Sunday, February 19, 2023

ছুটিতে ছোটাছুটি (ইলোরা)

অজন্তার গুহায় সোনা রঙ এসে পড়ছে আমরাও এই শিল্পীর হাতে তার ক্যানভাস ছেড়ে বাসের দিকে এগোলাম।  ব্যাপারটা আমার ভালো লেগেছে। গাদাগাদা গাড়ি বাইক আসবে না এই অব্দি, ট্রাফিক জ্যাম হবে না। পর্যাপ্ত সরকারী বাস আছে টি জাংশন থেকে অজন্তার কাউন্টার অব্দি,  টিকিট কেটে উঠে পড়ো।  সেই যে বলেছিলাম একজন খুব সাহায্য করেছিল বাস অব্দি পৌঁছে দিয়ে, মনে আছে? তার দোকানে যেতেই হবে। তা তিনি তো পাক্কা সেনর অলিভেরা! এক কাপ চা আর চাট্টি বাজেকথা বলে একগাদা জিনিস গছিয়ে দিলো আমাদের মতো শপিং বিমুখ লোকেদেরও।
 সারাদিন ট্রেন পৌঁছবে কিনা,  অজন্তা দেখা হবে কিনা, তারপর অজন্তায় পৌছে সেসব দেখা সব মিলিয়ে এত উত্তেজনায় ছিলাম, টের পাইনি,  এখন পেলাম ভয়ানক খিদে পেয়েছে আর শরীরও কিঞ্চিৎ বিশ্রাম চাইছে। স্থানীয় খাবার খেতে আমরা তিনজনেই খুব উৎসাহী থাকি, সেটা মনিপুরী অদ্ভুত স্বাদের স্যালাড হোক, ভেগান বাল্টিক খাবার হোক কি চেনা মহারাষ্ট্রের বড়া পাও হোক। 
বড়াপাও, চা, মারাঠি পকোড়া খেতে খেতেও সারাদিনের অভিজ্ঞতায় আমরা উত্তেজিত, চিকু ও তার মা থেকে গাম্বাট দস্যু যারা চকচকে জিনিস দেখেই সোনা মানিক ভাবে, সেনর অলিভেরার মতো দোকানদার...শেষমেশ আদনানজি ঘেঁটি ধরে তুলে না নিলে মনে হয় আওরাঙ্গাবাদ পৌঁছনো হত না!

আওরাঙ্গাবাদ থেকে ইলোরা কাছেই। সুতরাং আমরা পয়সা বাঁচাতে একটা অটো নিয়ে পাড়ি দিলাম। যাবার পথে প্রথম হল্ট আওরঙ্গজেবের সমাধিতে। সত্যি বলতে এটা নিয়ে আগে থেকে কিছুই পড়ে আসিনি তাঁর ফলে একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে। এই লোকটার সম্পর্কে ইতিহাসে মোটামুটি সবাই পড়েছে। তাজমহল দেখতে গিয়ে শুনেছি শাহজাহানকে বন্দী করে রেখেছিল , বাকি ভাইদের খুন করে সিংহাসনে বসাটা ছেড়েই দিলাম । এর সাথে আছে জিজিয়া কর ফের চালু করা ,নানান গোঁড়ামি সব মিলিয়ে আওরাঙজেব মনে হয় সব চেয়ে আনপপুলার মুঘল সম্রাট। অথচ তার কবরটা একটা কাঁচা কবর। আগে চালা মতো ছিল ইংরেজ শাসকের অনুরোধে হায়দ্রাবাদের নিজাম চারপাশটা পাকা করে দেন। কিন্তু এত সাধারণ কবর মনে হয় মুঘল কোনো কর্মচারিরও হয়নি! আর আশ্চর্য এই যে কবরে বন তুলসীর ঝাড়! এটাও নাকি স্ম্রাটের ইচ্ছায়! জানিনা এটা কতটা সত্যি কিন্তু তুলসীর ঝাড়টাও মিথ্যে না , কাঁচা কবরটাও না! ভাবতে অবাক লাগে না?  আওরঙ্গজেবের মতো একজন রাজার শেষ ইচ্ছে আকাশের আচ্ছাদনে শুয়ে থাকার? জিজিয়া কর চালু করা একজন রাজার কবরে তুলসীর ঝাড়! সত্যিই কোন আমিটা যে আসল আমি কে তাঁর খবর রাখে!



ইলোরা সম্পর্কে প্রথম জানি কোনো ইতিহাস বই থেকে নয়, ফেলুদার কাছ থেকে নাকি বলা ভালো সিধুজ্যাঠার থেকেই। কৈলাস মন্দির আর দশাবতার গুহা নিয়ে আলাদা আগ্রহ ছিলোই। কাল অজন্তাতেও দেখেছি, আজ ইলোরাতেও দেখলাম, ১৫ বছর অব্দি টিকিট লাগে না বলে সারা মহারাষ্ট্রের স্কুল প্রায় হাজির। ভীড়ে ভীড়াক্কার। তবে আমার ব্যপারটা ভালোই লেগেছে, বুঝুক না বুঝুক আমাদের দেশের ইতিহাস সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হোক, ছোট বয়সে ব্রেন তাজা থাকে, একেবারেই বুঝবেনা তাও না। বড় হয়ে কারো হয়তো উৎসাহ হল কে বলতে পারে!  ইলোরায় গেট দিয়ে ঢুকেই কৈলাশ গুহা। কিন্তু আমরা নাম্বার অনুযায়ী দেখবোই ঠিক করেছিলাম। জৈন, বৌদ্ধ আর হিন্দু এই তিন ধরনের ধর্মের কাজ অনুযায়ী তিন ধরনের গুহা। ১-১২ বৌদ্ধ গুহা, ১৩-২৯ হিন্দু আর ৩০-৩৪ হল জৈন৷ এবং অবশ্যই স্থাপত্যকাল অনুযায়ী নাম্বারিং না, পজিশন অনুযায়ী।  ইলোরা পড়ার কথা ছিল আমাদের এরকম, ময়ূরাক্ষী পড়বে বৌদ্ধ গুহা, আমি আর সৌরভ হিন্দু গুহা ভাগভাগ করে। তো কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো আমি আর সৌরভ কিছুই পড়িনি। মানে ঐ দশাবতারে বিষ্ণুর দশ অবতারের কাহিনী আছে, তাছাড়া শিবের নানান মূর্তি আছে, কৈলাস মন্দিরটা একটা সিঙ্গেল পাহাড়কে কেটে কেটে করেছে, এরকম যা সবাই জানে ওটুকুই। বৌদ্ধ মন্দির গুলোয় , বজ্রপানি, পদ্মপানি ,তারা, আর বুদ্ধের মূর্তি। একসাথে পড়তে বসার জায়গা। একতলা, দোতলা, বারান্দা, সেই বারান্দাতেও নানান কাজ। হাঁ করে দেখতে দেখতে ঘুরি।
ওইদিক থেকে শুরু

এটা তিনতাল , কেমন হোটেল এর মতো দেখতে না?

বৌদ্ধগুহা  দেখতে দেখতেই পায়ের অবস্থা খারাপ। এহেহে ফিটনেসের তো যাচ্ছেতাই অবস্থা রে!! জল খেয়ে টুপি বাগিয়ে এগোই। দশাবতার গুহায় ঢুকে থতমত খেয়ে যাই। সিঁড়ির দেওয়ালেও নানান কাজ, অর্ধনারীশ্বর এর মূর্তি একটাই দেখলাম এ তল্লাটে। দোতলার হলে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বিষ্ণুর দশ অবতার শুধু না,  শিবেরও নানান রূপ খোদাই করা৷ স্রেফ ছেনি হাতুড়ি দিয়ে এ কী করেছে হ্যাঁ!! ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যাটা ভাবলেও বমকে যেতে হয়! এই সব পিলার কেটে বের করা,  কতটা কাটলে ধ্বসে যাবে না কতটা কাটলে হাজার হাজার বছর দাঁড়িয়ে থাকবে এ বিদ্যা তখনকার ভারতবর্ষ জানতো, সে বিদ্যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি, আবার আমাদের নতুন করে শিখতে হয়েছে সব। ধাতু বিদ্যা থেকে চিকিৎসা থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে স্থাপত্য।একটা জাতির পরাজয় কত দিকে হয় হ্যাঁ! আরো বড় করে ভাবলে এ আসলে মানুষের পরাজয়। যা জানতাম তাকে আরো প্রসারিত না করে সেটা আবার করে শিখে কত সময় নষ্ট করতে হয়েছে, আরো এগোনো হল কই তাহলে? এ যেন বৃত্তের মধ্যেই এগিয়ে যাওয়া! আনমনা হয়ে গেছিলাম, ময়ূরাক্ষীর ধমকে অপরাধী মুখ করে তাকাই, সত্যিই এই গুহাটা নিয়ে পড়া উচিত ছিল। কোন মূর্তি কোন গল্পকে বলছে এ আবিষ্কার সহজ হত। একটু আগের আমার ভাবনারই যেন ছোট স্কেলে ছবি!  যাকগে, যা গেছে যাক ভেবে ময়ূরাক্ষী বই দেখতে লাগলোয়ার আমি শর্টকাটে বিশ্বাসী, আমাদের বয়সী কি আরেকটু ছোট হবে একজোড়া ছেলে মেয়ের পিছু পিছু দেখছিলাম। ওরাও পড়াশোনা করে এসেছে।  একে অপরকে বলছিল আমি শুনছিলাম, চুরি করে অন্য গাইডদের থেকে যেমন শোনা হয় অমন করে। তা দেখা গেল ময়ূরাক্ষীর পড়া আর আমার শোনা দুই'য়ে মিলে ব্যপারটা বোঝা গেছে। বাঁ দিকের মূর্তিগুলো শিবের নানান মূর্তি,  কোনোটা শিব পার্বতীর বিয়ে, কোনোটা তাদের পাশাখেলা, কোনোটা ত্রিপুরাসুর বধ এরকম আর ডানদিকের দেওয়ালে মৎস্য কূর্ম বরাহ ইত্যাদি অবতার। আবিষ্কারের বেশ একটা আনন্দ আছে। মূর্তি গুলো দেখে দেখে আরে এটা তো ওই ওটাতো সেই বলে খুঁজে পাওয়া, কালের স্রোতে ভেঙে যাওয়া বা পাথর মসৃন হওয়া উপেক্ষা করেও। নটরাজ মূর্তি কিংবা গড়ুর দেখে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। যে শিল্পীরা এসব বানিয়েছিল তাদের মনে মনে নমস্কার করি।



