Thursday, June 29, 2017

জল জঙ্গল পাহাড়ের গল্প (২)

হোং হোয়াং ছো টাইপ একটা গুরুগম্ভীর মন্ত্রের আর প্যাঁপ্পোর পোঁ আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। পর্দা সরিয়ে দেখি দিব্যি ছিমছাম একটা রোদ বেরিয়েছে। মেঘের সমুদ্রে পাহাড়ের চড়া পড়েছে। বিছানা ছেড়ে নেমে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ছাদে। দূরে সান্দাকফু দেখা যাচ্ছে নাকি, আমি অবশ্য ওটা মেঘ বলে ভুল করছিলাম। আবার ফের মেঘ করে আসতে নেমে গেলাম। মঠের পাশেই একটা পাহাড়ে ধাপ কেটে চাষের ক্ষেত। ভোরের কুয়াশায় মেঘে জড়ানো সে রাস্তা এক অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ তৈরী করেছে। টিপটিপ করে বৃষ্টি উপেক্ষা করে একটু এগিয়েই ফের ফিরে আসতে হলো, পিডি ভাই এসে গেছে ব্রেকফাস্ট করতে হবে, বেরোতে হবে। 

ভার্সে যাওয়ার জন্য বন্ধুর গাড়িতে দুজন হেল্পার, আমি আরেকটা যে ছেলে ছিলো সে  মিলে ওঠা গেলো। হেল্পার দুজনের একজনের না মিংমা শেরপা আরেকজনের নাম খুব কঠিন মতো, বাচ্ছা শেরপা বলাই সহজ বরং। মিংমা কম কথার মানুষ,  এমনি সময়ে সে গাইড হয় বটে ডেন্টামের রাস্তার কিন্তু বর্ষায় হবে না কিছুতেই। আসল কারনটা পরে জেনেছিলাম অবশ্য। সে যাই হোক, রেঞ্জার কিছুতেই গাইড ছাড়া ভার্সে থেকে ডেন্টাম যেতে পারমিশন দিলো না। কি আর করা! সই সাবুদ সেরে এগোনো গেলো। সঙ্গের ছেলেটা সদ্য কলেজ শেষ করেছে বেরিয়েছে একা কিন্তু বেজায় ভীতু দেখলাম। মিংমা আর বাচ্ছাকে কম করেও বিশ বার জিজ্ঞেস করলো,  আচ্ছা বর্ষাকাল তোমরা সবাই নেমে গেছো এ জঙ্গলে তো ভালুক আসতেই পারে না? হ্যাঁ, ও দাদা আসতে পারেনা? প্রথমটা মজা পাচ্ছিলাম পরে বিরক্ত হচ্ছিলাম। এরম প্যানপ্যানে ছেলে বাড়ির খুঁটো ছেড়ে আসে কেন কে জানে! আমি একটু তফাতে হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছিলাম। ছেলেটার আবার নার্সিজিজম সিন্ড্রোম আছে। থেকে থেকে ছবি তুলে দিতে বলে। আর সে ছবি আবার তার পছন্দও হয়না। শেষে তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে, পর পর বেশ কিছু খারাপ ছবি তুলে দিলাম যাতে আর না দেয়। ওয়ান টাইম ইনভেস্টমেন্ট কিন্তু লম্বা সময়ের শান্তি।
মেঘ কুয়াশা ঢাকা রাস্তা, বর্ষার জল পেয়ে জঙ্গল ঘন হয়ে উঠেছে। ফার্ন গুলো চকচকে সবুজ হয়ে আছে। রাস্তার ধারে নাম না জানা বুনো ফুল ফুটে আছে। পাতায় জলে রাস্তাটা পিচ্ছিল হয়ে আছে।সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগোতে হয়। সারা জঙ্গল সরগরম হয়ে আছে পাখির ডাকে, ঝিঁঝির আওয়াজে। কোলকাতায় ইঁট কাঠ এর মধ্যে বসে হাওয়া তবু এক আধবার পাওয়া যায় কিন্তু এই যে জঙ্গুলে বুনো গন্ধ আহ কতদিন পরে পারফিউম, খাবার, আবর্জনা এসবের বাইরে কোনো গন্ধ পেলাম। খুব শান্তি লাগছে,  ফোনে টাওয়ার নেই তাই ফোন চেক করার বদরোগও নেই। বাড়িতে বলেই এসেছি টাওয়ার থাকবে না আর কেউ চিন্তা করবে না ফোনে না পেলে।
এলোমেলো খচাং খচ করে ছবি তুলছি, আস্তে আস্তে এগোচ্ছি। ওরা খানিকটা এগিয়ে গেছে। কুয়াশা মাখা জঙ্গল এক অদ্ভুত আদিমতা তৈরী করেছে। কি এক গভীর রহস্য যেন লুকিয়ে আছে, পথ ছেড়ে বেপথে পা দিয়ে দেখলেই যেন খোঁজ পাওয়া যাবে তার। 

এসময় হঠাৎ বনে হাওয়া দিয়ে গেলো, পাতায় জমে থাকা জল শিশির টুপটুপ করে ঝরে পড়লো গায়ে মাথায়। গাছেদের সমাজ মানে জঙ্গল যে অনেক উন্নত সে তো আমি জানিই। আমার মনের কথা টেলিপ্যাথিতে নিশ্চিত বুঝেছে, তাই এ আদর।
ঝুম হয়ে একটা ভেজা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।হঠাৎ শুনি খোকাটি মিংমা আর বাচ্ছা শেরপার সাথে হাঁক দিচ্ছে ভাই কোথায় গেলিরে। ধ্যার বাবা দিতে হয় এটার কানের গোড়ায়। আমি যদি ভালুকের পেটেই যাই যেতে দে তো বাবা শান্তিতে। যাকগে তক্ক করে খালি মেজাজ নষ্টই হবে তাই কথা না বাড়িয়ে ফের এগোলাম।

মেঘের আড়ালে ওই যে বাড়িটা ওটাই বুঝি গুরসকুঞ্জ? বেজায় ভালো তো? বরদার গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। আহা একটা পেত্নী টেত্নী থাকলে খারাপ হতো না। মুশকিল হলো আমি শরীরকে একটা যন্ত্রই ভাবি, আর ব্রেনকে তার কন্ট্রোলার। হতে পারে সেই মস্তিষ্কএর অনেক কিছুই অজানা আমাদের কিন্তু তাই বলেই একটা এক আউন্সের আত্মা জাতীয় কিছু ভুস করে শরীর থেকে শরীরে বিরাজমান হয়ে বেড়াবে এ আমি ভাঙ খেয়েও হজম করতে পারবো না। তাই পেত্নী যে আসবে না তা আমার জানাই।  তাতে কি,  আমি যখন একা একা এখানে ঘুরবো রাক্ষুসে গাছ, রহস্যময় কুয়াশা, কোনো বিদেহিনী, সাপের মাথার মণি সব আবিষ্কার করব।

চা খেয়ে বেরোনো গেলো। খোকাটি আমার সাথেই আসছিলো, কিন্তু বকবক করে কানের মাথা খাচ্ছিলো বলে আমি বাধ্য হয়ে বললাম, ভাই তুই ওদিকটা যা আমি এদিকটা একটু একা ঘুরে আসি। বললে বিশ্বাস করবেন না মশাই কি বলল আমায়!! বলে, ভাই তুই এরকম চুপচাপ আছিস কথা বলছিস না বেশী সুইসাইড ফাইড করে ফেলিস যদি তাই একা ছাড়ছিনা, মানে বুঝতেই পারছিস আমিও এসেছি এক সাথে কেস খেয়ে গেলে!! শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝলাম না, বললাম,  ভাই আমার বাড়ির কাছে গঙ্গা আছে মেট্রো আছে সেসব ছেড়ে এখানে আসব কেন বলতে পারিস? তুই চল তোকে মিংমার সামনে রেখে আমি ঘুরতে বেরোই তাহলে আমি মরলেও তোকে খুনের দায়ে কেউ ধরবে না!!
তাকে ছেড়ে এসে নিজের মনে এগোচ্ছি,  দেখি একটা লাল আর একটা সাদা কুকুর আমার পিছন পিছন আসছে। মহা ঝঞ্ঝাট!  আমায় কি মহাপ্রস্থান এর যুধিষ্ঠির ঠাওরালো নাকি সব? নকুলকে কাটাই তো ডবল ধর্মরাজ! আমি আবার একটু অধার্মিক কিনা তাই ধর্মরাজদের নিজের আশেপাশে ঠিক ভালো চোখে দেখিনা। উদাস মুখে আড়চোখে দেখলাম ব্যাটারা চলে গেলো হেঁউমেঁউ করে। যাক বাবা! রাস্তায় ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে, বোঝাই যায় টুরিস্টকাল শেষ। একটা স্ট্রবেরীর মতো দেখতে ফল। বর্ষাকাল ছোট ছোট পাখি জন্মেছে অনেক। কিচিরমিচির করে ডেকে ডেকে ওড়া প্র‍্যাক্টিস করছে। আমি দু এক বার ছবি তোলার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম। ও আমার দ্বারা হবার না। তার চেয়ে এই এখানটায় শুই লম্বা হয়ে পাথরের উপর। নীচে গাছ পালার ফাঁকে গুরসকুঞ্জ দেখা যাচ্ছে। জঙ্গলের আওয়াজ মাথার উপর নেমে আসা মেঘ নিয়ে আমি ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।  টুপটুপ করে বৃষ্টি শুরু হতে ঘুম ভেঙে তড়াক করে উঠে হাঁটা দিলাম।  খিদেও পেয়েছে মন্দ না।   (ক্রমশ...)



4 comments: