Saturday, April 4, 2020

বালিতে কদিন ( চার )

ফিরে এলাম উবুদে। উবুদ এর কথা তো আগেই বলেছি, প্রাচীন এই শহর হল বালীর সাংস্কৃতিক রাজধানী। আমরা আজ আর কাল যেখানে থাকবো সেটা হল একটা গেস্ট হাউস। ছবিতে দেখে খুবই পছন্দ হয়েছিল।এক  বালিনিজের বাড়ি আসলে, সেটারই একটা পার্ট গেস্টদের ভাড়া দেওয়া হিয়। এয়ারবিএনবি টাইপ বলা যায়, কিন্তু এখানে হোটেলের মত রেজিস্টার, রিসেপশনিস্ট আছে। রিসেপশনিস্ট হল দুজন বালিনিজ ছেলে, যারা খুবই কম ইংরেজি বোঝে, কিন্তু ভারী হাসিখুশী আর সরল মতো মানুষ। হা ক্লান্ত হয়ে উবুদে ঢুকলাম যখন তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। গেস্ট হাউসটা একটা সরু গলির মধ্যে, মেইন রোড থেকে তিনটে বাড়ির পরেই, সেখানে বড় গাড়ি ঢোকে না। গেট দিয়ে ঢুকেই একটা উঠোন, এক পাশে একটা ঘরের সামনের দালান(আগেকার বাড়ির যেমন হত মনে আছে? চওড়া দালান, মাটি থেকেদু ধাপ উঁচুতে ওইরকম) একজন মহিলা পুজোর জিনিস সাজাচ্ছেন। অন্যপাশে একটা জমকালো মন্দির। সামনে আরো এগোনোর জায়গা আছে, অর্থাৎ বাড়িটার ভিতর দিকে আরো বিস্তৃত।  আগে কখনো এই জাতীয় বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা নেই বলেই কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে জিগ্যেস করলাম ভদ্রমহিলাকে, এটাই ওই গেস্ট হাউস কিনা। তাতে অ্যাইসান গোমড়া মুখে হ্যাঁ হ্যাঁ বলল, ভারী দমে গেছিলাম শুরুতে। তখন অন্ধকার মতো হয়ে গেছে,  জমকালো কাজ করা বাড়ি , ধূপের গন্ধ , ঝুপসি গাছ কেমন অদ্ভুত লাগছিলো। অথচ মাত্র তিনশো মিটার গেলেই মেইন রোড ।



ফ্ল্যাশ জ্বেলে খারাপ এসেছে খানিক,  তবে দেক্তে এমনই ছিল



বাড়ির মন্দিরেই




ভগবানেরও এসব জায়গায় থাকা ভালো না বাপু , একা একা



মূল মন্দিরের গা


সিঁড়ি দিয়ে উঠে খানিক ফাঁকা জায়গা, ওইপাশে একটা খিল দেওয়া, কারুকাজ করা কাঠের দরজা, সেই দরজা ঠেলে খুললেই গাছের ডাল ছোঁয়া যায় বারান্দা। বাড়িটা জুড়ে একটা ধূপ ধূপ গন্ধ৷ ঘরের মধ্যে থেকেও আরেকটা বারান্দা আছে। সেখানে আবার একটা পাতলা বাঁশের একটা পর্দা দেওয়া ছিল, পোকামাকড়,মশা ইত্যাদি আটকাতে। আমি তুলেই দিলাম, আকাশ ঢেকে পোকামাকড় আটকানো সইবে না।  কাল সাত সকালে বেরোতে হবে। কেন এত সকালে ওরা বেরোতে চায় এ নিয়ে খুব গুঁইগাঁই করলাম কিন্তু এদের কিছু বোঝাতে এত পরিশ্রম করতে হয় তাতে লাভ কিছু হয় না।

