Saturday, December 11, 2021

মহারাজ, একি সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে (পর্ব দুই)

"বাইরেটা একবার দেখ রে গিয়ে"।
তড়াক করে উঠে ঘুমভাঙা চোখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই স্থির হয়ে গেলাম। বারান্দায় দাঁড়ালে অনতিদূরেই হিমালয়ের বরফ ঢাকা চুড়ো। সামনে বিয়াস নদী বয়ে চলেছে। মনে  হয় চুপ করে দাঁড়িয়ে এই  জীবনকে, এই আকাশ বাতাস  পাহাড় নদীকে, প্রনাম জানাই। রোজকার না পাওয়াগুলো ঠান্ডা হাওয়ায় উড়ে যায়, বুকের ভিতরটা শান্ত শীতল হয়ে দাঁড়ায়।




 


রাজা শৌখিন, রুচিবান ছিল মানতেই হবে।  কী দেখবো সেটা তো আসলেই নিজের উপর তাই একই জল হাওয়ায় পুষ্ট হয়েও সবাই সব দেখতে পায় না।  যাই হোক, অমন সটান সতেজ সকালে স্নোক্যাপ মাউন্টেউন, উপত্যকা আর কাঠ আর পাথদের তৈরী রাজপ্রাসাদ এ নিয়েই এমন বিভোর হয়ে গেলাম, ধুত্তোর রিভার র‍্যাফটিং করার ম্যালা জায়গা আছে ও পরে করব খন বলে কাটিয়ে দিয়েছি। একটা চমৎকার মন্দির আছে, সে মন্দিরে ঠাকুর দেবতা নেই, একটা পাথর আছে।  হিমাচল তো শুধু স্নো ক্যাপ মাউন্টেইন দেখার জায়গা না, এখানকার লৌকিক অলৌকিক বিশ্বাস, গল্পগাথা, আচার আচরণ সব মিলিয়ে আলাদা একটা অনুভূতি তৈরী করে দেয়। এখানেও গল্প শোনা গেল, এই নাগগরের এই শিলাটা নাকি এক ঝাঁক মৌমাছি নিয়ে এসেছিল। দেবতা আর দানবদের যুদ্ধে দেবতারা হেরে যাচ্ছিলো প্রায় টায়ার্ড হয়ে। তাই তারা রূপ বদলে মৌমাছি হয়ে এই শিলাকে এখানে সরিয়ে আনে আর নিজেদের শক্তি রিচার্জ করে নেয়। প্রতি বছর আশপাশ সব গ্রাম থেকে দেবতাদের নিয়ে আসা হয় ( যুগ বদলেছে, এখন দেবতারা নিজেরা আসতে পারে না),  এইখানে নিজেদের রিচার্জ করে নেবার জন্য। হিমাচলের দেবতাদের গল্প গুলো একটু আলাদা না? এরকম রিচার্জ এর গল্প আমি শুনি অন্য কোথাও। আর্য অনার্যদের যুদ্ধ ইতিহাস কি খানিক লুকিয়ে থাকে এসব গল্পে? যাকগে এদের আচারটা বেড়ে খেতে, স্থানীয় কি একটা স্পব্জি দিয়ে বানায়।  আলুর পরোটাটাও চমৎকার।  আমরাও রিচার্জ করে নিলাম।

নাগ্গ‌রের মন্দির। দেবতার মূর্তি নেই , শিলা খন্ড আছে, যেখানে রিচার্জ করে দেবতারা!






