 2020

ছবি

বাংলা ক্যালেন্ডার আমাদের বাড়িতে থাকে একটা। থাকে মানে থাকতো। ঝড়ে খুব ওড়াউড়ি করলো, দেওয়ালে দাগ সে অপরাধে বেচারাকে নির্বাসন দেওয়া হল। বাংলা ক্যালেন্ডারেই নানান রকম জিনিস জানা যায় পূর্নিমা, অমাবস্যা, দশোহরা, আষাঢ়স্য প্রথম দিবস, শ্রাবণ এর শুরু। ক্যালেন্ডার নেই দিকদারিও নেই এসব জানার। দশোহরা মিস হয়ে গেল। দশোহরার দিন চিঁড়ে দই আম দিয়ে ফলার করতে বেজায় ভালোবাসি। পরের দিন জোর করে করলাম বটে ফলার তেমন সেইই ব্যপার হল না। ছোটবেলায় যে যেটা করে সেটা স্মৃতিতে থেকে যায় প্রবলভাবে তাই হয়ত টুকরো মন খারাপ। এসব আলগা মনখারাপ অবশ্য সরের মতো জমতে পায়না। নাড়া দিলেই চলে যায়, তাই যখন টের পেলাম না কোন অমাবস্যায় ঘটপুজো করে এবারের কালীপুজো হল তাতেও খুব কিছু হল না। 

রাস্তা দিয়ে সুর ভোলে বাবা শুনতে পেয়ে বোঝা গেলো শ্রাবন মাস চলে এসেছে আর এই করোনাকালেও দূর থেকে ছুটে যাওয়া পুন্যলোভীর অভাব নেই। আমাদের বাংলার মাস গুলো আমার কাছে ছবি আসে । মানে একটা নাম বললে সেই জায়গার বা সেই জিনিসের ছবি ভেসে ওঠে না? আমার কাছে অবশ্য প্রতিটা বর্ণ, প্রতিটা ডিজিট এর একটা করে ছবি আছে, জেন্ডার আছে। এটা খানিক হাস্যকর হয়ত, তবে আমার কেমন মনে হয় আমরা যাদের জড়বস্তু বলে তফাৎ করে দিচ্ছি আসলে তারাও কথা বলে নিজেদের মধ্যে। তাদের এক নিজস্ব জগত আছে,  সে জগতে ভাব আদানপ্রদান আছে। বর্ণ বা সংখ্যার জেন্ডারের কথা বলছিলাম, আমার কেন জানি মনে হয় "ক" হল পুরুষ, "খ" মহিলা, "গ", " ঘ" আবার পুরুষ। আবার "ক" হল ঝকঝকে যুবক টাইপ, "ঘ" হল এলেবেলে টাইপ; এইরকম সব। সেই ছোটবেলা থেকে ওদের সাথে আলাপ। ওদের কথা চাইলেই শোনা যায়, কিন্তু ধরা যায় না যেন। 

যাকগে, লোকে শুনলে পাগল ঠাউরাবে।  শ্রাবন মাস হল মহিলা আমার কাছে, আষাঢ় অবশ্য পুরুষ। তারকারন "শ" হল মহিলা তাই শ্রাবণ সামহাউ মহিলা। যাক এসব বোকাটে কথা, ছবি ভেসে ওঠে বলছিলাম না?  শ্রাবণ মাসের সাথে এই ঝুম ঝুম করে হেঁটে চলা বাঁকধারীরা জড়িয়ে আছে আমার ছবিতে। কোন আশায় এত কষ্ট করে ভিক্ষে চাইতে ছোটে কে জানে! স্মৃতিরা বড় তালগোল পাকানো হয়, কার সাথে যে কে কানেকটেড কে জানে! ঝুমঝুম আওয়াজে হঠাৎ করে বড় জানতে ইচ্ছে করলো বিশু, সোমনাথ, বিহারী মুড়িওয়ালা, ডালডায় বানানো লুচি ছোলার ডাল বিক্রেতা,  চাউমিনের দোকানদার, পেয়ারাওয়ালা এরা সব কী করছে? অজানা অচেনা শিক্ষানবিশ যে সব ডাবওয়ালা, আমওয়ালাদের দেখছি তারা হয়ত কোনো অফিস পাড়ার বিশু সোমনাথ। শ্রাবনমাসের বৃষ্টি ঝরা রাতের ছবিটার সাথে একটা হাসিমুখ ছেলের চা বানানোও হয়ত যুক্ত হয়ে গেল এরপরের দিনগুলোয়।

