Sunday, April 19, 2020

বালিতে কদিন(পাঁচ)

আগের পর্ব

বেশাখী মন্দির থেকে গাড়ি অব্দি আসার রাস্তাটা হেঁটে নামতে হবে অথবা বাইক এ রাইড ভাড়া নেওয় যায়। মন্দির চত্বরটাই এতটা হাঁটাহাঁটি করে খিদে খিদে পাচ্ছিলো, তাই হাঁটার বদলে দরাদরি করে দুই বুড়োর বাইকে চড়েই বসলাম। সারং ফেরত দিয়ে গাড়ি অব্দি যেতে যেতেই খিদে বেশ চনমন করে উঠেছে। অগাস আমাদের নিয়ে গেলো আগুং পাহাড়ের কোলে এক রেস্তোরাঁয়, চমৎকার পরিবেশ কিন্তু সেখানে আবার আ লা কার্টে নেই, আমরা এরপর যাব টেকাড চেপুং প্রপাতে, তাই পেটপুরে বাফে খেতে চাইনা। সুতরাং বিস্কুটে ভর  টেকাড চাপুং এর পার্কিং লট অব্দি যাওয়া গেল। তখন দুপুর গড়িয়েছে অনেকটাই, রোদ আড়াল করে একটু এগোতে একটা ছোট্ট মত দোকান।  এক বুড়ি চালাচ্ছে, সে কোনো মতে কথা শোনে, হেসে হেসে খাবার দেয় নিজের মত, ইংরেজি প্রায় বোঝেই না। তবে দোকানটা নেহাতই ছোট মত এবং স্থানীয় লোকেই খাচ্ছে। একটা শিল নোড়া মর জিনিসে এটা সেটা দিয়ে পিষে কি যেন বানাচ্ছে দেখে কৌতূহল হল, টেস্টের জন্য অল্প একটু কেনাও হল।এটা একেবারেই স্থানীয় খাবার, ট্যুরিস্টরা খায়না, যে লোকগুলো বসে খাচ্ছিলো তারা ভাত আর এটা একটা কলাপাতায় নিয়ে খাচ্ছিল। আমাদের তেমন স্বাদ লাগলোনা। অগাস জানালো, সামনে ভালো খাবারের দোকান পাবো।


এর নাম গাদোগাদো, এখানে নিরামিষ বানাচ্ছিল , তবে চিকেন দিয়েও হয়

টিকিট কেটে ছায়া মাখা রাস্তা ধরে খানিক যেতেই খাড়াই পাহাড় ভাঙা শুরু হল, বন্যুমালার থেকেও বেশী উঁচু উঁচু স্টেপিং। দু তিন ধাপ নামতেই বাঁ পাশে ডানপাশে পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট মিষ্টি সব রেস্তোরাঁ।  দাম তেমন কিছুনা, অথচ অদ্ভুত শান্তির পরিবেশ। আমরা আমাদের ইন্দোনেশিয়ান কমফোর্ট খাবার অর্ডার দিলাম, নাসি গোরেং, মি গোরেং। কফি আর চা সাথে। খিদে পেয়েছিল খুবই, সাথে এমন পরিবেশ,জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ে বসে খাওয়া, খুবই উপভোগ্য। 
আহা বড় ভালো ছিলো



