Thursday, July 6, 2017

জল জঙ্গল পাহাড়ের গল্প (শেষ)

...ঘুম ভেঙে দেখি ফের সব মেঘে ঢাকা। মিংমা চা এনেছিল। বললাম কি হলো ভাই আয়া নেহি। উত্তরে যথারীতি ঘাড় নেড়ে দাঁত বের করে বলে 'নেহি আয়া'। আরে! নেহি আয়া তো পাতা হ্যায় নাকি কেন নেহি আয়া সেটা জিজ্ঞেস করছিরে মর্কট। ফের বললাম কিঁউ নেহি আয়া? 'নেহি আয়া'। আর বেশীক্ষণ প্রশ্নোত্তর চালালে হয়ত আমি লোটা কম্বল নিয়ে হিমালয় চলে যেতাম তাই তাড়াতাড়ি চুপ করে চা খেয়ে রেডি হয়ে ফের আশেপাশে ঢুঁ মারতে বেরিয়ে গেলাম।
কভি আও মেরে হাভেলী পে

শেষ রাতে বৃষ্টি হয়েছে, গাছ গুলো চনমনে হয়ে আছে। আচ্ছা অসময়ে চান করলে গাছেদের সর্দি লাগার ভয় নেই না? কোনো মা গাছ কি তার ছানা গাছ কে বলে 'এক দিনে দু বার তিন বার ভিজছিস, বর্ষার জল জ্বর আসবে। যা মাথা মুছে নে শিগগির।' ছানা গাছ কি তখন বলে 'মা এক কাপ রোদ দাও না, সকালের রোদের ফ্লেভার দেওয়া'? এই সব হাবি জাবি ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি। চারদিকে পাখিদের বর্ষার ক্লাস চলছে। কিচমিচ কিচমিচ করে বাচ্ছা পাখি গুলো কুচুর কুচুর করে একটু উড়ছে, আমি ক্যামেরা তাগ করছি তারা ফের কিচ কিচ করে দুয়ো দিয়ে অন্য জায়গায় উড়ে পালাচ্ছে। ভোঁ ভোঁ করে ভোমরা উড়ছে, ভেজা মাটি গাছ সব মিলিয়ে চমৎকার একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারা জায়গাটায়। এক জায়গায় বসে বসে পাখির ডাক রেকর্ড করতে গেলাম, হতভাগা পাখিটা কি বদ রে ভাই, যেই আমি রেকর্ড অন করছি ব্যাটা টের পাচ্ছে বোধহয় লম্বা একটা পজ দিচ্ছে তারপর আমি পজ করছি ও ব্যাটা ডেকে উঠছে। হলুদ হলুদ ফুল ফুটেছে এক জায়গায়, ছবি তুলতে গেলাম কিরম বিচ্ছিরি এলো!! 













ও আচ্ছা আচ্ছা, বেশ নাও এই ক্যামেরা মোবাইল সব রাখলাম তোমাদের দিকে পুরো ফোকাস নাও হে বলো কি বলবে। অনেক অনেকক্ষণ জঙ্গল কোনো কথা বলল না আমায়। পাখি নিজের মনে ডাকতে থাকলো, জঙ্গলে পাতা কোনো পাইপ থেকে ছিড়িক ছিড়িক জল ছিটকে পড়ার আওয়াজ আসতে লাগলো, পোকার আওয়াজ হতে থাকলো। চুপ করে জঙ্গল কি বলতে চায় শুনতে গিয়ে বুঝলাম আসলে এ সমবেত শব্দ শোনাতে চায় আমায় সে, আমার প্যান্টের, জ্যাকেটের পকেটে মুঠো ভরে দিয়ে দিতে চায় পাথেয় যাতে অনেক অনেক দিন আমার মন খারাপ না করে অকারণ। সেই যে সেবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ফ্রেন্ডলি আম গাছটার সাথে মোলাকাত হয়েছিলো, ওইই নিশ্চয়ই খবর পাঠিয়ে দিয়েছে বিষণ্ণতা ব্যাধির খপ্পরে পড়ে যাই আমি খালি খালি, অকারণ মন খারাপ সারারে আমার পথ্যি দরকার। প্রকৃতি আমাদের শেষ আশ্রয় আমরা সবাই জানি তবু তা ধ্বংস করার সে কি আশ্চর্য নেশা আমাদের। অদ্ভুত! স্যাডিস্ট না বোকচন্দর বোঝা মুশকিল। চলে যাওয়ার আগে সব্বাইকে থ্যাংকু বলতে ইচ্ছে করছে খুব, মন ভালো হয়ে গেছে আমার, কোনো অভাববোধ কোনো না পাওয়া কোনো রেস আমায় উত্তেজিত করছে না। গাছেরা যে আমাদের থেকে ঢের উন্নতপ্রাণ তা ফের টের পেলাম আরো খানিক পর। আমার আরো খানিকক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করছিলো।।কিন্তু পারমিট একদিন এরই এনেছি আর বন্ধু শেরপাও একদিনের রসদ দিয়েই পাঠিয়েছে। মোবাইলে যোগাযোগ করা যাবে না টাওয়ার নেই। বাংলোয় যাবার আগে ইচ্ছেটা পড়ে ফেলেছিলো বোধহয়।

