Sunday, October 21, 2018

পুজোর গল্প

এবারে পুজোয় কোলকাতায় থাকতে হয়েছিলো বেশীর ভাগ দিন। দশমীতে গিয়েছিলাম খালি । সেসব নিয়েই গল্প খানিক।

*****************************************************************************

পঞ্চমী

"পঞ্চমীতে কি করছিস? অনেক দিন দেখা হয়না, চলে আয় নরক গুলজার করি"। উস্তুম খুস্তুম আড্ডা, মাটন বিরিয়ানি, মিষ্টি খেয়ে ল্যাদ ট্যাদ খেয়ে বিকেলে নেহাত যখনই গা তুলতে হলো ভাবলুম একটু ঘুরে দেখি। ঋকানন্দের সফরনামা চালু না হলে আর চলে নাকি! 
বন্ধুবান্ধব ছাড়া একা একাই বেরিয়েছিলা। সল্টলেক জায়গাটা আমার ভারী ভাল্লাগে, গাছপালা, ঝকঝকে রাস্তা নিয়ে কেমন চুপ করে বসে থাকে।

একা একা একটু তফাতে থেকে উৎসব দেখতে আমার দিব্যি লাগে। এই যে বাবা মা ছেলে মেয়ে নিয়ে রাস্তার দোকানের প্লাস্টিকের চেয়ারে তরিবত করে চাউমিন খাচ্ছে, ওই যে একটা বাবা তার ছেলের হাত ধরে আসছে, ছেলে বলছে, "বাবা, ঠাকুর আমার দিকেই চেয়েছিলো না?" একটা বাচ্ছা ছেলে তার পসরা সাজিয়ে বসেছে, বেলুন, ক্রাউন, শিং। শিংটা সে নিজেই একটা পরে নিয়েছে। হাফপ্যান্টুল, খালি গায়ে লাল শিং, চমৎকার লাগছে। আমার একটা ক্যাপ বন্দুক কিনতে ইচ্ছে করছিলো। নাহ থাক! ঋকানন্দ জানে সব ইচ্ছের জিনিস পেতে নেই....

আইস্ক্রীম, চিকেন, রোল, পান, বিরিয়ানি, ফুচকা কি যে নেই। ডাইনোসর পেরিয়ে তবে দুগগা ঠাকুর, হুঁ হুঁ বাওয়া, এ মোটেও গৌরি না, যে বাপের বাড়ি এসেছে, উনি হলেন ডাইনোসর মর্দিনী। বাচ্ছা গুলো ডাইনোদের ভয় দেখাচ্ছে নিরাপদ দূরত্বে, যেমন আমরা দেখাই না ফেসবুকে? অমনি।

উল্টোডাঙায় ফলওয়ালা আর সব্জিওয়ালার পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হলো যেন পুজো এসেছে বলে কিছু নেইই, আশেপাশে যা হচ্ছে বেবাক ইগ্নোর করে নিজেদের মধ্যে বাজার নিয়ে আলোচনা চলছে। একটা ঘেয়ো কুকুর গজিয়ে ওঠা চাউমিন সেন্টারের পাশে শুয়েছিলো, তার অবশ্য পুজো দিব্যি রোল চাউমিনে চলছে। তেলেঙ্গাবাগানে এরা এটা কি করতে চেয়েছে হ্যাঁ? আমি আবার গোদা মানুষ তো, এমনিতেই ছোট হাত বড় মুখ দুর্গামূর্তি বুঝিনা, তায় থিম গুলো তো আধুনিক কবিতার মতোই দুর্বোধ্য ঠেকে।

হাঁটতে হাঁটতে সেল্ফি ভীড়ে ক্লান্ত লাগে...ঝপাং করে একটা অটোয় উঠেছি, দুটো সিট ফাঁকা এখনো তাও অটো দাঁড়াচ্ছেনা কোথাও। জ্যাম নিয়ে অটোওলাও বিরক্ত হয়ে পড়েছে, 'ছুটি নেবে কবে ঠাকুর দেখতে?' 'অষ্টমী নবমী তো যেতেই হবে ভাই, বউ ছেলেটার পুজো আর নষ্ট করা যায়! লোকসান হবে, হোগগে, বচ্ছরকার দিন, কি বলো হ্যাঁ?' মাঝ রাস্তায় একটা ছেলে হাঁইমাই করে অটো থামালো, তাকিয়ে দেখি তার গার্ল্ফ্রেন্ড রাস্তার ধারে একটা ল্যাম্পপোষ্টের নীচে বসে পড়েছে, নির্ঘাত নতুন জুতোয় ফোস্কা! 
অটোয় উঠে শুনতে পাই বলছে, 'খুব কষ্ট হচ্ছে না রে? আসলে বুঝতে পারিনি এতোটা হাঁটা রে....সরি'।
মেয়েটার গলা ভেসে আসে, 'আহ সরি কেন....গাধা কোথাকার'। 
ফিক করে হাসলো কিনা দেখিনি অবশ্য।

আরো নতুন পুরোনো গল্প তৈরী হোক পুজোয়, আনন্দে, ভালোবাসায়....


*************************************************************************
ষষ্ঠী

উফফ এই ফোনের আর ডিএসেলার ক্যামেরা! সারাক্ষন দুমদাম দাঁড়িয়ে ভীড় বাড়াচ্ছে!প্যান্ডেলগুলোয় ঠাসাঠাসি ভীড়ে, যাদেরই ফোন/ক্যামেরা নিয়ে দুর্গার/থিমের/নিজের/ফুলপিসির/নরেনকাকার/খেন্তিসোনার ছবি তুলতে দেখেছি হাত নাড়িয়ে দিয়েছি....


***************************************************************************
সপ্তমী

পাড়ার প্যান্ডেলে এতক্ষন "চিতাতেই সব শেষ চলছিলো" --- সপ্তমীর রাতের উপযুক্ত গানই বটে!

ও হ্যাঁ সকালে চলছিলো, "পালকিতে বউ চলে যায়, হায় রে শরমে মন ভরে যায়" -- এ গানটার তাৎপর্য কি? মানে পালকিতে বউ গেলে শরমে মন ভরবে কেন? বউ দেখে লজ্জা? ভাগ্যিস গানটা পুরুষ কন্ঠে না, তাহলে ফুলশয্যায় তো বিরাট চাপ ছিলো!


কিংবা ওই উপরোক্ত চিতাতেই সব শেষ কি শরমে জর্জরিত হয়ে হতাশার ফুলশয্যার পরের দিনের গান?

******************************************************************************
অষ্টমী

লুচিতে ডুবে ছিলাম কিনা তাই বিকেলের পঁচানব্বই এর পল্লীর পাঁচ মাইল হাঁটাও মাফ করে দিয়েছি।
তবে সন্ধি পুজো নিয়ে একটা ভাবনা মনে এসেছিলো ঃ
মাঝরাত পেরিয়ে গাল্ফেন এর বাড়ির দোরগোড়ায় হতে পারে শ্বশুর এর সাথে দেখা হওয়াকেই সন্ধিক্ষন বলা হয়ে থাকে!

তারপর উভয়েই উভয়ের দিকে তাকিয়ে(এই উভয় মাল্টিপল, গাল্ফেন এর সাথে এক দফা ও হতে পারে শ্বশুরের সাথে এক দফা), ফ্যাকাশে হাসির ক্ষনটিই সন্ধিপুজো!

