Thursday, July 13, 2017

বাউন্ডুলের দিন রাত

একটা লোকের সাথে কাজ ছিলো ডিএলেফে, ছুটির দিন ল্যাদ কাটিয়ে বেরিয়ে মাঝরাস্তায় টেক্সট এলো আমার শরীর খারাপ স্যার আজ হবে না প্লিজ পার্ডন মি। হতভাগাকে ইচ্ছে করছিলো জিওর এক জিবির পরের অবস্থায় উবের বুক করার দায়িত্ব দিতে। 
ইকো পার্কের কাছে ঝপাং করে নেমে গেলুম আহা ভাড়া দিয়েই রে ভাই।
হাঁটতে আমি খুব পারি আর একা একা হেঁটে চষে বেড়ানো আমার নেশা। রোদ আছে ভালোই, এদিকে ফাঁকা মাঠ অনেক এখোনো। মন মেজাজ ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে। একটা ক্রেন কাদায় দাঁড়িয়ে মজাসে কাদা তুলছে হাতল দিয়ে দিয়ে। আমায় একটু চালাতে দেবেনা না? রাস্তা ঘাট কি ঝকঝকে এদিক্টায় রে, কেউ হিসি করে পিক ফেলে প্লাস্টিক ফেলে নোংরা করে রাখেনি। গাছে ছাওয়া মসৃন ফুটপাথ। তাঁবু খাঁটিয়ে রাস্তা বানাবার লোকজন রয়েছে, রান্না চলছে। এরকম তাঁবুর মধ্যে থাকতে কেমন লাগে? এর চেয়ে গাছের নীচে থাকলে তো আরামে থাকা যেত। কাশফুল ফোটা শুরু হয়েছে। একজন লোক দেখি গাছের নীচে ঘাসের আসনে আরাম করে বসে টিফিন ক্যারিয়ার থেকে ঝোল মাখা ভাত খাচ্ছে। সকাল এগারোটায় ঝোল ভাত খেতে আমার খুব খারাপ লাগলেও এরকম ঘাসে বসে খেতে হয়ত খারাপ লাগবে না।
সোজা না গিয়ে বাঁ দিকের ফাঁকা রাস্তাটায় ঢুকলাম। বাস যায় না এ রাস্তায় গাড়ি, টোটো এক দুটো সাইকেল। ছুটির দিন বেজায় ফাঁকা সব। এমনকি ঝিঁঝিঁ্র ডাক শোনা যায় কান পাতলে। পুকুর পারে খেজুর গাছের তলায় ঝিম হয়ে বসে আছি। একটা বউ দূরে কলাবাগানের পাশ দিয়ে গরু নিয়ে যাচ্ছে। 
কিচ কিচ করে চড়াই ডাকছে, সাদা ফুলে ভোমরা উড়ছে। একটু এগিয়ে জলা আছে। হাফপ্যান্টুল পড়ে টেরি আর গোঁফ বাগিয়ে মাছ ধরছে। কি।মাছ ধরলে ভাই? শোল ল্যাটা? 
- হ্যাঁহ বড় মাছ নাই। 
পার্থেনিয়ামের ভয় অগ্রাহ্য করে প্রাণ ভরে বুনো গন্ধ নিচ্ছি, আকাশে গোঁত খেয়ে একটা শালিক আর একটা এরোপ্লেন উড়ছে। আরে একটা বাদামি ঠোঁটের, সাদা ডানার কি পাখি এটা? বেজায় রোদ্দুর। গরমেদেশে ভদ্দরলোক সেজে থাকা দায়। এই পুকুরে একটা ডাইভ মারার দম আমার নেই।কিচিরমিচির শব্দ নিয়ে, কলকে ফুলে ভোমরার ওড়াউড়ি, পাগলা কোকিলের ডাক, মাছরাঙার ডাইভ দেখতে দেখতে তেতে ওঠার রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি.....
হঠাৎ দেখি ফাঁকা মাঠের মাঝে একফালি একটা চা এর দোকান। ভারী হতশ্রী চা এর দোকান। আর্ধেক বিস্কুটের কৌটো খালি। উনুন অব্দি নেই চা বানানোর, ফ্লাস্কে ভরা চা। একটা নুয়ে পড়া বুড়ো মানুষ দোকানে বসে আছে আনমনে। 'কাকা চা দেবে নাকি'? 
-কেন দেবোনা বাবা, বোসো। 
অজস্র বার ফোটা গুড় মিষ্টি গুঁড়ো চা। খেতে খেতে গল্প হলো বলেই খাওয়া যায় সে চা। 
-বাস ধরবে?
-না না হেঁটে যাবো। 
-তাহলে বেরিয়ে পড়ো। মেঘ করেছে খুব বৃষ্টি এলো বলে। 
সত্যিই তাই। এগোতে এগোতে আকাশের রঙ বদলে গেলো। হাওয়া দিলো দমকা। সিটি সেন্টারের উলটো দিকের বাসস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছি বৃষ্টি এলো। বাস স্ট্যান্ডটা টিনের চালের। মুড়ি ভাজার আওয়াজের মতো বৃষ্টির শব্দ, হু হু বাতাস শুনছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ একটা ছাগল দেখি গুটিশুটি মেরে আমার জিন্সের কোন ঘেঁসে দাঁড়িয়েছে। ভাগ বলতে গিয়েও সামলে নিলাম, বেচারা এ বৃষ্টিতে যাবেই বা কোথায়।
বৃষ্টি একটু কমতে ফের এগোচ্ছি। গাড়ির প্যাঁ পোঁ আওয়াজ, চিনার পার্কের কাছটা গোবরের গন্ধে ম ম করছে, জলে গোবরে মিশে গেছে। একজন ভ্যানে করে মাছ বিক্রি করতে করতে যাচ্ছে। 
পরের অটোতে আর না উঠে আমি ফের হাঁটা লাগালাম। চুপ্পুস বৃষ্টি নেমেছে আবার। হাঁ করে করে বৃষ্টি খাচ্ছি দেখে তুমুল বৃষ্টিতে রাস্তার মাঝে দেখে লোকজন তাকাচ্ছে। আমার কিছুই যায় আসে না তাতে... গান গাইতে গাইতে অঝোর বৃষ্টিতে ফাঁকা রাস্তা ধরে হাঁটছি.....


