Saturday, April 22, 2023

উৎসবে-জীবনে

একশো আশী ডিগ্রি চোখ ঘোরালে চোখে পড়ে আম গাছ থেকে আম ঝুলছে, কাঁঠাল ঝুলছে কাঁঠাল গাছ থেকে, একটা বসন্তবৌরি সজনে গাছে বসে, তারপর সারি দিয়ে দিয়ে নারকেল গাছ। একটা বাঁশের মাচায় শুয়ে আছি। চোখ একটু নামালে দেখা যায় প্রজাপতি উড়ছে, একটা কাঠপিঁপড়ে আমার পায়ের উপর উঠছে কামড়ালেই হয়ে গেল। লাল গরু জাবর কাটা ছেড়ে ঠ্যাঙ মুড়ে বসে ঝিমুচ্ছে।তার পাশে সাদা বাছুরটা মুখ দিয়ে দিয়ে গা চুলকুচ্ছে। পিত্তিপুকুরের জল শুকিয়ে কচুরিপানাও শিকুয়ে গেছে। দূরে তিল গাছের সাদা ফুল দেখা যাচ্ছে। চোখ বুজলে হরিনাম সংকীর্তন এর আওয়াজ থেকে ফোকাস সরাতে পারলে কানে আসবে পাখি ডাকছে। ওই হরিনামের বাড়িতে খেতে যাবো, হাঁড়ি বারনের নেমতন্ন। মানে রান্না যেন না করা হয়, সপরিবারের নেমতন্নকে গ্রামে হাঁড়ি বারন বলে।বাড়িতে আসা আত্মীয় কুটুম সমেত সকলে এসো। খিদে পেয়েছে বলেই পাখির আওয়াজের বদলে কীর্তনেই বেশী কান চলে যাচ্ছে। কীর্তনীয়া আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে, কে যেন বলছে, আমায় শাপ দিলে তো,  দেখো আমিও বলে যাই, তুমিও এই বিরহ ভোগ করবে আয়ান ঘোষের স্ত্রী হয়ে জন্ম নেবে, বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরা চলে যাবে ভগবান। 
কালীপুজোয় গ্রামে এসেছি। আজ আবার ঈদ। রাস্তা জুড়ে উৎসবমুখী মানুষ দেখতে দেখতে এলাম। এই চড়া রোদে দেখি কেউ কেউ ভেলভেটের কালো কুর্তা পরে বেরিয়েছে। মেয়েদের  পোশাকে নানান রঙের মেলা হলেও ছেলেদের বেশীরভাগ সাদা পাঞ্জাবী, পাজামা না হলে কালো পাঞ্জাবি পাজামা। বয়স্ক লোক লোকে লুঙি। ফেজ টুপিরও কতরকম বাহার। কারো সবুজ, কারো ক্রীম, কারো চুমকি দেওয়া ঝলমলে। জুতোর বাহারও কম না, কালো পাঞ্জাবি পরুয়াদের কালো কুতো বেশীরবাগ, জড়ির কাজ করা কারোর কারো। আরে আদে বাইকটায় দেখো,  চারটে আছে তিনটে ভেবেছিলা। দুটো এমন ক্ষুদে আর একই রঙের পাঞ্জাবিতে মিশে গেছে। সামনের বাইকের ছেলেটার আবার দু লেয়ারের চুল! একটায় কালো রঙার একটায় লাল, লালটা পতপত করে উড়ছে। মুখে পান কিংবা জর্দা ছোট ছোট ছেলেদেরও,ছুঁচোলো উঁচিয়ে রাখা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এহেহে এ বেচারার বাইক গেছে বিগড়ে, মাথার চুমকি দেওয়া ফেজ টুপি এখনো ঝলমলাচ্ছে কিন্তু রোদে তার মুখ মলিন, বাইক টেনে এগোতে হচ্ছে কিনা। কটকটে গোলাপী জামা পরা একটা ছেলে জামা উড়িয়ে বাইক চালিয়ে বেরিয়ে গেল। মেয়েদের ঘাগরা হয় যে কাপড়ের ওই কাপড়ের ঝলমলে জামা, টিকলি পরা ছোট মাঝারি সব মেয়ে চলেছে। একজায়গায় জলের বোতল আর একলিয়ার্স দিলো। আহাহা আরো কয়েক জায়গায় মিষ্টি দেবে না? কিশোররা ও কিশোরীরা সব টোটোয়, যুবক ও বৃদ্ধরা বাইকে। যুবতী কিংবা বয়স্কা দেখলাম না রাস্তায়, ওদের কোথাও যাবার নেই? 