বাংলোয় এসে দেখি লুচি তরকারি রেডি, খেয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এবার ফেরার সময় ইচ্ছে করে মিংমা, বাচ্ছা আর খোকনকে এগিয়ে যেতে দিয়ে পিছিয়ে পিছিয়ে হাঁটছিলাম। হাঁ কিরে কুয়াশা মেঘে ঘেরা রাস্তা দেখবো বলে, গাছ দেখবো বলে। বাঁশ গাছ গুলো কি রোগা চেহারা রে বাবা। এদের বাবা মা কি অন্য বাঁশ গাছ দের দেখিয়ে ওদের মতো হতে বলে? না মনে হয়, গাছেরা সভ্য জীব। আচ্ছা তলতে বাঁশ না কি পড়েছিলাম ছোটবেলায় নানান বইতে সেগুলো কি এই রোগা বাঁশ গুলোই? ব্যাগটা বেজায় ভারী লাগছে, কাল থেকে সমানে বয়ে চলেছি কিনা। একটু থামি। আচ্ছা গাছেরা হয়ত নিজেদের মধ্যে কথা বলে জোরে জোরে, চলাফেরাও করে তারপর যেই মানুষ দেখে অম্নি শিকড় গজিয়ে স্থির। হতেই পারে, কে আর জঙ্গলে সিসিটিভি অন রেখেছে। 


টুকটুক করে হিলি পৌঁছে গেলাম। মিংমা দেখি খুব লাফাতে লাফাতে এগোচ্ছে। বললাম কি এতো তাড়া কিসের? বলে, 'গাঁও মে জায়েঙ্গে লেড়কি দেখেঙ্গে মস্তি করেঙ্গে'। ও তাই বলো কাকা, এই জন্যই তুমি ডেন্টাম যেতে চাওনি। ব্যাটা নরকে লাউএর বিরিয়ানি পাবি হতভাগা দেখিস। যাকগে। খোকন এম্নিতে খোকন হলে কি হবে টাকাপয়সার ব্যাপারে বেশ চৌখস। বন্ধু শেরপাকে ফোনে পাকড়ে বলল, আমাদের ব্রেকফাস্ট বেজায় কম হয়েছে, মোটে তিনটে চারটে করে লুচি পেয়েছি। এখনই খিদে পেয়ে গেছে। এখানকার লোকেরা অত প্যাঁচাল না। বলে দিলো বেশ হিলিতে বাইচুং এর দোকান থেকে (ভুটিয়া না ইনি শেরপা) নুডলস খেয়ে নাও, পয়সা দিতে হবে না। 

ভাইচুং থাকে ওখানেই, ওর হোমস্টে আছে হিলিতে।চাষবাস করো।না? 'না প্রচুর খাটতে হয় , তার চেয়ে ট্যুরিজম এ টাকা বেশী খাটনি কম'।

হিলি থেকে ফের ওখ্রে নামবো কিভাবে? হেঁটে বারো কিলোমিটার। বন্ধুকে গাড়ি পাঠাতে বলা যায় বা হেঁটেই নামা যায়। উৎরাইতে বারো কিলোমিটার চাপ হবে না খুব। 'কিরে তুই কি করবি?' খোকনকে জিজ্ঞেস করলাম। বলল চল চল হেঁটেই যাই। খানিক দূর এগিয়ে এসেছি, পিচ রাস্তা দুধারে গাছপালা পাহাড়, ক্রমে হিলি আর দেখা গেলো না, মোবাইলের টাওয়ার ফের চলে গেলো আর আমাদের খোকনবাবুর ভয় করতে লাগলো। 'ভাই গাড়ি নিয়ে নিই চল, আরেকটু পিছলেই টাওয়ার পাবো, একটাও লোক নেই দেখছিস, বর্ষার জঙ্গল, এই দেখ কোনো জন্তুর টাটকা পটি। ঘুরতে এসেছিস ভাই লাইফ রিস্ক কেন নিবি।' কাল থেকে সমানে ঘ্যানঘ্যান শুনে অলরেডি বিরক্ত ধরে গেছিলো, খুব ঠান্ডা গলায় বললাম, 'আমি এই জন্যেই একা বেরিয়েছি, মদ খাওয়ার জন্য না। তুই তোর মতো ঘোর, আমায় আমার মতো ঘুরতে দে কেমন?'।