খানিক ফ্রেশ হয়ে নীচে আসতেই হল। এদের এখানে খানা মেলে না রাতে, বাইরে যেতে হবে। এইটাই ভয়ানক খারাপ দিক মাইরি গেস্ট গাউসের। যদিও বেরিয়ে ভালোই লেগেছিলো।  মেন রোডের ধারে ধারে প্ছিরচুর রেস্তোরা, বাইরে মেনুকার্ডও সাজানো আছে । চাইলেই দাম আর মেনু দেখে ঢুকে পরা যায় । রাস্তায় বিদেশীইই বেশী , ভিখারি দেখিনি ঐ রাস্তায় একটাও । ইনফ্যাক্ট পুরো ট্যুরে স্রেফ এক জায়গায় ভিখারী দেখেছি! মূলতঃ ট্যুরিজম এর উপর নির্ভরশীল বলেই প্রচুর গাড়ি, ট্যুর ইনফো এসবের দোকানও আছে। আমরা রাস্তাটা এক পাক এমনি এমনি হাঁটা লাগালাম ।মৃদু আলো , মন্থর স্বচ্ছল জীবন এদের বোজাই যায় । হাঁই হাঁই ছুট নেই একেবারেই । এদের অবশ্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলে কিছু নেই , সব বালিনিজ নিজের স্কুটারে চড়ে , আর ট্যুরিস্টরা হয় স্কুটার ভাড়া নেয় নয়ত গাড়ি বা শাটল। এদিক সেইক ঘুরে একটা ছিমছাম রেস্তোঁরা  পছন্দ হল । সিঁড়ি দিয়ে উপরে গিয়ে বারান্দায় বসে রাস্তা দেখো , দূরে কে যেন বাদ্যযন্ত্রে ফুঁ দিয়েছে শোনো, এরই মধ্যে এক ফাঁকে তোমার বালিনিজ ডিনার তৈরী হয়ে যাবে।

 এসে রিসেপশনিস্ট ছেলেগুলোর সাথে কথাবার্তা বলছিলাম ।আসলে এই ঘর গেরস্থালী দেহে ভারী কৌতূহল হয়েছে, কেমন হয় এদের ঠাকুর দেবতা। এখনো অব্দি সব মন্দিরের বাইরে "পুজোর জন্যে ছাড়া অনুমতি নিষিদ্ধ" দেখেছি তাই আরোই কৌতূহল। ছেলেটা কিন্তু কিন্তু বলল , সারং ছাড়া ত হবে না, আমি তাতে আরো উৎসাহ দিয়ে বললাম , বেশ তো তুমি এনে দাও । আসলে আমি একবার প্রনাম না করে অস্থির বোধ কছি , ঘুম আসবে না। বলে প্রনাম এর ভঙ্গীও করলাম। লাউ নরকেই হয়ত আমার জায়গা হবে এত ঢপ দিয়ে অতি পবিত্র স্থানে ঢুকে পড়ার জন্যে। স্রেফ লাউ দিয়েই ভাত জুটবে হয়ত! অন্য ছেলেটা ততক্ষনে সারং এনে দিয়েছে। কোমরে জড়িয়ে , মন্দিরে বাইরের গেট পেরোলাম , এইখান অব্দি সারং থাকলে সব মন্দিরেই আসা যায় । এটা খোলা চত্ব হয় , উঠোন মত , মন্দির থাকে এখানেও , প্রসাদ, ধূপ ইত্যাদি দেওয়া হয় । এরপরেই আছে মূল মন্দির , যেখানে কেউ ঢুকতে পায়না । কেউ নেই, খুব ভক্তিটাইপ মুখ করে প্রচুর কাজ করা দরজা খুলে ঢুকতেই ধূপের তীব্র গন্ধ নাকে ঝাপটা মারে। নটরাজ মূর্তি ছাড়া বাকিগুলো বোঝা গেলো না। তবে এমনিই সাধারন ঠাকুর ঘর যেমন  হয় তেমনই। "হেনকালে হায় যমদূত প্রায় ছুটে এলো" সেই মহিলা । কঠিন চোখে হাতের ইশারায় বেরিয়ে যেতে বলল । তার ভাবভঙ্গি এমনই রাগী চট করে বেরিয়ে এলাম বাবা।




পরদিন সকালে কেমন হাসিখুশী লাগছে আলোয়


খুব জমকালো যাই বলো


একদিক অমন আরেকদিকে সুইমিং পুল টুল সব হ্যায়
'