Monday, July 20, 2020

ব্যাকাপ

মুশকিল হল যতক্ষন আছে ততক্ষন খুব প্রয়োজন,  না থাকলে নেই। এই যেমন ধরো, মোবাইলে গাদা গাদা জিনিস রাখা আছে, বন্ধুদের সাথে বেড়ায়ে যাবার, ছোটবেলায় মায়ের কোলে চড়ে থাকার, উদ্ভুট্টে মজার কোনো মিম, কিংবা প্রচুর পিডিএফ। কাল যেই দুম করে ব্যাকাপ নেবার আগেই মোবাইল খারাপ হয়ে গেল, মনের মধ্যে উচাটন,  মন খারাপ,  তারপর? তারপর অন্য কিছু।আবার নতুন কিছু। 
আমাদের জীবনের সব কিছুই তাইই আগেও তাই ছিল, এখন অপশন বেশী বলে আরোই হয়েছে। আমার আগের অফিসের কম্পিউটারে গাদা গাদা ট্যাব খোলা থাকতো, সে ক্রোমেই হোক কি নোটপ্যাডে। বন্ধ করতে যাবার আগে ভাবতাম দরকার হবে যখন আবার খুঁজতে হবে, থাক। তারপর একদিন দুম করে খারাপ হয়ে গেল। ওগুলোর কিছুরই প্রয়োজন হল না। কিংবা হয়েছে ওইগুলোর অভাব বুঝিনি। 
যেটুকু সঞ্চয় তা ওই মগজে, তাও দিয়ে করে খাওয়া। তবু কী অদম্য আমাদের জমিয়ে রাখারা চেষ্টা, ধরে রাখার চেষ্টা, বিবর্ণ চিঠি কিংবা ভয়েস নোট কিংবা ফটোগ্রাফ। যেন ওইটুকুতেই সব ছেঁড়া সম্পর্ক, হারিয়ে ফেলা সময়, ভুলে যাওয়া দিন ধরে রাখা যাবে। আমার ঠাকুমার বড় মেয়ে, মানে আমার বড় পিসি, তিনি তাঁর সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। আমার ঠাকুমা সে শোক সইতে পারেননি, মাথার গোলমাল হয়ে যায়। তিনি পাশের গ্রামে তাঁর ভুলে যাওয়া বাপের বাড়ি পালিয়ে যেতেন কাউকে কিছু না বলে, চুপিচুপি। কী জানি, হয়ত নিজের মেয়ের চলে যাওয়া ভুলতে ডুব দিতেন নিজের ছোটবেলায়, যখন তিনি ছিলেন ছোট্ট খুকিটি, সেই অনুষঙ্গ দিয়ে প্রলেপ বোলাতে চাইতেন। আমি জানিনা, আমি তাঁকে কোনোদিন দেখিনি।মানুষের তো ব্যাকাপ নেওয়া যায়না, তবু কিছু কিছু জিনিস উত্তরাধিকারীর হাতে তুলে দিয়ে যায়, টাকাপয়সা, জমি জায়গা, পান্ডুলিপি, গান, বোধ, সংস্কার ইত্যাদি।  তা সকলের সেসব দেওয়ার থাকে না, সে অর্থে কিছুই বলার বোঝানোর থাকে না, যেমন মাথা গোলমাল হয়ে যাওয়া আমার ঠাকুমার কিছুই আর বলার ছিল না, দুম করেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মেশিন,ব্যাকাপ নেবার আগেই। আটকায়নি কিছুই আটকায় না কিছুই। খালি কিছু জিনিস শব্দে শব্দে মগজে মগজে ট্রান্সফার হয়ে যায়...

