Monday, March 9, 2020

বালিতে কদিন (দুই)

আগের পর্ব

সীবীচ গুলোর নামগুলো সব অদ্ভুত -গুনুং পায়ুং, পাদাং পাদাং! নাম যাই হোক বীচগুলো খুবই সুন্দর। সুন্দর তকতকে,  নীল জল। আমরা খান চারেক বিচ দেখলাম তারমধ্যে মেলাস্টি আর ড্রিমল্যান্ড বিচ দুটো বেশী চমৎকার, বাকি দুটোও দিব্যি।  মেলাস্টি যাওয়ার মুখে একটা ক্লিফ আছে, দুই খানা পাহাড় যেন প্রতিবেশী। এই যে হরেক কিসিমের লোক যায়, ছবি তোলে দেখে মজা নেয় রাত ঘনিয়ে আসলে পরে  তাদের উদ্দ্যেশ্যে বলে নিজেদের মধ্যে"মানুষ গুলোর এই লঘুচিত্ততা কবে যাবে বলতো! একটা মুহূর্ত আটকে রেখে দেবে একটা  ছবির মধ্যে তাও কী হয়!" আমরা অবশ্য লঘুচালের লোক, তাই বিস্তর ছবি তুলে নিলাম। আজ আমাদের ড্রাইভার ছিল রেভো, সে নিজে থেকেই পোজ দাও পোজ দাও বলে ছবি তুলে দিলো অনেক কটাই।


এখানে আসার আগে একটু পড়াশোনা করেছিলাম। তাই কেচক ডান্স এর কথাটা মাথায় ছিল। এটা হয় উলুয়াটু (uluwatu) মন্দিরের ওপেন এয়ার অডিটোরিয়ামে,বিকেলে শুরু হবে ওটা। মন্দিরটা এগারোশ শতকে বানানো, একটা পাহাড়ের উপর। পাহাড়ের ঠিক নীচেই সমুদ্র এসে আছড়ে পড়ছে। ভয়ানক রোদ উপেক্ষা করেই পাহাড়ের গা ধরে পাথর দিয়ে তৈরী উঁচু নিচু রাস্তা ধরে চলছিলাম ও বাব্বা পাঁচ ছটা কচি আর গোদা হনুমান পাঁচিলে বসে খুব আড্ডা দিচ্ছে দেখি! আমাদের দেখে মুখ ভ্যাংচায়নি, কিন্তু গোদাটা কেমন সন্দজনক ভাবে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল দেখে আমরা আবার রিরুট করে নিলাম। চড়া রোদ্দুর, ভেবেছিলাম গাছাপালার মধ্যে দিয়ে যাব,  নাহ বাবা থাক!




গুটিগুটি পায়ে ওপেন এয়ার অডিটোরিয়াম এর দিকে এগোতে দেখি এর মধ্যেই বিস্তর লোক জড়ো হয়ে গেছে। রেভো আমাদের টিকিট কেটে রেখেছিল, পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উঁচু দেখে একটা জায়গায় বসে গেলাম। ব্যাকগ্রাউন্ডটা ঘ্যামা মাইরি, সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সমুদ্রের বুকে, এগারোশ শতকের একটা পাথুরে মন্দিরে বসে, প্রায় একশো বছর আগের একটা নাচ দেখতে বসেছি! কেচক ডান্স কেন বলে তার কারনটা নাচ শুরু হতে বোঝা গেল, এখানে কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হয়না। একদল লোক এক নাগাড়ে গান,  তাল, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়ে গেল খালি গলায় আর সেজে গুজে রামায়নের তিনটে অংশ অভিনয় করে গেলেন আর কিছু কুশীলবরা। চ্ক্চ্ক্চ্ক্চ্ক্...এরম করে একটানা মন্ত্রের মতো বলেই যাচ্ছিল লোকগুলো , কেচক শুনতে লাগে একটানা শুনলে। সব মিলিয়ে ভারী অন্যরকম একটা দৃশ্যকল্প যেন।মারীচ ছদ্মবেশে রামকে বোকা বানালো, নকল আর্তনাদে সীতা চঞ্চল হয়ে লক্ষনকে বকে ধমকে পাঠালো, রাবন বুড়োর ছদ্মবেশে সীতাকে চুরী করলো, জটায়ু বাধা দিলো, তারপর রামের অনুনয়ে হনুমান লাফ দিয়ে সীতার কাছে অঙ্গুরীয় পৌঁছে লংকা কান্ড ঘটালো এসবই হলো ঐ লোকগুলোর চকচকচকচকচচক্াচক্া এরকম অদ্ভুত ধ্বনি আর মাঝে মাঝে কিছু অন্যরকম সুর গলায় তুলে। এদের দেশেও রাম দেখি বাঙালীর রামের মতোই পত্নীপ্রেমে কেঁদে ফেলা নরম সরম রাম। হনুমান এদের লেঙ্গুর এর মতো দেখতে। সীতাকে পাহারা দেওয়া রাক্ষসীরা নাচানাচি করে থাকে। সীতা হয়েছিল যে মেয়েটি তাকে ভারী চমৎকার দেখতে। সব শেষে হনুমান যখন নেচেকুঁদে মঞ্চ মাতাচ্ছে আগুন জ্বালিয়ে, সূর্য তখন লাল হয়ে ডুব দিচ্ছে ব্যাকগ্রাউন্ডে।




