Wednesday, December 18, 2019

তাড়াহুড়োয় তাড়োবা (শেষ)

বাঘ দেখে ফিরে ভয়ানক খিদে পেয়েছে দেখে গেটের বাইরেই এক হতভাগা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পরা গেল। সে এক আজব রেস্টুরেন্ট মাইরি! ধরো খাবার অর্ডার দিলে,  বলল দেরী হবে কিন্তু, তুমি অন্য একটা অর্ডার দিলে বলল আচ্ছা এটা হয়ে যাবে এক্ষুনি। তো স্বাভাবিকাবেই জলদি হবে এমন জিনিস, ডিম পাঁউরুটি অর্ডার দেবে তুমি। তাতেও দেখবে এক্ষুনি ব্যাপারটা কালের কাছে স্রেফ মায়া। তার এক্ষুনি আসলে আধঘন্টা, কিন্তু তাতে কি, পুরো মহাকালের তুলনায় সে তো নখের ডগাও না। তাই তুমি বসেই থাকবে বসেই থাকবে, ঘড়ির কাঁটা সরে যাক, খিদেয় তুমি নেতিয়ে যাও, যাই হয়ে যাক। আমায় এমন হাব্লা মত দেখতে কাউকে তাড়া দিলেও পাত্তা দেয়না। সমুটা বেশ লম্বা চওড়া আছে , সৌরভটাও কুস্তিগীর মত হয়েছে দেখতে, কিন্তু দুটোই ভারী মোলায়েম স্বভাবের। কাউকে গিয়ে ধমক দিয়ে বলবে সে ওদের ধাতে নেই, নিজের মনে বিড়বিড় করবে , তারপর হয়ত দুটো ঘাসের ডগাই চিবোবে। আর দলের মেয়েগুলোও ওরমই , তাদের আবার যত ধমক ধামক মার ধোর আমাদের উপর, কিচ্ছু না করলেও , বাইরে বলতে বলো ঝিম মেরে পড়ে থাকবে। শেষে আর্যদা গিয়ে দাঁড়াতে সামান্য মিলি সেকেন্ড তাড়াতাড়ি করল বটে।

তখন বেশ রোদ উঠে গেছে। রিসর্টের চারদিকে যে উঁচু উঁচু ঘাসের বন দেখে মনে হয়েছিল কাল রাতে বাঘ লুকিয়ে বসে আছে, আজ কেমন রুক্ষ মত মায়া মায়া লাগছে। চারদিকটা বেশ ফাঁকা, রিসর্টে বেশী কাউকে দেখতেও পাচ্ছিনা। যদিও আরেকটা গাড়ি আছে এখানে। এমন পাখি ডাকা শান্ত পরিবেশ,  এমন ছুটি আমাদের খুব একটা মেলেনা কারোরই। এলোমেলো ছড়িয়ে বসে আড্ডা হচ্ছে,  তারই ফাঁকে একজন দুজন করে গিয়ে চান সেরে আসছে। সৌরভ এর ইচ্ছে ঘুম, এর মধ্যেই ঘুমিয়েও পড়েছে। কাল সারা রাত থেকে প্রায় জাগা, পেটে খাবার পড়তে আর এমন শান্ত পরিবেশে ইচ্ছে করছিল শুয়ে পড়তে। কিন্তু আমাদের ফের একটা সাফারি আছে। এবারের সাফারিটা ঘোষ দিয়েই বুক করা ছিল, তাই রিসর্টেই আনতে এসেছিল লোক। রাতের অন্ধকারে টের পাইনি, কিন্তু দুপুরের রোদে দেখতে পেলাম রিসর্ট আর মোহারলি গেটের মাঝে মস্ত একটা জলাশয়।  একটু দূর থেকে হুডখোলা জিপে বসে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।

