Monday, December 24, 2018

মাধুকরী

একপাশে ছোট ছোট বাড়ির মাথা দিয়ে দেখা যাচ্ছে খোপ খোপ আল দিয়ে আলাদা করা মাঠ, জায়গায় জায়গায় ধান কাটা হয়ে গেছে, আর একদিকে কাদা মাটির চড় নিয়ে বয়ে চলা রায়মঙ্গল। তার বুকে একটা দুটো নৌকা কখনো কখনো।

এরকম একটা জায়গার ছবিই দেখছিলাম কবে যেন, কোন সময় জানিনা কিন্তু এই নদীর ধার এই গ্রামের ধারের রাস্তা, এই আলসে দুপুরে ছোট পুকুরে জাল টানার শব্দ এ আমি চিনি, প্রিমনিশন কিনা জানিনা কিন্তু আমাকে এখানে আসতেই হত। রবিবারের শীতের মেঘলা দিন, হিসেব কষা লোকের জন্য আদর্শ ল্যাদ রবিবার। বাজার করা স্কিপ করে দাও, খিচুড়ি খাও শীতের ফুলকপি দিয়ে আর গায়ে কম্বল চাপিয়ে একঘুম। কিন্তু ঋকানন্দের যে ঘরে সয় না, বুকের মধ্যে ছটফট নদীর সাথে থাকতেই হবে, বেরোতেই হবে। তাই এই বেরিয়ে পড়া। কোথায় যাচ্ছি সঠিক জেনে বেরোইনি, সায়েন্স সিটির পাশের রাস্তা ধরে টাকি থেকে ফিরেছিলাম যেদিন সেদিনই ঠিক করেছিলাম, ওই গাছ পালা ছাওয়া চমৎকার রাস্তাটা ধরে আরো অনেক খানি আমায় যেতে হবে। নদীর কাছে।

রাস্তাটা সত্যিই বড় ভালো, মসৃন পিচ, দুইধারে গাছের পাঁচিল। একদিক দিয়ে একটা খাল বইছে, খালের ওদিকে কলাবাগান। এগোতে এগোতে ক্রমে রাস্তার দুধার বদলায়। ফুলকপি, সর্ষেবোনা চাষের ক্ষেত, পেরিয়ে এখন খালি ভেড়ির জল। একটা লোক সাদা পাউডার এর মত কী যেন ছড়াচ্ছে জলে। ওদিকের ভেড়িতে একটা লোক নৌকা ঠেলছে নিজে জলে দাঁড়িয়ে। আমার এইরকম হুটহাট বেরোনোয় গন্তব্যর থেকে রাস্তা জরুরী থাকে। এই বিস্তীর্ণ আকাশ, বিস্তীর্ণ জলাভূমির মাঝখান দিয়ে কালো চকচকে রাস্তা ধরে ছুটে চলায় যেমন আনন্দ হয়, তেমনই হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়তেই যেন আনন্দ। আমার তো সব সময়েই তাই। ছুটতে ছুটতে ছুটতে যখন ফিনিশিং লাইনের মুখে আমার আর খেলতে ভালোলাগেনা, ইচ্ছে করে আমার স্বপ্নের সেই জায়গাটা, একটা বটগাছের কোলে, নদীর ধারে আমার আস্তানায় বসে থাকবো। জানি ও আমার সইবে না বেশীক্ষন। নিস্তরঙ্গ একটানা জীবন ভালোলাগলে রবিবারের সকালে রাস্তায় থাকতাম না।

কোথা থেকে কোথায় চলে গেছি। আসলে এ সেই অর্থে ভ্রমণ কাহিনী তো না। চলার গল্প। বাইরে বেশ ঠান্ডা আছে। কোলকাতা ফেলে এসেছি বোঝা যায়। রাস্তায় নানান রকম ফেস্টুন টাঙানো আছে। কেউ একজন জনপ্রতিনিধি আসবেন, তার জন্যে। নানান রকম অঞ্চল থেকে নানান রকম লোক তাকে স্বাগত জানায়;আড়ি পদবীর একজন, কাইজার নামের একজন। আচ্ছা কাইজার কী জানে তার নামের মানে? আর আড়ি বেশ ছোটবেলায় বলত, আমি আড়ি আর তার বান্ধবী বলত আমি ভাব?

এ জায়গার নাম গুলোও বেশ। ঘুষাঘাটা। কবে কারা ঘুষোঘুষি করেছিল কে জানে! মীনাখাঁ। নেমে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে মীনা খাঁ কে ছিলেন? কী করতেন? সামনে একটা মোটর ভ্যানে এক মিঁয়া চলেছেন তার কালো কাপড়ে মোড়া বিবিকে নিয়ে। ভারী যত্ন করে মাঝে মাঝে কাপড়ের তলা থেকে খাবার নিয়ে বাচ্ছাকে আর বাচ্ছার বাপকে কি যেন দিচ্ছে। আমি পাশ কাটিয়ে যাই। এলাহী মালিক লেখা বাসকে পিছনে ফেলে।

পথের সাথী বলে সরাইখানা টাইপ হয়েছে আজকাল। হিসি করতে গেছি সেখানে, দেখি থাকার জন্য বিস্তারিত নির্দেশিকা। " আমরা ভদ্র দম্পতিদের থাকতে দিই" থেকে "ম্যারেজ সার্টিফিকেট থাকা জরুরী", " একলা মহিলার প্রতি শালীন ব্যবহার করবেন"। বাপ্রে সরাইখানা না নীতিশাস্ত্রমালা। ওখানে যিনি পয়সা নিচ্ছিলেন, সেই দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম নদী কোথায়? ধামাখালিতে? 
- হ্যাঁ। কেন? নদী খুঁজছ কেন?
- এমনিই...নদী দেখবো।
- ও। আসলে অনেকে মনে দুঃখ নিয়ে নদীতে যায়,তাই, খুঁজছ কেন জানতে চাইছি।

বোঝো! আবার! আচ্ছা আমায় দেখলে কি সুইসাইডাল মনে হয়? নাকি একা একা ঘুরে বেরাই বলেই? যাকগে। তাকে আস্বস্ত করে বেরোলাম ফের। ধামাখালীর আগে রাস্তা এখনো তৈরী হচ্ছে৷ রাস্তা বানানো দেখতেও আমার ভারী ভাল্লাগে। কিন্তু এখন তো নদী দেখবো আগে। 
ধামাখালী জায়গাটা ছোট্ট গঞ্জ মতন জায়গা। গঞ্জ শব্দটা এখন আর ব্যবহার হয়না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে বইতে যত গঞ্জ পড়ে যেমন কল্পনা করেছি এটা তেমন জায়গা। বাস গুলো সব এসে এসে এখানেই থেমে যায়। একটা গেস্ট হাউজ আছে পর্যটন বিভাগের। তার বাগানে দুটো নধর কুকুরছানা একটা রুমাল নিয়ে খানিক উস্তুম খুস্তুম লড়াই করে নিলো। শেষ অব্দি যেমন সব বোকারা করে, রুমাল ফেলে নিজেরা লড়াই করা শুরু করলো।



এখান থেকে ফেরী করে করে এ ঘাট সে ঘাট, সে গাঁ, করা যায়। তিন টাকা টিকিট কাটতে গিয়ে টিকিটবাবুর মাথা খেয়ে নিয়েছি। কোথায় যায়? সন্দেশখালী? আর? বড় তোষপুর, ছোট তোষপুর। আমি প্রথমে বড় তোষপুরকে পরিতোষপুর শুনেছি। ভাবছি অবাক হয়ে, পরিতোষ বলে একটা লোক হয়ত এখানে বসতি গড়েছিলো। তোষপুরের লোকেরা ভারী খুশিতে থাকে? আগেকার হাতে টানা নৌকাগুলোতে মোটর লাগিয়ে নেওয়া নৌকা। সে নৌকায় সবাই ওঠে, সাইকেল, মোটর সাইকেল, শিশু, বুড়ো, বাদামওলা, ছোলামাখা ওলা। রায়মঙ্গলে কামট থাকার গল্প পড়েছি কত্ত। কামটে এসে কুচ করে হাত পা কেটে নিয়ে যায় কেউ টেরও পায়না। জায়গাটা লাল হয়ে যায় খালি। আমি হাত দিলাম জলে, কই কামট? বাচ্ছা, মানে একেবারে দুধের বাচ্ছা, তাদেরকে বুকে নিয়েই নৌকার সরু দেওয়ালে বসেছে, প্রাণে ভয় নেই এদের দেখি। অবশ্য এ অঞ্চলে ভয় থাকলে বাঁচাও যাবে না।

সন্দেশখালীতে অফিস কাছারি আছে শুনেছি, তাই ওখানে নামার মানেই নেই। লাস্ট স্টপ ছোট তোষপুর ওখানেই নামা যাক। ঘাটের কাছে একটা মিষ্টির দোকান, আর এক দুটো দোকান আছে ব্যাস। ধামাখালিতে হোটেল মোটেল ছিল। নদীর পাশেই বাঁধ, তার দুধারে কয়েকঘর করে করে লোক। আসল গ্রাম হুইই ওই দিকে। ভ্যান যায়। আমি হাঁটা দিই নদীকে পাশে রেখে। অভাবী মানুষদের বাস এখানে কিন্তু গরীব না, মানে বোঝাতে পারলাম না না? ধরো পাকা বাড়ি নেই, কিন্তু পেটে ভাত নেই বা মনে শান্তি নেই এমন গরীব না। । দিব্যি রোদে বসে কেউ উকুন বাছছে, কেউ রোদ পিঠ করে খেতে বসেছে। এক বাড়ি থেকে রেডিওর বা টিভির আওয়াজ আসছে। প্রায় প্রতি ঘরেই গরু বা ছাগল বা শুয়োর পোষা আছে৷ একটা ছাগল ছানার আবার আমায় ভারী পছন্দ করে ফেলেছে। আরে এ তো আমার সাথে সাথেই আসছে, আরে কতদূর যাবি রে? হারিয়ে যাবি তো! আমি কিন্তু ফিরবো না এ পথে। আমি থমকালে সেও থমকায়, আমি চললে সেও।ওরে বাবা সামনে একটা বড় মোরগমশাই যে! 'ও মানুষ দাদা তুমি থামলে কেন, চলো না। আমায় যদি ঠুকরে দেয়!'
আচ্ছা আচ্ছা চল যাচ্ছি। মোরগ, বড় শুয়োর সব পার হয়ে অনেকটা রাস্তা আসার পর, যখন ছাগল ছানাটা বুঝেছে এ পাড়া তার একেবারেই পরিচিত না, বেজায় ভয় পেয়েছে। ম্যা ম্যা ব্যা ব্যা করে সে কীই কান্না। ' ও মা তুমি কোথায় গেলে? আমি তো হারিইয়েই গেছি, আমায় নিতে এসো না'। 
ভারী মুশকিল হলো তো! ওই তো আরো কটা ভেড়া আর ছাগল চড়ছে, ওদের সাথে ভিড়ে গেছে। যাক! না হলে এর জন্যেই আমায় ফিরতে হত!

একটা বেনে বৌ শিরীষ গাছের ডালে বসে টুকটুক করে ডেকেই পালালো। ওই দূরে একটা নৌকা যাচ্ছে কোথায় যেন। নিজেদের পুকুরে জাল ফেলছে দাড়িওয়ালা একজন। আর তাকে ঘিরে কয়েকজন। শীতের দুপুর গড়িয়ে চলেছে। ধানের গাদায় শুয়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছে একজন। ফুরুত করে দুটো ছোট্ট পাখি লাফালাফি করছে। তিনটে রাজহাঁস পুকুরে নেমে আরাম করে স্নান সারছে। স্নান সেরে ফিট বাবু হয়ে ডানা ঝেড়ে, টুকটুক করে হেঁটে ফিরছেন ওই যে। ভারী রাজকীয় ভঙ্গী কিন্তু। বাঁদিকে মা মুরগীটা তার ছানা গুলোকে নিয়ে দানা খুঁটছে। চারদিকে বড় শান্তির ছবি। আমার খিদে পাচ্ছে, অনেক্ষণ হাঁটছি কিনা। আচ্ছা এ রাস্তা ধরে পৌঁছয় কোথায়?

আরো অনেকখানি হাঁটলে আতাপুরের ঘাট পড়বে, একজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো। আতাপুরের ভূত বলে একটা গল্প ছিলো না? ওই ঘাট থেকে নৌকা মিললেও মিলতে পারে ধামাখলী ফেরার। না পেলে? দেখা যাবে খন। আতাপুরের ঘাট দেখতে ইচ্ছে করছে। একটা ছোট্ট ম্যানগ্রোভের জঙ্গল, পার হয়ে হাঁটছি হনহন। নৌকায় রঙ করছে এক বুড়ো, আর তার ছেলে। টায়ার নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে আসছে একটা ছেলে, আমি হাত বাড়িয়েছি যেই অমনি ভুরু কুঁচকে টায়ার খানা সরিয়ে দে দৌড়। একটা ছাগলকে ভড়কি দিলাম, ব্যা ব্যা আওয়াজ করে। দুটো হাঁস পাখায় মুখ গুঁজে গেঁড়িঘুম দিচ্ছে। ওইতো একটা দোকান মত। ওটাই আতাপুরের ঘাট মনে হয়।

ঘাটে একটা নৌকায় মাল উঠছে। শেষ নৌকা চলে গেছে, আর ধামাখালী যাবার নৌকা পাবো না। তাহলে? যে ভ্যান থেকে মাল নামছিলো তারাই নিয়ে গেলো, ভাড়া নিয়ে, ধুচনোখালী না কী যেন নামের একটা জায়গায়। ওখান থেকে ফের ভ্যান, এবার গ্রামের মধ্যে দিয়ে, পিচের রাস্তা ধরে। দু ধারে সাজানো গাছ, ঝকঝকে রাস্তা। এহ বৃষ্টি এল এক দু ফোঁটা, ঠান্ডা হাওয়া, শীতের বেলা পড়ে গেছে।

খিদে পেয়েছে। কী খাই? তুষখালির বাজারে, মিষ্টির দোকান থেকে সিঙারা, বোঁদে আর তার পাশের দোকান থেকে চানাচুর কিনে ঠোঙায় হাত দিয়ে দিয়ে সব কিছু দিয়ে মুড়ি। নদীর পাড়ে বসে বসে৷ এক দুটো নৌকা এলো, গেলো। আতাপুরের ওদিকের গ্রাম গুলোয় যাওয়া হলো না, আজ থাকতে হত তাহলে। এহ কবে এমন হবে, ফেরার কথা না ভেবে গ্রামের পর গ্রাম, নদীর পর নদী পার হয়ে হয়ে যাব।

অনেক ক্ষন পর অন্ধকার হবার মুখে নৌকায় উঠে ফিরতি পথ নিয়েগি। যদি বলো কী দেখার আছে? আমি তো এক কথায় উত্তর দিতে পারবো না। কিছুই নেই হয়তো। যদি জিজ্ঞেস করো কেন বেরোই এমন, তারও উত্তর জানা নেই। কিন্তু ওই নদী পাশে নিয়ে শীতের দুপুরের গ্রামটা, ছোট্ট ছাগল ছানাটা, ঝোপের পাশে মৌতাত করে সিগারেট খাওয়া ছেলেটা, তুষখালির বাজারে আমার সিঙারা চানাচুর বোঁদে মুড়ি দিয়ে লাঞ্চ করাটা আমার পাথেয়। সবার পথ এক না, সবার পাথেয়ও এক না। তাই আমি বলতে পারবো না, ঠিক কী আছে, ওই মরা রোদের গ্রামটায়....রাস্তাটায়..আমার পাথেয় টুকু রাখা আছে খালি এই জানি।









No comments:

Post a Comment