সেসবের জন্য ব্যাকাপ লাগেনা, ব্যাকাপের অভাবও বোধ হয় না।

Friday, July 3, 2020

সংসার

- কী হল আবার? আমি তো কিছুই করিনি? 

আরে বলবে তো কী হয়েছে? 

- দেখো একবার দেখো,  এটা লালীদের ইন্সটা, কেমন চমৎকার করে চুমু খেয়ে প্রপোজ করছে দেখো, আর তুমি.. তোমার মতো মাছের সাথে প্রেম করাই অন্যায়।

- ইয়ে মানে আমি যে পাঁচটা নুড়ি দিয়ে এক গোছা শ্যাওলা আনলাম।  শ্যাওলাও তো খেতে চমৎকার। 

- ওই তো ওইই। খাওয়া ছাড়া কিছুই কি চোখে পড়ে না হ্যাঁ? সেদিন দেখি লাল্টু মৌরলা কি সুন্দর ব্যাকগ্রাউন্ডে গান টান দিয়ে কেতের একটা পাতা নৌকায় ওর বউকে নিয়ে যাচ্ছে তার ভিডিও দিল। তুমি তো কখনোই আমায় ভালোবেসে কিছু বলো না।

- আহা বউ কাঁদে না,  এই তো বলছি, তোমায় আমি এইইই এত্ত ভালোবাসি।

- বঁড়শি আর ছিপ বাসো। হুহ। আমি তো কত্ত ছবি দিই, তুমি কিচ্ছু করো না।

- ও এই কথা। আরে ছবিতে কী এসে যায়। ওসব ছেলে ছোকরাদের কারবার। আমার বয়সে কি আর ওসব মানায়।

- কথা ঘোরাবে না একদম। কেন আমি দেখিনি, সেদিন কেমন বোয়ালমশাই সে সুদূর নীলসাগর থেকে এক বাক্স বোঝাই চিঠি পাঠিয়েছে, এমনকি পমফ্রেটদের বাড়ির ঝন্টুদা বিয়ের আগে কত কত চিঠি পাঠাতো।

- ওহ এই কথা! চিঠি তো আমি এক্ষুনি লিখে দিতে পারি। কিন্তু চিঠি তো আবার যত্ন করে রাখার ব্যপার থাকবে, অত খাটনি তোমায় দিয়ে করাতে পারি বলো?

- থাক থাক খুব বুঝেছি। 

-আরে শোনোই না, বলছি ওই দিকে কারেন্ট দাদাদের বাড়ি পেরোলে একটা ডুবো পাহাড় দেখেছি জানো, তার ফাঁক দিয়ে একটা সরু পথ আছে, বেশী মাছ খোঁজ পায়নি। উপর থেকে সরু মতো আলো আসে, আর নীচে নরম শ্যাওলা আর বালি। যাবে নাকি?

- হ হ যাবো যাবো। নিয়ে চলো এক্ষুনি।

- আরে দাঁড়াও,দাঁড়াও , চাট্টি খেয়ে নিয়ে জলদি শুয়ে পড়ি, কাল ভোরে বেরোবো। সকালের জলটা ওখানে চমৎকার গরম হয়, তুমি একটা হট বাথ নিয়ে নিতে পারবে। 

- হ্যাঁ তাহলে আমি যাই খাবার গুলো জলে ভেজাই। 

- হ্যাঁ। আর বলছি গিন্নী, মানে কাল অতটা যাওয়ার আছে, একটু তাড়াতাড়ি রিল্যাক্স করে ঘুম দরকার। বলছি আঁশটা একটু চুলকে.....

- উহ।  জ্বালাতনে বুড়ো একটা। 

ছবিঃ ইন্টারনেট