ব্যাকগ্রাউন্ড দামামা ধ্বনি--- তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরন যাত্রা যেদিইইইইন যাবে


*******************************************************************************
নবমী

একা একা কোলকাতায় পুজো কাটবে বলে মন খারাপ করেছিলাম পুজোর আগে। তা সাধক মানুষের কি আর লোকের অভাব হয়, কেউ না হলেই নিজেই নিজের জন্য জুটে যায়। কাল অব্দি টই টই করে, খেয়ে, আড্ডা মেরে এমন অবস্থা আজ এক বন্ধুর বাড়ি মাটনের নিমন্ত্রণ ইগ্নোর করে দুপুরে ঘরে ঘুমাবো ঠিক করেছি।

এদিকে সকাল থেকেই মন খারাপ বেজায়। গ্রামের বাড়িতে আজ মাছ ধরতে আসে সকালে, অষ্টমীর লুচি খেয়ে আপোষ করেছি বলে মা তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্টেই মাছ ভেজে দেবে। তার আগে নবমীর চিঁড়ে ভোগ প্রসাদ। তারপর মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াবো, সাইকেল নিয়ে কিংবা পায়ে হেঁটে। আড্ডা। দুপুরে জমিয়ে খেয়ে একটু পুজোবার্ষিকি পড়ব তারপর ফের পালাবো এদিক সেদিক....সেই সন্ধে নামার মুখে বাড়ি আসবো...প্রতিবারেই মা কিংবা জেঠিমা বলবে, 'উহঃ রোদে ঘুরে ঘুরে পুড়ে গেছিস তো'।

এখানে আমি বাজার করে এনে দিলেই মিঠুদি বানিয়ে দিতো হয়তো কিছু, আমি একা আছি বলে ছুটি নেয়নি, কিন্তু ইচ্ছে করেনা....লস্ট চাইল্ডের বাচ্ছাটার মতো না না করতে ইচ্ছে করে খালি। কিন্তু আমি জানি এ ভাবে থাকলে আরো খারাপ লাগবে, বিকেলে বন্ধুর বাড়ি যাবার আগে তাই একটু পাড়া টহল দিতে গেছি।

একটা পুজো মন্ডপে দেখি ঠাকুরটা দিব্যি ভালোমানুষের মতো দেখতে, ভীড়ও নেই। টেবিল ফ্যানের সামনে বসে পড়েছি। ওদিকে কি যেন প্রসাদ দিচ্ছে, চাইবো? নাহ! বাড়িতে কিনা সেধে দিয়ে যায় ধনাদা, বেছে বুছে খেজুর, চিঁড়েভোগ, লুচি,নাড়ু...বেপাড়ায় নবমীর দিন চাইতে বাধে। চুপ করে বসে আছি, দেখি একটা লোক শালপাতার বাটিতে, একটু লুচি,সুজি, চালকলা মাখা দিয়ে গেলো। এরা বুঝি চাল্কলা মাখা খায়? দুধচিঁড়ে না? যাকগে। এও ভারী ভালো খেতে। আরে, শাল্পাতার বাটিতে দুখানা খেজুরও আছে দেখছি!


মনের আনন্দে একটা মশালা ছাঁচ খেতে খেতে বাড়ি এসে শুকতারা পড়ছি...শুভ নবমী। আজকের দিনটাই তো আর পুজো...আনন্দে কাটুক সবার।।

******************************************************************************
দশমী

'রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও, 
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?' 
'ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ 
কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা; 
সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া, 
সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা 
সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না!' 

-জসীমউদ্দিন







শুভ বিজয়া


6 comments:

  1. Replies
    1. শুভ বিজয়া পাপিয়াদি। আমার ছবি আর দিইনি এখানে 😀

      Delete
  2. শুভেচ্ছা বারবার দিলেনিলে ক্ষতি নেই, কাজেই আরও একবার প্রীতিভালোবাসা জানালাম, প্রদীপ্ত। পুজোর গল্প পড়ে খুব ভালো লাগল, ছবিগুলোও চমৎকার। এই রকম প্রতিমা আমার বেস্ট লাগে। দনুজদলনীর থেকে পাড়ার মেয়ে ভাবটাই যেখানে প্রধান। তোমার সামনের দিনগুলো খুব ভালো কাটুক।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ হ্যাঁ চলুক না শুভেচ্ছার পালা, হিংসা দ্বেষ তো আর না। তোমাকেও আমি আবার প্রীতি ভালোবাসা জানালাম।
      থ্যাংক ইউ 😊, ভালো থেকো।

      Delete