এসব গুলো পুজো দেওয়ার জায়গা



সকালে প্যাকড ব্রেকফাস্ট (খুবই যৎকিঞ্চিৎ ছিল আগের হোটেলের হেব্বি ব্রেকফাস্টটা খুবই মিস করছিলাম) গাড়িতে ঢুলতে ঢুলতে খেয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে চললাম লেম্পুয়াং মন্দির আর হেভেন গেট। ঢোকার মুখে যথারিতি দুটো সারং দিলো কোমরে জড়িয়ে ঢুকতে হবে। এইটাও অনেক পুরোনো মন্দির লেম্পুয়াং পাহাড়ের কোলে দুহাজার ফিট উঁচুতে অবস্থান করছে।

ম্যালা লোক হয় এইখানে, এক তো বালিনিজদের কাছে এটা খুবই পবিত্র মন্দির আর এই পুরো মন্দির কম্পলেক্সটা এত সুন্দর ছবি তোলার জন্যেও প্রচুর লোকজন আসে। আমরা সেই কোন সকালে বেরিয়েছিলাম, পৌঁছেও গেছি তাড়াতাড়িই,  তবুও আমাদের ছবি তোলার লাইন পড়ল একশো ছত্রিস নাম্বারে! ছবি তোলার ব্যপারটা বলি, টিকিট কাটার সময় এই মন্দিরে ফিক্সড প্রাইস না, ডোনেশন এর মত, সে তুমি যা দেবে দাও আর এই হেভেন গেটেও ছবি তুলে দেবে একজন, তাকেও তুমি যা ভালো মনে করো ডোনেশন দিয়ে দাও। এবার এই একশো ছত্রিশ লাইন শুনে আমাদের মনে হয়েছিল নমো করে চলে আসি, কিন্তু খানিক পাহাড় চড়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে উঠতেই দেখলাম নব্বই নাম্বার চলছে তখন। সকালে চা কফি ভালো জোটেনি, একটা চাতালে বসে বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে হরেক রকম পোজ আর পিছনের পাহাড়ে মেঘের কারসাজি দেখতে দেখতে সময় কেটেও গেল।
দূর থেকে ব্যাপারটা অতটা বুঝিনি, গেটে পৌঁছতে বুঝলাম, কেন হেভেন গেট বলে একে। লেম্পুয়াং পাহাড়  আর মেঘ এর ব্যকগ্রাউন্ডে গেটটা সত্যিই মনে হচ্ছে যেন স্বর্গের প্রবেশদ্বার। 


হেভেন গেট




লেম্পুয়াং মন্দির

লুঙি ব্যাপারটা খারাপ না প্যান্টের উপর পরলে

আজকের সারথি অগাস। সে আবার তার এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছে একা একা এতটা ড্রাইভ করতে যাতে না হয়। আজকেরটা সত্যিই একটু লম্বা। সেইই কোন ভোরে বেরিয়েছি , তখনো ভালো আলো ফোটেনি , হানিমুনে এসে এরম ভোর বেলায় ঘুরতে পাগলেই বেরোয় , কিন্তু ওই আর কি । গাড়িতে আধা ঘুমে আধা দেখছি এক এক করে জায়গা পেরিয়ে চলেছি , কখনো দশকর্মার দোকানের মতন দোকানে ভরা বাজার, কোথাও ফলের , ফুলের বাজার , কোথাও ছোট ছোট গাঁ , সমৃদ্ধ বাড়ি , খোয়া ওঠা ময়লা টাইপ না , ঝকঝকে তকতকে আর সবুজ গাছে ঢাকা , এক জায়গায় রাস্তা ভুল করে একটা পাহাড় ঘেরা জায়গায় চলে গেছিলাম , সেখান থেকে ওই পাড়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছিলো। হাঁ করে দেখতে দেখতে , ঘুমোতে ঘুমোতে, গল্প করতে করতে পৌঁছলাম তীর্তা গংগা ওয়াটার প্যালেস। এটা ইন্সটাগ্রামারদের খুব প্রিয় জায়গা মনে হয়, কতক্ষন ধরে ধরে পোজ দিচ্ছে! আর এই গনগনে গরমে সেজেছেও বিরাট! জলের মধ্যে পাতা পাতজর টপকে টপকে মাছেদের খাওয়াতে খাওয়াতে যাওয়া যায় মন্দিরের দোর গোড়ায়। মন্দিরের ঠিক পিছনে একটা বিরাট বট গাছের বাঁধানো চত্বরে ভীড় নেই তেমন, কারন সে জায়গাটা ফটোসেশান এর উপযোগী না। আমাদের এরকম জায়গাই বেশী পছন্দের। ঝিরঝিরে হাওয়ায় অনেক্ষন বসে থাকলে প্রান ঠান্ডা হয়।


