Sunday, September 30, 2018

হারিয়ে গিয়ে...

 সেদিন আনমনে হাঁটছিলাম। কলেজ স্ট্রীট যাবো বলে বেরিয়েছি, সীতারাম ঘোষ লেন থেকে ঢোকার পর  কোনদিকে যাচ্ছি খেয়াল না করেই হাঁটছিলাম। রাস্তাগুলো এখানে পরে সারানো হয়েছে, উঁচু হয়েছে আর বাড়িগুলো নীচু হয়ে গেছে। আচ্ছা এইরকম ঝুপসি জানলার একতলার ঘরগুলোয় কারা থাকে? আলো ঢোকে? আরিব্বাস কি চমৎকার একটা বারান্দা, এহে ভেঙে পড়বো পড়বো হয়ে গেছে তো। কেউ সারায় না মনে হয়। 

দুপুর খুব এখন। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ্দুর। লোকজন তেমন নেই রাস্তায়, একটা দুটো ছোট ট্রাক যাচ্ছিলো জিনিসপত্র নিয়ে,  তাদেরও আর দেখা যাচ্ছে না কই। 
এ গলি ও গলি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, এ গলিটা আমি চিনিনা। মানে চিনি হয়তো কিন্তু অচেনা লাগছে খুব। এই রাস্তার ধারে এতো ফাঁক ফাঁকা জায়গা ছিলো বুঝি? বাড়ি গুলোও অতটা পুরোনো না। একটা কাক ডাকছিলো কাছে কোথায়, জল তেষ্টা পেয়েছিল হয়তো, কই সেটাকেও তো আর দেখতে পাচ্ছিনা। একটা নেড়ি কুকুরও নেই কোত্থাও। কোথায় যেন কাঁসি ঘন্টার আওয়াজ। আমার ভারী জল তেষ্টা পেয়েছে। রাস্তায় এর ওর কাছে দরজা ধাক্কিয়ে জল আজ থেকে পনেরো বছর আগে খেতাম ঠিকই, তবে এরকম এখন আর করি না। হঠাৎ করে হোঁচট খেয়েছি জোর। হাঁটুর কাছটা গেলো মনে হয়।

"ওই তো,  ওই তো ছোটকত্তা ফিরেছে।" 

একটা বাড়িতে পুরোনো দিনের পোশাক পরা কিছু লোক। আমি কাউকে চিনতে পারছি না এদের, একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি, অবশ্য এরাও আমায় নিয়ে ব্যস্ত না তেমন, একটা ছোট ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত। ওই লোকটা মনে হয় ওর বাবা, গম্ভীর মুখ খুব। আর ওই পিরান পরা বয়স্ক কিন্তু শক্ত চেহারার লোকটা মনে হয় ওর ঠাকুর্দা। ওই খেঁটো ধুতি পরা লোকটা... উমম চাকর মনে হয়। আরো সব লোকজন। আরে পুজোর মন্ডপ দেখছি। দুর্গা পুজো এসময়? এখন তো বৈশাখ মাস! এরা এতো পুরোনো দিনের জামা পরে, ওই দিকে কিছু মহিলা দাঁড়িয়ে, এক মাথা ঘোমটা টানা। কিরকম গোলমাল লাগছে। সিনেমার শ্যুটিং হচ্ছে নাকি? 

"যাও গিয়ে কাপড়চোপড় বদলে নাও। এক্ষুনি খ্যামের পুজো শুরু হলো বলে। মা এর জন্যেই আজ কোনো বিপদ আপদ ঘটেনি। যাও। " 

বাপরে কি দাপট। এরা কারা? এদের বাড়িতে এরকম ঢুকে  গেছি চোর টোর ভেবে না মারধর করে! কিন্তু পুজো কেন এসময়? শ্যুটিংই হবে, কিন্তু ক্যামেরা ট্যামেরা কিছু নেই কেন? কিছু বুঝতে পারছিনা। এহে হাঁটুটা কেটে গেছে অনেকখানি! একটু তুলো পেলে ভালো হতো। ভালো ব্যাথা করছে তো হাঁটতে গেলে। একটু বসে যাই এই সিঁড়ির কোনায় একটু। 

"তুমি কে?"

রিনরিনে গলায় কেউ জিজ্ঞেস করে উঠলো। তাকিয়ে দেখি সেই ছেলেটা। আমি তড়িঘড়ি বলতে গেলাম,  'আমি চলে যাচ্ছি, তোমাদের শ্যুটিং এ ঢুকে পড়েছিলাম মনে হয়, আমি দুঃখিত, আসলে পা টা একটু কেটে গেছে কিনা।'

ছেলেটা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো দেখি। এর পরনেও ধুতি। পুরোনোদিনের কোনো গল্পের শ্যুট হচ্ছে মনে হয়। 

"আমি তোমার কথা ভালো বুঝতে পারছিনা, তুমি বরং এসো আমার সাথে। এদিক দিয়ে এসো, নাহলে কেউ দেখে ফেললে মুশকিল হবে"। 

কী মুশকিল, কেন মুশকিল কিছু বুঝলাম না। কোনো বিপজ্জনক কিছু চলছে নাকি? কিন্তু এই ভরদুপুর বেলা,  কোলকাতা শহরে, কলেজ স্ট্রীট চত্বরে আমায় কেউ বিপদে ফেলবেই বা কেন! বাচ্ছাও না, বড়লোকও না। পুরোনো একটা টিশার্ট আর জিন্স,  ওয়ালেটে একশোটা টাকা কিডন্যাপ করতে চাইলেও করবে না কেউ কারন ঘেমে নেয়ে গা থেকে যা খুশবাই ছাড়ছে আমিই চমকে চমকে উঠছি। যাক এতো ভেবে কি করবো আর যাই বরং এর সাথে। 

ছেলেটার পিছন পিছন তিনতলায় এলাম। উত্তর কোলকাতার পুরোনো বাড়ির খড়খড়ি লাগানো জানলা দরজা। এরকম জানলা আমার ভারী ভাল্লাগে।

" তুমি কে? এটা কিরকম পোষাক? তোমার হাতে এইটা কি?"

কিরকম পোষাক মানে? ছেলেটা কি অপ্রকৃতিস্থ?  গোলমাল লাগছে। নিকুচি করেছে হাঁটুর ব্যাথার। বেরোই এখান থেকে। মোবাইলটা চেক করতে গিয়ে দেখলাম সুইচড অফ হয়ে আছে, অন হচ্ছে না।পড়ে গেছিলাম যখন তখনই গেছে মনে হয়।

"আরে তোমার পা অনেকটা কেটে গেছে দেখছি, দাঁড়াও আমি ছাদ থেকে গাঁদা পাতা নিয়ে আসছি। 

গাঁদা পাতা!! এ কে! মানে ডেটল জাতীয় কিছু নেই?  ডেকে বললাম, 'এই শোনো, তোমার কাছে ডেটল জাতীয় কিছু নেই?'

" ডেটল কি?"

বারো তেরো বছরের ছেলে ডেটল জানে না! না আগে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা দরকার। ওদিকে সে গাঁদা পাতা আনতে গেছে।  তিনতলার একদিকটা ছাদ।  আমি ছাদে গিয়ে পুরো ঘেঁটে গেলাম। আশপাশটা যা দেখছি আর যাই হোক ২০১৮ সালের কোলকাতা শহর না। কিরকম একটা সন্দেহ হলো।

'এই এদিকে এসো জলদি, আজ কত তারিখ? '

কথাবার্তায় যা বুঝলাম আমার তো আক্কেল গুড়ুম!   বৈশাখের ঝাঁঝালো রোদ, পরিশ্রান্ত, হোঁচট ঠিক কিসে কী হয়েছে আমি জানিনা, কিন্তু আমি সম্ভবত কোনো ওয়ার্ম হোলে পড়ে গেছিলাম। আমি  ২০১৮ সালের বদলে ১৯৩৩ সালের শরৎকালে পৌঁছে গেছি! এদের কাউকে আমি চিনি না, এরা আমার কোনো রিলেটিভ না কিন্তু প্রকৃতির কোন রহস্যে আমি আর আমার চেনা জগতে নেই! ভয় পেলাম, ফিরবো কি করে? আমি যদি এক হাজার বার ওই কাজ গুলো ফের করিও আবার আমার জায়গায় ফিরতেও পারি নাও পারি। না ফেরার সম্ভাবনাই বেশী কারন ওয়ার্ম হোলের মুখটা বন্ধ হয়ে গেছে এতোক্ষনে।

দরদর করে ঘামছিলাম, আমার মুখ চোখ দেখে বুঝি ছেলেটা কিছু আন্দাজ করেছিলো। এর মধ্যে সে আমায় যত্ন করে গাঁদা পাতা এনে লাগিয়ে দিয়েছে। ছেলেটার মুখটা ভারী মায়াবী, চোখ দুটো কেমন যেন এইখানে নেই অন্য কোথাও। ক্রমে আলাপ জমে গেলো। ভালো নাম বলল,  দুলাল, এমনিতে খোকা, ছোটকত্তা এইসব বলেই ডাকে। একমাত্র ছেলে না হলেও, এ বাড়ির ছোট ছেলে বলে কথা।  তবে ওর নাকি এসব ভালো লাগেনা। এইটুকু বয়স কিন্তু বেশ ঝরঝরে পরিনত কথাবার্তা।  বন্ধু বান্ধব নেই বিশেষ। এক তো বড়লোক বাড়ির ছেলে, পড়ে গেলে কেউ তুলে ধরে অবস্থা,  তায় ও নিজেও একটু অন্তর্মুখী। পড়াশোনা করে নানান জিনিস নিয়ে, গাছেদের সাথে ভালো রকম আলাপ আছে। আর একটা জিনিস পারে বলল। খুব ফিসফিস করে, পাছে কেউ শুনে ফেলে এমন ভাবে। 

"আমি না বাঁশীতে সুর তুলতে পারি।" 

'আরে বাহ এতো দারুন ব্যাপার। কিন্তু কত্তা এ জিনিস লুকোনোর কি? এতো খুব ভালো ব্যাপার। ' 

আমার মনের আশংকা অস্থিরতা সরিয়ে রেখেই বললাম। চিন্তা করে তো কিছু করতে পারবো না।  বরং যে পরিস্থিতিতে এসে পড়েছি সেটাই জানা যাক! এক নিমেষে আমার জগত বদলে যাবার আগে অব্দি তো জানতাম না, কত কি প্ল্যান করে রেখেছিলাম, প্যারামাউন্টে সরবত খেয়ে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরবো আজ জলদি। মা কী যেন বানাচ্ছে বলছিলো....

"তুমি জানোনা,  আমাদের তো সবাই ব্যবসা করে। আমাদের তাই শিখতে হয়, আমি তো ব্যবসা করতে  চাইনা নতুনদাদা, আমি বাঁশী বাজাতে চাই। আমি অনেক দূরে একটা নদীর ধারে বাঁশী বাজিয়ে মেঘ নামাতে চাই, পাহাড়ে উঠে গান গেয়ে গাছেদের শোনাতে চাই, জাহাজে চড়ে নাম না জানা দেশে যেতে চাই। এরা আমায় খুব ভালোবাসে আমি জানি কিন্তু আমি যে এখানে থাকতে পারবোনা। আমাকে যেতেই হবে জানো, আমি স্বপ্ন দেখি নৌকায় শুয়ে শুয়ে আমি ভেসে চলেছি, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। আমি চলে যাই তাই মাঝে মাঝেই। ধরা পড়ে যাই। আরেকটু বড় হলে আমি আর ধরা পড়বো না দেখো। " 