  টেকাড চেপুং আসলে একটা পাহাড়ের নীচে, দুটো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া জল, নুড়িপাথর  হাইক করে গুহায় থাকা এক প্রপাত। পাশ দিয়ে একটা জলের ধারা সঙ্গে নিয়ে গাছপালা ময় একটা পাথুরে পাহাড় এর নীচে যাওয়া যে কী আনন্দের সেটা বোঝাতেই পারব না। খানিক বাদে কোমর সমান উঁচু ধাপ ধরে নেমে দেখি এবার একেবারেই নেমে গেছি, এবারের রাস্তা হবে জলে নেমে। জলে স্রোত বেশী নেই, কিন্তু পায়ের তলার পাথর খুবই অমসৃন,বন্ধুর। মাঝে মাঝে বড় উঁচু পাথর,  গায়ে শ্যাওলা মাখা শুয়ে আছে গিরিখাতে। খুব সাবধানে পাথর পেরিয়ে চলতে হয়। ঠান্ডা ঠান্ডা জল আর পাথরে পায়ে অদ্ভুত অনুভূতি হয়। অনভ্যস্ত পায়ে ব্যথা লাগে, প্রকৃতিকে সেইই কবেই এত দূরে ঠেলে দিয়েছি কাছে আসলেও দূরেরই থেকে যায়। একসময় রাস্তা আরো সরু হয়ে যায়, পাথরের ফাঁক দিয়ে আসা এক চিলতে আলোয় অন্ধকার কাটে না তেমন আর আরো খানিকটা এগোলেই ম্যাজিক দেখা যায়। পাহাড়ে ঘেরা চারদিক, মাথা খোলা একটা গুহার মাথা থেকে জল পড়ছে অঝোরে,
খানিকটা জমে আছে। সেই ধারায় দাঁড়ালে মন ভালো খারাপ এর বাইরে, শান্ত সমাহিত হয়ে যায়।মাথা উঁচু করলেই গাছপালা ঘেরা আকাশ আর জলের ধারা।
এমন সময়,
"বেবি,ফোটো এহি লেনা হ্যায় লেকিন থোড়া আউর দূর সে....অউর এক ক্লিক করো"।
চমকে তাকাতেই হতাশ, করুণ ছেলেটার চোখাচোখি হয়ে গেল,বেচারি এই সব সুন্দর ছেড়ে "বেবির" জন্যে জল ভেঙে কোমর নীচু করে ছবি তুলতে গেল.....
ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে যারা ফেসবুক ইন্সটার সুন্দরী দেখে তাক করেছ হে বালকগন, এ বিষয়টা খেয়াল রেখো।




আজ জলদিই ফিরে গেছি হোটেলে। দিনের আলোয় জায়গাটা অন্যরকম লাগছে কেমন। কাল আবার সকালে বেরোনো আছে,  গিলি এয়ার আইল্যান্ডে যাব। একেবারে চেক আউট করে বেরোবো, আরে তাই তো, টাকা বদলানো হয়নি তো! পড়িমড়ি করে ফের বেরোলাম দু মক্কেলে। ছটা বেজে গেছে তখন, কিন্তু আলো আছে এখনো। চতুর্দিকে হরেকরকম দোকান, রেস্তোরাঁই বেশী, আমরা অবশ্য মানি এক্সচেঞ্জের দিকে চোখ মেলতে মেলতেই চললাম ঊর্ধ্বশ্বাসে। ডলার বদলালে আসলে এত এদেশীয় টাকা হয় আমরা দু দিন এর মতো করে বদলাই। এক গাদা টাকা ব্যাগে  পুরে খানিক ধীরে সুস্থে ফিরছি গল্প গুজব করতে করতে, খানিক বাদে মনে হল এ রাস্তায় তো হেঁটে আসিনি! টেকনোলজি এসে জীবন এত সোজা হয়ে গেছে যে এই রকম মুহূর্তেও কোনো চিন্তা হয়না, খালি মনে হয় এহে এক কিলোমিটারের বদলে দেড় কিলোমিটার হাঁটতে হবে এখন।


সকাল সকাল গাড়ি এলো, আজ আমাদের দ্বীপান্তর হবে। বালির আর লম্বকের মাঝে তিনটে ছোট ছোট দ্বীপ আছে,  গিলি টি,  গিলি এয়ার আর গিলি মেনো। আমরা একরাত থাকবো আর আমরা ঠিক করেছিলকম এটা স্রেফ কিচ্ছু না করার জন্য যাওয়া হবে। করার অনেক কিছু হয় এখানে, স্নরকেলিং এর উপকরণ নিয়ে সমুদ্রে ডুব দিয়ে এসো, বা বোট ভাড়া করে জলের নীচে স্ট্যাচু দেখে এসো, বা কচ্ছপ। এর মধ্যে গিলি টি হল সব চেয়ে জমজমাট, গিলি মেনোটা ভূমিকম্পের পর একেবারেই নিরালা, গুলি এয়ার এর মাঝামাঝি, চাইলে পার্টি লাইফ না চাইলে ল্যাদ লাইফ।চিরকালের মধ্যমেধার, মধ্যবিত্ত, ভীরু, না ঘরে টিকতে পারে না ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারে এমন বাঙালী কোনটা বাছল তা নিয়ে কোনো ক্যুইজ হয়না অবশ্য। জেটিঘাটে অনেক্ষন বসতে হল, স্থানীয় এক বুড়ি আর এক বুড়ো চিপস, নরম পানীয় ইত্যাদি বিক্রী করছিল। তারা ইংরেজি ভালো জানেনা, তবুও আকারে ইঙ্গিতে বোঝালো ছায়ায় খানিক বসতে, বোট আসতে দেরী আছে। এরকম লোক সব দেশেই একই রকম হয় তাই না?