ফিরতি পথেও কানের মধ্যে যেন ওই চক্চক্চক্চক্চক্চক্ ধ্বনি হয়েই যেতে লাগল....






আমাদের হোটেলের রেস্তোরাঁটাও বেশ চমৎকার,  রাতের খানা ওই গোরেং চাম্পুরই নেওয়া গেল। কাল সকালে আবার সকাল সকাল ওঠা আছে। হানিমুনে এসে সকাল ছটায় বেরোয়! আমরা মনে হয় খুবই হাবা টাইপ, পইপই করে রেভোকে বললাম,  একটু পরে গেলেও তো হয়, নাহয় নটার বোট নেবো, আটটার না, আর যদি আটটার বোটও নিই তাহলেও সাতটায় বেরোলেই হবে তো! কিছুতেই মানলো না,  অনেক দরাদরাইর পর সাড়ে ছটায় রফা হল। 

আরিব্বাস এই সাত সকালেও ম্যালা লোক উঠে পড়েছে দেখছি! পরে বুঝেছি যদিও, আসলে রোদ চড়া হয়ে যায় কিনা, তাই সকাল সকাল বেরোলেই সুবিধে। আজ নুসা পেনিডা যাব।ওটা আরেকটা আইল্যান্ড, বোটে করে যেতে হবে। বোটের টিকিট কেটে রেভো আমাদের টাটা পরে আক্ষরিক অর্থেই জলে নামিয়ে দিল! জেটি নেই, জল ঠেলেই বোটে চড়তে হবে।  বাঁ পাশে মাউন্ট আগুং কে রেখে একটা ছিমছাম দ্বীপে আমাদের বোট ঠেকলো। এখানে অন্য এক ড্রাইভার আমাদের ঘোরাবে। সে ছেলেটি ইংরেজি প্রায় বোঝেই না। এদিকে আমার তো হাঁ করা স্বভাব। চারদিকে গাছপালা বাড়ি  মন্দির পাহাড় যাইই দেখি হাবলার মতো জিজ্ঞেস করতে থাকি এটা কি সেটা কি, সে তো কিছুই বোঝে না সম্পূর্ণ উল্টো কোনো জবাব দেয়!  খানিক বাদে রনে ভঙ্গ দিয়ে পৌঁছলাম  যে জায়গাটায় তার নাম এঞ্জেল বিলাবং। তার ঠিক পাশেই আছে ব্রোকেন বিচ। চড়চড়ে রোদ উপেক্ষা করেও হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়েছিল অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য পটের জন্যে। 


ঘন নীল জল আর ঝকঝকে নীল আকাশ তার সাথে একটাও নোংরা পড়ে না থাকা পাহাড়ের ধার। এসব জায়গায় হেব্বি হেব্বি হবি ওঠে, ক্যামেরার হাত বিশেষ ভালো না হলেও প্রকৃতিই পোজ দিয়ে ভালো ছবি আদায় করে নেয়। মানুষদের ছবিও ভালো ওঠে, তবে আমরা দুজনেই  খানিক হাবলা মত, আর আমরা অমন পিকচার পারফেক্টও না। তাই আমরা নিজেরা হেব্বি কেত মেরে যে সব ছবি তুললাম তা ওইসব জায়গায় লোকজন যা ছবি তোলে তার তুলনায় নেহাতই পরোটা কাবাব পাশে চারাপোনার ঝোল। তবে আমরা অত দুঃখ পাইনা, আমাদের ভোমলা ছবিতে দিব্যি আনন্দ হয়।  আর অমন চমৎকার জায়গায় গেলে অত পোজ দেবার থেকে হাঁ করে দেখতেই বেশী ভালো লাগে। ব্রোকেন বিচটা আরো ভালো, পাহাড়ের শিলা ক্ষয়ে ক্ষয়ে ন্যাচারাল ব্রিজ তৈরী করেছে আর জলটা নীচ দিয়ে এসে যে পাহাড়ের উপর আমরা দাঁড়িয়ে তারই গোড়ায় এসে আটকে গেছে। 





বোকার মত হাওয়াই চটি পরে বেরিয়েছিলাম আজ। জানা ছিলো না এখানে পাহাড়ি রাস্তা বাইতে হবে। ঘামে ভিজে হাওয়াই চটি  ফস ফস করে বেরিয়ে যাচ্ছে, ঘামে চুপচুপে হয়ে গেছে গেঞ্জি তাতেও উৎসাহ কম নেই আমাদের,paluang cliff থেকে একটা পাহাড় নামলেই  kelingking beach। ওই হড়কানো পা নিয়ে নীচে আর নআ সম্ভব হল না। আমরা উপর থেকেই উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে নিলাম। উঁকিঝুকি না মেরেও উপায় নেই, এখানে প্রচুর লোক এসেছে, মূলতঃ চীন বা কোরিয়া (আমি ঠিক বুঝিনি),  তারা আবার বেশীরভাগ ইনস্টাগ্রামার। ফলে,  সে নানানরকম ভাবে পোজ দিয়ে, বেঁকেচুরে ছবি তুলিয়েই যাচ্ছে,  এমনকি একজন দেখি গাছের উপর উঠে ছবি তুলে দিচ্ছে!! এদের নমো করে ফেরার পথ ধরলাম। 


লাঞ্চে একটা লোকাল রেঁস্তোরায় গিয়ে ফের নাসি চাম্পুর আর মি গোরেং এর একটা অন্য ভার্শন খাওয়া গেল। মানে নামটা আলাদা ছিল, আমি ভুলে গেছি সে নাম।


ভরপেট খেয়ে কেউ সমুদ্রে নামে? নামে না তো? কিন্তু আমরা দুই হাবল, আমরা অত্যন্ত সুন্দর সি বিচ দেখেই ক্ষান্ত দিতে রাজি না, এমন চমৎকার জলে নাইবো না মনোভাব! আজ সুইমিং কস্টুম আনেনি ময়ূরাক্ষী, তাতেও আমরা দমিনি, বিচে পোশাক বিক্রী করছিল একজন, তার থেকেই কিনে চেঞ্জিং রুম ভাড়া করে, ক্যামেরা টাকার ব্যাগ, পাসপোর্ট সব ড্রাইভারের হাতে তুলে   জলে নেমেই....ঘপাৎ। মানে আর কিছুই না ঢেউ এর জোর খুবই, আর তলাতেও বালি না, মরা কোরাল। কী জানি কেমন করে সাহেবগুলো এমন আরাম করে ঢেউ এর তালে স্নান করতে পারছিল! আমরা মনের দুঃখে থেবড়ে বিচের গোড়ায় বসে বসে সে কথাই বলছি অমনি ফের একটা বদমাশ ঢেউ এসে বসা অবস্থাতেও ফেলে দিলো মাইরি!! ক্ষোভে দুঃখে হতাশায় আমরা তুরতুর করে ফের চানের ঘর ভাড়া করতে ছুট। তবে এখানে এ জিনিসটা ভালো, সীবিচ সংলগ্ন জায়গায় চেঞ্জিং রুম আর শাওয়ার রুম ভাড়া পাওয়া যায়। 