আমি আমার কথা বললাম। আমারও ভালো লাগত না বাড়িতে থাকতে। কিন্তু যেই টের পেয়েছি আর হয়তো কোনোদিন মাকে দেখতে পাবো না, নিজের বই গুলোয় হাত দিতে পারবোনা, বাবার বকুনি খাবো না...আমার মন কেমন করছে। আশ্চর্যজনক ভাবে আমার লজ্জা লাগছিলোনা ওইটুকু ছেলের কাছে এরকম অকপট স্বীকারে। যেন আমি জানি, ও তামাশা করবে না। কিন্তু এখানে তো থাকা হবে না আমার। বললাম সে কথা। সে ছেলে তৎক্ষনাৎ বলল, আমিও যাবো তোমার সাথে চলো।  

আরে না, ধরা পড়লে কী হবে? তাছাড়া আমি কি করবো কোথায় যাবো কিছুই জানিনা। এ সময়টা আমি চিনিনা। এরকম ভাবে হয়নাকি? সেও শুনবে না, তার বক্তব্য আমি তো যেতামই যাবোই। তোমার সাথে নাও না। আমার তো বন্ধু নেই কেউ। পিছনের খিড়কি দরজা দিয়ে চলে যাবো, এখন অষ্টমীর আরতি হবে সবাই ব্যস্ত। কেউ টের পাবে না। চলো না।

তারপর? তারপর সত্যি সত্যি খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পুজোর ঢাকের আওয়াজ, শহরের কোলাহল ফেলে দুজন অসমবয়সী বন্ধু, অচেনা জগতে চলল। হাওড়া স্টেশন একেবারেই অন্যরকম। একটা ট্রেনে চড়ে বসেছি দুজন। ওদের বাড়ি থেকে আসার সময়েই আমার পোশাক বদলে নিয়েছি,  তাই কেউ তাকাচ্ছেনা তেমন। দু ভাই যেন বেরিয়েছে। সকালে তখন একটু একটু আলো ফুটছে, আমরা একটা স্টেশনে নেমে পড়েছি। লোকজন খুব কম বলে মনে হচ্ছে আমার। না বাঁধানো প্ল্যাটফর্ম।  দূরে একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। আমরা এমনি হাঁটা শুরু করেছি। খিদে পেয়েছে। কিন্তু আমি বা দুলাল কেউইই কিছু করতে পারিনা। বেশ খানিকক্ষণ হাঁটার পর আর যখন পারছি না, একটা গ্রামে এক বাড়িতে একটু জল চাইলাম। বেলা প্রায় দশটা হবে, মুখ দেখে কিছু মনে হলো কিনা কে জানে! প্রশ্ন করল এক গাদা, আমরাও বানিয়ে বানিয়ে, আত্মীয়রা বাবা মা মারা যাবার পর তাড়িয়ে দিয়েছে ইত্যাদি গল্প বলে দিলাম। জল এর সাথে একটু মুড়ি আর বাতাসা পাওয়া গেলো। গপগপ করে খেয়ে ফের পা চালালাম।

অনেক অনেকটা হাঁটার পর একটা নদী দেখে তার পাশে পৌঁছে দুজনেই থেবড়ে বসে পড়েছি। খানিক জিরিয়ে নিচ্ছি চোখ বুজে। অনেক্ষন বিশ্রাম নেবার পর, দুলাল বাঁশী বের করে ফুঁ দিলো। আহা বড় ভালো বাজায় ছেলেটা এ বয়সেই। মন থেকে ক্লান্তি মুছে যায়, খিদে ভুলে যাওয়া যায়।

সত্যি তো ভোলা যায় না। খিদে পেয়েছে যখন বেশ খানিক, দেখি ক্যাপ্টেন চলো যাওয়া যাক,  কিছু খাবারের জোগাড় তো করতে হবে নাকি? পয়সা এখনো কিছু আছে, দুলালেরই টাকা, নিয়ে এসেছিল, টিকিট কেটেও ছিলো কিছু। কিন্তু এই জনহীন মাঠে দোকানই বা কোথায় খাবারই বা কোথায়! 


