Wednesday, July 10, 2019

একদিন হাসপাতালে

সার সার বেড পাতা। সার সার জানলা। তবুও হাওয়া আসছেনা মোটেও। প্রায় সবারই পরণে লুঙ্গি। বুকের খাঁচা ছোট হয়ে যাওয়া বুড়ো কোনো বেডে, কোনো বেডে পেট প্রায় মিশে যাওয়া জোয়ান ছেলে, কোনো বেডে এই গরমে কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে থাকা লোক। শহরের হাসপাতাল নয় কিনা, তাই ভীড় লাগামহীন না।

সকাল বেলা থেকে দুপুর অব্দি ডাক্তার, নার্স, বাড়ির লোক, নতুন টেস্ট, নতুন রুগীর ভীড় বেশী। দুপুরে নীচ থেকে খাবার আনে যে যার থালায়। খাবার পর শুনশান হয় খানিক। একটা অল্পবয়সী ছেলের বাড়ির অনেক লোক এসেছে, মা,  মাসী, আরো কারা যেন, একজন হাতপাখার বাতাস দিচ্ছে, একজন পেটে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। জানলার পাশ থেকে দুটো বেড পর একটা লোকের মাথায় শিরা ওঠা শাঁখা পরা একটা হাত পরম মমতায় বুলিয়ে দিচ্ছে।

পাশের ঘরটা ফাঁকা।  সারি সারি বেড পাতা কিন্তু রুগী থাকার সিস্টেম নেই। আসলে হাসপাতালটায় কাজ হচ্ছে। মাথায় গামছা বেঁধে, যে রোদে হাসপাতালের গেট পার হয়ে জলের জায়গা অব্দি  যাওয়া যায় না সেই রোদের মধ্যেই, দেওয়ালে  রঙের তুলি বোলাচ্ছে কার্ণিশে দাঁড়িয়ে একজন আর বাঁশে দাঁড়িয়ে একজন। গেটে ঢোকার মুখে মালাই বরফ  বিক্রী করছিল, বারোটার রোদে মাথায় গামছা আর সাইকেলের ক্যারিয়ারে টিনের বরফের বাক্সে লেবু নুন দেওয়া বরফ। পাঁচ টাকায় একটা পিতলের হাতা দিয়ে প্লাস্টিকের গ্লাসে তুলে দেওয়া বরফ।
ফাঁকা ঘরটায় অনেকে শুয়ে আছে। রুগীর বাড়ির রাত জাগা লোক। ছেলেই বেশী। যে বউ গুলো বরের সাথে রয়েছে তারা তো রুগীর খাটেই একটু জায়গা করে শুয়ে পড়েছে। আর যে মায়েরা এসেছে বড় ছেলের সাথে তারা মাটিতে বেড পেতে শুয়েছে। ক্রমে দু চারটে পাখির ডাক ছাড়া বাইরের মিস্ত্রীরা ছাড়া সবাই চুপ করে যায়, ঝিম ধরা দুপুর নামে। একটা বিড়াল এসে উঁকি মেরে দেখে যায় ডাস্টবিনে কিছু আছে নাকি। এক পা দুই পা পুরো মাথা নেমে যায় ভাতের খোঁজে.....