আমরা অনেকেই ভাবি পাহাড়ে গিয়ে থাকবো ঠিক একদিন, পাহাড় দেখবো, ছবি আঁকবো বা গান গাইবো বা বাগান করব এরকম কিছু। তা আমরা ভাবি আর রুশ সাহেব নিকোলাস রোইরিখ নানান কাজকর্ম করে, হিমালয়ের প্রেমে পড়ে সস্ত্রীক নাগগরে বাড়ি বানিয়ে রইলেন। সে বাড়ি আর ছবি গুলো মিউজিয়াম করে দিয়েছে তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি।  আমি ছবিটবি তেমন বুঝিনা, তাও আমার বেজায় ভালো লাগল। আর বাড়িটার কথা আর কি বলব, পাহাড়ের গায়ে গাছপালা ঘেরা দোতলা কাঠের বাড়ি।দোতলার স্টাডি কিংবা বারান্দা থেকেই হিমালয় দর্শন হবে। এদিক সেইক দেখতে দেখতে  পাক খেয়ে খেয়ে নীচে নেমে সমাধির জায়গাটায় পৌঁছেছিলাম। ইচ্ছে করে একটু নীচে সমাধিস্থল পছন্দ করেছিলেন মনে হয়। অযথা ভীড় হবে না, এতটা পাহাড় বেয়ে নামতে হবে বলে, এদিকে পাতা আর ফুল ঝড়ে পড়বে।  মানুষ মরলেই সব শেষ, কারন আদতে এটা যন্ত্র কিন্তু যন্ত্রের তো মেমারিও থাকে। মানে ভিডিও বা ফটো জিনিসটার সাথে অপরিচিত একজন লোকের কাছে সেটা ভূত বলেই মনে হবে, অন্য ডাইমেনশন থেকে কেউ এসে আমায় কিছু বললে সেটা আমার কাছে অলৌকিক অবিশ্বাস্য কিংবা ভৌতিক বলে মনে হবে। তেমনই মানুষ মরে গেল সেই যন্ত্রের ছাপ কোথাও একটা রয়ে গেল কিংবা আসলে অন্য ডাইমেনশনে অন্য জগত শুরু হল? গাছ, পাহাড়, নীল আকাশ, নদী, পাখির ডাক শুনতে শুনতে শুয়ে থাকার বহু পুরোনো  ইচ্ছেটা জোরদার হচ্ছিল। পাক মেরে মেরে ফেরার পথে দেখি একটা বেঞ্চে একজন পাহাড়ি মহিলা শুয়ে আছেন আরামে। ঝাঁটপাট দেওয়া হয়ে গেছে, রোদ উঠেছে আর কি চাই!


দু বছর ধরে টানা ঘরে বসে কাজ করে ফিটনেসের বারোটা বেজে গেছে। একশ মিটার উঁচুতে মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে জিভ বেরিয়ে যাবার জোগাড়। রাস্তাটা যথারীতি গাছে ছাওয়া, চড়াই এর মাথায় একটা এই মস্ত লোমওয়ালা কুকুর বসে আছে  অভ্যর্থনা করতে। নিকোলাস আর হেলেনা দুজনেরই একখান করে পালকি ছিল,  ভারতীয় চাকর বাকরেরা বয়ে আনত তাই বুড়ো বয়সেও থাকতে কষ্ট  হয়নি। কে বলতে পারে হয়ত পালকিতে চড়েই মিনিমালিজমের তত্ত্ব আওড়াতেন, যেমন দামী এসইউভিতে চড়ে ইউটিউব ভিডিওতে মিনিমালিজমের তত্ত্ব আওড়ানো হয়। তবে যাই হোক  রোইরিখ সাহেব আর তাঁর স্ত্রীর কাছে ঋণী থাকার কারন অনেক, আধ্যাত্মিকতা, অভিযান, শিল্প, শান্তির প্রচার, সব মিলিয়ে মানুষটা বেশ একটা ছাপ রেখে গেছেন।