ভীড়টা দেখো একবার


বেশাখী মন্দির হল এদের সবচেয়ে প্রাচীন, সব চেয়ে পবিত্র মন্দির কম্পলেক্স। মানে গোটা তেইশেক মন্দির আছে এই চত্বরে। বেশাখীর থেকে উঁচু কোনো স্ট্রাকচার বালিতে নিষিদ্ধ। আগুং পাহাড়ের কোলে এই মন্দিরে পৌঁছতে কিঞ্চিৎ চড়াই ভাঙতে হয়। তবে এত পুরোনো একটা স্থাপত্যর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে অত কষ্ট খেয়াল থাকে না, হাঁ করে দেখতে ইচ্ছে করে কীভাবে এত নিঁখুত একটা স্থাপত্য হাজার হাজার বছর আগে বানিয়েছিল৷ তবে এরা খুব যত্নেও রেখেছে, পানের পিক না, নাম খোদাই করে রাখা না, আবর্জনা ফেলে রাখা কিচ্ছু নেই। খান কতক দোকান আছে, সেই স্যুভেনির বিক্রী হচ্ছে। খাবার দাবারও হচ্ছে কলাপাতায় মুড়ে কী যেব একটা, তবে খুব একটা ভক্তি হয়না সে দেখে। 





এখানে জুটেছিল সবুজ লুঙি থুড়ি সারং









পুজো দিতে চলেছে



বেশাখী মন্দির কমপ্লেক্স



মন্দিরে ঢোকার মূল প্রবেশ পথ



পাহাড়ের এক এক ধাপে মন্দির গুলো আছে, সব চেয়ে উঁচু ধাপটায় দাঁড়ালে মেঘে ঢাকা আগুং পাহাড়, আর পুরো উপত্যকাটা দেখা যায়। লোকেশনটা দারুন বেছেছিল কিন্তু। মাঝে মাঝে মনে হয় ধর্ম যেমন এত হানাহানি কাটাকাটি দিয়েছে ধর্ম তো স্থাপত্য, দর্শন, গান এসবও দিয়েছে। মানে ভগবান এর জন্যে নিবেদিত যে গান গুলো সেগুলো প্রার্থনা হয়তো কিন্তু তার সুর বড় টানে। এ বিশ্বপ্রপঞ্চময় এ কথা অবিশ্বাস করতে পারিনা, সত্যিই এই যে হাওয়া এই যে আকাশ এই যে পুরোটা একসাথে,এই মন্দিরের পাথরগুলো এসব যেন কী ভীষন জ্যান্ত,  যে ভাষা আমি, আমরা শুনতে পাচ্ছিনা বুঝতে পারছিনা। ধর্ম আমাদের যে ভয়ানক ভেদ দিয়েছে তা থেকে বেরিয়ে সে সুর সে গান সে শব্দ শোনার ইচ্ছে আমাদের নেই কিংবা  সেই বোধটাই হারিয়ে ফেলেছি আরো কিছু শোনার আছে আরো কিছু দেখার আছে।

 "আমি নয়নে বসন বাঁধিয়া বসে, আঁধারে ঘুরি গো কাঁদিয়া, আমি দেখি নাই কিছু বুঝি নাই কিছু...."
(ক্রমশ)

4 comments:

  1. শেষ টা সুন্দর

    ReplyDelete
  2. ছবি গুলো দেখেই যেতে ইচ্ছে করছে

    ReplyDelete
    Replies
    1. দারুণ জায়গাটা অর্ণবদা, যেও।

      Delete