দুপুরের জঙ্গল সকালের থেকে আলাদা। শীতের দুপুরে গাছগুলো সারসার দাঁড়িয়ে। সকালের হিহি ঠান্ডা এখন নেই। নিস্তব্ধ জঙ্গলে মাঝে মাঝে মাঝে দুটো চারটে পাখির ডাক,  হরিনের ডাক। শুরুতে একটা সম্বর দেখে এদিক ওদিক ঢুঁ মারছি, এখনো কিছু পাইনি তেমন। তারপর হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে বলল কল শোনা গেছে কল শোনা গেছে। হুড়মুড় করে জিপ নিয়ে গেলো।  বাঘ ওই জঙ্গলে দেখা গেছে অল্প, এবার তিনি যে কোনো দিকে যেতে পারেন। এমন কি আরো গভীর জঙ্গলেও যেতে পারেন। সবাই অপেক্ষা করছে।  অপেক্ষা করতে করতেই দেখি একটা ডালে এক ঝাঁক হরিয়াল বসেছে। ওইদিকের গাছে ছোট্ট একটা দোয়েল পাখি মনের আনন্দে দোল খাচ্ছে। ওই একটা কাঠঠোকরা উড়ে গেল। কোনো চাপ নেই জীবনে, বাঘ দেখতে পাওয়ার, দেখাতে পারার কিচ্ছু না। ঝলমলে কটা প্রজাপতি উড়ছে এদিক্সেদিক।দূরে একপাল হরিণ অব্দি ঘাস খেয়ে চলেছে একমনে। জাস্ট পাত্তা দিচ্ছে না বাঘ আসতে পারে কি পারেনা তার। আর মানুষগুলো, ছুটিতে এসেও বাঘ দেখতে পাবে কিনা, পেলেও ক্যাপচার করতে পারবে কিনা সেই নিয়ে উৎকন্ঠায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে!  সুখ শান্তি আসলে মানুষ হারিয়েই ফেলেছে!









অনেক্ষন এদিকসেদিক করেও পাওয়া গেলনা বাঘের দেখা। খালি একদিনের বাসী বাঘের বর্জ্য দেখা গেল। এ জঙ্গলে একটা বেশ সুন্দর গাছ আছে। এরা বলে ঘোস্ট ট্রি। সাদা,  লাল আর বাদামী তিনটে কালার চেঞ্জ হয় সারা বছর ধরে।  ভারী সুন্দর গাছ। সাদা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ডালপালা মেলে ভূতের সিনেমা ভাব আসে বটে। এ জঙ্গলে শাল গাছ প্রচুর আছে। তাড়োবা লেকে নাকি কুমীর আছে বলছিল। মিথ্যে না সত্যি কে জানে! এইসব জায়গায় এলে আমার কেমন মনে হয়, আমরা কখন চলে যাব তার অপেক্ষা করে গাছগুলো। চলে গেলেই নিজেদের গল্পগুজব শুরু করে দেবে। গাছ টু গাছ টক, মানুষের সে কথা শোনার অধিকার নেই। নিজেদের বিরাট সভ্য ভেবে সে অধিকার তারা নিজেরাই হারিয়ে ফেলেছে!


ফেরার পথে দুপুরের দেখা বাঁধটার জলে দারুণ একটা সূর্যাস্ত দেখলাম। হালকা থেকে গাঢ় হয়ে যাওয়া লালের নানান শেড দিগন্তব্যাপী বাঁধের জলের উপর।আহা এমন রঙ এর খেলা দেখতে পাওয়াও কম সৌভাগ্য না। না সে ছবি তুলিনি আমরা , ও ছবি স্রেফ মনে তুলে রাখতে হয়।রিসর্টে ফিরে খুব খানিক কাড়াকাড়ি করে খাওয়া,  আড্ডা হল জমাটি। আমরাবেই কজন সবসময় প্রাণের নেশায় বুঁদ থাকি, আলাদা করে মদ গাঁজা দিয়ে আমাদের বুঁদ হতে হয়না, হুল্লোড় করতে,  ফূর্তি করতে আলাদা করে উপকরণ দরকার পড়েনা। নেশা আমাদের কিসে হয় কে জানে, হয়ত একইরকম কটা একটু আধপাগল, তথাকথিত আনস্মার্ট,  হাবলা লোকেরা এক হলে তাদেরই আঁচে। নয়ত এরকম জঙ্গুলে সন্ধ্যেয়, মদ গাঁজা ছাড়া এত হাহা, এত প্রাণ লোকের কাছে অবিশ্বাস্য বটে।






