Tuesday, July 18, 2023

কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টো

ট্রোল করাটা সব চেয়ে সহজতম কাজ মনে হয়। এক গ্রুপে এক ভদ্রলোক জানতে চেয়েছেন, চার্লস ডিকেন্সের বই কেমন, পড়া শুরু করতে চাই। মানছি, চার্লস ডিকেন্সের নামটা গুগল করলেই পেতেন। তাও,  একটু ধৈর্য্য ধরে বলে দিলেই মিটে যেত,  বদলে কিছু মানুষ বিদ্রুপ শুরু করলেন। যাকগে, ছায়ার সাথে কুস্তি করার মানেও নেই। চার্লস ডিকেন্স শুনে ছোটবেলার কথা মনে এলো হুট করে। যদিও স্মৃতিটা ডিকেন্স নয়, আলেকজান্ডার ডুমার বিখ্যাত উপন্যাস নিয়ে।আসলে স্মৃতিরা বেজায় গোলমেলে। যে জিনিস ভাবি ভুলেই গেছি তাও রয়ে যায় দিব্যি আর যা মনে করি খুব স্পষ্ট তা দেখি আবছা। আসলে এই বিদ্রুপ,  ইত্যাদির প্রেক্ষিতেই মনে এলো আরো। আমি গেঁয়ো মানুষ, তখনো কথার জড়তা কাটেনি, শহুরে আদব কায়দাও রপ্ত হয়নি তেমন। আর আমি ছিলামই একটু অড ম্যান আউটের অড ম্যান। ফলে বন্ধু বান্ধব ছিল না মোটেও। বন্ধু বলতে লাইব্রেরির বইগুলো। পড়ার নেশা আগেই তৈরী হয়ে গেছিল, তাই তার সুবিধে ছিলোই একটা। তো হাতে এলো একদিন কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টো। রাত নেই দিন নেই, লুকিয়ে চুরিয়ে পড়ে চলেছি বিশ্বাসঘাতকতার গল্প, হেরে গিয়ে ফিরে আসার গল্প, সাহসের গল্প, প্রতিশোধের গল্প।  পড়তাম আর ভাবতাম আমিও এরকম একদিন বদলা নেবো সবার। এখন শুনলে হাসি পেতে পারে, যদিও আমার পায়না,  কারন সেই সময় সেই বিদ্রুপ সেই অপমানগুলো কষ্টকর ছিল বইকি! অপমান,  বিদ্রুপ এরপরেও সেদিনকার হাবা বালক বহুবার পাবে কিন্তু তখন সে বড় হয়েছে খানিক, তাছাড়া ইউজড টুও হয়ে গেছে। নাহ অপমান কারোরই কম্ফোর্ট জোন হয়না, কিন্তু সারভাইভাল শিখে যায়। সে সময় আমি জানতাম না, কিন্তু কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টো আমায় বাঁচিয়েছিল। অন্তত ঘুরে দাঁড়ানো যায় সেটা তো বটেই। কোনো হারই শেষ কথা নয় সেটাও। 

Tuesday, July 4, 2023

নতুন পাড়ায়

লেখালিখির পাট প্রায় উঠেই গেছে। সময় পাচ্ছিনাটা বললে নিজের কাছে ভালো সাজা যায় বটে, কিন্তু নিজের কাছে তো অন্তত শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। তাই এক্ষেত্রে বলা ভালো,  যে একটা কিছু গোলমাল তো হয়েছে বটেই, লিখতে আমার ভালো লাগে কারন আমি যা লিখি তা কোনো ভাবেই সাহিত্য টাইপ কিছু না, প্রাচীনকালে মানুষ যেমন নিজের ভাব ফুটিয়ে তুলতো হিজিবিজি অক্ষরে সেরকম যা মনে আসে, কিংবা যা দেখি তাইই লিখি। শিল্পের নিয়ম হচ্ছে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করা। স্রেফ মাটির তাল রেখে দিলেই তো মূর্তি হয়না, কিংবা আঁকাচোরা কিছু একটা বানিয়ে দিলেই বিরাট শিল্পকলাও হয়না সুতরাং এ স্রেফ এমনিই বকে যাওয়া। তাও এক দুজন বন্ধু বান্ধব পড়ে, কেন কে জানে তাদের ভালোও লাগে! কিন্তু লিখতে শুরু তো করেছিলাম নিজের জন্যেই। নিজের চাট্টি বুদবুদ কাটা কথা বলার জায়গা মিলেছিল বলেই তবে কেন লিখছি না কিছু? লেখার বস্তুর অভাব আমার যদি হয় বলতে হবে আমার একটা অংশ মৃত। কারন আমি তাহলে কিছু দেখছিনা বা কিছু ভাবছিনা। সেটা হলে তো মশাই চিন্তার ব্যপার। জোম্বি নিয়ে সারা জীবন ঘর করা খুব চিত্তির। তা লেখার বস্তুর অভাব ঘটে না। মনে মনে বিড়বিড় করিনা কখনো তাও না। তাহলে? তাহলে আমার মনে হয় আদি অকৃত্রিম ল্যাদ।  কিন্তু কারন যাই হোক, তাকে সরাতে তো হবেই। কথা বলা দরকার, নিজের কথা গুলোও বলা দরকার কেউ না শুনলেও।