ভগীরথের গঙ্গা আনা

দশাবতার যদি ট্রেইলার হয় তবে কৈলাস মন্দির হল আসল সিনেমা। মন্দিরের পাশ দিয়ে একদম পাহাড়ের উপর উঠে ড্রোন ভিউ পাওয়া যায়। বাপরে কী বানিয়েছে রে!!! এটুকুই শুধু বলতে পেরেছিলাম আমরা। ডিটেইল আর্কিটেকচারে আমি যাচ্ছি না, সেসব আর্কিওলজিকাল সাইটেই মিলবে। একদম নভিস একজন লোক, যেমন দেখেছিল সে কথাই বলব। একটা মনোলিথিক পাহাড় কেটে কেটে মন্দিরের স্ট্রাকচার দেওয়া স্রেফ ছেনি হাতুড়ি দিয়ে এই ব্যপারটা ধারনা করতেই খানিক সময় লেগে যায়। মূল মন্দিরের সামনে নন্দী মন্দির যেমন তৎকালীন মন্দিরের সামনে থাকতো। তারপরের মন্ডপ অংশের মাথায় চারটে মিষ্টি মতো সিংহ পাহারা দিচ্ছে। সিংহ মিষ্টি মতো? আজ্ঞে হ্যাঁ তখনকার দিনে সিংহ তো এঁরা দেখেনি, ফলে মুখের ভাব তেমন সিংহমাফিক নয় কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধে হয়না। কোনো কোনো জায়গায় সিংহ আর হাতির মূর্মতি একসাথে । লড়াই করছে। সিংহ জিতছে। অ্ন্রেআসলে হিন্রদু ধর্ম ফের মাথা চাড়া দিচ্ছে।  চার পাশে ছোট ছোট আরো মন্দির ঘিরে আছে। এবং প্রতিটা মন্দিরের গায়ে পাথর কেটে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানান মূর্তি। কখনো রাবনের কৈলাস পর্বত ধরে ঝাঁকানো(মূল মন্দিরে তো বটেই আরো অনেক জায়গায় দেখলাম এটা),  দশাবতার, শিবের বিভিন্ন রূপ। মন্দিরের প্রবেশের মুখেই আছে গজলক্ষ্মী হাঁ করে দেখার জো নেই অবশ্য। পেল্লায় ভীড়! কৈলাস মন্দির শুনেই আর সব থেকে ইজি অ্যাক্সেস হওয়ায় পিলপিল করছে লোক, নন্দী মূর্তি অর্থাৎ ষাঁড়ের গলা জড়িয়ে সে কী ছবি তোলার ধূম। মাঝে মন্ডপে যেখানে শিবের দক্ষিনামূর্তি,  যা কিনা ছয় হাতের আর সিংহ পরিবেষ্টিত আসনের উপর আসীন দেখার জন্য বেশ লড়াই মতো করতে হয়।  কারন এরপরেই আছে মূল গর্ভগৃহ। সেখানে শিবলিঙ্গের পুজো দেওয়ার জন্য কোটি কোটি লোক ঢুকছে! সেই ভয়ানক ভীড়ে পেরিয়ে শিবলিঙ্গ দেখার শখ ছিল না। আমরা ঘুরে ঘুরে মূল মন্দিরের কাজ দেখছিলাম। এত ভীড়, ক্লান্ত দেহ সব উপেক্ষা করেও বারবার অবাক হচ্ছিলাম কী সেই বিদ্যা যা কিনা একটা পাহাড়ের মাথা উড়িয়ে দিয়ে,  সেটাকে শেপে এনে একটা আস্ত ত্রিস্তরীয় মন্দির বানিয়ে ফেলে!! 
বার বার মনে হয় আমার এই যে প্রাচীন সব শিক্ষা বিদ্যা আমরা হারিয়ে আবার নতুন করে শুরু করছি আসলে আমরা যেন একটা বৃত্তেই ঘুরে চলেছি। এই ইঞ্জিনিয়ারিং যদি আমরা বহন করতাম তাকে আরো উন্নত করতে পারতাম, কিন্তু তা হারিয়ে গেল, আবার আমাদের নতুন করে শিখতে হল! 

কৈলাসের ড্রোন ভিউ(মানে পাহাড় থেকে তোলা আর কি)






কৈলাস মন্দিরের পিছনের পাহার থেকে



উপরে শিব-পার্বতী পাশা খেলছে। নীচেরকি ভালো বুঝতে পারছিনা, কারো মনে পড়লে কমেন্টে বলে দেবেন হ্যাঁ?






মৎস্য অবতার(কৈলাস মন্দির)

নৃসিংহ অবতার(দশাবতার গুহা)

এটা কি বলিরাজের গল্পটা? মনে পড়ছে না




চার দিকে প্রহরারত সিংহ

কৈলাস মন্দিরের একটা মিনার

দশাননের কৈলাস ঝাঁকানো

গজলক্ষ্মী- কৈলাস 


সিংহটা কেমন হাসিমুখে লড়াই করছে! এটা আসলে রূপক, হাতিকে হারিয়ে দেওয়া অর্থে হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মকে হারাচ্ছে, হাতি জেতা মানে বৌদ্ধ ধর্মের বাড়বাড়ন্ত আর একই রকম মানে দুজনেরই প্রায় একই রকম প্রতিপত্তি


কৈলাস মন্দিরের মূল অংশের ছাদের কাজ




এটা বরাহ অবতার ,দশাবতার গুহা (কৈলাস মন্দিরেও একে পাবেন)