রিসর্টে একটা ভারতীয় মেয়ের দল আর কটা বিদেশী এসেছে। বিদেশীগুলো রাতের একটা সাফারিতে যাচ্ছে। আমাদের অফার করেছিলো, দুটো সিট আছে, কেউ যদি যাই। সবাই আড্ডা দিতেই উৎসাহী বেশী, বন্ধুদের ছেড়ে অযাচিত সাফারি কেউই নিলনা। বাইরে আগুন জ্বেলে মেয়েদের দলটা নাচ গান করছে। আমাদের দলের ছেলেপুলেরা নেহাতই দুধভাত টাইপ। কেউই মাইরি গিয়ে আলাপ জমাবার চেষ্টাও করলাম না! বরং এক আকাশ তারা দেখে কোনটা কালপুরুষ,  কোনটা সপ্তর্ষিমণ্ডল, গুঁড়ো গুঁড়ো তারাগুলো কী হতে পারে সে সব আলোচনায় মেতে গেলাম সবাই মিলে। তবে মিথ্যে বলব না, আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসে আড্ডা মারার ইচ্ছে আমাদের সকলেরই ছিল। রাতে খাওয়ার পর তাই নিভু নিভু আগুনের চারপাশে গুটিগুটি জড়ো হয়ে নরক গুলজার শুরু করা গেল ফের। হোটেলে লোকগুলো আমাদের দেখে ফের কাঠকুটো গুঁজে দিয়ে গেলো। আগুনে আঁচে মাথার উপর এক আকাশ তারা নিয়ে আমাদের আলাপ আরো একটু দমে বসানো গেলো, পাক হতে গেলে তা বড় জরুরী কিনা।

পরেরদিন আমাদের খুটওয়ান্ডা গেট থেকে সাফারি করার কথা। ওটা একটু দূরে, সকাল সকাল বেরোতে হবে কাল থেকে ভালো ঘুম নেই, তবুও শুয়ে পড়েও ফুক্কুড়ির শেষ হয়না। এ ওর ঠ্যাং টানাটানি করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে। ভোরের আলো ফুটছে তখন, আমাদের গাড়িটা জঙ্গুলে রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে জঙ্গলের পাশেই একটা ছোট্ট গ্রাম পেরোচ্ছে। সার সার লোক, বউ সব রাস্তাতেই সুলভ শৌচাগার চালু করেছে! আমাদের দেশের লোকেদের বেসিক সেন্স এত কম কেন? নোংরা থাকবো নোংরা ভাববো এতে এত সুখ পায়! এত গুরু ঠাকুর, এত ধর্মীয় অনুশাসন এত ছুৎমার্গ কোথাও বলা নেই পরিচ্ছন্নতার মত প্রাথমিক বিষয় নিয়ে? দারিদ্রতা কোনো কারনই না, আমি মার্সিডিজ এর দরজা খুলে থক করে রাস্তায় থুতু ফেলা লোক দেখেছি প্রচুর। বোধটাই নেই। মন খারাপ হয়ে যায় এসব ভাবলে। একটা সময় পর হয় সব ধ্বংস হয়ে যাওয়াই ভালো। ভারতবর্ষের এত প্রাচীন ইতিহাস, আজ নোংরা, জনসংখ্যার ভারে ক্লান্ত, অশিক্ষিত, গাম্বাট লোকের মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাকগে,  ভাবব না এসব বেড়াতে এসে। মনটা সরাতে তাকালাম আকাশের দিকে একবার, সকাল হয়ে গেছে, আমরাও খুটওয়ান্ডা গেটে পৌঁছে গেছি।



খুটওয়ান্ডা গেট দিয়ে বেশী গাড়ি ঢোকে না, তাই সামনে আর কোনো গাড়ি ছিলো না। ঘুরে ফিরে সেই মোহারলির দিকেই যাবে যদিও তাও,  খানিক হলেও অন্য রাস্তা। জঙ্গলে হুড খোলা জিপসিতে ফাঁকা জঙ্গলে সকালবেলার বুনো গন্ধ নিতে নিতে যাচ্ছিলাম আমরা। ময়ূর, সম্বর, চিত্রল হরিণ, প্রজাপতি, পাখি দেখতে দেখতেই ফের উত্তেজনার খবর পাওয়া গেল। বাঘ দেখা গেছে!









বাঘের খবর শুনেই সারা পাড়া চুপ! দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই, মানে বসে আছি আর কি জিপে।বিস্কুট খাচ্ছি, শুকনো ডাল থেকে পাশের বন্ধু কারোর ছবি তুলতে ছাড়ছিনা, দু চারটে ফিসফিস করে কথাও বলছে লোকজন, এমন সময় ঘাড়ুম করে একবার বাঘ ডেকে উঠলো, ব্যাস, পুরো এলাকা বোমা ছাড়াই তটস্থ। ও বাবা! সেই যে ডাক শোনালো তারপর আর কিচ্ছু নেই। মহা অলস বাঘ তো! আমার থেকেও বেশী দেখছি! বসে বসে আলোচনা করছি, বিস্কুটের লোভ দেখি বাঘটাকে বাইরে বের করা যায় কিনা। আসলে সে খুবই কাছে আছে, শীতকালের শুরুতে ঘন জঙ্গল বলে একশো মিটারের তফাতেও ব্যাটা গা ঢেকে জিরোচ্ছে। অনেক অনেক্ষন বসে থাকার পর,  গাইড আমাদের কথাকেই সমর্থন করল,"শুয়ে পড়েছে মনে হয়"। বোঝো! এ কেমন ব্যাভার হল হ্যাঁ? লোকজন এসেছে বাড়িতে আর আপনি শুয়ে থাকবেন? অবশ্য ঠিকই আছে! আমিও বাড়িতে লোকজন এলে পালাতে ভালোবাসি। মহারাজদের ধরন একই রকম হবে স্বাভাবিক!

একটা ঘুরতে যাবার কত কথা হতে থাকে, কত আলোচনা, কত ঝগড়া, কত তর্ক...... বেড়ানো মনে হয় আমাদের সেই সময় থেকেই শুরু হয়ে গেছিল,  সেই যখন থেকে স্বপ্ন দেখছিলাম। আমাদের বেড়ানোটা আসলে তো দেড়দি এর না, অনেক গুলো দিনের, মাসের। আবার কবে সবাই একসাথে হব কে জানে! ফেরার পথে  দুপুরবেলার হাইওয়েতে গাড়ির মধ্যে, পড়ন্ত বিকেলে ধাবায় খেতে গিয়ে, এয়ারপোর্টের সফিস্টিকেশনে আমরা দেড় দিনের মেয়াদটা আরো আরো লম্বা করছিলাম। না, বাঘ আমরা তিনটে সাফারিতে মোটে একটাতে দেখেছি, তবে তাতে আমাদের প্রাপ্তির ঝুলি কিছু কম হয়নি।  শেষ হয়ে গেল তাই মন খারাপ তো হচ্ছিলোই, কিন্তু তাই বলেই আমরা মন খারাপ করে মুষড়ে পড়ে বাকি সময়টা নষ্ট করার জনতা না। যেটুকু মুঠোয় ধরে বুকপকেটে গুঁজে নিই....পরের জার্নি শুরু করার আগে অব্দি।



6 comments:

  1. সেই লাল সন্ধ্যের ছবি আমি তুলেছিলাম তো! আর আমাদের বেড়ানোর ৯০% প্ল্যানিং এর স্বপ্নেই হয়ে যায় এ কথাটাও উহ্য থাকল। আর হ্যাঁ, বাঘের ডাককে 'ঘাড়ুম' বলাটা ভারী অন্যায় হল মশায় ��

    ReplyDelete
    Replies
    1. লাল সন্ধ্যের ছবি দেখতে চাই । তাছাড়া এরা এতটাও নিরীহ নয় সে প্রমাণ পাওয়া গেছে একটা করে আলুপরোটা পাওয়ার পর তজ্জন গজ্জন শুনে -_- বরং ছোট চুল ছাঁটা মেয়েটাই একটু নিরীহ নিস্পাপ টাইপ ছিল ।

      Delete
    2. না সে খুবই বদ ছিল -_-

      Delete