বাড়ি বদল করা মানে কী বলব আর হারকিউলিসের সেই  গোয়াল পরিষ্কার করার কাজের সমান। বাড়ি বদলানো জরুরি ছিল, কিন্তু তাই বলেই এত কাজ অ্যাঁ! গেরস্ত ঘরদোর মানে যদি পনেরো কুড়ি বস্তা বাজে কাগজ, কাপ ডিশ জামা কাপড় থাকে তবে আমি সন্ন্যাসী হওয়াই প্রেফার করছি আবারও। কী নেই! মানে কী না ফেলেছি! ২০০৭ সালের রাজমিস্ত্রীর হিসেব, প্রাক্তন গার্ল্ফ্রেন্ডের পাঠানো চিরকুট, বর্তমানকে লেখা প্রেমপত্র, প্রাক্তন(-১) গার্ল্ফ্রেন্ডের এর পাঠানো কার্ড, প্রাক্তন(-২) এর পাঠানো বই, হতে পারতো কেউ এর পাঠানো অমুক, এক কোটি বছর আগের ডাক্তার দেখানোর প্রেসক্রিপশন!মায়ের শাড়ির সংখ্যা দেখে ভিরমি খাচ্ছি, তুলে রাখা কাপডিশ দেখে অজ্ঞান, বাতিল কিন্তু মায়া করে রেখে দেওয়া জিনিস দেখে বিষন্ন হবো না বিরক্ত ভাবছি। মানে সে এক ত্রাহিমাম ত্রাহিমাম অবস্থা। ওদিকে নতুন বাড়ির কাজ যে করছে সে হল একেবারে ভগবানের এগারোতম অবতার, হয়ে যাবে সব হয়ে যাবে কিন্তু কিছুই আর শেষ করে উঠতে পারেনা। এদিকে চোখের আড়াল হলেই মা বাবাই চুপচাপ যত রাজ্যের বাজে জিনিস ব্যাগে পুরে রেখে দিচ্ছে! 

সে সব দিন যে পেরিয়ে এসেছি লিখতে গিয়েই অবাক হচ্ছি। চিমটি কেটে দেখছি ঠিক আমিই, আমরাই এ সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলাম? তারপর এলো ডি ডে। রাশি রাশি কার্টুন ভরছে, উঠছে, নামছে। পঞ্চাশটা মতো কার্টুন বাক্স থেকে জায়গার জিনিস জায়গায় রাখাই কী সোজা কাজ নাকি! এ কাজ আমি আমার জীবদ্দশায় অন্তত আর করতে চাইনা। প্রতিদিন আমি আর ময়ূরাক্ষী আড়াইটায় ঘুমোচ্ছি, সাড়ে সাতটায় উঠে পড়ছি।তাছাড়া গোটা পঁচিশেক গাছ, যার মধ্যে চার পাঁচটা বড় বড় গাছ, নিম, কারিপাতা, জবা ইত্যাদি।  একটা জবাকে রাখতে পারলাম না, ওটাই বড্ড বেদনার  তবে এর মধ্যে সবচেয়ে সময় লেগেছে কিন্তু সব চেয়ে আনন্দ দিয়েছে আমাদের ছোট্ট স্টাডিরুমটা গুছোতে। দিন তিনেক সময় নিয়েছিলাম মনে হয়, নাকি চারেক যাই হোক, সারা মেঝেতে ছড়ানো ছেটানো বই, সকালে দরজা খুললেই সেইই ছোটবেলায় লাইব্রেরিতে যেমন গন্ধ পেতাম তেমন গন্ধ পাচ্ছি...আহাহা। নতুন বাড়ি যা হয় আর কি, রাতে শুয়ে বৃষ্টি নামলেও ছুটে গিয়ে ব্লাইন্ডস ভিজলো কিনা দেখছি, জল, দাগ লাগলেই মুছছি। বুড়ো হলে নিজেদের নিয়ে খুব হাসাহাসি করবো নির্ঘাত। আদেখলার ঘটি হল দশা আর কি। 