গিলি এয়ারে বেশী লোক নামলো না। গিলি টি তেই বেশী যাবে, কারন ওখানে হুল্লোড় করার বেশী অপশন, তাছাড়া ওই দ্বীপটাও বড়। আমাদের সাথে যে কজন নামলো আমরা ছাড়া আর ভারতীয় কেউ নেই। আমরা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।  জানি এইটা পড়েই আপনারা আমায় গালাগাল দেবেন, আগে যেখানে আমি লিখেছি, বিদেশে এসে চেনা গাছ দেখলে ভারী ভালো লাগে সেখানে বিদেশে দেশের লোক নেই ভেবে কেন স্বস্তির নিঃশ্বাস? আমি খুবই খারাপ লোক এটা তো  প্রথম কারন,  পরেরটা হলো, বিদেশে থাকতে না আমি ঘুরতে গেছি, ছুটি কাটাতে গেছি দেশীয় কৌতূহলের হাত থেকে বাঁচতে।  আমি দেশের মধ্যে বেড়াতে গেলে বাঙালী দেখলেও শশব্যস্ত হই, আর  এরকম একটা নিরিবিলি দ্বীপে সেই চেনা কথা চেনা অভিযোগ বা চেনা ফর্মালিটিস  জাতীয় কিছু করতে ইচ্ছে করে না। এ আমার ত্রুটি, আমি জানি। 

আমরা এই আইল্যান্ডে থাকার জায়গা ইচ্ছে করেই জেটি থেকে অনেকটা দূরে খুঁজেছিলাম, তাই হেঁটে যাওয়া যাবে না কোনোভাবেই। যাওয়ার উপায় হলো ঘোড়ার গাড়ি। এই দ্বীপে কোনো যন্ত্রচালিত যান নিষিদ্ধ, হয় সাইকেল নয় ঘোড়ার গাড়ি এইই আছে। পরের দিনের ফেরার বোটের সময় জিজ্ঞেস করে, একটা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বসা গেল। চালকের নাম আবদুল, ছোট খাটো চেহারার আবদুল আর তার বড়সড় চেহারার ঘোড়া নিয়ে রওনা হলাম, খানিক বাদের মনে হল পঞ্চাশ ষাট বছর আগের কোনো গ্রামের রাস্তায় চলেছি যেন, কিংবা আন্দামানের কোনো দ্বীপের ভিতরের রাস্তা। ঘোড়ার পায়ের খটখট ছাড়া কোনো শব্দ নেই, পাখির ডাকও কম। ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে, হঠাৎ বাঁক ঘুরে সমুদ্রের ধারের রাস্তায় পড়লো। এক পাশে হোটেলগুলো আর সমুদ্রে তীরে ওপেন রেস্তোরাঁ।  বিচ নেই কোনো। সমুদ্রে নামার জায়গা কই? 
আব্দুল(যদিও ছুঁচোলো দাড়ি নেই)
ঘোড়াটা ভদ্র ছিলো কিন্তু






আরো খানিক গিয়ে আমাদের থাকার জায়গা এলো। সমুদ্রের পাশেই একটা দোলনা টাঙানো তারপর সরু একফালি রাস্তা পার হলেই আমাদের আস্তানা। চমৎকার একটা মুসাম্বির জ্যুস  খেতে দিয়ে সরাইখানার কর্মচারী বলল একটু সমুদ্র দেখো ওই দোলনায় বসে আমি তোমাদের ঘর ঠিক করছি। আরে হ্যাঁ হ্যাঁ সে আর বলতে! কোনো তাড়া নেই,  ছাতার মাথা লাগেজ,জলের বোতল,  হাবিজাবি সব রেখে রোদ মাথায় নিয়েই জলের সাথে আলাপে গেলাম। নীল আকাশ, নীল জল, সাদা মেঘ আর চড়চড়ে রোদ। দূরে লম্বকের পাহাড় দেখা যাচ্ছে। জলে নামতে গেলে আরেকটু এগোতে হবে,আমাদের আস্তানা  উত্তর-পশ্চিম দিকে,  এখান থেকে সানসেটও দেখা যাবে না। খানিক হাঁটতে হবে আর তাতে সমস্যা কিছু নেই। ঘরটা একটু সমস্যার।  মানে খুবই ভালো, সামনে সুইমিংপুল,  আধুনিক সুবিধে যুক্ত ওপেন এয়ার বাথরুম, গোল মশারিওলা খাট সব আছে কিন্তু ওই ওপেন এয়ারের কন্সেপ্টের কারনেই নন্দিনীর দ হয়ে গেছে। মানে কামধেনু নন্দিনীর কাছে কিছু চাইলে নাকি যেমন পাওয়া যায় তার সাথে ফাউতে কিছু ঝামেলাও আসে, নন্দিনীর দ । এইখানে সেই গোলমালটা হল, একটা গেকো, ওদের দেশের একটা নিরীহ সরীসৃপ, গিরগিটি টাইপ। বাথরুমে গেকো দেখে আনন্দ পাওয়া গেলো না। গেকোর গল্প পরে বলছি।





 সমুদ্রে ভূত হবার বাসনায় দুপুর রোদে আমরা চল্লুম। সমুদ্রে ধারে এইদিকটা সানসেট পয়েন্ট না বলেই খানিক লোক কম, খানিক ফাঁকা জায়গা, খানকতক গাছ। এখানের সমুদ্রের জলে টান খুব, ঢেউ নেই, আর পায়ের তলায় বালির বদলে মরা কোরাল, অভ্যস্ত হতে সময় লাগে। তারপর? তারপর এমনি এমনি ভাসতে হয়, নাক ডুবিয়ে কোরালন্দেখা যায় কিনা দেখতে হয়, ফেরার সময় খলবল করতে বেশী হয় স্রোতের বিপরীতে আসার জন্যে। পশ্চিমদিকে অনেকটা চলে গেছিলাম, এইদিকটা অনেক বেশী সাজানো দেখছি, বিকেলে আসবোখন। বালি মেখে ফেরার সময় এক জেলের সাথে আলাপ হল, মাছ কিছু নাই এসময় ঘরে ফিরছে সে। পেটের মধ্যে এক সমুদ্র খিদে ততক্ষনে, সমুদ্রে একদম  পাশে একটা ছায়ামাখা রেস্তোরাঁয় আরাম করে খাওয়া গেলো, একটা মাংসের সব্জি আর নারকেলের দুধ দেওয়া ঝোল, যাকে বলে ইন্দোনেশিয়ান কারি আর ভাত,আর একটা টুনা মাছ ভাজা সব্জি দিয়ে আর ইন্দোনেশিয়ান সস দিয়ে। হামহাম করে খেয়ে নিয়েছি সব। ঝাল ছিল, কিন্তু খিদেও পেয়েছিল খুব।




এমন একটা ফাঁকা দ্বীপে দুপুরবেলা ঘরে শুয়ে ঘুমোনোর প্রশ্নই ওঠে না, সুতরাং আমরা গাছের ছায়ায় নৌকার পাশে বালিতে তোয়ালে পেতে আরাম করে এক ঘুম লাগালাম। আহা মাথার উপর পাতার ফাঁকে নীল আকাশ, সামনে সমুদ্র, তকতকে সৈকত, আর ভরা পেট, এর চেয়ে বেশী কী লাগে হ্যাঁ? ঘুম ভাঙে এক বুড়ি ফেরিওয়ালার ডাকে। স্থানীয় কিছু ফল, চালের এবং আরো সব কিসের কিসের চিপস টাইপ বস্তু মাথায় নিয়ে ফিরি করছে বুড়ি। আমায় উঠে বসতে দেখে, ভাঙা ইংরেজিতে তার ডালা নামাতে বলল।  নামানো গেলো, এটা সেটা দেখে একটা ম্যাঙ্গোস্টিন (নামটা পরে খুঁজে বের করেছি) ট্রাই করে দেখা গেলো, বেশ খেতে। চালের গুঁড়ি দিয়ে বানানো চিপসটাও বেশ খেতে। ঘুম ভেঙে গেলে বসে থাকা যায় না, বিকেলও হয়ে এসেছে। দ্বীপটা হাঁটাহাঁটি করে এক্সপ্লোর করাও দরকার, সুতরাং উঠো মুসাফির বাঁধো ছাঁদা....(ক্রমশ)