গ্রামের দিকে শরৎকালের রাতে হিম পড়া শুরু হয়ে যায়। ছোট ছেলেটাকে হিমে ভিজতে দেওয়া যায়না। অন্ধকার নামার আগেই লোকালয়ে পৌঁছতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে একটা গ্রামে পৌঁছনো গেলো। একজনের মুখেই জানা গেলো, নবমীর রাতে যাত্রা বসেছে বারোয়ারি তলায়। সবাই সেখানেই চলেছে। একটু জল পাওয়া যাবে কোথাও? খাবার তো চাইতে পারিনা দুজনের কেউই। যে লোকটা যাত্রার খবর দিচ্ছিল,  সেইই বলল পুজোর মন্ডপে গেলেই জল মিলবে, তবে তার আগে যে কোনো বাড়িতে চাইলেই হবে, ওর বাড়ি এখানে নয়, গ্রামের অন্যদিকে। 

পা চালিয়ে পৌঁঁছনো গেলো। সন্ধ্যারতির প্রসাদ দিচ্ছিলো, মুড়কি, বাতাসা আর নাড়ু। পেটে খানিক শান্তি হতে দুজনে যাত্রার আসরের দিকে চললাম। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে, আমাদের দুজনের কারোরই এতো পরিশ্রম করার অভ্যেস নেই। যাত্রা শুরু হতে বিস্তর দেরী। ঘুম তাড়াতে দুলাল বাঁশীতে ফুঁ দিলো, টুকটাক সুর তুলছে। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে একজন আমাদের সামনে এলো।

  - এই ছোঁড়া তুই বাঁশী বাজাস?

দুলাল ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম কেন বলুন তো? 

  - আপনি কে? 
  - ওর দাদা। 
  - আপনাদের তো এ তল্লাটে দেখেছি বলে মনে হয়না। 
  - না আমরা এ গ্রামের না।
  - অ। শুনুন মশাই। আপনার ভাইটিকে দেখতে বেশ, বাঁশিও বাজাতে পারে টুকটাক দেখছি। যাত্রাদলে দিয়ে দিন। মাসে পাঁচটাকা করে পাবে, খাওয়া, বছরে একজোড়া ধুতি।
  - না না ও যাবেনা।  
  - ভেবে দেখুন। এ গ্রামের জমিদারের সাথে আমার চেনা আছে, ঝামেলার কিচ্ছু নেই।

ঝামেলার যে কিছু একটা আছে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে। আমি তাড়াতাড়ি,  আচ্ছা দাদা ভেবে জানাচ্ছি, বলে তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম। দুলালও চটপট উঠে পড়েছে। আমরা যাত্রার আসর থেকে, স্টেশন কোন দিকে জেনে হাঁটা দিয়েছি। 


স্টেশন এ গ্রাম থেকে মাইল পাঁচেকের দূরত্বে। কিছু করার নেই, লোকটার হাসি আমার ভালো লাগেনি। এখানে জোরজুলুম করলে কিছুই করতে পারবো না। দুলালও দেখলাম টের পেয়েছে, বলল, "আমি পারবো নতুন দাদা। চলো"।  অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে, রাস্তা ভুল করে,  হাঁটাহাঁটি খুবই বিপজ্জনক।  তাও আবার যে রাস্তা চিনিই না। তাই আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম যাত্রার আসর থেকে দূরের কোনো ঘরের রোয়াকে যদি আজ রাত টুকু কাটানো যায় চেষ্টা করা যাক। দু তিনটে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো, চার নম্বর বাড়িটা একটু সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি। সে বাড়িতে গিয়েই আগে সে বাড়ির কর্ত্রীকে দেখতে পেয়ে সাস্টাঙ্গে প্রনাম করে বললাম, 'মা আজ রাত টুকু দু ভাইকে থাকার অনুমতি দিন, আমরা কুটুম বাড়ি যেতে গিয়ে রাস্তা হারিয়েছি। স্টেশন যাবো, কিন্তু এ রাতে আর যাওয়া যায় না। তাছাড়া ভাইটা আমার আর হাঁটতেও পারছেনা'। 

সেকি কথা! বচ্ছরকার দিন! নিশ্চয়ই বাবারা। তোমার ভাই এর বয়সী আমার নাতি আছে, তাদের আসার কথা ছিলো, আসতে পারেনি। থাকো তোমরা। বছরকার দিনে দুটো মুখে দাও। কাল সকালে যেও।
গরম ভাত, ঘি, বেগুনভাজা, ডাল, তরকারি, মাংস,  এতো কিছু জুটবে আমরা নিজেরাও ভাবিনি। দুজন চোখাচোখি করে নিলাম,  খেয়ে হাত মুখ ধুয়েই  বাড়ির কর্তা প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসলেন। আসলে আগেই চেয়েছিলেন, বাড়ির গিন্নীর আপত্তিতে করতে পারেননি। কোথায় বাড়ি, কুটুমবাড়ি কোথায়, আসার পথে যে সব স্টেশন চোখে পড়েছিলো তাদের একটার নাম বলেও ওনার সন্দেহ খুব একটা গেলো না। কাদের বাড়ি, কি নাম। আমি দেখলাম বেশী প্রশ্ন মানেই বিপদ। তাছাড়া দুলাল অত ভালো বানিয়ে বলতেও পারেনা। কিছু গোলমাল বেঁফাস বললেই মুশকিল। তাড়াতাড়ি গিন্নিমার দিকে তাকিয়ে বললাম, বড় ক্লান্ত লাগছে আসলে অনেকটা হাঁটা হয়েছে কিনা।

ব্যাস ও কথাতেই কাজ হলো। বউ এর কটমট চোখের সামনে কোন কালে কেইই বা টিকেছে। সকাল সকাল উঠেই বিদায় নিয়েছি। বেশীক্ষণ থাকা মানেই ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।  আমার কথা শুনলে তো পাগল বলবে। দুলালকে অল্প আধটু বলেছি। ওর কাঁচা মন,  তাই অত অবিশ্বাস করেনি। স্টেশনে গিয়ে জানলাম ট্রেন আসছেই। ট্রেনে ফাঁকা। দশমীর দিন এ সময় আর কে ট্রেনে থাকবে! দুলালকে বললাম,  'এবারে তোকে দিয়ে আসি বুঝলি, আরেকটু তৈরী হয়ে বেরোতে হবে, নিজের মতো থাকতে গেলে আগে নিজেকে তৈরী করতে হয়। তুই আমি কেউইই তেমন তৈরী না।তবে আমার তো থাকার উপায় নেই। তোকে পৌঁছে দিয়ে আমায় খুঁজতে বেরোতে হবে, যদি আমি বাড়ির পথ খুঁজে পাই।'

দুলালের চোখ ছলছল। তর্ক ও করতে পারে না। আমায় ওর বাঁশীটা দিয়ে বলল, "এটা রাখো তুমি নতুনদাদা। আবার আসবে তো?"
 ওর বাড়ির কাছে আসতেই, সোরগোল পড়ে গেলো। 
"ছোটকত্তা ফিরেছে "। 
" একটা লোক সাথে,  অ্যাই কে আছিস একে ধর,  এ তো মেজকত্তার কামড়জামা। চোর ব্যাটা, ছেলে ধরা, আমাদের ছোটকত্তাকে ভুলিয়ে নে গেছিলো, মার ব্যাটাকে"। 

কে যেন আমায় খুব জোর একটা মারলো মাথায়, চোখে অন্ধকার দেখছি, তেষ্টা পাচ্ছে খুব, মুখ থুবড়ে পড়ছি....পড়ছি...

"কী হয়েছে ভাই? মৃগী না গাঁজা? 

চারদিকে ছোটখাটো জটলা, বিকেলের রোদ পড়েছে ভাঙা বাড়িটার গায়ে।
চারদিকের নোংরায়, কোলাহলে বুঝলাম আমি ফিরে এসেছি আবার আমার চেনা শহরে। তবে কি সব স্বপ্ন ছিলো? 

তাকিয়ে দেখি আমার পরনে, ধাক্কাপাড় ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি আর একটা আড়বাঁশী।

No comments:

Post a Comment