Saturday, May 14, 2022

পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা...(২)

লম্বা একটা লোহার বিম আর আড়াআড়ি অনেক গুলো কড়িবরগা মাথা তুললে দেখা যায়। ছোট্ট একফালি দোকানটার গায়ে বয়সের ছাপ পড়েছে। দেওয়ালে পলেস্তারা খসেছে অনেক জায়গায়, কাঠের ছোট চেয়ার টেবিল, কালো হয়ে গেছে দেওয়ালের রঙ।  উপরে নাচা করে রাখা কত সব জিনিস, এক কোনে উঁচুতে কেন কে জানে একটা ধূলোয় ঢাকা মিক্সি৷ বয়সের ছাপ পড়েছে বটে কিন্তু তার এখনো দাঁত পড়েনি, চুল পাকেনি,সুগার প্রেশার কোলেস্টেরল পাকড়ায়নি। কোলকাতা শহরের বুকে নিজের মতো সময় কিনতে পাওয়া যায়। এসির আরামে, কেতাদুরস্ত গদিতে বসে, কেতাদুরস্ত মোহিতো নামের সরবতে চুমুক দেবে? তার দাম আলাদা। আলাদা করে রিসর্ট, ওয়ো ইত্যাদির কথা বলছিইনা। আমার মতো মানুষ যাদের রাস্তায় হাঁটা নেশা, তাদের কাছে এই রকম দোকানের মূল্য বেজায়। চায়ের দাম ফুটপাথের চায়ের দোকানের থেকেও কম। আমার চাহিদাও বেশী না ফলে  এ দোকানে যা যা মেলে, পোচ, ডিম টোস্ট, অমলেট, গোলমরিচ আর মাখন দেওয়া টোস্ট ইত্যাদি আমার জন্য ঢের। কায়দার কাপের কফির চেয়ে বরং বেশী লোভনীয়। তা আমারও যেমন চকচকে উন্নতি নেই, এ দোকানটারও নেই। শ্যামবাজারের মোড়ের মাথায় সারাদিন অগনিত "কাস্টমার" আসলেও নেই। দু ঘন্টা বসে থেকে পঞ্চাশ টাকা বিল হলে হবেওনা। তাতে তো কই এদের মুখে ছায়া পড়তে দেখছিনা?

আমাদের এ দেখার গোলমাল আছে। আমি অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম না, মূল্য স্থির ব্যপারটা আমার আয়ত্ত্বের বাইরে। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের এত অপশন এত স্বাচ্ছন্দ্যেও সুখ নেই কেন? বলতেই পারো নেই কে বলেছে! ও তোনার দেখার ভুল। বেশ তো,  তবে মানুষে মানুষে এত কোন্দল কেন ফেসবুক টুইটারেও। এখানে তো দেশ, বর্ণ, জাতি, টাকার সে অর্থে প্রভাব থাকা উচিত ছিল না। তবে তা হল না কেন? সামান্য একটা জিনিস ভালো বা লাগলেও পাঁচজনে ঝাঁপায় কেন ট্রোল করবে বলে? স্রেফ যশ খ্যাতির ছবি ছাপাবে বলে পাখির বাসা ভেঙে পাখির ছানার ক্ষতি করতে বাধে না।মানুষ তো সুখে আছে, হাতে টাকা আছে তার। রেস্তোরাঁ যাত্রা তার কাছে পারিবারিক ক্যালেন্ডারের তারিখ হিসেবে না, নতুন জামা কিনতে তিথি লাগে না। এত চাই, এত পাচ্ছো তবু অস্থিরতা কমে না কেন?   

এসব কিছুই ভাবছিলাম না ওই দোকানে বসে। কাঠে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে আরাম করে গল্প করছিলাম মোবাইল সরিয়ে রেখে। তার আগে সেই কলেজ স্ট্রীট থেকে হাঁটতে শুরু করেছি। বেশী দূর নয় অবশ্য, অনভ্যাসে তাইই অনেক মনে হচ্ছিল।রাস্তায়  কপিলা আশ্রমের দোকান ভেঙে জায়গা না পাওয়া যুবক ভারী অনুনয়ের সঙ্গে বলছিল সেইই আসলে আসল। ঠনঠনিয়া পার হতেই  উদয়পুরের হাভেলীগুলোর মতো দেখতে নাম না জানা রাণীর প্রাসাদ কত গল্প শোনাতে চাইছিল, সেসব পার হয়ে যেতে হয়। অমৃতর লাল দইটা দোকানের নামকরণের মর্যাদা রেখেছে। তারপর নিয়মিত ক্রেতারাও উঠতে লাগলো, পাশের টেবিলের নতুন আসা খদ্দেরের টোস্ট ফুরিয়ে গেল। চা নেবে কিনা আর কেউ জিজ্ঞেস করে আর কেউ হ্যাঁ বলল না, শাটার আর্ধেক নেমে গেল। 

আর সেই মুহূর্তে আর একবার উপলব্ধি করলাম , সুখ স্বপনে শান্তি শ্মশানে নেহাতই  লরিবাক্য, ভালো থাকতে জানলে দুইই দিব্যি ধরা যায়। এই তো কালিঝুলো দোকানে,  চায়ের কাপে, হাতের ফাঁকে তারা হাজির.....কুড়িয়ে নিলেই হল।

No comments:

Post a Comment