Thursday, November 28, 2019

তাড়াহুড়োয় তাড়োবা

দেড় দিনে?!!! কিই বলছিস!! পয়সা বেশী হয়েছে?! মাথা খারাপের দল সব!কিরকম বন্ধু, অ ফেসবুকে!এরকম করে ঘোরার কোনো মানেই হয়না যাই বলিস! 

উপরের সব কথাই শুনতে হয়েছে। তাদের পক্ষে অস্বাভাবিকও না। কেউ যদি শোনে স্রেফ দেড় দিনে কোলকাতা থেকে নাগপুরে গিয়ে ঘুরে আসছে তাহলে এসব বলবেই। খুলেই বলি তবে। আমরা সাতজন বন্ধু পাঁচটা আলাদা লোকেশনে থাকি দেশ আর রাজ্য মিলে। সবাইকে জড়ো করতে হবে, আবার ছুটিও নিতে পারবে না,  আবার একসাথেই বন্ধুরা মিলে বেড়াতে হবে এত ক্রাইটেরিয়া থাকলে যা হয় আর কি! সুতরাং উইকেন্ডে আমরা তাড়োবা যাবার তোড়জোড় করতে লাগলাম। ফেসবুক এক আজব জায়গা সবাই জানে কিন্তু আজব মানুষের গজব দুনিয়া কেমন হয় বলে নিই আগে বেড়াতে যাবার আগে। একটা কথা সত্যি যে তুমি যা খুঁজবে তাইই পাবে বা তার কাছাকাছি কিছুই পাবে, মানে তুমি ঝিনুক খুঁজলে পাখি পাবে না, তেমনই আমি নিজে আজব বলেই হয় আমার আজব কিছু লোকজন জুটে যায়। তার মধ্যে একজন মানুষ বাংলাদেশ থেকে দুদিনের জন্যে এলেও আমার সাথে দেখা করে যান, একগাদা বই আনেন, নিজের ছেলের আলমারী থেকে। আমেরিকায় থাকা এক দিদি জামাইবাবুকে আমার খুব দরকারি জিনিস বিনা দ্বিধায় আনার জন্যে বলতে পারি।  আর বন্ধু বান্ধবদের কথা? সে বলে শেষ করা যাবেনা!!  এইটুকু বলি আমার গল্প, আড্ডা, বেড়ানো, প্রয়োজন,  সবই এই ফেসবুক থেকে পাওয়া। তো এইরকমই কটা ছেলে মেয়ে মিলে আমরা সারাক্ষনই প্রায় বেড়াতে যাবার কথা ভাবি। কত জায়গা পৃথিবীতে আমরা কিছুই দেখিনি প্রায়। বেড়ানো জন্য সঙ্গী যদি প্রপার না হয় তবে একা বেড়ানোই বেটার এ আমি মনে করি। প্রত্যেকের বেড়ানোর ধরন আলাদা, কেউ ভালোবাসে কোনো জায়গায় গিয়ে স্রেফ ল্যাদ খেতে, কেউ ভালোবাসে খুব ঘুরে নিতে, কারোর খাওয়া, থাকা প্রায়োরিটি থাকে তো কারো আরেকটা জায়গা দেখা। কেউ ভালোবাসে শপিং বা পাবে যেতে কেউ ভালোবাসে ঝুম হয়ে বসে থেকে নিস্তব্ধতা শুনতে। তা আমাদের এই সাতজনের বেড়ানোর ধরন, বা জায়গা একই রকম পছন্দ তা কিন্তু না৷ আমাদের কারোর পাহাড় ভালোলাগে, কারোর সমুদ্র, কেউ ভালোবাসে সমুদ্রের ধারে হোটেলে সাতদিন ঝুম হয়ে কাটাতে কেউ ভালোবাসে পাহাড়ে হেঁটে বেড়াতে। তাও আমরা একসাথে যেতে চাই,  প্রাণপণ চেষ্টা করি একটা এমন জায়গা, সময় ঠিক করতে যাতে করে সবাই একোমোডেট করে যাই। আসলে বোধহয় যদি পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, মায়া আর কম্ফোর্ট জোন ব্যাপারটা থাকে নিজের পছন্দ অপছন্দটা আপনা থেকেই নমনীয় হয় যায়।

অনেক ক্যালকুলেশন, অনেক দিন ক্ষন, অনেক জায়গা  মেক মাই ট্রিপে ঘুরে স্থির করা গেল এবার হবে জঙ্গল, আর  নাগপুরের ফ্লাইটটা খানিক সহজ হচ্ছে।  বেশ কথা, কিন্তু ছুটি? তা তো নাই আমাদের কারোরই! বাবুবাড়িতে ছুটি মেলা সোজা না। কিন্তু ওই যে,  আমরা যাবো ভেবেছি যখন, কে পারে রুখতে! সুতরাং প্ল্যান হল, শুক্রবারের ফ্লাইট ধরা হবে, আপিসের পর, রাতে পৌঁছে, শনিবার সকাল আর বিকেল দুটো সাফারি নেওয়া হবে,  আর রবিবার একটা সাফারি করে সেদিনই ফেরা।  কি আর এমন ব্যাপার তাই না?  