চোখ মেলে দেখি, ওদিকে হরিনাম বাড়িতে সবাই ছুকছুক করছে কখন কীর্তন শেষ হবে। শুনতে পাচ্ছি কীর্তনে প্রভু এখন ভোগ খাচ্ছে। জল প্রদান হচ্ছে নতুন ভান্ডে....হয়ে এলো আশা করা যায়। হ্যাঁ হ্যাঁ ওইতো সেবা করো সেবা করো বলে কানছে। অবশ্য আমি প্রভু হলে বলতুম," ব্যাটা মাছ নিদেন গেঁড়ির ঝাল দিচ্ছিস না আর এদিকে সেবা করো নিজগুনে বলছিস!!অন্তত গুগলির ঝাল দিতে পারতিস।" অবশ্য দই মিষ্টি আছে শুনতে পেয়েছি।  এবার ভোগ মন্দিরের দরজা বন্ধ করবে...কিন্তু নাহ কিন্তু গৌরহরি সেবা করছেনা বলে, নাকি কৃষ্ণও করবে না। জ্বালাতন মশাই। তা গৌরহরি খাচ্ছে নাইই বা কেন! আমিই গৌরহরি সেজে নেবো নাকি অ্যাঁ। ইরিবাবা এবার আবার বলছে বলছে সবাই এখন সবাই মিলে অযোধ্যায় যাবো কলিযুগ থেকে দু মিনিটের জন্য! নাহ বেচারা কীর্তনীয়ারও খিদে পেয়েছে দেখছি!

মোটা চালের গোল গোল ভাত, শুক্তো, ডাল, ভাজা, তরকারি,  আমের, চাটনি,লাল দই, মিষ্টি। ম্যান্ডেটারি জমি দর্শনে বেরোতে হয় এত খেয়েছি! বাদাম, তিল,  পাট বোনা হয়েছে। দুয়েক জায়গায় পটল। সবুজে সবুজ হয়ে আছে চারদিক। সবুজেরই শেড এত রকম, আমগাছের আম গুলোকে মনে হচ্ছে টুনি বালব জ্বলছে যেন। বাঁশবাগানের নীচে শুকনো বাঁশপাতা পরে গালিচা মতো হয়ে আছে। উবু হয়ে নিড়ানি দিচ্ছে একজন। দুটো মেয়ে খালপাড়ে আম না কি যেন মাখা খাচ্ছে। চারদিকে ঘন দুপুর। আলের উপর দিয়ে সড়সড় করে একটা হলুদ ডোরাকাটা কানা মেটুলি চলে গেল। দুটো ছাগলে আরাম করে ঢুঁসোঢুঁসিকরছে। গামছা পেতে একটা লোক নারকেল গাছের নীচে ঘুমোচ্ছে। বাপ ব্যাটায় খালের জলে পাম্প লাগাচ্ছে।
"কোথায় যাচ্ছিস রে দুপুরবেলা"।
-কোত্থাও না,  তোরা কি করছিস?
-ছিঁচতে হবে নে?এক ফোঁটা বিষ্টি হলুনিতো। 

এসব কথা আলগোছে পেরিয়ে হেঁটে যাই, কোথায় যাই জানিনা। কিংবা জানি। আমি সেইই আমগাছটার কাছে যাচ্ছি, যে আমায় একবার আশ্রয় দিয়েছিল অনেকদিন আগে, যখন খুব অস্থির ছিলাম। আর এমনিই উপহার দিয়েছিল দুটো আম। না চাইতেই, যেন খানিক আদর দেখাতেই। তাকে থ্যাংকইউ বলা হয়নি,কত বছর হয়ে গেছে যাওয়াও হয়নি। গাছেরা রাগ করেনা, তবু অকৃতজ্ঞতার লজ্জা নিয়ে যাই। সেই ছোট পাতার ডালটা এখন বড় হয়ে গেছে, মোটা হয়ে যাওয়া চোখে তাকে চিনতে পারিনা আর। বিড়বিড় করে, মনে মনে, জোরে জোরে কথা বলি। কতদিনের পুরোনো গাছ, নিজেদের মধ্যে কতদূর দূর অব্দি কানেক্টেড শিকড়ে শিকড়ে। অস্থিরতা, অকারণ মনখারাপ সমর্পণ করে দিলেই হল না। কানেকশন তৈরী করতে হয়, বুঝতে হয় বোঝাতে হিয়। গাছেরা জ্ঞানী বলেই সেই বোঝানো সহজ। অনেকক্ষণ পরেও পাত্তা দেয়না, একটা পাতাও কাঁপেনা। অনেক অনেক পরে মন খারাপ করে চলে আসবো ভাবছি। কোথাও কিছু নেই, দমকা হাওয়ায় একটা ফলভরা ডাল নড়ে ওঠে। আদর ছুঁড়ে যায় গায়ে মাথায়...আমি চাইতে আসিনি কিছুই তবুও পেয়ে যাই। এই
হঠাৎ হাওয়া দেওয়ায়, গাছের পাতা নড়ায় গাছ আমার কথা বুঝতে পেরেছে শুনে হাসবে তোমরা, কিন্তু বারবার একই ঘটনা ঘটলে তাকে কোইন্সিডেন্স বলা যায় কি? যেদিন মানুষ গাছেদের সাথে কথা বলতে পারবে আরো সহজে তখন জানবে এ আমার আত্মপ্রবঞ্চনা নয়, মনের  ভুল নয়। 

রাতের বেলা যাচ্ছিলাম কোথায় যেন...নিকষ অন্ধকার চারদিক, তবুও যেন অন্ধকার নয়। একটা আবছা আলো আছে চোখ সয়ে গেলেই। আমাদের পুজোর আলো শেষ যেখানে, সেখানের পরই যেন ফিল করতে পারি অপুর ক্লস্ট্রোফোবিক কেন লাগতো গ্রামে। এক জায়গায় স্থির থাকা আমার সইবে না আবার খুব উদ্দামতাও সয়না..ঠিক কী চাই তা জানতেই মনে হয় এ জীবন কেটে যাবে।


 







Sunday, April 16, 2023

ছুটিতে ছুটোছুটি (ঔরঙ্গাবাদ )

"অ্যাই বিস্কুট খাবি নাকি? " 
"যা তোর বাবাকে ডেক্কে নিয়ে আয় না, সব শেষ হয়ে গেল যে "। 
" ও ভাইয়া চায়ে মিলেগা?"

যে কোনো ট্যুরিস্ট স্পট হল মানুষ দেখার আদর্শ জায়গা। ইলোরার শান্ত প্রাচীন গুহা ছেড়ে বেরোতেই, হই হই লোকজন। সব ওখানেই ছিল,  বেলাশেষে বেরিয়েছে।  চায়ের দোকান খুব নেই এ চত্বরে, একটা সবেধন নীলমনি  দোকান দেখে চা বানাতে দিয়ে জুত করে বসে মানুষ দেখছি। নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বলছি না,  পাছে "ও আপনারাও বাঙালী, কোথা থেকে আসছেন, কতদিন থাকবেন...." ইত্যাদি শুরু হয়। এমনিতেই আমরা অসামাজিক মতো, তায় ভীতু মানুষ এত দাপুটে লোকেদের থেকে ডিস্ট্যান্স রেখে বসাই ভালো। শুরুর কথা গুলো ওরকম একটা দলই বলছিলো। চুক চুক করে শুনছি, আর নিজেদের মধ্যে তাকাতাকি করছি," বাপরে কী দাপঅট"।  ইলোরার প্রাচীনকাল যেমন উপভোগ করি,  তেমনই তফাৎ থেকে বর্তমানের এই কলরবও কম উপভোগ করি না, স্বীকার করতে বাধা নেই। সত্যি বলতে বাঁদরদের কিচিরমিচির আর মানুষদের কিচিরমিচির খুব তফাৎ নেই, নিরাপদ দূরত্ব থেকে দুইই দেখতে মজা লাগে। 
সৌরভ আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, ওই অত চড়াই উৎরাই ভাঙার জন্যই, যে আজ ও বিরিয়ানি খাবেই খাবে। এমনিতে বেড়াতে গিয়ে আমরা যা পাই তাই খাই টাইপ। আর যেখানেই যাবো বিরিয়ানি খেতে হবে এমনও না আমাদের কিন্তু  আওরাঙ্গাবাদের নিউ সাগর হোটেলের বিরিয়ানির খুব নাম শুনেছিলাম। সুতরাং ওটা আমাদের লিস্টেই ছিল। ফিরতি পথে দেখলাম সারিসারি ধাবা গুলোয় আলোজ্বলা শুরু হয়ে গেছে। একটা রাজস্থানী ধাবা ভারীচোখ টানছিল, যেন একটুকরো রাজস্থানের গ্রাম। 

এখানের অটোওয়ালারা কী নাটুকেরে ভাই! একজনকে দাম জিজ্ঞেস করেছি, অস্বাভাবিক দাম বলায়, না বলেছি। ও বাবা সে আবার যাওয়ার সময় বলে গেলে, এত বড় হোটেলে কত টাকা দাও আর অটোওয়ালাদের দিতেই যত আপত্তি। প্রায় ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদেই দেয় আর কি! নিউ সাগর থেকেও ফেরার সময়ও, লোকটা নাকি বোঝেনি আমাদের হোটেল, তাই ভুল ভাড়া বলেছে। সে কী অভিমান,  ছেড়ে দিন আমার ভুল আমায় আর ভাড়া দিতেই হবে না!! আলাদাই!  যাই  হোক নিউ সাগরের খাবার দাবার চমৎকার ছিল, ঝাল ছিল অবশ্য। কালকেও বিস্তর হাঁটাহাঁটি আছে। এইটুকু ঘুষ দিতেই হত আমার সঙ্গের দুই মক্কেলকে। এবারে ঘোরায় এত ছুটোছুটি তার মধ্যেও এই যে এক ঝলক শহর দেখা হয়ে গেল এও বেশ কিন্তু। এদিক সেদিক গলি বাজার ঘুরে নিউ সাগরে যখন এনে ফেলেছিল অটোওয়ালা দাদা, ততক্ষনে বিরিয়ানির বদলে মাথার যন্ত্রণায় আধমরা হয়ে নেতিয়ে পড়েছি। 
সৌরভের চিকিৎসা খুব সিম্পল, মাথা ব্যথা? জল খা। জল যাকে খেতে বলছে সে হয়তো কুঁজো খালি করে ফেলল, কমেনি? আচ্ছা তাহলে খিদে পেয়েছে। খেয়ে তার পেট ফেটে যাবার জোগাড়,  কমেনি? আচ্ছা হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে পড়িস! সহজ সরল চিকিৎসা পদ্ধতি আর কি। 

ঠাকুমার সৌধ দেখে নাতির সাধ হল মায়ের নামে সৌধ করবে। আমাদের মতো টানাটানি তো আর তাদের ছিল না, ইচ্ছে হয়েছে করে ফেলো। লাগে টাকা দেবে কোষাগার। সুতরাং ঔরঙ্গজেবের ছেলে আজিম শাহ মা দিলরাজ-বানু-বেগমের স্মৃতি সৌধ বানালো যা কিনা অবিকল তাজমহলের মতো দেখতে। ডুপ্লিকেটের বাজারদর কম তাই সারা তাজের সমতুল জনপ্রিয়তা নেই এর।  তবে ডুপ্লিকেট হোক যা হোক, দেখতে ভালোই লাগে। আমাদের লোভী মন, ভিতরে মাজারের উপর প্রচুর নোট দেখে ভাবনা আসে এহে চাট্টি তুলে নিলেই হয় টাইপ। অত অমন করার কিছু নেই৷ নোট তুলে নেওয়া হয় নিয়মিত ব্যবধানেই, না হলে কয়েক বছর আগের বাতিল নোট নেই কেন!