Saturday, April 4, 2020

বালিতে কদিন ( চার )

ফিরে এলাম উবুদে। উবুদ এর কথা তো আগেই বলেছি, প্রাচীন এই শহর হল বালীর সাংস্কৃতিক রাজধানী। আমরা আজ আর কাল যেখানে থাকবো সেটা হল একটা গেস্ট হাউস। ছবিতে দেখে খুবই পছন্দ হয়েছিল।এক  বালিনিজের বাড়ি আসলে, সেটারই একটা পার্ট গেস্টদের ভাড়া দেওয়া হিয়। এয়ারবিএনবি টাইপ বলা যায়, কিন্তু এখানে হোটেলের মত রেজিস্টার, রিসেপশনিস্ট আছে। রিসেপশনিস্ট হল দুজন বালিনিজ ছেলে, যারা খুবই কম ইংরেজি বোঝে, কিন্তু ভারী হাসিখুশী আর সরল মতো মানুষ। হা ক্লান্ত হয়ে উবুদে ঢুকলাম যখন তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। গেস্ট হাউসটা একটা সরু গলির মধ্যে, মেইন রোড থেকে তিনটে বাড়ির পরেই, সেখানে বড় গাড়ি ঢোকে না। গেট দিয়ে ঢুকেই একটা উঠোন, এক পাশে একটা ঘরের সামনের দালান(আগেকার বাড়ির যেমন হত মনে আছে? চওড়া দালান, মাটি থেকেদু ধাপ উঁচুতে ওইরকম) একজন মহিলা পুজোর জিনিস সাজাচ্ছেন। অন্যপাশে একটা জমকালো মন্দির। সামনে আরো এগোনোর জায়গা আছে, অর্থাৎ বাড়িটার ভিতর দিকে আরো বিস্তৃত।  আগে কখনো এই জাতীয় বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা নেই বলেই কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে জিগ্যেস করলাম ভদ্রমহিলাকে, এটাই ওই গেস্ট হাউস কিনা। তাতে অ্যাইসান গোমড়া মুখে হ্যাঁ হ্যাঁ বলল, ভারী দমে গেছিলাম শুরুতে। তখন অন্ধকার মতো হয়ে গেছে,  জমকালো কাজ করা বাড়ি , ধূপের গন্ধ , ঝুপসি গাছ কেমন অদ্ভুত লাগছিলো। অথচ মাত্র তিনশো মিটার গেলেই মেইন রোড ।



ফ্ল্যাশ জ্বেলে খারাপ এসেছে খানিক,  তবে দেক্তে এমনই ছিল



বাড়ির মন্দিরেই




ভগবানেরও এসব জায়গায় থাকা ভালো না বাপু , একা একা



মূল মন্দিরের গা


সিঁড়ি দিয়ে উঠে খানিক ফাঁকা জায়গা, ওইপাশে একটা খিল দেওয়া, কারুকাজ করা কাঠের দরজা, সেই দরজা ঠেলে খুললেই গাছের ডাল ছোঁয়া যায় বারান্দা। বাড়িটা জুড়ে একটা ধূপ ধূপ গন্ধ৷ ঘরের মধ্যে থেকেও আরেকটা বারান্দা আছে। সেখানে আবার একটা পাতলা বাঁশের একটা পর্দা দেওয়া ছিল, পোকামাকড়,মশা ইত্যাদি আটকাতে। আমি তুলেই দিলাম, আকাশ ঢেকে পোকামাকড় আটকানো সইবে না।  কাল সাত সকালে বেরোতে হবে। কেন এত সকালে ওরা বেরোতে চায় এ নিয়ে খুব গুঁইগাঁই করলাম কিন্তু এদের কিছু বোঝাতে এত পরিশ্রম করতে হয় তাতে লাভ কিছু হয় না।

