Sunday, December 26, 2021

আনাচ কানাচ

শীতের শুরুতে এখানে বেশ ভালোই ঠান্ডা পড়ে যায়। এ বছর এখনো পড়েনি। এখানে মানে বাংলা বিহারের বর্ডারের এক ছোট শহর যেখানে আছি।  ওয়ার্ক ফ্রম হোম অপশনটা আমার জন্য ভালোই হয়েছে। দিব্যি কল নিতে নিতে দেখতে পাই চিড়িকদাসের খুড়তুতো নাতি জানলার কার্নিশে বসে বাদাম খাচ্ছে, সেদিন তো ঘরেই এসেছিল আলাপ করতে। কিংবা নীল রঙের পাখিটা টুইটুই ডেকে ফুরুত করে উড়ে যায়। এ বাড়িটাও ভাঙাচোরা, আগেরটার মতো না হলেও ছাদে লম্বা লম্বা ঘাস, ড্রেনেজ পাইপের ফাঁকে বা জানলার কার্নিশে হলদে রঙের ফুল ফুটেছে। কিন্তু সে সব সমস্যা বলে আমাদের মনেই হয়না। নিজের অবস্থায় অখুশী থাকলে বা অভাববোধ থাকলে উন্নতি হয়,  আমাদের উন্নতি হবে না মনে হয় কখনো। আমরা দিব্যি এসব ছোটখাটো জিনিস পাত্তা না দিয়ে হাঁড়িচাঁচা কিংবা দোয়েল এর আনাগোনা দেখি, নীল রঙের প্রজাপতিটার ছবি তুলতে পারছি বলে কুঁইকুঁই করি, বাড়ির সামক্নে কামিনী ফুলের গাছটায় সাদা হয়ে আছে ফুলে, রাতের বেলা বেরিয়ে প্রানভরে গন্ধ নিই বারান্দা চেয়ার পেতে বসে। 
এমনিতে এ জায়গাটা গরু আর ষাঁড়দের স্বর্গ বলা যায়। ইচ্ছে মতো হাঁটে দুলকি চালে, যেখানে খুশী গোবর ছড়ায়। এখানকার মানুষও মোটামুটি ওই পর্যায় এর উদাসীন করে ফেলেছে, পুরো শহরটাই যেন ডাস্টবিন, যেখানে খুশী থুতু ফেলা স্বাধীন নাগরিকের অধিকার। তবে সবে মিলে একসাথে আছে ভালোই৷ এই তো সেবার একজনের টোটোতে গরুতে মাথা গলিয়ে দিয়েছিল। ভেবেছে সেও যাবে হয়ত একটু হাওয়া খেতে। টোটোওয়ালা না না পয়সা না দিলে নেই ভাব নিয়ে তাড়িয়ে আবার চলতে লাগল। 