ঔরঙ্গাবাদেও কিছু কিছু গুহা আছে। সেসব গুহায় হীবযান, মহাযান, বজ্রযান সবের প্রভাবও আছে। যেহেতু আজ ঔরঙ্গাবাদ ফোর্টে ওঠার প্ল্যান আছে, আর কাল বিস্তর হাঁটাহাঁটি হয়েছে (টু বি প্রিসাইজ গতকাল ১০ কিলোমিটার হেঁটেছি),  তাই আজ ভেবেছিলাম,  বেশী চাপ নেবো না। গাড়ি পুরোটা যাচ্ছে না, রাস্তার কাজ চলছে, তাই  এখানেও হাঁটতে হবে ভালোই।  রাস্তায় আবার চটের বস্তা চাপা দিয়ে ভিজিয়ে রেখেছে। সে বস্তার যা খুশবাই বাপরে! এই গুহাগুলোর তেমন পপুলারিটি নেই, মানে ইলোরার মতো, তাই ভীড় কম।  দু চারজন কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়ে প্রেম করতে আসে,  তাও এত সিঁড়ি ভাঙতে হয় বেশী আসে না। বেশ জায়গাটা৷ এখানে আসলে বোঝা যায় কেন সে প্রাচীন আমলে এই জায়গাটা নির্বাচন করেছিল শিল্পীর দল। মানে তখনও চারপাশ এমন জনবহুল হয়ে ওঠেনি হয়ত কিন্তু ভাবতে ইচ্ছে করে সেই সময়েও হয়ত আকাশ এমনই নীল ছিল, মাথার উপর টিয়ার দল এমনই ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে পাড়ি দিতো। গুহা অব্দি পৌঁছতে হাঁফ ধরে বটে কিন্তু পৌঁছনোর পর ভারী ভালো লাগে। এমন গাছের ছায়ায় মোড়া পাহাড়, ঝকঝকে একটা দিন, কটা কাঠবিড়ালি তুড়ুক তুড়ুক করে খেলে বেড়াচ্ছে, খারাপ লাগার অবকাশও নেই খুব। 
এই গুহাগুলো দুটো ভাগে ভাগ করা আছে। বাঁদিকের গুলোয় বজ্রযান প্রভাব কম যা বুঝলাম, ডানদিক ধরে খানিক এগোলে একটা জমকালো গুহা মেলে। বারান্দা ওয়ালা গুহাটায় প্রায় সব কটা দেওয়ালেই কাজ আছে। বুদ্ধ এখানে সিংহের উপর আসীন। কেন জানিনা, পড়াশোনা নেই। এছাড়া বজ্রযানের প্রভাবেই কিনা কে জানে নানা রকম দেবীর মূর্তির সংখ্যা বেড়েছে। 


ঔরঙ্গাবাদ ফোর্টে গিজগিজ করছে মানুষ, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সরু সরু অন্ধকার সিঁড়িগুলো দিয়ে যাবার সময় বিকট পিলে চমকানো আওয়াজ করছে। স্কুলের বাচ্ছাগুলো অনেক ভালো, তাদের টিচাররা যেমন বলে দিয়েছে তেমনই করছে, যথাযথ লাইন মেনে যাচ্ছে। সমস্যা বড় বাঁদরগুলোকে নিয়ে। বাঁদর মানে সত্যি বাঁদরও অনেক আছে।  মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পরে তাদের কাজকর্ম দেখতে হয়, এমনই চিত্তাকর্ষক।  একটা একদম গেঁড়ি মতো বাঁদরছানা এদিক সেদিক দোল খেতে খেতে,  বেশ খানিক উঁচুতে দুর্গের একটা অংশে লাফ মেরে উঠে পরেছে। উঠেছে তো উঠেছে,  আর তো সে নামতে পারে না।কারন আশপাশে আর কিছু সাপোর্ট নেই। ভয় পেয়ে মুখ মলিন করে বসে আছে। পাশে গাছটা অব্দি ঝাঁপাবার ক্ষমতা তার নেই। ওদিকে ওই গাছে তখন আরো  দুটো ছানা দোল খাচ্ছিলো। সে দুটো এটার চেয়ে একটু বড়, ওই লোয়ার নার্সারি আর প্রথম শ্রেনীর মধ্যে যতটুকু তফাৎ আর কি। তা বড়রা যেমন হয়, খুব দোল খাচ্ছে, এক এক বার লাফ মেরে ওই উঁচুটায় উঠেও যাচ্ছে, প্রবল কসরত করতে হলেও নেমেও আসছে। খানিকটা ভরসাও দেওয়া হচ্ছে যেন, ওরে পারবি, একবার লাফ দিয়েই দেখ না। এদিকে ক্ষুদেটার ভয় আর ভাঙে না, সত্যিই ওর পক্ষে মুশকিল। আশেপাশে বড়রাও কেই নেই, ক্লাস ওয়ানের গুলোর পক্ষে ওকে রেস্কিউ করাও সম্ভব না। বিরাট টেনশের সিরিজে আটকে গেছি, কী হয় কী হয়।  দুর্গবিজয় মাথায় ওঠে প্রায়। শেষ অব্দি যা হয়, সাহস করে ঝাঁপিয়েই পড়লো আর হাঁচোড়পাঁচোড় করে গাছের ডাল ধরেও ফেললো! তারপরেই তুরতুর করে ছুট ছুট! "বাপরে ওদের সাথে আর মেশে! দাঁড়া না আজ মাকে বলব, তোদের সাথে গিয়ে কেমন বিপদে পড়েছিলাম!"
ওদিকে আর একজন তখন কার থেকে ছিনিয়ে আনা একটা সিঙারা জুত করে বসে খাচ্ছে। পাশে একজন তার ছানাকে গলায় ঝুলিয়ে উদাস মুখে বসে। ভাবখানা, "এহ ভালো দাঁও মেরেছে ? একটুও দেবে না সিঙারা? এর যা চেহারা বাপ্রে, লড়াই করে তো আর পারবো না, দেখাই যাক  একটু বসে, যদি দেয়! তা সিঙারাওয়ালার ওসব ভাবাবেগ নেই। জানে এ মহিলা স্রেফ সিঙারার লোভেই কাছে এসেছে, সুতরাং আরাম করে তারিয়ে তারিয়ে সে সিঙারা শেষ করল। তারপর,  জল খেতে গেল, যেখানে "ড্রিংকিং ওয়াটার" লেখা সেখান থেকেই। এবং কল ঘুরিয়ে জল নেই দেখে অন্য জায়গার অপরিশ্রুত জল না খেয়ে লেজ নেড়ে চলে গেল। হনুমান হলেও কলেরার ভয় আছে যথেষ্ট! 
সিঙারা খোর

একটুও কি দেবে না?

লোকগুলো গাধা নাকি! এখানে ড্রিংকিং ওয়াটার লেখা ওখানের নোংরা জল খাচ্ছে!


হাঁচোড়পাঁচোড় করে দুর্গজয় করা হল। রাস্তায় কত রকম মানুষ দেখলাম। বছর কুড়ি বাইশের৷ বাপ আরো ছোট, অত্যন্ত রোগা মা, তাদের বাচ্ছাকে নিয়ে এসেছে।  এ দুর্গ যখন তৈরী হয়েছিল,  লোকেশন বুঝেই তৈরী হয়েছিল। দূর দূর অব্দি ফাঁকা প্রান্তর, সৈন্যদল আসলেই কামান দাগা যাবে। সেসব কারন, সেসব সৈন্য, সেনাপতি, অস্ত্র সব মরে হেজে গেছে। এখন সেখানে একটি মানবক আর দুটি মানব চড়া রোদ, অর্থনৈতিক অবস্থা উপেক্ষা করে বেঁচে থাকা উদযাপন করছে। কিংবা কোনো ফোকরে, যেখান থেকে নজর রাখা হত স্রেফ কে আসছে কে যাচ্ছে, সেখানে নিবিড় ভাবে বসে স্বপ্ন বুনছে, প্রাকৃতিক শোভা দেখছে। ইতিহাসে এদের কথা লেখা থাকবে না, কে কবে যুদ্ধ জিতেছিল, কে কবে হেরেছিল, কার সাথে কে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সেটুকুই লেখা থাকবে, বড্ডজোর আধুনিক ইতিহাসের ধারা মেনে, কোন সময়ে কোন কাজ কিভাবে সে সময়ের ডেমোগ্রাফি বা সম্পর্ক বদলে দিয়েছিল সেই অব্দি। কিন্তু একদম ধর্তব্যের মধ্যে না আনা মানুষও কেমন করে জীবন উপভোগ করতো তা স্রেফ এই রোদ ঝকঝকে দিন, আর এই দুর্গ মনে রেখে দেবে। কে জানে রাত হলে সবাই চলে যাবার পর, ওদের ইতিহাস খাতায় ওরা কোনটা লিখে রাখে, অকারণ হাসি না কঠিন লড়াই....


ওই যে উঁচু পাহাড়টা ...ওইটেয় উঠবো






দুর্গ জয়ের পর


দুর্গ জয় করে হাসি মুখে পোজ দিতে হয়





এককালের বিরাট ক্ষমতাশালী...




উঁচু থেকে চারপাশ



রাস্তাও বটে , নজরদারীর জায়গাও বটে