খানিক ফ্রেশ হয়ে নীচে আসতেই হল। এদের এখানে খানা মেলে না রাতে, বাইরে যেতে হবে। এইটাই ভয়ানক খারাপ দিক মাইরি গেস্ট গাউসের। যদিও বেরিয়ে ভালোই লেগেছিলো।  মেন রোডের ধারে ধারে প্ছিরচুর রেস্তোরা, বাইরে মেনুকার্ডও সাজানো আছে । চাইলেই দাম আর মেনু দেখে ঢুকে পরা যায় । রাস্তায় বিদেশীইই বেশী , ভিখারি দেখিনি ঐ রাস্তায় একটাও । ইনফ্যাক্ট পুরো ট্যুরে স্রেফ এক জায়গায় ভিখারী দেখেছি! মূলতঃ ট্যুরিজম এর উপর নির্ভরশীল বলেই প্রচুর গাড়ি, ট্যুর ইনফো এসবের দোকানও আছে। আমরা রাস্তাটা এক পাক এমনি এমনি হাঁটা লাগালাম ।মৃদু আলো , মন্থর স্বচ্ছল জীবন এদের বোজাই যায় । হাঁই হাঁই ছুট নেই একেবারেই । এদের অবশ্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলে কিছু নেই , সব বালিনিজ নিজের স্কুটারে চড়ে , আর ট্যুরিস্টরা হয় স্কুটার ভাড়া নেয় নয়ত গাড়ি বা শাটল। এদিক সেইক ঘুরে একটা ছিমছাম রেস্তোঁরা  পছন্দ হল । সিঁড়ি দিয়ে উপরে গিয়ে বারান্দায় বসে রাস্তা দেখো , দূরে কে যেন বাদ্যযন্ত্রে ফুঁ দিয়েছে শোনো, এরই মধ্যে এক ফাঁকে তোমার বালিনিজ ডিনার তৈরী হয়ে যাবে।

 এসে রিসেপশনিস্ট ছেলেগুলোর সাথে কথাবার্তা বলছিলাম ।আসলে এই ঘর গেরস্থালী দেহে ভারী কৌতূহল হয়েছে, কেমন হয় এদের ঠাকুর দেবতা। এখনো অব্দি সব মন্দিরের বাইরে "পুজোর জন্যে ছাড়া অনুমতি নিষিদ্ধ" দেখেছি তাই আরোই কৌতূহল। ছেলেটা কিন্তু কিন্তু বলল , সারং ছাড়া ত হবে না, আমি তাতে আরো উৎসাহ দিয়ে বললাম , বেশ তো তুমি এনে দাও । আসলে আমি একবার প্রনাম না করে অস্থির বোধ কছি , ঘুম আসবে না। বলে প্রনাম এর ভঙ্গীও করলাম। লাউ নরকেই হয়ত আমার জায়গা হবে এত ঢপ দিয়ে অতি পবিত্র স্থানে ঢুকে পড়ার জন্যে। স্রেফ লাউ দিয়েই ভাত জুটবে হয়ত! অন্য ছেলেটা ততক্ষনে সারং এনে দিয়েছে। কোমরে জড়িয়ে , মন্দিরে বাইরের গেট পেরোলাম , এইখান অব্দি সারং থাকলে সব মন্দিরেই আসা যায় । এটা খোলা চত্ব হয় , উঠোন মত , মন্দির থাকে এখানেও , প্রসাদ, ধূপ ইত্যাদি দেওয়া হয় । এরপরেই আছে মূল মন্দির , যেখানে কেউ ঢুকতে পায়না । কেউ নেই, খুব ভক্তিটাইপ মুখ করে প্রচুর কাজ করা দরজা খুলে ঢুকতেই ধূপের তীব্র গন্ধ নাকে ঝাপটা মারে। নটরাজ মূর্তি ছাড়া বাকিগুলো বোঝা গেলো না। তবে এমনিই সাধারন ঠাকুর ঘর যেমন  হয় তেমনই। "হেনকালে হায় যমদূত প্রায় ছুটে এলো" সেই মহিলা । কঠিন চোখে হাতের ইশারায় বেরিয়ে যেতে বলল । তার ভাবভঙ্গি এমনই রাগী চট করে বেরিয়ে এলাম বাবা।




