Wednesday, August 8, 2018

হিজিবিজি আঁকিবুঁকি


তো যা বলছিলাম, আমার আবার একটু নদী, জল এসব প্রীতি একটু বেশীই। বহুদিন আগে গাল্ফেরেনের সাথে টাকি গেছিলাম, সে নিয়ে বিস্তর ফ্যাচফ্যাচও করেছিলাম, ইয়ে মানে লিখেছিলাম। এক জ্ঞানী লোক বলেছেন, গাল্ফেনের সাথে ঘোরা জায়গা গুলো বউ এর সাথে ঘুরে দেখলে অভিজ্ঞতা বাড়ে। গত সপ্তায় গাদিয়ারা আর তার আগের সপ্তাহে কোলাঘাট, বোম্বে রোড ধরে খুবই স্মুদ যাওয়া হয়েছিলো কিন্তু আবার বম্বে রোড না ধরে অন্য কোনো রাস্তায় যেতে মন করছিলো। তাই সে জ্ঞানী মানুষের পরামর্শ মনে রেখে, ফের টাকি।

ভেবেছিলাম, আজকাল রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে চুরুট খান যখন, নিশ্চিত ভাবে রাস্তা গুলো বেশ মাখন এর মতোই হবে। তবে আমার ভাবাটাই ভুল ছিলো, মাখনে কি ভালো করে দাঁড়ানো যায়? অমসৃন তলা না হলে হবে? পিছলে যাবে না চাকা? তাই বারাসাত পেরোতে না পেরোতেই দেখি গাড়িটা বেশ দুলকি চালে চলছে। আহা একই সাথে গাড়িও চড়ছি নৌকাতেও যাচ্ছি এ কি কম নাকি! গান চালালাম তাড়াতাড়ি, এ মুহূর্ত টার মানাসই, 'সাগরে উথালপাথাল বুকেও এই নৌকা চলে'।

সেই বাণে বাণে অন্ধকার দেখতো কুরুক্ষেত্রে সবাই, মনে আছে? খানিকপর আমিও দেখলাম, ইয়ে বাণে বাণে না, ধুলোয় ধুলোয়। তোমার ওই ধূলায় আমি ছিলেম, না কি যেন গান আছে না? কাচ তোলা বলে আমি ধুলো খাচ্ছিনা, কিন্তু উইন্ডস্ক্রীনটা বেশ রঙ বদলে গেছে।এরপর হলো বৃষ্টি শুরু, তেড়েই হলো। আমিও আর গর্ত গুলো একেবারেই বুঝতে অপারগ হয়ে নেচে নেচে চললাম। এরপর একবার থেমে দেখি বাহ বাহ, তেনার চ্যায়্রা ছবি বেশ খোলতাই হয়েছে। কাদার আঁচল দিয়ে গা মাথা ঢেকে চলেছেন।

তবে রাস্তায় চলার মজা হলো, খানিক জীবনের মতো, যখন একেবারেই হাল ছেড়ে দেওয়া গেলো, আর কিছুই পাবার নেই, আশা করার নেই তখন বেশ চমক মেলে। এই যেমন দেখছি রাস্তাটা বদলে আস্ত পিচের রাস্তা হয়ে গেলো, ওই দেখ না দেখ কেমন দুধারে মস্ত মস্ত গাছের ছায়া দিয়ে দিয়ে জুড়ে রেখেছে। জুড়ে থাকাই দরকার বড়, চোখ তুলে তাকাও একবার। ছায়া ছায়া রাস্তা শেষ কিন্তু রাস্তা এখনো গোটাই, ওই দেখো কেমন মাঠ পুকুর এক হয়ে গেছে সব, সারি সারি পাট শুকুচ্ছে রাস্তার দুপাশে, প্যাঁকাটি শুকোতে দিয়েছে।

রাস্তার দুধারে কত নতুন নতুন বাজার, জমকালো সব নামের জায়গা। মিষ্টির দোকান গুলো এসব গাঁ গঞ্জ জায়গায় যেমন হয় তেমনই, সার সার রসগোল্লা আর পান্তুয়া আর দানাদার। ভোঁ ভোঁ মৌমাছি। মিষ্টি গুলোর চেহারা এক্কেবারে আশপাশের সাথে মানানসই, তেমন ভালো দেখতে হয়তো না, খেতেও গরীব মতোই । ইছামতীর কাছে পৌঁছতে চাই এবার। বেলা আড়াইটা বাজে, সেই কখন বেরিয়েছি!

আগেরবারের মতোই এবারেও দেখি সেই একগাদা লোক, বলে মিনি সুন্দরবন গোলপাতা জঙ্গল, ভূমিকন্যার শ্যুটিং, হ্যানাত্যানা যেতে। দুশো আড়াইশো ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কোত্থাও যাবো না। কিংবা যেতেও পারি, এতো ঠিক করে তো আসিনি। আপাতত একটু চরে বেড়াই নিজের মতো। নদীর ধার দিয়ে খাবার জায়গা, ফেরিঘাট পার হবার পর খানিক হাঁটলে একটা মাচা বাঁধা দেখলাম। নিকুচি করেছে কোথাও যাওয়া, মাচায় লম্বা হয়ে নদীর হাওয়া খাওয়ার থেকে আর কিছু আমি চাইনা মোটেও। ওই দূরে ওপারের গাছগুলো বাংলাদেশের। আচ্ছা বাংলাদেশের গাছেদের সাথে ভারতের গাছেদের কথা হয়? ওদের তো টেলিপ্যাথিতে কথা, শিকড় দিয়ে দিয়ে, পাখি দিয়ে দিয়ে, কি বলে? "কিরে ব্যাটা আজ পাসপোর্ট ছাড়া কথা বলিস? হাহাহা, মানুষ গুলো পারেও বল? হ্যাঁ, এদ্দিন ধরে আমাদের দেখে তাও কিছু শেখে না রে উজবুক গুলো? এতো এতো ছানা পোনা তো মাছেদেরও হয়না, সে বুদ্ধি নেই, তারা কাঁটাতার দিয়ে সমাধান খুঁজবেনা তো কি?"

নদীর ধারে মানুষ আসে বোঝাই যায়, একগাদা নোংরা প্লাস্টিক, থার্মোকল ফেলা! সাড়ে চারটে বাজে, দেখি কিছু খাওয়া যাক, নাকি? নদীর ধারে একটা হোটেলে দেখি লেখা, ছাদে বসে খাবারের সুব্যবস্থা আছে। কিন্তু তাদের আবার খাবার নেই। বলল আচ্ছা ওই পাশের দোকান থেকে কিনে উপরে গিয়ে খাও না হয়। বেশ বেশ। আমার তো শীত গ্রীষ্ম বর্ষা ডিম পাঁউরুটি ভরসা। ডিম পাঁউরুটি নিয়ে ছাদে গিয়ে দেখি মোটাসোটা এক হুলো মনে আনন্দে মাছের কাঁটাকুটো খাচ্ছে। ওদিকে নদীর বুকে মেঘ করেছে কালো হয়ে, ওইই দূরে বাংলাদেশে ভেড়ী দেখা যাচ্ছে। নদীতে ইতস্ততঃ মাছ ধরার নৌকা। ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে। সমস্তটা যেন একটা হাতে আঁকা ছবি। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় কাঁপতে থাকা জলে ভাসা নৌকা, কালো মেঘ, হাওয়ার টানে ভেসে আসা কোনো চিৎকার সবটা যেন এই পুরোটা কমপ্লিট করছে, একটুও বেচাল নেই, আবার কোনো একটা না থাকলেও কিচ্ছু অসম্পূর্ণ হবে না! এই আমি আছি এখানে রেলিঙে হেলান দিয়ে, এটাও যেন এই ছবিটার অংশ আবার না থাকলেও ক্ষতি নেই। বোঝাতে পারলাম মনে হয়। এ আমার হিজিবিজি ভাবনা।

অনেক্ষণ পর নীচে নেমে গাড়িতে উঠেছি, তিনি এলেন, টপটপ করে করে বড় বড় ফোঁটায়। একটু পরেই অঝোরে। ফেরার রাস্তায় দেখি মালঞ্চ হয়ে কোলকাতা যাবার দিক নির্দেশ। বেশ তো যাওয়া যাক না। নতুন রাস্তা দেখতেই তো বেরোনো। এই রাস্তাটা সত্যিই ভালো, খুব বৃষ্টি তাই কাচ নামানো যাচ্ছেনা, কিন্তু ঝাপ্সা কাচে দিব্যি দেখাশোনা যায়। ওই যে দুধারে আদিগন্ত ভেড়ী। আরে একটা ভেড়ীর মাঝখানে একটা একলা গাছ কেমন দাঁড়িয়ে দেখ, আরেকটু এগোতে দেখি একটা আধভাঙা নৌকা শুয়ে। এই রাস্তাটাও বেশ ভালো, গাছগাছালিও বিস্তর। একটা মোড়ে দেখি খুব করে চপ, বেগুনি ফুলুরি, পিঁয়াজি ভাজছে। ঝমঝম করে বৃষ্টিতে চারধার শুনশান প্রায়। মাথায় ছিট থাকলে যা হয়। গাড়িটা সাইড করে, ওই ঝমঝমে বৃষ্টিতে হেঁটে হেঁটে চুপ্পুস ভিজে মুড়ি কিনতে গেছি। চুল বেয়ে জল নামছে, এহেহে চশমাটা গাড়িতে রেখে আসা উচিত ছিলো। 
- কাকা দু টাকার মুড়ি দুটো পিঁয়াজি, দুটো আলুরচপ দাও দেখি, আর দুটাকার ছোলা সেদ্ধ হ্যাঁ? 
কাকা গজগজ করে, 'কি সব ছেলেপুলে আজকালকার, এরকম ভিজে কেউ আসে, তাও খাওয়া দেখো! আমাদের ছেলেরা এর তিনগুন খাবে বুঝলি, সব খালি কল্লামি করা, বৃষ্টিতে ভেজার নকশা খালি।'

কিই বা বলি সত্যিই তো এ আমাদের শখের খাওয়া, আমাদের গ্রামের বাড়িতে জমি চাষ করতে আসতো যারা তারা মুড়ি খেতো এক একজন একটা ইয়াব্বড় গামলা ভর্তি করে, থাবা দিয়ে দিয়ে খেতো। চা এর দোকানে কত সময় দেখেছি, এক কাঁসি মুড়ি নিয়ে এক হাতা ঘুগ্নি আর জল দিয়ে মেখে খেতে। যাকগে শখ আহ্লাদও থাকার দরকার বটে, না হলে জীবন বড় গোদা হয়ে যায়।সে কারোর জমিতে চাষ করেও হতে পারে কারোর শেয়ার মার্কেট কিংবা প্রমোশনের গোলোকধাঁধাতেও হতে পারে। শখ জরুরি হ্যায়।

ভেজা গেঞ্জি পরে এসিতে বসলে বাড়ি পৌঁছবার আগেই মরে যাবো, তাই খালি গায়ে বসে স্টিয়ারিং ধরেছি, ব্যাস আমি এখন আমার সেই স্বপ্নের ট্রাক ড্রাইভার। সুতরাং সমস্ত জল জমার উপর দিয়ে দিয়ে ইচ্ছে করে অ্যাক্সিলারেট করে ঝরনা বানাচ্ছি, দুধারের বাইক, গাড়ি সব ভিজিয়ে ভিজিয়ে। হ্যাঁ এবার বলতেই পারো, 'ও আবার কি! এ তো অসভ্যতা। অমন কেউ করে! তোমায় করলে কেমন লাগতো?' ইয়ে খুবই খারাপ লাগতো বটে। খিস্তিও করতাম, কিন্তু ইয়ে আশেপাশে লোককে ভেজাইনি সত্যি বলছি। মাক্কালি। আহ অত কূটতর্ক করার কি নাস্তিক তো কি? তুমি তো মানো তবে?

মালঞ্চ বলে জায়গাটার নাম যেমন সুন্দর তেমন ওর একটা নদী আছে। কি নাম নদীর কে জানে! বাসন্তী হাইওয়েতে উঠেছি যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। বৃষ্টি থেমে গেছে। কোলাব্যাঙের কটরকটর, ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। অদ্ভুত লাগছে। আজ রবিবার বলেই না বৃষ্টির দিন বলেই কে জানে গাড়িও খুব কম। এক জায়গায় পাশের দিকে খানিক জায়গা আছে দেখে দাঁড় করিয়ে আলো টালো সব নিভিয়ে দিয়েছি। বিপজ্জনক কাজ অবশ্যই। কিন্তু ওই পোকা নড়া কেস!

এমন অন্ধকার বহুদিন ফিল করিনি, সে অন্ধকার যেন ধাক্কা মারা যায় এমন জমাট। ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝিঁর আওয়াজ যেন আরো তীব্র। সে অন্ধকার যেন কথা বলে উঠবে এক্ষুনি। আমি শুনতে পাচ্ছিনা খালি, শুনতে আমি কিছুই পাইনা, গাছ, ব্যাঙ, ঝিঁঝিঁ, নদী, ভেড়ি আকাশ, এই অন্ধকার, এই আলো, এমনকি আমার গাড়িটাও কত কি বলে নিজেদের মধ্যে। আমি কিচ্ছু শুনতে পাইনা, বুঝতে পাইনা, খালি দেখে যাই, ছুঁতে চেষ্টা করি নিজের মতো করে.....

যদ্দিন না এ ভাষা বুঝি আমার নিস্তার নাই...বারবার বেরোতে হবে।


2 comments:

  1. Tui amay marbi sala. Kaj hochhe na. Tui bondhu bole proud ami

    ReplyDelete
    Replies
    1. কেন আমি আবার কি করলাম ।😯

      Delete