Monday, July 3, 2017

জল জঙ্গল পাহাড়ের গল্প (৩)

আগেরবারের পর আরো খানিক...
মিংমা আর বাচ্ছা খুব,  মানে খুবই খারাপ খাবার বানায়। লোকজন কিরম ফাঁকা বাংলোয় চমৎকার সব বাবুর্চি পায়। কেউ কেউ তো ভূতকেও বাবুর্চি হিসেবে পায়। যাকগে কচরমচর করে যা দিলো খেয়ে নিলাম। জলটা কাঠের আঁচে ফুটিয়েছে। ধোঁয়া গন্ধওলা জলটা অদ্ভুত লাগছিলো। খেতে খেতেই ছোকরার লেকচার শুনলাম খানিক। দু বোতল বিয়ারের এফেক্ট আর কি। সে নাকি মানুষকে চাইলেই প্রভাবিত করতে পারে। নেশাড়ুদের সাথে তক্কেযেতে নেই শুধু তাই না এইসব ক্ষেত্রে মজা নিতে হয় খালি চুপটি করে। আরো বলতে দিতে হয় আর খোরাক নিতে হয়।আমিও ঘাড় নেড়ে নেড়ে শুনলাম। তারপর দেখি আমাদের খাওয়ার আধখোলা দরজা দিয়ে হু হু মেঘ ঢুকে আসছে।

বাইরে গিয়ে দেখি পুরো এলাকাটা মেঘে ঢেকে গেছে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। কোথাও আওয়াজ নেই। সে এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। মেঘবন্দী হয়ে আছি মনে হচ্ছে যেন। মাঝে মাঝে সাদা কুকুরটা কেশে উঠছে, ব্যাস আর কোনো আওয়াজ নেই কিচ্ছু নেই। মেঘ ভেদ করে একবার ঢুকলেই যেন সেই অজানা কোন রহস্যময় দেশে ঢুকে যাবো। আর এই সময়েই টুপটুপ করে বৃষ্টি এলো। সে যে কি অদ্ভুত বলে বোঝানো যাবে না। যাদের চশমা।আছে তারা দেখেছেন নিশ্চয় এসি ঘর থেকে টপ করে গরমের মধ্যে বেরোলে চশমার কাঁচ কিরকম বাষ্প জমে ঝাপসা হয়ে যায়? তারপর আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়? ঠিক সেরকমভাবে দূরের পাহাড়টা প্রথমে দেখা গেলো এদিকে সামনেটা পুরো মেঘে ঢাকা তারপর মাঝের পাহাড়টা তারপর সামনেটা। দেখি মেঘ গুলো আকাশে ছুটেছুটে কোনো বিরহী যক্ষের চিঠি নিয়ে যাচ্ছে আর আকাশখানা মেঘের বোরখার ফাঁক পেয়ে মুচকি হাসি দিচ্ছে। সেইরকম নীল মিষ্টি হাসি বড় একটা দেখা যায় না। আরে দেখ না দেখ দূর পাহাড়টা ফের মেঘে ঢেকে গেলো আর ক্রমে ক্রমে আমিও।

মেঘের পোশাক পরেই চারপাশটা ছানবিন করতে বেরোলাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা বেরিয়ে গেছে ছোট ছোট গ্রামের পথে কিন্তু জঙ্গলে ঢেকে আছে রাস্তা আর টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জঙ্গলটা মেঘ মেখে হাতছানি দিচ্ছে। যেন কোন এক রহস্যময়ী রহস্য মেখে দাঁড়িয়ে। আমাদের ট্যুরিস্ট বাংলোটা ভুতুড়ে গল্পের প্লট হয়ে আছে যেন।বৃষ্টিটা জোরে আসতে বাংলোয় ফিরে চেয়ার নিয়ে বসে রইলাম অনেক্ষণ চুপটি করে। টাওয়ার হীন,  কারেন্ট হীন এসব জায়গা মানুষকে নিজের সাথে কথা বলতে শেখায়। বড় দরকার মাঝে মাঝে এই দৌড়াদৌড়ি, লড়াই ঝগড়া সব সব কিছু থেকে তফাতে গিয়ে নিজের সাথে বসার, প্রকৃতিতে ডুব দেবার। অনেক্ষণ পর মিংমা  দন্তরুচি কৌমুদী হয়ে পপকর্ন আর চা এনে দিলো। দুধ নেই লিকার চা। সেই কাঠের আঁচের  ধোঁয়া গন্ধ জল দিয়েই। বললাম চল ব্যাটা এতো জবরদস্ত খাবার খাওয়াচ্ছিস একটু ঘুরে আসি চল। খোকাটি তো খুব একটা এদিক সেদিক যেতে ভরসা পাচ্ছে না তোমাদের ছাড়া। বেচারা প্রায় ঘরেই বসে আছে। ল্যাদ কাকে বলে এ মক্কেলকে দেখে শেখার। 

যাই হোক নড়ে চড়ে রওনা দিলো। সূর্য না দর্শন দিলেও তার আলো দেখা যাচ্ছে দিব্যি।
ফেরার সময় হুড়মুড় করে সন্ধ্যে এসে গেলো। পাখিদের কিচিরমিচির বেড়ে গেছে। ঝুপ্সি অন্ধকার রাস্তা, পাতলা আলো পড়ছে তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে ফিরতে খুব ভালো লাগছে। টুপটাপ জলের আওয়াজ পড়ছে পাতা থেকে, সাদা আর লাল কুকুর দুটো দৌড়ে এগিয়ে গেলো। বাংলোয় ফিরে ফের বারান্দায় বসেছি। আশেপাশে দু তিনটে পাহাড়ের মধ্যে চারটে মানুষ। কারেন্ট নেই, জেনারেটরে তেলও নেই।  মিংমা একটা মোম জ্বেলে রেখে গেলো ঘরের মধ্যে। বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে বসে রইলাম। পাতলা অন্ধকার, আশেপাশে সব দেখা যাচ্ছে কিন্তু যেন সব ভারী দূরের। ঝিঁঝি ডাকছে। একটা কিসের যেন খড়মড় করে শব্দ হলো, কুকুর দুটো তাড়া করলো সেদিকে চিৎকার চেঁচামেচি করে। সঙ্গী ছোকরা আগেই ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে গেছে। আমি টর্চ হাতে বসে রইলাম। একটু একটু গা ছমছম করছিলো না বলব না। অন্ধকারে শহুরে মানুষদের একটু অস্বস্তি লাগেই। তাছাড়া জঙ্গল তো পরিচিত হয়ে ওঠেনি এখনো। তবু এক অমোঘ টানে বসে আছি। আকাশে এক গাদা তারা ফুটেছে মেঘ কেটে, একটা বুনো গন্ধ ভেসে আসছে। সমাহিত শান্ত হয়ে বসেছিলাম। তারপর দেখি কুকুরগুলো বাড়াবাড়ি রকম চ্যাঁচামেচি শুরু করে তেড়ে তেড়ে যাচ্ছে গেটের দিকে। হাওয়াটাও বেশ জোরে দিচ্ছে। আমি গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম।

বাচ্ছা শেরপা তার স্পিকারে নেপালী গান চালিয়েছে। কাঠের উনুনের পাশে বসে আগুনে ভিজে পা শেঁকতে শেঁকতে সেই গান শুনছি মোমের আলোয়। ছোকরাটিও এসে বসেছে এখানে। বেশ লাগছে,  অন্ধকারে আগুনের আঁচে নেপালী গানে।
এখানে নীচে একটা ঘর আছে ট্যুরিস্টদের জন্য আর হোটেলের লোকের থাকার ঘর আছে দুটো। উপরটা ডরমিটরি। এবার নীচের ঘর গুলো একটু অদ্ভুত। ঘরের সামনে একটা স্পেস আছে যেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। খোকার তো পুরো বাংলোয় অন্ধকারে একা থাকতেই হাল খারাপ মিংমাদের বলল, আমরা চারজনেই উপরে ডরমিটরিতে থাকিনা? মিংমা তো হাঁ হাঁ বলে দিলো। আমার নিজেরও নীচের ঘরটা একটু গুমোট টাইপ লাগছিলো, আমার আপত্তি নাই।
উপরের ঘরে জানলার কাচটা ভাঙা, প্লাস্টিক দিয়ে মেরামত করা আছে বটে তবে তাও হাওয়া আসছে দিব্যি। রাতে মিংমা আর বাচ্ছা মিলে গরম গরম রুটি আলুভাজা ডাল আর ডিম বানিয়ে দিয়ে গেলো।মোমের নড়বড়ে আলোয় অমৃতের মতন লাগছিলো সে খাবার। আমি আর খোকন যার যার বিছানা পেতে টেতে শুয়ে পড়লাম ওরা পড়ে আসবে জিনিস টিনিস গুছিয়ে।
মাঝরাতে হঠাৎ 'ভাই... এই ভাই ওঠ না' ডাকে ঘুম ভেঙে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে অন্ধকার শহরের লোডশেডিং এ বোঝা যাবে না। মোমটা শেষ হয়ে গেছে। হাওয়ার তেজ বেড়েছে, অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছে জানলায়। কুকুরগুলো খুব চেঁচামেচি করছে শুনতে পেলাম, মনে হচ্ছে যেন ভিতরে ঢুকে পড়েছে। টর্চের আলোয় দেখলাম বাকি বিছানা গুল ফাঁকা!! মিংমা আর বাচ্ছা আসেনি!!
আমি ফের ঘুমানোর উদ্যোগ করতেই খোকন বলে কি 'ভাই এই অন্ধকারে ঘুমাবি?'
- হ্যাঁ কি হবে এতোক্ষণ তো অন্ধকারেই ঘুমালি
- না, মানে যতক্ষণ ঘুম ভাঙেনি একরকম এভাবে শোয়া যায় নাকি।
-মিংমাকে ডাকবো তাই তো?
- হ্যাঁ মানে অচেনা জায়গায় এভাবে অন্ধকারে...
যা বুঝলাম এখন আমায় কম্বলের আরাম ছেড়ে বেরোতেই হবে, নইলে এ মাল জ্বালিয়ে খাবে।তাছাড়া সত্যি বলতে কি কুকুরের ডাকটাও ভয়ানক বেড়ে গেছে, অন্ধকারে অস্বস্তিকর।
টর্চ জ্বেলে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। নামতেই খুব জোর চমকেছি। সত্যিই কুকুরদুটোর একটা ঘরে ডাইনিং হলে সোফার উপর উঠে এসেছে। ঘেউ ঘেউ করলো আমাদের একবার। মিংমারা দেখি দরজা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে। নাক ডাকার শব্দও শোনা যাচ্ছে। মেজাজ হেভভি খাপ্পা হয়ে গেল। হতভাগারা বলতে পারতো যাবে না। দরজা ধাক্কা দিচ্ছি মিংমা, মিংমা?
-হাঁ কওন?
-হামলোগ
ব্যাস আর সাড়াশব্দ নেই।কিরম বদ রে ব্যাটা! এই মিংমা? কিছুতেই সাড়া নেই। ভেবেছে কি এম্নিই চলে যাবো,  মোম না নিয়ে যাবোই না ব্যাটা আমার ঘুম ভেঙেছে আমিও ছাড়বো নাকি।
মিংমা, মিংমা?
অনেক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করে শেষে কেয়া মুসিবত বলে গজগজ করে উঠে মোম বের করতে গেলো। মোম বেরোলো তো দেশ্লাই নাই। উপায়?
রান্নাঘরের দরজা খুলে বেচারী গ্যাস জ্বেলে মোম জ্বালিয়ে দিলো। তারপর খোকন যেই বলেছে তুমি উপরে চলো শুতে বলে হ্যাঁ হ্যাঁ হিসি করেই যাচ্ছি।
আসেনি যে তা পরদিন ভোরে জেনেছিলাম। (ক্রমশ)

আগের কথা -
পাহাড় জঙ্গলের কথা (১)- https://elomelo-hijibiji.blogspot.in/2017/06/blog-post.html

পাহাড় জঙ্গলের কথা (২) - https://elomelo-hijibiji.blogspot.in/2017/06/blog-post_29.html

8 comments:

  1. Khub valo laglo. Porer part tar apekkhay roilam

    ReplyDelete
  2. এই সিরিজটায় কমেন্ট করব করব ভেবেও করা হচ্ছে না, প্রদীপ্ত। দারুণ লাগছে। বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে আবার।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংকিউ কুন্তলাদি ^_^ ।

      Delete
  3. New Hampshire বা rocky যেতে হবে দেখছি

    ReplyDelete