ভুন্টুরে পার্বতী আর বিয়াস মিলে গেছে, আমরা পার্বতী নদীর ধার ধরে ধরে কাসৌল এর দিকে যাচ্ছি। পার্বতী নদীটাও একটা কিশোরী মেয়ের মতো বইছে,  আর দূরে বরফ পাহাড়ের চুড়ো দেখা যাচ্ছে। আহা, আকাশটা বেজায় নীল,আর হাওয়াটাও তেমনই তকতকে। এখানেই থেকে গেলে হয় না? হিমাচলে আরো অনেকবার আসতে হবে। এই উদার করা প্রকৃতি থেকে কতদূরে বাস করি, "লক্ষ্য শূন্য লক্ষ বাসনা"। খুব একটা ধার্মিক না বলেই হয়ত মনিকরণ তেমন মনে দাগ রাখেনি যতটা কসৌল আর তার চারপাশটা রেখেছে। যদিও শিখদের এই অক্লান্ত পরিশ্রম দেখলে শ্রদ্ধা করতেই হয়। কোনো আলাবেজার নেই, বড়লোক গরীবলোক যেমনই হও একই মাটিতে বসে একই খাবার খেতে হবে। আমাদের কিছু কিছু ধর্ম সংঘ আছে যারা ডোনেশনের উপর খাবারের বা প্রসাদের তফাৎ করে। এদের সেসব নেই, এটাই বড় আনন্দ দিয়েছে। ফিরতি পথে কুলুতে একটা বৈষ্ণোদেবীর মন্দির আছে। সে মন্দির তিন তলায়, সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। মা দেখলাম উঠেও গেল। ভয় পাচ্ছিলাম,মা এর পায়ের হাল খুবই খারাপ, তাও উঠে গেল দিব্যি। ধর্ম বা ভগবান ব্যপারটা যদি কোনোদিন প্রমানিত হয়ে যায় কিছু নেই ফক্কা সেদিন ওই লোকগুলোকে অল্টারনেট কিছু দিতে হবে,  না হলে সে প্রমান না করে দেওয়াই ভালো। 





ওই মন্দিরের উলটো দিকেই নদীর ধারে একটা চা ওয়ালার থেকে চা খেতে খেতে দেখছিলাম, বিকেলের সূর্য আলো ছায়ার খেলার খেলছে পাহাড়ের উপর। কাজকাম শেষ আজকের মতো, শাটডাউন করার আগে একটু আড্ডা দেওয়া আর কি। দুপুরে খেতে দাঁড়িয়েছিলাম একজায়গায়, একটা ছোট্ট চায়ের দোকান, স্থানীয় কিছু বিস্কুট, লজেন্স, ম্যাগি, ডিম নিয়ে যেমন হয় আর কি। ইন্টারেস্টিং হচ্ছে তার কাছে এক থলি আখরোট আছে, আর পিছনে নিজস্বে একটা তিরতিরে ঝর্ণা, উনুনের পাশে বসে আখরোট ভরে ঠোঙায়, আর ঝর্ণা থেকে জল ভরে আনে মাঝে মধ্যে উঠে। সেই সময়টা আমি হয়ত বসে বসে রেভিনিউ ক্যালকুলেট করি কিংবা অটোমেট করি কোনো ক্যালকুলেশন। জীবনটা এমন সোজা সরল হলে হয়ত আমার ভালোলাগত না, একজায়গায় বসে শান্ত হয়ে থাকাটা তো শিখলামই না এ জীবনে কিন্তু তাও এইসব এতাল বেতাল জীবন ছেড়ে প্রকৃতির মধ্যে ডুবে যাওয়ার ইচ্ছেটা যেন আরো বেড়ে যায় গাছপালা, পাহাড়, নদীর কাছে এলে। 
আমাদের চা খাওয়া শেষ, সূর্যও ডুবি ডুবি, মানালী যাওয়ার আগে একটা শাল ফ্যাক্টরিতে ঢুঁ মারা হয়েছিল। শাল কেনার জন্য না, কাজ কেমন করে করে দেখতে। যে পরিমান ডেডিকেশন দেখলাম, যিনি করছিলেন কাজটা সেই ভদ্রলোকের  বাপ্রে বাপ। কবে যে আমার এরকম ডেডিকেশন হবে, তাহলে তারের বাজনা শেখার শখটা তাহলে মিটবে। নদীর জলের, বাতাসের আওয়াজের সুর তুলতে পারবো বেশ।

 





