Thursday, July 11, 2019

বুড়ো শহরটায়

বাড়িটার নাম ছিল ড্রিমল্যান্ড। দোতলা,  বারান্দাওয়ালা বাড়ি। যেমন হত আগেকার দিনে, বারান্দাটা টালির ছাওয়া। যখনকার বাড়ি এখানে তেমন লোক ছিল না মনে হয়, বাড়ির গায়েই হয়ত সব্জিওয়ালারা বসে যায়নি, কিংবা মুরগির ঝুড়িটা লাগানো থাকতোনা। এখন অবস্থা বদলেছে, ড্রিম আর নেই, ডিম হয়ে গেছে। ডিমল্যান্ড। পথচলতি কেউ তাকিয়ে দেখেও না হয়ত। কারা থাকে ওখানে এখন কে জানে! 

কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে সারাদিনে। ধর্মতলা থেকে ময়দানের পাশ দিয়ে ইডেন গার্ডেন হয়ে বাবুঘাটের রাস্তাটা বড় প্রিয় আমার। মনুষ্য-বর্জ্যের  গন্ধ ছাপিয়েও এক এক জায়গায় বৃষ্টি ভেজা বুনো গন্ধ নাকে ঝাপ্টা মারে। কোলকাতা শহরে এ বড় কম। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে দেখি বাবুঘাটের গোল্লাটায় আটকে গেছে, দু পা এগোয়, একটা বাস আসে ফের দু পা পিছোয় আর তাতে তাদের হাসাহাসি বাড়ে। প্রেমে থাকলে ছোটখাটো অসুবিধে মনে হয় ইগ্নোর মোডে চলে যায়। ওই যে,  বেঞ্চের সামনে গোড়ালি ডোবা জলকে কাটিয়ে দুজন জমিয়ে প্রেম করছে। বাফ্রে ডেডিকেশনের হদ্দমুদ্দ যাকে বলে। একটা লোক ডানহাতে গোলাপি লেডিস ব্যাগ বাঁ হাতে ছেলের হাত ধর হেঁটে যাচ্ছে, একদল ছেলে মেয়ে সেলফি তুলছে লঞ্চ আর মেঘলা আকাশ নিয়ে। আরে আরে ওইখানে কি হচ্ছে! একজন ন্যাড়া সাহেবকে পাকড়ে কজন মিলে সেল্ফি তুলছে!! বড় লজ্জা লাগে, কেন এমন করে দেশের মাথা নিচু করে দেয়? একটু পরে দেখি সাহেব তড়িঘড়ি করে চলে যাচ্ছে,  পাছে ফের কেউ পাকড়ে ধরে। 

তবে যাই বলো, বর্ষার এই মেঘ ধোয়া বিকেলগুলো বড় সুন্দর হয়। গঙ্গার ধারটা সুন্দর করে দিয়ে বড় ভালো হয়েছে। দূরে দূরে ভেসে থালা হাত নৌকা গুলো ডাক দেয়। সন্ধ্যে নেমে আসা কোলকাতায় একটা তেরপলের নীচে কাঠের উনুনে ভাত বসিয়েছে একজন মাঝি। কাছেই জোয়ার আসা গঙ্গায় তার হ্যারিকেন ঝোলা নৌকা দুলছে। মাঝি এখন রাঁধুনিও বটে। বড় খুঁতখুঁতে রাঁধুনি দেখি, শিলনোড়ায় রসুন থেঁতো করে ঢাকনা খুলে কেটে রাখা পেঁয়াজের পাশে যত্ন করে তুলে রাখে, ফের চাপা দেয়। জানান দিল, মাছ ধরা হয়েছে আজ। কোনদিন মাঝির অতিথি হয়ে যাব ঠিক। জোর করেই। এসব বলছি কিন্তু জানি হবে না, আমি কোনোদিনই অমন মুখ ফুটে চাইতে পারবো না, কোনোদিন পারিনি বলে কত পাওনা জোটেনি আগে,  পরেও জুটবেনা সেও জানি। 

অন্ধকার ছায়া ছায়া রাস্তাটা পার হলেই ব্যস্ত এসপ্ল্যানেড, দুম করে প্রেক্ষাপট বদলে গেলে কেমন ঘুম ভেঙে যাওয়া অনুভূতি হয়। দেখি এক বয়স্ক দম্পতি ফুচকাওয়ালার সামনে। ফুচকার জল বুড়ির গায়ে পড়ে, বুড়ো যত্ন করে রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দেয়। এ শহরের খারাপ টুকু তো সবাই জানে, বড় শিল্প নেই, কাজের মন নেই, আলসে, অভদ্র, কিন্তু তাও এইযে ভালোবাসার গল্প গুলো বাঁচিয়ে রেখেছে সে খবর জানে কজনা। অবশ্য প্রেম ভালোবাসা এ গতিময় যুগে বাহুল্য বটে। কিন্তু আমি তো ওই ভালোবাসার ভরসাতেই বেঁচে থাকি, বুড়োটে ক্ষয়াটে শহরটার মতই......

2 comments: