Sunday, January 19, 2020

ফির লে আয়া দিল...মজবুর কেয়া কিজে

"ফির লে আয়া দিল, মজবুর কেয়া কিজে....রাস না আয়া রেহনা দূর কেয়া কিজে..."

এই লাইনটাই মনে হয় ঠিক আমার গ্রামের বাড়িতে   যাবার রাস্তায় পড়লে, যখন থেকে হাওয়ার গন্ধ বদলে যায়, জমির আল ধরে হাঁটা হয়, অন্যরকম একটা হাওয়া এসে বয়ে যায়। খুব বেশী আবেগ বোধহয় নেই আমার, আমার সারাদিন কাজের ফাঁকে মনে পড়ে গ্রামের বাড়ির কথা, এমনও না, কিন্তু এলেই ভারী একটা অন্যরকম হয়। সে আমি ঠিক বোঝাতে পারবো না কেমন। 

"আরে পাইলট, কখন এলি?" "কেমন আছিস"?  "আজ থাকবি তো"? এসব কথা খুব বেশী শোনা হয় না বলেই হয়ত। আমাদের বাড়িতে বিস্তর লোক থাকতো এক সময়, জেলেদের হাঁড়ির মত হাঁড়িতে ভাত বসাতে হত, এখন সেই বাড়িতে জনা পাঁচেক লোক থাকে। শীত প্রায় চলেই গেছে, জল মিষ্টি মুখে দিয়ে পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে মাঠে। চড়া রোদের মধ্যেই পিঠে মেশিন নিয়ে একজন আলুতে ওষুধ দিচ্ছে। জানুয়ারি মানে বাংলায় মাঘ মাস, এখনই হাওয়ার ধরনটা দেখো! যেন বসন্ত আর অপেক্ষা করতে নারাজ! আরে ওইটা কি হুশ করে চলে গেল? ভাম না খাটাশ? মোটা মত লেজ, কুকুরের মত দেখতে। মাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে। 

একগাদা ছাতারে পাখি ছ্যা ছ্যা করে উড়ে গেল, ঠিকই তো, এমন জায়গায় এসে ফোন দেখা মোটেও কাজের কথা না। আচ্ছা ওই হলুদ পাখিটা কি ফেলাকাকা? "কোকিল মনে হচ্ছে, পাতকো কোকিল"।  অ্যাঁ কোকিল! হলুদ রঙের! ধুস নির্ঘাত  অন্য কোনো পাখি। এহ না মানুষের বইটা না পড়ে ফেলে রাখা খুবই খারাপ করেছি। দূর থেকে ভুটভুট করে পাম্পের শব্দ আসছে, জমিতে জল সেঁচা হচ্ছে। আমাদের এবারে সর্ষে বোনেনি? হয়ত  অন্য কোনো মাঠে হয়েছে।

 জুতো খুলে মাঠে নামি, কাদা মেখে এগোই,আমগাছটার কাছে যাব, সেই গরমে আমায় আম দিয়েছিল, তারপর থেকে কাছে এসে কথা তো দূর মিনিমাম থ্যাঙ্কিউটাও দিইনি। 

থ্যাংক ইউ হে, মনে আছে আমায়? সেইই যে  সেইই বছর আমায় আম দিলে, কচি আমডালটা কই? দু বছরে এত বড় হয়ে গেছে? দুই না তিন? কথা বলবে না নাকি হে? আমি তো সব জায়গার সব গাছকে বলেছিলাম তোমায় জানাতে, আমি কী করব বলো, বন্যা হল একবার, একবার তো আমি এলামই না। না না অজুহাত হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা শোনো তবে,  আমি সত্যিইই চেয়েছিলাম, তবু আসিনি, আসা হয়নি। মানুষদের নানান রকম থাকে জানোই তো, সব চাওয়া পাওয়া মেলে না যে।  হয়ত আমার আরো বেশী করে চাওয়া উচিত ছিল, যাতে দেখা করতে আসা যায়।

ছাতারে গুলো চুপ করে গেছে। র‍্যাট্যাট্যাট করে করে একটা কাঠবিড়ালী ডাকছে খালি। আমগাছেরা গম্ভীর হয়, আরো মন দিয়ে বলতে হবে। একটা পাতা ছুঁয়ে চোখ বুজে বললাম, থ্যাংক ইউ,  সত্যি সত্যি।  তারপরেই সেই হাওয়াটা আবার দিলো, যে হাওয়াটায় মাথার চুল এলোমেলো হয়, বুকের ভার নেমে যায়, চোখ বোজা যায় আরামে।

" তুমি আমাদের ঘর বানিয়ে দেবে? "

কচি গলায় ডাক শুনে চমক ভাঙে।  দু তিনটে বাচ্ছা মেয়ে। রঙীন ফুলের মত। 

কীরে? তোরা কী করছিস এখানে?

"দেখোনা, আমাদের ঘর তৈরী করছি আর ভেঙে যাচ্ছে খালি।" 

তারপর দেখা যায়, সমস্ত কিছু ছড়িয়ে ফেলা, ভেঙে ফেলা অগোছালো একটা লোক কঞ্চি বাঁধা গাছের গায়ে লাল নীল ওড়না, চটের বস্তা এসব চাপিয়ে ঘর বেঁধে দিচ্ছে তাদের। ঘরের ব্যবস্থা হতেই রান্না বসাতে ব্যস্ত হয়ে গেল।নেমতন্নও ছিল বইকি। কিন্তু ওই আর কি, মহারাজের এসব সয় না যে। পা চালাই ফের। একটা বুড়ি একগাদা কাঠকুটো নিয়ে নড়বড় করে চলেছে। এক বার নামিয়ে ফের নতুন বোঝা নিতে এলো। সাদা শাড়ি কোনোমতে প্যাঁচানো গায়ে। এই বয়সেও এত বোঝা বইতে হয়? মলি পাগলি নিশ্চিন্তে গাছের নীচে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। পাগলদের আর নির্বান পাওয়া লোকেদের তফাৎ কিছু নাই মনে হয়। 

বাড়ির ছাদে এলেই পুরোনো শীতের কথা মনে আসে হুড়মুড় করে। লেপ রোদে দেওয়া দুপুর, কমলালেবুর দুপুর, দিদিদের কয়েতবেল মাখা দুপুর, নীচে বালির পাহাড় করা থাকতো সে সময়, ঘর বানাবার কী একটা প্ল্যান হয়েছিল।আচ্ছা আমি বরাবরই ভীতু মনে হয়, কই কখনো তো ছাদ থেকে বালিতে লাফ মারিনি। কী হত এমন হাত পা ভাঙতো হয়ত।যাকগে,  নস্টালজিয়ায় বাঁচতে আমি তেমন ভালোবাসিনা।যা গেছে তা যাক। বরং আলসেতে ঠেস দিয়ে দেখি   ধলিগাইটা একলা দাঁড়িয়ে জাবর কাটছে, ওই দিকে নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে তালফোঁপরার ঢিপি।মেজদাদাকে বললে ছাড়িয়ে দেবে। বলব না যদিও। কিন্তু এই যে চাইলেই পাবো এই নিশ্চিন্ততাটা বড় জরুরি জীবনে।



খাবার ডাক পড়ে। সাজিয়ে গুছিয়ে বড় যত্ন করে খেতে দেয় দুই জ্যেঠিমা মিলে। ঘরের তৈরী গাওয়া ঘি থেকে ঘরের বানানো আমসত্ত্ব, বড় ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে সবেতে। একবার এক বন্ধু বলছিল, পরের জন্মে, সে কিছুতেই মানুষ হতে চায় না। কেন যে এ বারেই হয়েছে সে জানেনা কিন্তু যদি হবার চয়েসেই দেওয়া হয়, সে মানুষ হবেনা। আমি বলেছিলাম, আমারও মনে হয় আগের জন্মে নির্ঘাত কোনো বদ কুত্তা ছিলাম আমি। মানে এত বিস্কুট খেতে ভালোবাসি দেখেই মনে হয়। হয়ত কোনো এক বেখেয়ালে ভুল করে বলে ফেলেছিলাম, "শালা মানুষে এত বিস্কুট খেতে পায় পরের জন্মে মানুষ হলে ভালো হয়"।তারপরেই এই দুর্দশা, মানুষ হবার এত হ্যাপা সইতে হচ্ছে!
কিন্তু এই যে এত মানুষের এত অকারণ  ভালোবাসা আমি পাই, শুধু মানুষ কেন গাছেদেরও পেয়েছি,কেউ না জানুক আমি জানি সে কথা....এত মায়া এত ছায়া এসব বড়ই মহার্ঘ্য জিনিস। হ্যাঁ সফল সুদর্শন ঝকঝকে পুরুষ আমি নই কিন্তু আমার পাওয়ার ঝোলাটাও কম না...প্রতিদিনের খারাপের মধ্যে যে ভালোটুকু, সে দিয়ে কুড়িয়ে বাড়িয়ে বলে ফেলাই যায় হয়ত, পরের বারেও মানুষ হলে এত ভালোবাসা পাবার ঝোলা নিয়েই মানুষ হলে মন্দ হয়না।


No comments:

Post a Comment