পরদিন সকালে কেমন হাসিখুশী লাগছে আলোয়


খুব জমকালো যাই বলো


একদিক অমন আরেকদিকে সুইমিং পুল টুল সব হ্যায়
'


এসব গুলো পুজো দেওয়ার জায়গা



সকালে প্যাকড ব্রেকফাস্ট (খুবই যৎকিঞ্চিৎ ছিল আগের হোটেলের হেব্বি ব্রেকফাস্টটা খুবই মিস করছিলাম) গাড়িতে ঢুলতে ঢুলতে খেয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে চললাম লেম্পুয়াং মন্দির আর হেভেন গেট। ঢোকার মুখে যথারিতি দুটো সারং দিলো কোমরে জড়িয়ে ঢুকতে হবে। এইটাও অনেক পুরোনো মন্দির লেম্পুয়াং পাহাড়ের কোলে দুহাজার ফিট উঁচুতে অবস্থান করছে।

ম্যালা লোক হয় এইখানে, এক তো বালিনিজদের কাছে এটা খুবই পবিত্র মন্দির আর এই পুরো মন্দির কম্পলেক্সটা এত সুন্দর ছবি তোলার জন্যেও প্রচুর লোকজন আসে। আমরা সেই কোন সকালে বেরিয়েছিলাম, পৌঁছেও গেছি তাড়াতাড়িই,  তবুও আমাদের ছবি তোলার লাইন পড়ল একশো ছত্রিস নাম্বারে! ছবি তোলার ব্যপারটা বলি, টিকিট কাটার সময় এই মন্দিরে ফিক্সড প্রাইস না, ডোনেশন এর মত, সে তুমি যা দেবে দাও আর এই হেভেন গেটেও ছবি তুলে দেবে একজন, তাকেও তুমি যা ভালো মনে করো ডোনেশন দিয়ে দাও। এবার এই একশো ছত্রিশ লাইন শুনে আমাদের মনে হয়েছিল নমো করে চলে আসি, কিন্তু খানিক পাহাড় চড়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে উঠতেই দেখলাম নব্বই নাম্বার চলছে তখন। সকালে চা কফি ভালো জোটেনি, একটা চাতালে বসে বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে হরেক রকম পোজ আর পিছনের পাহাড়ে মেঘের কারসাজি দেখতে দেখতে সময় কেটেও গেল।
দূর থেকে ব্যাপারটা অতটা বুঝিনি, গেটে পৌঁছতে বুঝলাম, কেন হেভেন গেট বলে একে। লেম্পুয়াং পাহাড়  আর মেঘ এর ব্যকগ্রাউন্ডে গেটটা সত্যিই মনে হচ্ছে যেন স্বর্গের প্রবেশদ্বার। 


হেভেন গেট




লেম্পুয়াং মন্দির

লুঙি ব্যাপারটা খারাপ না প্যান্টের উপর পরলে

আজকের সারথি অগাস। সে আবার তার এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছে একা একা এতটা ড্রাইভ করতে যাতে না হয়। আজকেরটা সত্যিই একটু লম্বা। সেইই কোন ভোরে বেরিয়েছি , তখনো ভালো আলো ফোটেনি , হানিমুনে এসে এরম ভোর বেলায় ঘুরতে পাগলেই বেরোয় , কিন্তু ওই আর কি । গাড়িতে আধা ঘুমে আধা দেখছি এক এক করে জায়গা পেরিয়ে চলেছি , কখনো দশকর্মার দোকানের মতন দোকানে ভরা বাজার, কোথাও ফলের , ফুলের বাজার , কোথাও ছোট ছোট গাঁ , সমৃদ্ধ বাড়ি , খোয়া ওঠা ময়লা টাইপ না , ঝকঝকে তকতকে আর সবুজ গাছে ঢাকা , এক জায়গায় রাস্তা ভুল করে একটা পাহাড় ঘেরা জায়গায় চলে গেছিলাম , সেখান থেকে ওই পাড়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছিলো। হাঁ করে দেখতে দেখতে , ঘুমোতে ঘুমোতে, গল্প করতে করতে পৌঁছলাম তীর্তা গংগা ওয়াটার প্যালেস। এটা ইন্সটাগ্রামারদের খুব প্রিয় জায়গা মনে হয়, কতক্ষন ধরে ধরে পোজ দিচ্ছে! আর এই গনগনে গরমে সেজেছেও বিরাট! জলের মধ্যে পাতা পাতজর টপকে টপকে মাছেদের খাওয়াতে খাওয়াতে যাওয়া যায় মন্দিরের দোর গোড়ায়। মন্দিরের ঠিক পিছনে একটা বিরাট বট গাছের বাঁধানো চত্বরে ভীড় নেই তেমন, কারন সে জায়গাটা ফটোসেশান এর উপযোগী না। আমাদের এরকম জায়গাই বেশী পছন্দের। ঝিরঝিরে হাওয়ায় অনেক্ষন বসে থাকলে প্রান ঠান্ডা হয়।


