Saturday, April 22, 2023

উৎসবে-জীবনে

একশো আশী ডিগ্রি চোখ ঘোরালে চোখে পড়ে আম গাছ থেকে আম ঝুলছে, কাঁঠাল ঝুলছে কাঁঠাল গাছ থেকে, একটা বসন্তবৌরি সজনে গাছে বসে, তারপর সারি দিয়ে দিয়ে নারকেল গাছ। একটা বাঁশের মাচায় শুয়ে আছি। চোখ একটু নামালে দেখা যায় প্রজাপতি উড়ছে, একটা কাঠপিঁপড়ে আমার পায়ের উপর উঠছে কামড়ালেই হয়ে গেল। লাল গরু জাবর কাটা ছেড়ে ঠ্যাঙ মুড়ে বসে ঝিমুচ্ছে।তার পাশে সাদা বাছুরটা মুখ দিয়ে দিয়ে গা চুলকুচ্ছে। পিত্তিপুকুরের জল শুকিয়ে কচুরিপানাও শিকুয়ে গেছে। দূরে তিল গাছের সাদা ফুল দেখা যাচ্ছে। চোখ বুজলে হরিনাম সংকীর্তন এর আওয়াজ থেকে ফোকাস সরাতে পারলে কানে আসবে পাখি ডাকছে। ওই হরিনামের বাড়িতে খেতে যাবো, হাঁড়ি বারনের নেমতন্ন। মানে রান্না যেন না করা হয়, সপরিবারের নেমতন্নকে গ্রামে হাঁড়ি বারন বলে।বাড়িতে আসা আত্মীয় কুটুম সমেত সকলে এসো। খিদে পেয়েছে বলেই পাখির আওয়াজের বদলে কীর্তনেই বেশী কান চলে যাচ্ছে। কীর্তনীয়া আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে, কে যেন বলছে, আমায় শাপ দিলে তো,  দেখো আমিও বলে যাই, তুমিও এই বিরহ ভোগ করবে আয়ান ঘোষের স্ত্রী হয়ে জন্ম নেবে, বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরা চলে যাবে ভগবান। 
কালীপুজোয় গ্রামে এসেছি। আজ আবার ঈদ। রাস্তা জুড়ে উৎসবমুখী মানুষ দেখতে দেখতে এলাম। এই চড়া রোদে দেখি কেউ কেউ ভেলভেটের কালো কুর্তা পরে বেরিয়েছে। মেয়েদের  পোশাকে নানান রঙের মেলা হলেও ছেলেদের বেশীরভাগ সাদা পাঞ্জাবী, পাজামা না হলে কালো পাঞ্জাবি পাজামা। বয়স্ক লোক লোকে লুঙি। ফেজ টুপিরও কতরকম বাহার। কারো সবুজ, কারো ক্রীম, কারো চুমকি দেওয়া ঝলমলে। জুতোর বাহারও কম না, কালো পাঞ্জাবি পরুয়াদের কালো কুতো বেশীরবাগ, জড়ির কাজ করা কারোর কারো। আরে আদে বাইকটায় দেখো,  চারটে আছে তিনটে ভেবেছিলা। দুটো এমন ক্ষুদে আর একই রঙের পাঞ্জাবিতে মিশে গেছে। সামনের বাইকের ছেলেটার আবার দু লেয়ারের চুল! একটায় কালো রঙার একটায় লাল, লালটা পতপত করে উড়ছে। মুখে পান কিংবা জর্দা ছোট ছোট ছেলেদেরও,ছুঁচোলো উঁচিয়ে রাখা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এহেহে এ বেচারার বাইক গেছে বিগড়ে, মাথার চুমকি দেওয়া ফেজ টুপি এখনো ঝলমলাচ্ছে কিন্তু রোদে তার মুখ মলিন, বাইক টেনে এগোতে হচ্ছে কিনা। কটকটে গোলাপী জামা পরা একটা ছেলে জামা উড়িয়ে বাইক চালিয়ে বেরিয়ে গেল। মেয়েদের ঘাগরা হয় যে কাপড়ের ওই কাপড়ের ঝলমলে জামা, টিকলি পরা ছোট মাঝারি সব মেয়ে চলেছে। একজায়গায় জলের বোতল আর একলিয়ার্স দিলো। আহাহা আরো কয়েক জায়গায় মিষ্টি দেবে না? কিশোররা ও কিশোরীরা সব টোটোয়, যুবক ও বৃদ্ধরা বাইকে। যুবতী কিংবা বয়স্কা দেখলাম না রাস্তায়, ওদের কোথাও যাবার নেই? 


চোখ মেলে দেখি, ওদিকে হরিনাম বাড়িতে সবাই ছুকছুক করছে কখন কীর্তন শেষ হবে। শুনতে পাচ্ছি কীর্তনে প্রভু এখন ভোগ খাচ্ছে। জল প্রদান হচ্ছে নতুন ভান্ডে....হয়ে এলো আশা করা যায়। হ্যাঁ হ্যাঁ ওইতো সেবা করো সেবা করো বলে কানছে। অবশ্য আমি প্রভু হলে বলতুম," ব্যাটা মাছ নিদেন গেঁড়ির ঝাল দিচ্ছিস না আর এদিকে সেবা করো নিজগুনে বলছিস!!অন্তত গুগলির ঝাল দিতে পারতিস।" অবশ্য দই মিষ্টি আছে শুনতে পেয়েছি।  এবার ভোগ মন্দিরের দরজা বন্ধ করবে...কিন্তু নাহ কিন্তু গৌরহরি সেবা করছেনা বলে, নাকি কৃষ্ণও করবে না। জ্বালাতন মশাই। তা গৌরহরি খাচ্ছে নাইই বা কেন! আমিই গৌরহরি সেজে নেবো নাকি অ্যাঁ। ইরিবাবা এবার আবার বলছে বলছে সবাই এখন সবাই মিলে অযোধ্যায় যাবো কলিযুগ থেকে দু মিনিটের জন্য! নাহ বেচারা কীর্তনীয়ারও খিদে পেয়েছে দেখছি!

মোটা চালের গোল গোল ভাত, শুক্তো, ডাল, ভাজা, তরকারি,  আমের, চাটনি,লাল দই, মিষ্টি। ম্যান্ডেটারি জমি দর্শনে বেরোতে হয় এত খেয়েছি! বাদাম, তিল,  পাট বোনা হয়েছে। দুয়েক জায়গায় পটল। সবুজে সবুজ হয়ে আছে চারদিক। সবুজেরই শেড এত রকম, আমগাছের আম গুলোকে মনে হচ্ছে টুনি বালব জ্বলছে যেন। বাঁশবাগানের নীচে শুকনো বাঁশপাতা পরে গালিচা মতো হয়ে আছে। উবু হয়ে নিড়ানি দিচ্ছে একজন। দুটো মেয়ে খালপাড়ে আম না কি যেন মাখা খাচ্ছে। চারদিকে ঘন দুপুর। আলের উপর দিয়ে সড়সড় করে একটা হলুদ ডোরাকাটা কানা মেটুলি চলে গেল। দুটো ছাগলে আরাম করে ঢুঁসোঢুঁসিকরছে। গামছা পেতে একটা লোক নারকেল গাছের নীচে ঘুমোচ্ছে। বাপ ব্যাটায় খালের জলে পাম্প লাগাচ্ছে।
"কোথায় যাচ্ছিস রে দুপুরবেলা"।
-কোত্থাও না,  তোরা কি করছিস?
-ছিঁচতে হবে নে?এক ফোঁটা বিষ্টি হলুনিতো। 

এসব কথা আলগোছে পেরিয়ে হেঁটে যাই, কোথায় যাই জানিনা। কিংবা জানি। আমি সেইই আমগাছটার কাছে যাচ্ছি, যে আমায় একবার আশ্রয় দিয়েছিল অনেকদিন আগে, যখন খুব অস্থির ছিলাম। আর এমনিই উপহার দিয়েছিল দুটো আম। না চাইতেই, যেন খানিক আদর দেখাতেই। তাকে থ্যাংকইউ বলা হয়নি,কত বছর হয়ে গেছে যাওয়াও হয়নি। গাছেরা রাগ করেনা, তবু অকৃতজ্ঞতার লজ্জা নিয়ে যাই। সেই ছোট পাতার ডালটা এখন বড় হয়ে গেছে, মোটা হয়ে যাওয়া চোখে তাকে চিনতে পারিনা আর। বিড়বিড় করে, মনে মনে, জোরে জোরে কথা বলি। কতদিনের পুরোনো গাছ, নিজেদের মধ্যে কতদূর দূর অব্দি কানেক্টেড শিকড়ে শিকড়ে। অস্থিরতা, অকারণ মনখারাপ সমর্পণ করে দিলেই হল না। কানেকশন তৈরী করতে হয়, বুঝতে হয় বোঝাতে হিয়। গাছেরা জ্ঞানী বলেই সেই বোঝানো সহজ। অনেকক্ষণ পরেও পাত্তা দেয়না, একটা পাতাও কাঁপেনা। অনেক অনেক পরে মন খারাপ করে চলে আসবো ভাবছি। কোথাও কিছু নেই, দমকা হাওয়ায় একটা ফলভরা ডাল নড়ে ওঠে। আদর ছুঁড়ে যায় গায়ে মাথায়...আমি চাইতে আসিনি কিছুই তবুও পেয়ে যাই। এই
হঠাৎ হাওয়া দেওয়ায়, গাছের পাতা নড়ায় গাছ আমার কথা বুঝতে পেরেছে শুনে হাসবে তোমরা, কিন্তু বারবার একই ঘটনা ঘটলে তাকে কোইন্সিডেন্স বলা যায় কি? যেদিন মানুষ গাছেদের সাথে কথা বলতে পারবে আরো সহজে তখন জানবে এ আমার আত্মপ্রবঞ্চনা নয়, মনের  ভুল নয়। 

রাতের বেলা যাচ্ছিলাম কোথায় যেন...নিকষ অন্ধকার চারদিক, তবুও যেন অন্ধকার নয়। একটা আবছা আলো আছে চোখ সয়ে গেলেই। আমাদের পুজোর আলো শেষ যেখানে, সেখানের পরই যেন ফিল করতে পারি অপুর ক্লস্ট্রোফোবিক কেন লাগতো গ্রামে। এক জায়গায় স্থির থাকা আমার সইবে না আবার খুব উদ্দামতাও সয়না..ঠিক কী চাই তা জানতেই মনে হয় এ জীবন কেটে যাবে।


 







4 comments:

  1. Replies
    1. থ্যাংক ইউ সুদীপ।
      -প্রদীপ্ত

      Delete
  2. অসামান্য। অদ্ভুত।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক অনেক ধন্যবাদ কুন্তলাদি।
      -প্রদীপ্ত

      Delete