জায়গাটা মূল শহর থেকে বেশ দূরেই। তায় ছোট। তবে আমাদের চারজনেরই  সব মিলিয়ে ভালোই লাগছে। কারন অনেক অনেক গাছ আছে ক্যাম্পাসের মধ্যে। কোনো অংশে দুধারে চাঁপা গাছের সারি, কোনো অংশে দুধারে শাল, কিংবা কোথাও বকুল, কোথাও জারুল। সবুজ ঘাসে চাও তো বসে নাও একটু, চিড়িক চিড়িক করে একটা কাঠবিলাই চলে যাবে ছুটে। কিচিরমিচির করে পাখির ডাক শুনতে পাবে। পিছন দিকের গেট পেরোলেই একদম গ্রাম, বাঁশ ঝাড়টার সমেত। সাইকেলে করে চক্কর কেটে দুধ দই মিষ্টি কিনি, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকানের খোঁজ করি। এক সপ্তাহে আত্মীয়রা এলো। আত্মীয় কুটুমদের অবশ্য তেমন সুবিধের লাগেনি। একে তো নতুন বাসস্থান বেজায় ছোট, তায় শহর থেকে এত্ত দূর, সব মিলিয়ে তারা হতাশই প্রায়। তাও নেহাত ভদ্রলোক বলেই তেমন কিছু বলেনি মুখের উপর, নেহাত মুখ ফস্কে যতটুকু বলে ফেলেছে ততটাই আর কি। 

আশপাশের দোকানদাররা বেশীরভাগ মুসলমান না হলে নস্কর, পাল, বিশ্বাস, মন্ডল পদবীর, খুকুমনি বিবি, শহিদুল মোল্লা, নাজমুল হোসেন, রুকমিনা বেগম, অর্জুন নস্কর, সঞ্জয় মন্ডল, মাধব পাল  ইত্যাদি। সেদিন বিকেলে এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে চারপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। আগে যাইনি এদিকটায়, সাইকেল থাকায় সুবিধে হয়েছে। দেখতে পাচ্ছি কেমন শিরীষ গাছগুলো সন্ধ্যের মুখে পাতা মুড়ে ফেলেছে। এরকম যে হয় জানতামই না। প্রজ্ঞাকে বলতাম সচারাচর এরকম।  মানে এই চারপাশের গাছপালার কিংবা পাখি নিয়ে প্রশ্ন থাকলে। কিংবা শহরেই পাশেই গ্রামগুলোর আর্থ সামাজিক যে বদল গুলো সেসব নিয়ে। অহেতুক গালগল্প আর কোনোদিন হবে না, কেমন দুম করে নেই হয়ে যায় মানুষে। যতদিন থাকে, আলগা হয়ে থাকি, যেই মানুষে চলে যায় সুতোয় টান পড়ে। অবান্তর কথা হোক কিংবা কেজো আলাপ আর কখনোই কিছু হবে না একটা মানুষের সাথে, এ সত্য দুম করে সামনে আসলে নড়ে যেতে হয় বটে। কিন্তু সত্যিই কি নড়ে যাই? প্রজ্ঞার চলে যাওয়ার পড়ে মনে পড়েছে বহুবার, কিন্তু বাকি কিছু তো থেমে থাকেনি। থাকেও না মনে হয়। কতলোকে জাজ করলো ওকে কেন ওই কেন সেই, যেন জীবৎকালে ওর ধার দেনা বিল সব মেটাতো তারা, ওর জুতোয় পা গলিয়ে কেউ দেখেনি, ওর রাস্তায় কেউ হাঁটেনি তবু কথার শেষ নেই। শিরীষ গাছ গুলোর আয়ূ আর কদ্দিন কে জানে! এদিকেও রাস্তা বাড়বেই শিগগিরই,  গাছেদের ভোট নেই, সুতরাং রাস্তা চওড়া করতে জবরদখল হওয়া জমির পুনরুদ্ধারের বদলে গাছ উড়িয়ে দেওয়া সহজ।

 একটা একা বোকা চায়ের দোকানে দাঁড়াই ভীড়ওয়ালা দোকান, পেঁয়াজির গন্ধ উপেক্ষা করে। কিন্তু বউটি হতাশ মুখে জানায়, "না বাপ চা নেই, কারেন্টে হয় কিনা। অন্য কিছু খাবে, খাও না? " মনটা ভালো নেই, এগিয়ে যাই।  তারপর আরো একটা দোকান জোটে, একলা বেঞ্চে বসে চা খাই। দোকানদার ছেলেটা মুখে খৈনি ঠেসে বসে। বসে থাকি চুপ করে অনেক্ষন। তারপর ফের একটা দমকা হাওয়া দেয়, উঠে পড়ি।  আরেকদিন বেরোবো, ওইই যে বাঁয়ের রাস্তা ধরে যাবো বেশ। কিংবা সোজাই চলে যাবো আরো অনেকদূর। আকাশের দিকে চোখ পাতি গাছেদের শামিয়ানা ভেদ করে, ফিবোনাচ্চি সিরিজে পাখি উড়ে গেল, মেঘের ফাঁক দিয়ে টকটকে আল আলো দেখা যাচ্ছে।.... "না চাহিতে মোরে যা করেছ দান আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ..."