ছুটির একদিনে বেরিয়ে পড়েছিলাম। গন্তব্যের থেকে চলার পথ আমাদের কাছে কম আকর্ষনীয় নয়। তাই হুট করে থেমে জঙ্গলের মধ্যে এক আশ্চর্য ঝালমুড়িওয়ালার কাছে দাঁড়াই। কাঁপা কাঁপা হাতে বুড়ো মেখে দেয়, ঝাল কমাতে  পাশের মন্দিরের সামনের টিউবওয়েল থেকে ঢকঢক করে জল খাই জামা ভিজিয়ে। কিংবা দাঁড়িয়ে পড়ি কোনো চায়ের দোকানে, আলগোছে রাজনৈতিক চর্চা শুনতে শুনতে চেখে দেখে স্থানীয় কেক বিস্কুট। ফের চলতে থাকি,  যতক্ষন না আমাদের আটকে দেয় বুনো ফুলে ঢাকা কোনো বাড়ি, কে থাকতো এখানে কিংবা কে থাকে? জানতে যাই না,  পুরোটা না জানাই ভালো। তারপর পৌঁছে যাই সুতানের জঙ্গলে। পিকনিক পার্টি এসেছে একটা, উব উব ডিজে নেই বটে কিন্তু এই জঙ্গলে কোলাহল ভালো লাগে না। হয়ত দলে এলে আমরাও তাইই করতাম। তার চেয়ে জঙ্গলের পথে পথে চলাই ভালো। কখনো পিচকালো রাস্তা কখনো লাল মোরাম। কাঠ কুটো তুলে নিয়ে চলেছে বউ আর তার ছোট দুটো ছেলে মেয়ে। এদের গ্রামটায় যাবে? চলো। দিব্যি ছিমছাম একটা গ্রাম। জঙ্গলের একদম গা লাগোয়া, খুবই সামান্য উপকরণ নিয়েই বেঁচে আছে। ভালো না মন্দ তা বলার আমি কে। তবে মন্দিরটা চমৎকার।  স্রেফ একটা ছাউনিয়াছে, মাটির দাওয়ায়। ভগবান যদি থাকে তো সে এরকম খোলামেলাতেই থাকতে ভালোবাসবে, ওই ঘুপচি ঘরের ধূপের ধোঁয়ার চেয়ে এ স্বাভাবিক বুদ্ধিটা ভগবানে বিশ্বাসীদের হয়না কেন?! এক বুড়ো চাদর জড়িয়ে লাঠি হাতে হেঁটে চলেছে রোদের দিকে, একটা মানুষের ছানা এক বালতি জলে খুব মন দিয়ে চান চান খেলা করছে। একটা ছাগল ছানা এক মনে পাতা চিবুচ্ছে। মাচায় শিম ফলে আছে। দুপুরবেলার সময়, খাটিয়ায় আরাম করে কেউ কেউ খেতে বসেছে। তথাকথিত সভ্য চোখে রাস্তায় খাওয়া যেমনই হোক আমার চোখে মন্দ লাগে না। দিব্যি আরামে খাওয়া। আজকাল প্রায়ই আমার মনে আমাদের এই অবিরাম ছুটে চলার সভ্যতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। চলার নামই জীবন এসব সাদা কালো সরিয়ে যদি একবার দেখি, সারাক্ষন এমন উন্মাদনার জালে  পড়েছি যে আমাদের আর শুধু বিরিয়ানিতে মন ওঠে না, তার সাথে এক হাতা চকলেট সস ঢেলে আরো অন্যরকম করতে হয়। আমি হয়ত খুব বেশী সরল করে দিলাম, বলতে যেটা চাইছি আমাদের কেন আরো আলো আরো বাতাসে সুখ আমাদের যেন হয়না। যাক এসব কথা, সত্যি কথা স্বীকার করা ভালো আমিও এরকম একটা জায়গায় জীবন কাটাতে পারবো কি? 
তালবেড়িয়া ড্যাম এর মত এমন সুন্দর জায়গা প্রায় মিস করেই যাচ্ছিলাম। রাস্তার চায়ের দোকান, মা ছেলেতে চালায়, মা সিঙারার পুর ভরছে আর ছেলে চা বানাচ্ছে। সেখান থেকেই খবর পেলাম কিলোমিটার দশেকের মধ্যেই আছে তালবেড়িয়া ড্যাম। পড়ন্ত দুপুরের গাঁ পেরিয়ে ড্যামের কাছে পৌঁছে দেখি তখনো ড্যামের চারিদিকের পিকনিক পার্টিদের দুপুরের খানার ইন্তেজাম হয়ে ওঠেনি। একদম কৃষ্ণানুগামী এসেছে তাদের রাধা কৃষ্ণকে সোয়েটার পরিয়ে।  কয়েকজন তরুন ড্যামের ঠান্ডা জলেই সাঁতার দেবার তোড়জোড় করছে।ড্যামটার চারধারে ঘন সবুজ শাল পিয়ালের বন। একটা নিম গাছের নীচে একটা সিমেন্টের বেঞ্চে রোদ মাখতে মাখতে দেখছিলাম কেমন একদলের রান্না শেষ হচ্ছে, একদলের নিরামিষ রান্না চলছে, কারোর মাংসের ঝোল নামল বলে।  একই জায়গা হরেক মানুষ হরেক পছন্দ। সৌভাগ্যক্রমে উব উব ডিজে পার্টি নেই বলেই অসহনীয় লাগছে না।  রাতে যখন এসব জায়গায় জ্যোৎস্না হবে কেমন ভেসে যাবে ভাবতে গিয়ে দেখি পড়ন্ত রোদেও কম ভাসেনি। 
তারপর ফের পথ ডাক দেয়, পথের ধারে খেজুর গুড়ের ভাটি। ইলেক্ট্রিসিটি নেই স্বাভাবিক ভাবেই এসব অস্থায়ী জায়গায়, সন্ধ্যে হলেই শুয়ে পড়ো আর সকাল হলেই উঠে খেজুর রস নামিয়ে জ্বাল দাও। মিঠে গন্ধে জায়গাটা আমোদিত হয়ে থাকে। লোভী মানুষ, থমকে যাই, আঁজলায় করে গুড় খাই। আবার কখনো মেচা সন্দেশ এর সারিসারি দোকান দেখলেও দাঁড়িয়ে যাই। চায়ের দোকান থেকে খেজুড় গুড় হয়ে মেচা সন্দেশ চলার পথ একটানা আর হয় কই।
ডিসেম্বরের শেষ, শীতের শুরু। বাপ্রে বাপ ঠান্ডা পড়েছে। পাশের কোয়ার্টার কদিন খুব পরিষ্কার হল, এক দম্পতি এসে থাকছে। যা কিছু বিনা পয়সায় মেলে তার দাম আমরা দিইনা। জ্যোৎস্না মাখতে ছাদে উঠেছিলাম, চাঁদের আলো থৈ থৈ করছে, নারকেল গাছের ফাঁকে, দেবদারু গাছের গোড়ায়, ভাঙা কার্নিশে। আর কোথাও কোনো আওয়াজ নেইঝালি ইলেক্ট্রিক আলো গুলো ব্যাঘাত ঘটায়, তাও গাছের ফাঁকে ফাঁকে এড়ানো যায়। চাঁদের চারদিন আলো জ্বালার কোনো মানেই নেই। আমাদের ভাঙা চোরা কোয়ার্টারে অভাববোধ না থাকার কথা বলছিলাম না, তা সেসব আমাদের ঘরে টুক করে ঘুরে যাওয়া কাঠবিড়ালী, লেবু গাছে ওড়াউড়ি করা প্রজাপতি, কামিনী গাছে দোল খেয়ে যাওয়া দোয়েল এদের জন্যই।  সেদিন গাছ কাটা লোক এসেছিল, হুড়ুমদুড়ুম করে গাছ এর ডাল কেটে "শোভা" বাড়াতে গিয়ে গাছ গুলোকে ন্যাড়াই করে দিয়েছে প্রায়। কাঠবিড়ালি, নীল প্রজাপতি, দোয়েল কেউইই আজকাল আসছে না। আসবেই বা কোথায়! অমন ঘন কাঁঠাল গাছ, কামিনী গাছ, লেবু গাছ কিচ্ছুই কি আর ভালো রেখেছে। ওদের ঘরবাড়ি আমরা রাখতে পারিনি। যে লোকটা গাছ কাটছিল, সে এত কিছু বোঝে না ভাবে না, তার মনে হয় ভালো লাগে না এ কাজ তাই নির্দয় হয়ে গাছ সাফ করে। রাতেরবেলা চুঁইয়ে চুঁইয়ে জ্যোৎস্না গড়িয়ে পড়ে, কাটা পড়া জায়গা গুলোয়, একটু একটু করে সেরে ওঠে। গাছ সাফ করে ফেলবো এ ভাবনাই বড় বেশী দাম্ভিক। কেটে কুটে সব শেষ করে ফেলে মানুষও যখন শেষ হয়ে যাবে জঙ্গল ফের নিজেকে খুঁজে নেবে মানুষ না থাকলেই। সে সময় গুলোতেও এরকম মায়া মায়া জ্যোৎস্না এসে সারা চরাচর ধুয়ে দেবে, ভাঙা কার্নিশ বেয়ে হয়েত কোনো ফ্রেমে হঠাৎ আটকে পড়া হাসি আহ্লাদ লুটোবে। কে বলতে পারে! 

8 comments:

  1. বাহ বড় ভাল হয়েছে হে

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ 😃😇

      Delete
  2. সকলের সঙ্গে আমিও একমত, এই পোস্টটা অন্যান্য সব ভালো পোস্টের থেকেও বেশি ভালো হয়েছে, প্রদীপ্ত। অপূর্ব সব লাইন আছে আনাচেকানাচে, সেগুলো আর তুলে তুলে বলছি না। তবে একাধিকবার পড়েছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ সো মাচ কুন্তলাদি। 😊😊😊

      Delete
  3. মন কেমন করা জোৎস্না ফুটিয়েছিস :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ অর্ণবদা। 😇😇

      Delete