রাত্তিরবেলা রাস্তা ঘাট গুলো ভয়ানক অন্য রকম হয়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি এ জগৎ প্রপঞ্চময়। রাস্তা বৃষ্টিতে ভিজলে রাতেরবেলা জেগে ওঠে, জ্যোৎস্নায় রাতের বেলা রাস্তারা নদী হয়ে যায়। সে নদীতে ডুব দিলে আর পারে ওঠা যায় না। পরীরা নেমে আসে তখন। অনেক রাতে আমি অফিস থেকে ফিরি যখন, সকালবেলার ভীষণ চেনা রাস্তাটুকু কিরকম অচেনা ভঙ্গীতে তাকায়।ঝিলের পারে গাছগুলো ফিসফিস করে, 'এ যাবে কখন? এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন?' যেদিন চাঁদ ওঠে সেদিন সব্বার উৎসব, সে উৎসবে জ্যোৎস্না দিয়ে পোশাক তৈরী হয় গাছেদের জন্য ঝিলের জলের জন্য, নদীর জন্য সমুদ্রের জন্য। একগাদা বাজে আলো দিয়ে বিরক্ত করা মানুষগুলো ছুঁতেই পারেনা সে পোশাক। 
রাতের শহরও ভারী আনমনা হয়। সাঁই সাঁই করে গাড়ি চলে যায় তীরের মতো ,হর্ন দেয়না। লরির খালাসি রেডিও শোনে পেট্রলপাম্প এর আগে দাঁড়িয়ে। নেড়িগুলো বাঘের মতো পাড়া দাপায়। ক্যাবের ড্রাইভার কথা শুরু করে। কোনো ঘরের ফিসফিস হাসি, কোনো ঘরের চাপা আর্তস্বর, কোনো ঘরের নিঃশব্দ চোখের জল ছিটকে আসে গলিতে রাস্তায়। তারপর হয় তুমুল বৃষ্টি বা উত্তাল জ্যোৎস্না টেনে নেয় সব। ঝুপ্সের শেষ দোকানটাও বন্ধ হয়ে যায়, ভ্যান গাড়ি গুলো ক্রমে শান্ত হয়ে রাস্তার পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে পরে। রাত বাড়ে...নিস্তব্ধতা আরাম করে পা মেলে বসে ফাঁকা মাঠে পুকুর পাড়ে।
সেই সময়টা যদি সব কিছু সব মানে সব, অহং ভয় লজ্জা রাগ ঘেন্না সব ভুলে ওই মাঠের ধারে ঘাসে বসে থাকা যেত গাছেদের কথা শোনা যেত বোধহয় , নিজের বুকের একদম ভিতরে লুকিয়ে আছে যে কথা নিজেও সঠিক জানিনা তার হদিশ পাওয়া যেত । ঝিলের জলের কোন গভীর অন্তঃস্থল আর মস্তিষ্ক এর অচেনা ঝিল পাড়া মিলে যেত এক সাথে । 
শান্ত হয়ে বুঝতে পারতাম নিস্তব্ধতা, অনুচ্চারিত ভালোবাসা । সব ক্লেদ জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যেত ।

6 comments:

  1. ভালো লাগল, প্রদীপ্ত।

    ReplyDelete
  2. E jagat propochomoy..hok kotha..bhalo laglo

    ReplyDelete
  3. office er majhe amar ektai shanti , tui amar bondhu , alingan pagla, chol chol erokom jyotsnamakha rastay hatte beroi dui bondhu , uhu jaga rajdeep jit jutleo jute jete pare

    ReplyDelete
    Replies
    1. :) এ জ্যোৎস্নায় একা ভিজতে হয় রে পাগলা

      Delete