কৈলাস মন্দির পেরোলে ভীড় কমে যায়। কারণ এর পরের রাস্তা একটু বেশীই চড়াই উৎরাই আর ডিসেম্বরের শেষ হলেও বেশ ভালোই সূর্যের তাপ। একুশ নাম্বার গুহায় ঢোকার মুখেই একদিকে যমুনা আর একদিকে গঙ্গার মূর্তি। এ জিনিস আর কোনো গুহায় নেই। ভিতরে শিবের বিয়ে, সাত মায়ের সাথে গনেশ, রাবনের কৈলাস মন্দির নাড়ানো, কালী, কার্তিক এরকম নানান পুরানের গল্প পাথর কেটে কেটে বানানো। বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা শেষ এখন স্রেফ মগ্ধ হয়ে দেখে চলেছি। বিশেষ করে ঢোকার মুখে গঙ্গা যমুনার মূর্তি বাহন সমেত বড় সুন্দর। যমুনারবাহন কচ্ছপ অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে কিন্তু প্রতিটা মূর্তির ডিটেইলিং অবাক করে। সে শিব দূর্গার বিয়ের হোক, কিংবা পার্বতীর তপস্যাক্লিষ্ট মূর্তি হোক৷ 
গঙ্গা

কালী...করাল বদনা



এর পর থেকে রাস্তায় একটাও গাছ নেই, জলের জায়গাও পাচ্ছিনা। পুরো রাস্তায় খালি আমরা তিনজন। খাঁ খাঁ করছে চারদিক দুপুরের তাপে। ২৯ নাম্বার গুহা হল শেষ হিন্দু গুহা। এটার চলতি নাম সীতা কি নাহানি। যদিও সেটা ভুল করেই, গুহার মুখে গঙ্গা দেবীর মূর্তিকে সীতার সাথে গুলিয়ে এমন ভজঘট করে ফেলেছে। পাহাড়ের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা, তার অন্যদিকে ওই সীতা কী নাহানি পুকুর। এ পুকুরে জল পরে ২৯ নাম্বার গুহার মাথা থেকে আসা ঝর্ণার জল। বর্ষায় এই রাস্তা বিপজ্জনক হবে কিন্তু দেখতেও ভারী ভাল্লাগবে বোঝাই যায়। এই গুহাটা বেশ মজার, তিনদিক খোলা। ভিতরে নটরাজ মূর্তি, শিবের  অন্ধকাসুরের বধ, শিব দুর্গার বিয়ের মূর্তি খোদাই করা। ২৯ থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা আরো মারত্মক৷ সূর্য মাথার উপর, জল শেষ রাস্তা যেন শেষ আর হয়ই না। এরপর আছে জৈন গুহা গুলো। রোদে গরমে প্রায় ধুঁকতে ধুঁকতে জৈন গুহার কাছাকাছি পৌঁছে ছায়া মিলল। জলও। খানিক বসে দেখতে চললুম ফের।

ভরদুপুরে এই স্ট্রেচটা হাঁটতে জিভ বেরিয়ে গেছিলো!


এই গুহায় আছে তীর্থঙ্কর দের মূর্তি। একজন তীর্থঙ্কর নাম গোমতেশ্বর,  সে ছিল আদিনাথের ছেলে। মোক্ষলাভের জন্য  সে এমন তপস্যা করছিল যে তার বাবার আগেই সে মোক্ষ অএয়ে যায়। তবে যতদিনে মোক্ষ পেয়েছিল ততদিনে তার শরীর ঘাসপাতা, শিকড়ে ঢেকে গেছে। আচ্ছা হাড়ে দুব্বো গজানো কী একে দেখেই বলে লোকে? যাই হোক, তীর্থঙ্করদের মূর্তি হল একেবারে মিলিটারি সাবধান টাইপ। কোনো মুদ্রা না কিছু না সোজা হাত পা,  শরীরের কোনো অঙ্গের সঞ্চালন নেই। অর্থাৎ জগৎ থেকে সে বিমুক্ত,  জামাকাপড় হোক বা কিছু তার অপ্রয়োজনীয় কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। জৈনদের গুহাগুলো খুব অর্নামেন্টেড। মানে প্রতিটা স্তম্ভ, ছাদ কারুকাজ করা। গোমতেশ্বরের মূর্তিতে অবশ্যই লতাপাতা উঠে এসেছে এমন রিলিফ। আর ৩২ নাম্বার গুহায় আছে কুবের আর অম্বিকার মূর্তি।এনারা সম্ভবতঃ যক্ষ ও যক্ষী কিন্তু জৈনধর্ম নিয়ে আমার জ্ঞান কম তাই এদের উপস্থিতির বিস্তারিত খবর জানিনা। ৩২, ৩৩ আবার ইন্টারকানেক্টেড। আলো আঁধারির মধ্যে দিয়ে দিয়ে এক গুহা তগেকে আরেক গুহায় যাওয়াও কম রোমাঞ্চকর নয়!