প্রথম ধাক্কা এলো শনিবার সকালের সাফারি বুক করতে গিয়ে। মারাঠা দস্যু আক্রমন ঘটে গেল আমার ব্যাংক একাউন্টে। আগে বুকিং করলে ডাবল চার্জ!! আমরা সাতজন মানে দুটো গাড়ি লাগবে। ফস করে ক্যামেরা আর দুটো জিপ মিলিয়ে হাজার পঁচিশেক নেই হয়ে যাবার পর আমার টনক নড়ল, আচ্ছা এত কেন? না ভুরু কুঁচকে তাকাবার কিছু নেই, আমি একটু ইয়ে মত আছি। বহুবার অমন ঘটেছে, ঘটনা ঘটানোর পর উপলব্ধি করেছি ছড়িয়েছি বলে৷ টিকিট কাটার আগে বাঘের মতই ক্ষিপ্র ভঙ্গীতে কাজ করেছি, স্রেফ একটা সাফারি আমার সোজা বাঘ থেকে ইঁদুর করে দিল, চিঁ চিঁ করে লিখলাম এই ঘটেছে।  এরা সবাইই ভীষণ ভদ্র ফলে কাঁচা খিস্তিটা আর করল না কেউ, বরং কেউ কেউ চেষ্টা করল ফোন করে কথা বলে ক্যানসেল করানো যায় কিনা, ইত্যাদি। অতীত বদলে বর্তমানের  আর ভবিষ্যতের ভিখারি দশা বদলাতে পারলে তো কথাই থাকত না। সুতরাং আমাদের কাছে দুটো অপশন রইল, হয় এই সাড়ে তিন হাজার এর মায়া ত্যাগ করা যাক না হয় লুঙ্গী ঝেড়ে মাঠে নেমেই পড়া যাক। কত দূর কপর্দকশূন্য হব আর,  এমনিতেও গরীবের হারানোর কিছু থাকেনা বিশেষ! 


পরের ধাক্কা এলো, ফ্লাইট বুক করতে গিয়ে, না দামে এবারে কুপোকাৎ করতে পারেনি, কারন এক অপরাধে দুবার সাজা যেমন হয়না, এক আঘাতে দুবার পেড়ে ফেলা যায়না। এবারের ধাক্কা সময়ে। বিভিন্ন রাজ্য থেকে সবাই জুটছিলাম বলেছি আগেই। তা দেখা গেল,  সবাই মিলে জড়ো হয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে এগারোটা-সাড়ে এগারোটা বাজবে। ওখান থেকে তিন ঘন্টা সাড়ে তিন ঘন্টা তাড়োবা। অর্থাৎ ভোর রাতে পৌঁছেই এক ঘন্টা পরেই হবে আমাদের প্রথম সাফারি। অবশ্য এটা যে আসলেই একটা চাপ এটা আমরা সকলে বুঝেছি অনেক পরে, যাবার  আগে আগে, কারন.... আচ্ছা সে কথায় পরে আসছি।


এরপর ধাপে ধাপে ধাক্কা খেয়েই গিয়েছি আমরা, নাগপুরে যে বন্ধুর ভরসায় ছিলাম, গাড়ি হোটেলের, সে দুম করে সবাইকে ব্লক করে পালিয়েছে। তারপর যে হোটেল বুক করেছি তার খরচা দেখে আমাদের হার্ট বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে, কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, কেউ কাজে ফেঁসে যাওয়াই ক্যান্সেল হয়ে যায় অবস্থা। তো ঘটনা হল আমরা এসবে আর পাত্তা দিইনা। আমাদের সাথে ভালো স্মুথ কিছু তো হবার কথাও না এ যেন আমরা জেনেই গেছি। যে ছেলেটা কোনোদিন মার খায়না সে মার খেলে কান্নাকাটি করে, আর যে মার খেয়ে খেয়ে পোক্ত সে মার খেলে হাসে। আমাদেরও তাই হাল আর কি। 

ক্রমে সেই দিন চলেই এলো। অফিস থেকে হাঁকপাঁক করে বেরিয়ে দেখি উবের কাস্তেতে শান দিয়েছে আমার গলাটা নামাবে বলে। একটা হলদে ট্যাক্সি ঝিমুচ্ছিল, ফিসফিস করে বললাম কাকা  তোমার ট্যাক্সিতে বসে উবের ডাকবো? ধড়মড় করে বলল, "তামাশা করনেকা ক্যা, যাব না বলেছি নাকি!"  

যাই বলো বাপু,  ট্রেনে যাওয়া অনেক আরামের, ফ্লাইটে বড় শীত করে,  তাছাড়া দশ টাকার চা একশো টাকায় বেচে বদ গুলো। শুধু নাক ঠেকিয়ে নীচের মিটমিটে আলো জ্বলা শহর দেখতে ভালো লাগে বেজায়। কোলকাতার থেকে সব এয়ারপোর্টই মনে হয় ভালো। মন খারাপ হয়ে যায় মাইরি। মন খারাপ অবশ্য বেশীক্ষন স্থায়ী হবার সুযোগ পায়না।  এয়ারপোর্টে সবাই মিলে জুটতেই ফের হাসাহাসি ,  গল্প আড্ডা। বন্ধুরা থাকলে অনেক কঠিন জিনিসই কেমন সহজ হয়ে যায় তাই না?


রাতের বেলা গাড়ি বা বাসে করে ট্রাভেলের একটা অদ্ভুত অনুভূতি আছে। হা ক্লান্ত হয়েও সমানে নিজেদের নিয়ে তামাশা করতে করতে কখন দেখি গাড়িটা হাইওয়ে ছেড়ে দিয়েছে। চারপাশ ঝোপঝাড় আর একটা অদ্ভুত আকাশ, গাড়ি কাচ দিয়েই একগাদা তারা দেখা যাচ্ছে, নিঝুম চারধার। একবার থামতে হল আমায়, খোলা বাতাস না হলে চলছিল না। ড্রাইভারজি পছন্দ করছিলেননা, কারন জঙ্গলের সীমান্তে আমরা ঢুকে গেছি তখন। চারপাশে বড় বড় মানুষ সমান ঘাস এর ফাঁকে কিছু থাকলেও টের পাবার উপায় নেই। এমন অদ্ভুত ছমছমে জায়গায় নামতে অস্বস্তি লাগে তো বটেই কিন্তু অদ্ভুতের আলাদা টানও থাকে। সেই টানেই মনে হয় শারিরীক অস্বস্তি ফেলে দিয়ে,  ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপট সরিয়ে অন্ধকারে চোখ মেলে দেখতে ইচ্ছে করে, এক আকাশ ভর্তি ঝুরো ঝুরো জটলা করা, কিংবা আলাদা থাকা তারা দেখে থমকে যেতে হয়।

ড্রাইভারজি তাড়া দেয়,উঠে আসি। ফের চলা শুরু হয়। কতক্ষন পর, জঙ্গলের মধ্যে কাঁটা তার ঘেরা হোটেলে আমাদের গাড়ি ঢোকে। শুনশান সে হোটেল্র খোলা জায়গায় দাঁড়ালে শিরশির করে পাশের ঝোপঝাড়ের দিকে তাকিয়ে।  খাবার জায়গায় আলো জ্বলছে, কেউ কোথাও নেই, আমাদের অবশ্য কিছু যায় আসেনা তাতে। কে যেন কেয়ারটেকারকে খুঁজতে গেল, বাকিরা ওইখানেই থাবা গেড়ে ঝোলাঝুলি খুঁজে কী আছে বের করতে লাগলো। বলছিলাম না,  মার খেয়ে খেয়ে বিগড়ে যাওয়া ছেলেপিলের দল সব! 

(ক্রমশ)

6 comments:

  1. ভয়ানক ঘটনাবহুল শুরু তো, প্রদীপ্ত। সবদিক বেঁধেছেঁদে গুছিয়ে বেরোব করতে করতে অনেকসময় বেরোনই হয় না, তাই থেকে এইরকম উঠল বাই বেড়ানো বেটার। তাছাড়া এ রকম বেড়ানোর একটা নিজস্ব চার্ম আছে। আমাদের অনেকদিন জঙ্গল জঙ্গল মন, তাড়োবা তোমাদের কেমন লাগল দেখি, তারপর না হয় প্ল্যান করা যাবে। গালে হাত দিয়ে বসলাম পরের পর্বগুলোর অপেক্ষায়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি এই প্রথম জঙ্গলে বাঘ দেখলাম খোলা জিপে বসে । তিনটে সাফারিতে একটা , লাক খারাপ বলা যায় কারন লোকে তাড়োবায় আরো বাঘ দেখে। তাও তাড়োবা আমায় সেই দুর্লভ সুযোগ প্লাস বন্ধুদের সাথে ঝাঁক বেঁধে ঘুরে অক্সিজেন , এই দুই এর চমৎকার কম্বো অফার করেছে খারাপ লাগার চান্সই নেই ।

      Delete
  2. টেক্নিকাল এরর আছে এক আধ জায়গায়
    বাকিটা বড় সুন্দরলিখেছ

    ReplyDelete
  3. বুঝেছি ওই পঁচিশ আর সাড়ে তিন হাজারটা গোলমাল লাগছে তো? আরে সাত জনে পঁচিশ হাজার মানে পার হেড সাড়ে তিন আর কি।

    ReplyDelete
  4. Sob bhalo, but Kolkata airport kharap kuse hya?

    ReplyDelete
  5. বাকি এয়ারপোর্ট গুলোর বেসিক ব্যবস্থা অনেক বেটার। ফালিট এর সংখ্যা তো ছেড়েই দিলাম।

    ReplyDelete