মানালীতে ফের গাড়ি খারাপ হয়ে গেল যোগীন্দরজির। ব্যাটা মনিকরণ থেকে টার্ণটা নেবার সময়েই ঠোকা লাগিয়েছিল, অ্যাক্সেল গেছে ভেঙে। গাড়ির ঝামেলাটা এ বারে চলবে মনে হচ্ছে। পৌরানিক জায়গা গুলো কেমন দিব্যি জায়গাদখল করে দাঁড়িয়ে আছে। হিড়িম্বা মন্দির, ঘটোৎকচ মন্দির, বশিষ্ঠ কুন্ড আর মন্দির, মনু মন্দির। আমাদের দেশের ইতিহাস আর পুরানে বিরোধ আছে একটা,  আমি বলছিনা সব কটা পুরানই হুবহু সত্যি কিন্তু এই যে বশিষ্ঠ বা মনু বা হিড়িম্বা কিংবা ঘটোৎকচ এদের মন্দির আছে তার একটা রূপ আছে হয়ত এরা এক্সিস্ট করত। দেবতা বা দানব হিসেবে না, মানুষ হিসেবেই। আমরা সবাইকেই পুজো করে ঠাকুর বানিয়ে দিই, রবীন্দ্রনাথ কিংবা সত্যজিৎ এর কোনো গল্প সিনেমার বিরুদ্ধে একটা কথা বললেই যেরকম রে রে করে তেড়ে আসে তাতে এদেরও মূর্তি বানিয়ে, ধূপ ধুনো মন্ত্র দিয়ে পুজোও শুরু হল বলে,  সুতরাং সে হিসেবে বলছি না কিন্তু এই যে হিমাচলের রাম সীতাকে অবিকল একটা মিষ্টি দুটো হিমাচলি বলে দেখা যাচ্ছে, এই যে একটা গ্রামের দেবতা অন্য গ্রামে নিয়ে গিয়ে একসাথে উৎসব হচ্ছে এসবের পিছনের ইতিহাস নিয়ে নিশ্চয়ই গবেষনা হয়, আমিই খবর রাখিনা। হিড়িম্বা দেবী হিসেবে পুজো এখানেই হয় স্রেফ। সারা ভারতে রাক্ষসী, এখানে দেবী। আমি শুনেছি দুর্যোধনের পুজোও হয় এদিককারই কোনো গ্রামে।  একদিন নিশ্চিত জানা যাবে কেন ঘটোৎকচের পুজো শিং লাগানো গাছে হয়, বশিষ্ঠমুনির মূর্তি এমন কালো কষ্টিপাথরে কেন। বশিষ্ঠ মূর্তির  চোখ গুলো জ্বলজ্বলে, ছবি তোলা বারন, মন্দিরের কাজ ভারী সুন্দর । মনুর মূর্তিটা তেল সিঁদুরে ক্ষরে গেছে কে ছিল কেমন দেখতে কিছুই বোঝা যায়না। কিন্তু জায়গার বেশ একটা ব্যপার আছে। ঘিঞ্জি সরু রাস্তা বসতি পেরিয়ে প্যাগোডা ধাঁচের মন্দিরটা, একটু উঁচুতে তাই চারদিক চমৎকার দেখা যায়। মন্দিরের বাইরে এক বুড়ো আর একটা বাচ্ছা বসে ছিল আপন মনে, একজন বলিরেখায়, ভাবনায় আর একজন চিপসের প্যাকেট হাতে আনন্দে।মনুর মন্দিরে এই কম্বোটাই স্বাভবিক বটে। মনুসংহিতা যেমনই হোক, মনুর নৌকার গল্পটা চমৎকার।  মনুর আলয় থেকেই নাকি মানালী নাম,  এখানে গল্প কোথায় শেষ আর সত্যি কোথায় শুরু বোঝা দুষ্কর বটে। 

ছেলের মন্দির (ঘটোৎকচ এর মন্দির । এরকম প্রাকৃতিক হওয়াই উচিত ছিল বটে ওরকম বীরের )
মা এর মন্দির (হিড়িম্বা দেবীমন্দির)



ঐ যে কালো মত মূর্তিটা বশিষ্ঠের(চুরি করে তোলা ছবি কিনা তাই এমন)

মনু মন্দির


(ক্রমশ)

আগের পর্ব এইখানে

2 comments:

  1. বাহ, চমৎকার ঘুরেছ বোঝা যাচ্ছে, প্রদীপ্ত। লেখা তো খুব সুন্দর, যথারীতি। ভালো লাগল পড়ে, ছবি দেখে, মনে মনে তোমাদের সঙ্গে ঘুরে। পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ সো মাচ কুন্তলাদি।

      Delete