জৈন গুহা - ইন্দ্রসভা না কী যেন নাম ছিল, ঢোকার মুকে













জৈন গুহার সিলিং এর কাজ


 এইসা উঁচু উঁচু সব পাথরের সিঁড়ি সারা ইলোরা জুড়েই।তখনকার দিনের মানুষের বাত টাত ছিল না মনে হয়! দোতলাটা প্রশস্ত, কিন্তু সিঁড়ি গুলো সরু সরু। আমাদের আগেইই কেউ একজন ঘুরে গেছে জুঁই ফুলের আতর মেখে, জানলা না থাকায় কয়েক হাজার বছরের পুরোনো গুহা সেই আতরের গন্ধ ধরে রেখে দিয়েছে বহুক্ষণ।  ইলোরায় ঘুরতে ঘুরতে বড় অদ্ভুত লাগছিল।  বিস্ময় মুগ্ধতা এসব ছাপিয়ে অন্যরকম মনে হওয়া, যা কাল অজন্তাতেও হচ্ছিল। এইসব গুহা পাথর এরা কতকাল ধরে কতরকম লোক দেখেছে, তখনকার দিনে ধর্মেও উগ্রতা ভালোই ছিল তাও কেন কে জানে এইখানে কেউ কারোর কাজ নষ্ট করে দেয়নি। হয়ত শিল্পীরা ছিল বলেই পারেনি অন্যের কাজ মুছে দিতে, নিজেদের আলাদা জায়গা খুঁজে নিয়েছে। যদি কাল একটা বহুমাত্রিক প্রবহমান জিনিস হয়,তবে কোনো মাত্রায় এই গুহায় কাজ শিল্পীরা সব বসে আছে,কোনো মাত্রায় সবে গুহা আবিষ্কার হয়েছে, কোনো মাত্রায় আমাদের মতো কেউ অবাক চোখে দেখছে!
সূর্য ডুবে এলো প্রায়। আমাদের মন ভরে আছে কিন্তু শরীরের হা ক্লান্ত দশা। মূল রাস্তা দিয়ে ফিরে কৈলাস মন্দিরের সামনে বসে রইলাম খানিক। বসে বসে আপন মনে কী জানি ভাবছি হঠাৎ খকখক করে কাশির আওয়াজে মাথা ফিরিয়ে দেখি একটা বড় বাঁদর খুব কাশছে ঠিক পিছনে বসে! মুখে হাত চাপা মানুষেই দেয়না তো বাঁদরে! সে না দিক এর সামনে থাকা বিপজ্জনক!  ফস করে চাঁটিয়ে দিলেই চিত্তির।ফিরতে ফিরতে দেখি, এ চত্বরে যে সব বাঁদরদের দল ছিল তাদের বিকেলের ছুটি চলছে। বাবা বাঁদর খোকা বাঁদরকে নিএ বিকেলে বেরিয়েছে। একটা একতু বেশী ছোট একটা আরেকটু বড়। নিজের মনে বসে অ্টাআছে বাবা বাঁদর, কাল ফের কাকে চাঁটাবে , কোত্থেকে চাট্টি ফল জোটাবে সেসব ভাবনাই হয়তো। কিংবা সবাই চলে গেলে কোন গুহায় ঢুকে বুদ্ধ না শিব না গোমতেস্বর না বিষ্ণু কার মাথায় চড়া যায় এইসব গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাভাবনা চলছে।  এই টুকু ছানা বাঁদরটা তার বাবার এই মস্ত লেজ ধরে ঝুলছে। নেহাতই ছোট বলে কিংবা বাবার ছদ্মবেশে মা কিনা কে জানে ধাড়িটা কিচ্ছুই করলো না, স্রেফ ইগ্নোর করলো ওই লেজ ধরে দোলাটা। সূর্য তখন কৈলাস মন্দিরের পিছনে ডুবছে।