ভীড়টা দেখো একবার


বেশাখী মন্দির হল এদের সবচেয়ে প্রাচীন, সব চেয়ে পবিত্র মন্দির কম্পলেক্স। মানে গোটা তেইশেক মন্দির আছে এই চত্বরে। বেশাখীর থেকে উঁচু কোনো স্ট্রাকচার বালিতে নিষিদ্ধ। আগুং পাহাড়ের কোলে এই মন্দিরে পৌঁছতে কিঞ্চিৎ চড়াই ভাঙতে হয়। তবে এত পুরোনো একটা স্থাপত্যর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে অত কষ্ট খেয়াল থাকে না, হাঁ করে দেখতে ইচ্ছে করে কীভাবে এত নিঁখুত একটা স্থাপত্য হাজার হাজার বছর আগে বানিয়েছিল৷ তবে এরা খুব যত্নেও রেখেছে, পানের পিক না, নাম খোদাই করে রাখা না, আবর্জনা ফেলে রাখা কিচ্ছু নেই। খান কতক দোকান আছে, সেই স্যুভেনির বিক্রী হচ্ছে। খাবার দাবারও হচ্ছে কলাপাতায় মুড়ে কী যেব একটা, তবে খুব একটা ভক্তি হয়না সে দেখে। 





এখানে জুটেছিল সবুজ লুঙি থুড়ি সারং









পুজো দিতে চলেছে



বেশাখী মন্দির কমপ্লেক্স



মন্দিরে ঢোকার মূল প্রবেশ পথ



পাহাড়ের এক এক ধাপে মন্দির গুলো আছে, সব চেয়ে উঁচু ধাপটায় দাঁড়ালে মেঘে ঢাকা আগুং পাহাড়, আর পুরো উপত্যকাটা দেখা যায়। লোকেশনটা দারুন বেছেছিল কিন্তু। মাঝে মাঝে মনে হয় ধর্ম যেমন এত হানাহানি কাটাকাটি দিয়েছে ধর্ম তো স্থাপত্য, দর্শন, গান এসবও দিয়েছে। মানে ভগবান এর জন্যে নিবেদিত যে গান গুলো সেগুলো প্রার্থনা হয়তো কিন্তু তার সুর বড় টানে। এ বিশ্বপ্রপঞ্চময় এ কথা অবিশ্বাস করতে পারিনা, সত্যিই এই যে হাওয়া এই যে আকাশ এই যে পুরোটা একসাথে,এই মন্দিরের পাথরগুলো এসব যেন কী ভীষন জ্যান্ত,  যে ভাষা আমি, আমরা শুনতে পাচ্ছিনা বুঝতে পারছিনা। ধর্ম আমাদের যে ভয়ানক ভেদ দিয়েছে তা থেকে বেরিয়ে সে সুর সে গান সে শব্দ শোনার ইচ্ছে আমাদের নেই কিংবা  সেই বোধটাই হারিয়ে ফেলেছি আরো কিছু শোনার আছে আরো কিছু দেখার আছে।

 "আমি নয়নে বসন বাঁধিয়া বসে, আঁধারে ঘুরি গো কাঁদিয়া, আমি দেখি নাই কিছু বুঝি নাই কিছু...."
(ক্রমশ)