ফাঁকা ঘরটায় দুটো ছেলে, একজন গল্প শোনায়, বিদেশে কেমন সেক্স ফ্রি তার। সে দেখেছে এক্সভিডিওতে এরকমই হাসপাতালে গেলেই রুগীর বাড়ির লোককে, "ম্যাসেজ" করে দেয়, তারপর সুযোগ পেলে....ইঙ্গিত করে হাতের মুদ্রায়। সে দেশে নাকি বর বউ বলে কিছু না, একটা ঘরে চোখ বেঁধে সবাই ল্যাংটা হয়ে যায়, "তারপর তোর বউ আমার...."..... শুনে যাই হুঁ হাঁ করে, এক্সভিডিও সত্যি, ইউটিউব সত্যি, হোয়াটসঅ্যাপে গুজব বন্ধ করবেন? সত্যি বলতে ছেলেগুলো নিজের বিশ্বাসে অদ্ভুত সরলতায় বলে যায় এসব।জানি জানি আপনি কি বলবেন,  হাসপাতালে এসব কথা বলে এরা কারা, কিংবা এরা প্রত্যেকে পোটেনশিয়াল রেপিস্ট এই তো? অত সাদা কালো মানুষ হয় না কত্তা। বন্ধুর বাবার জন্যে রাত জাগা যায়,  দুপুর রোদে স্ট্রেচার নিয়ে ছুটোছুটি করা যায়, কিন্তু সে কারনে মন খারাপ করা যৌবনের ধর্ম না যে! আর রেপিস্ট? মানুষ দেখেননি আপনি তবে। আরেকটু দেখেই নিন না কত্তা, অত সহজে নাই বা দাগালেন৷

হঠাৎ  করে একটা শোরগোল ওঠে। একটা লোক,বেশ শক্ত পোক্ত সা-জোয়ান চেহারা, মাথায় কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছে। বাইরের বারান্দাতেই পেচ্ছাপ করতে চায়। প্যান্টের চেন খুলে, বের করে দাঁড়িয়ে পড়েছে, তার বউটা তাকে অনুনয় করছে,  চলো না গো চলোও না গো বলে সে " ধোর বাঁড়া সর তুই বলে" ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। বউটা অসহায় ভঙ্গীতে কেঁদে ফেলেছে।এ ঘর থেকে ওই ছেলেটা ছুটে গিয়ে লোকটাকে, "কাকা এস এসো" বলে টেনে নিয়ে এগোচ্ছে, আমরা বাকিরাও হাত লাগাচ্ছি....বাথরুম অব্দি পৌঁছে দিয়ে দেখি লোকটার ছেলে এসে পৌঁছেছ্ব, হয়ত নীচে ওষুধ আনতে গেছিল সে ফাঁকে এই অবস্থা।

ক্রমে বিকেলের রাউন্ডের সময় হয়ে আসে।
নার্স হাঁক পাড়ে, অনুপ মাজি, অনুপ মাজির বাড়ির লোক কে আছে? য
এ পাশ থেকে ফর্সা রোগা বউটা ছুটে যায়....
"শেখ সাহাবুদ্দিন..."
নাম ধরে ধরে ওষুধ দেয় নার্স, কারোর স্যালাইন বদলে দেয়, কাউকে ইঞ্জেকশন। ডাক্তার আসে। অল্পবয়সী ছেলে।  কাল থেকে একে দেখছি, শান্ত মুখে সবার ওষুধ লিখছে, টেস্টের রিপোর্ট দেখছে। রেফার করার হলে রেফার করছে। একটা মাথা ফাটিয়ে গুন্ডার দল এসেছিল, তাদেরও ওষুধ দিল চুপচাপ। ক্যাপ্টেন কুল।

বিকেল গড়ায়....বড় কম্পাউন্ডটায় শিরীষ,  কদম, শিমূল গাছের ছায়া পড়ে। ভিজিটিং আওয়ার শেষের ঘন্টা পড়ে। যদিও এরকম গ্রাম গঞ্জে অত সময় মানে না কেউইই। মাঠের কাজ শেষ করে যে আসবে তার কি সময় মেপে আসা যায়! সেই মাথা খারাপ রুগীটাকে রেফার করেছে, বউটা শক্ত করে লোকটার হাত ধরে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে এগোয়। লোকটা শিশুর মত টলমল করে,  বিস্ময় মাখা চোখে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে এগোয়, তার কিছুতেই কিছু এসে যায় না, ওই দূরে রাস্তাটার দিকে নজর তার, ছাড়া পেলেই চলে যাবে যেন। বউ, ছেলে, সব গোলমাল হয়ে যাবার পর কীসের দর্শন পেয়েছে সে কে জানে!

No comments:

Post a Comment