ফেরার পথে হঠাৎ করে ঝুম বৃষ্টি! বেশ তীব্র,  সরু পাহাড় ঘেরা রাস্তায় সে বৃষ্টি অদ্ভুত লাগছিল। ড্রাইভারের হাত বেশ ভালো হতে হবে এখানে গাড়ি চালাতে।একটা গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। দু পাশে আমাদের দেশেরই গাছপালা বেশীরভাগ, কিন্তু বাড়ি গুলো সংলগ্ন মন্দির দেখলেই টের পাওয়া যায় দেশে নেই। এমন  মন্দিরের টেক্সচার আমাদের দেশে হয়না। 


আবার সমুদ্রের ধার আবার জল পেরিয়ে পাড়ে ওঠা। রেভো দাঁড়িয়ে ছিল, হাসিখুশি দিব্যি এই ছেলেটা। গাড়ি চালাতে চালাতে  মাঝে মাঝে ঘাড় নাড়ে।  জিম্বারনে সি বিচে বসে সূর্য ডোবা দেখতে দেখতে সু ফুড খাওয়া নাকি হেব্বি ব্যাপার না করলে চরম মিস! আমাদের ঘোরাটা আমরা ওই চরম মিস ব্যপারগুলো রাখতেই হবে এমন করে বানাইনি। তাই আমরা এমন সব জায়গায় গেছি যা ওই টিক মার্ক মার্কা গুলোর সব হয়তো নেই। জিম্বারনও ছিলো না, কিন্তু সূর্যাস্তের খানিক দেরী ছিল, হোটেলে ঢোকার থেকে সি বিচে যাওয়া বেশী ভালো,  রেভোও বলল চলো ভালো লাগবে তোমাদের। সুতরাং গেলাম সেখানে। এখানে পুরো বিচটাই কোনো না কোনো রেস্তোরাঁ নিয়ে রেখেছে, ফলে খাবার খেতে খেতে সূর্যাস্তটা অপশনাল না ম্যান্ডেটরি। জ্যান্ত কাঁকড়া,  বা বরফে শোওয়ানো মাছ যা খুশী চুজ করা যায় ওজন হিসেবে অথবা প্ল্যাটার নেওয়া যায়। আমরা দুজন মিলে অত খেতে পারব না ভেবে,  ওজন হিসেবে কিং প্রন, কাঁকড়া আর কিং ফিশ বেক করতে দিলাম। আস্তে আস্তে সমুদ্রের রঙ বদলাতে লাগলো, আকাশে মেঘ আছে তাও তার ফাঁক দিয়ে দিয়ে হরেকরকম রঙ চুবিয়ে দিতে লাগলো। ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, ওরা মোম জ্বালিয়ে গেল টেবিলে টেবিলে। একদল লোক এসে ভায়োলিন বাজিয়ে শোনাতে লাগলো...খারাপ লাগছিলনা কিন্তু তাও আমরা এক পা দু পা এগিয়ে আলো,  গান থেকে খানিক সরে ঢেউএর কাছে গেলাম। ঢেউএর গর্জনে অন্ধকারে বালির আরেকটা দিন মিশে গেল।(ক্রমশ)




6 comments:

  1. bah bah..darun hocche..chaliye jao

    ReplyDelete
  2. কী সুন্দর জায়গাটা! খুব ভালো ঘুরেছ বোঝাই যাচ্ছে, প্রদীপ্ত। আমারও যেতে ইচ্ছে করছে। আগের কমেন্টের সঙ্গে আমিও একমত। চমৎকার বর্ণনা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ কুন্তলাদি 😇😇

      Delete