গাড়ল হলেও বুঝেছে আমি গোঁয়ার টাইপ বেশী ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। আমায় বলল তাহলে প্লিজ একটু পিছিয়ে চল, বন্ধুকে ফোন করে ডাকি, তারপর ও এলে তুই চলে যাস। খুব বিরক্ত হলেও নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে ভেবে পিছিয়ে গেলাম ফের এক কিলোমিটার মতো, বন্ধুকে ফোন করে ডাকা হলো। আমি বললাম, বসে না থেকে হাঁটি, কারন তোর জন্তু হাঁটলেও খাবে বসলেও খাবে কেমন? নেহাত অনিচ্ছাকৃত ভাবে হাঁটতে লাগল সে, একা বসে থাকবে এমন সাহস নেই। যাই হোক একটু পরেই বন্ধুর গাড়ি এসে নিয়ে গেলো তাকে। গাছেরা বুঝেছিলো বলেছিলাম না?








আমি হাঁটছি টুকটুক করে। আর গাড়ি আসবে না বা যাবেনা এ পথে এখন। চওড়া পিচের বাঁধানো রাস্তা, গাছপালা দিয়ে ঢাকা, মাঝে মাঝে পাহাড়ের গা বেয়ে জল নেমে আসছে আহা আর কি চাই। বারো কিলোমিটার হোক কি যাই হোক আমার কিচ্ছু যায় আসেনা। পিঠের ব্যাগটা ভারী এই যা। 
একটা কাঠবিড়ালি তুড়ুক তুড়ুক করে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটলো, হয় খেলা আছে নয় কাঠবাদাম পার্টি নয় ডেটিং নইলে এতো ফুর্তিতে লাফাবে কেন। একটা বাঁদর এক মনে গা চুল্কাচ্ছে, মানুষের কাছাকাছি জীব তো তাই সন্দেহবাতিক। আমার দিকে ঘাড় উঁচিয়ে তাকালো। আমি না থেমে এগিয়ে গেলাম। একটা একটা বাঁক পেরোচ্ছি আর যেন মনের একটা একটা ফুর্তির দরজা খুলে যাচ্ছে। আশেপাশে কোলাব্যাঙ বা কুকুর নেই সঙ্গত দেওয়ার জন্য সেই ভরসায় গলা ছেড়ে গানও ধরে ফেলেছি। এই যাহ সাথে সাথে টুপটুপ করে বিষ্টি শুরু হলো যে হ্যাঁ। আচ্ছা আচ্ছা আর গাইবো না, মনে মনে গাইবো।অত ইয়ের কি হে, হ্যাঁ না হয় গলাটা ভেঙ্গেছে একটু বেশীই হেঁড়ে ভাব হয়েছে তাই বলেই গায়ে জল ঢেলে দিতে হবে!! আমিও ভেবেছিলাম ওখ্রে পৌঁছে তবেই হিসি করবো, জঙ্গল নোংরা করব না করে দেবো কিন্তু তার আগেই বৃষ্টি না থামালে। হুমকিতে কাজ হলো, অবশ্য সত্যি বলতে প্লাস্টিক ফেলার মতো খারাপ কাজের থেকে কম দূষণীয় কাজ হতো। যাই হোক ফের কাচ মুছে এগোলাম। আচ্ছা শোনো বৃষ্টিতে আপত্তি নেই এখন না কেমন আরেকটু এগিয়ে যাই। পাগল ভাবতে পারে গাছ কেটে গাছের গুঁড়ি দিয়ে পার্ক বানানো লোকজন আমায় কিন্তু গাছেদের সাথে কমিউনিকেশন করাটা শিখে গেলে মেঘ বৃষ্টি নদী পাথর সব কিছুর সাথে কমিউনিকেট করাই সহজ হয়ে যায়। আর একবার শিখতে পারলে একা একা ঘুরতে বেড়াতে ভারী মজা। নিজের মতো ঘোরো ভালো লাগলো অম্নি সেটা শেয়ার করে দাও গাছেদের সাথে রোদ্দুরের সাথে তারা সেটা ছড়িয়ে দেবে আর অদ্ভুত ভাবে তোমার খুশিটাও বাড়তে থাকবে।

ওখ্রের সীমানা শুরু হতে হতেই বৃষ্টি মেঘ দিয়ে ঢাকা পড়ে গেলো সব। ভিজিবিলিটির চেঞ্জটা দেখার মতো, প্রথমে পাঁচশো মিটার তারপর একশো মিটার তারপর জিরো। মেঘ ভেদ করে করে মেঘনাদ হয়ে এগোচ্ছি। ক্রমে মেঘটা একটু দূরে সরল বৃষ্টি বাড়লো। রাস্তার পাশে একটা আধটা ছোটখাটো দোকানের মালিক/মালকিনরা অবাক চোখে দেখছে আমায়। পিঠে ব্যাগ, রেনকোট পরা, একা একটা ছেলে কোত্থেকে কোথায় যাচ্ছে এ বৃষ্টিতে!
এবার একটু কষ্ট হচ্ছে, ওখ্রে মঠে পৌঁছতে চড়াই ভাঙতে হয়। একটা শর্টকাট নেবো বলে একজনের ক্ষেতের পাশ দিয়ে যেই না এগিয়েছি, ঘেউঘেউ খেউমেউ করে একটা কুত্তো হাঁকডাক লাগালো। কুয়াশায় মেঘে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না হতচ্ছাড়াটা কতদূরে আছে। কামড়ে দিলেই চিত্তির।।মানে মানে কেটে পড়লাম সেখান থেকে। যে বীর হৃদয় জোঁক ভালুক কিচ্ছুর জন্য কম্পিত হয়নি সে সামান্য কুকুরের চিৎকারে পথ বদলালো তা নিয়ে অত খ্যাক খ্যাক হাসির কিছুই হয়নি মশাই, ছোটখাটো দুঃখই চিরকাল বেশী বিব্রত করে মানুষকে বড় শোক হয়ত সয়ে যায়।

স্কুলের ছুটি হয়েছে সবে, অঝোর বৃষ্টির মাঝেই মস্ত মস্ত ছাতা মাথায় ছেলে মেয়ে গুলো ফিরছে। আমার সামনে তিনটে মেয়ে দুটো ছাতা মাথায় যাচ্ছে। কিশোরী মেয়েদের যেমন হওয়া উচিত তেমন, নিজেদের মধ্যে অনর্গল রহস্যময় বকবক করে করতে যেতে গিয়ে পিছন ফিরে যেই আমায় দেখেছে অমনি তাদের কারনহীন হাসির দমকে বৃষ্টিও থমকে যায়। যত্তসব! হুহ, এদিকে আমি খুব বুঝতে পারছি আমার পা জবাব দিয়েছে, আর হাঁটতে চাইছে না, জুতো ভিজে চুপ্পুর, পিঠের ব্যাগও ভিজে ঢোল। রেনকোট চুঁইয়ে জল আমার গেঞ্জি ভিজিয়ে দিয়েছে। পিঠের ব্যাগটা মনে হচ্ছে গন্ধমাদন। এমন সময় খামোখা হাসলে রাগ হবে না হ্যাঁ! হাঁটুর বয়সী সবকটার সামনে দিয়ে গম্ভীর মুখে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলাম। দলে থাকলেই মেয়েগুলো এরম খামোখা হাসে কেন কে জানে!

রাস্তার পাশে একটা বাড়ি দেখে ঢুকে পড়লাম একজন লোক দেখা যাচ্ছে 'বসব ভাই একটু'? আমার হিন্দি শুনেই বোঝা যায় নিশ্চিত আমি বাঙালী। আলাপ জমে উঠলো। গনেশ নাম তার, আলু ব্যাবসা করে, ঘুরতে সেও বেজায় ভালোবাসে। আমায় বলল আমি যেন যত পারি ঘুরে নিই এখন, নইলে এরপর বিয়ে শাদী হবে বৌ বাচ্ছার চক্করে পরে খালি আলু ব্যাবসা করতে হবে নো ঘোরা ব্যাবসা। বিয়ের আগে সেভেন সিস্টার স্টেট সব ঘোরা রে ভাই এখন খালি শিলিগুড়ি গ্যাংটক আর আলুরক্ষেত! আচ্ছা শিলিগুড়ি গাড়ি তো যাচ্ছে না তুমি যাবে কিভাবে? আমার গাড়ি গ্যাংটক যাচ্ছে তুমি গ্যাংটক চলে যেতে পারো, ওখান থেকে তো টুরিস্ট ফিরবেই তাই না, জোড়থাং থেকে যেমন চান্স টা কম। আমি জানালাম যে অত চাপ নিচ্ছিনা কিছু না কিছু পেয়ে যাবো আশা করি দেখাই যাক। তখন সেও বলল হ্যাঁ হ্যাঁ একলা আছো, কিছু ব্যাবস্থা হয়েই যাবে, আর আমার নাম্বার রাখো কোনো অসুবিধে হলে গ্যাংটক এলে ফোন কোরো। 
-আপনি থাকেন কোথায়?
-আরে আমার বাড়ি এখানে নাকি, আমি আমার বন্ধুর বাড়ি এসে থাকি আলু আনতে এলে। আমার কিরকম বন্ধু জানো? আমাদের এমএলএ এক, হা হা হা। যেমন কোলকাতার বাইরে গেলে স্টেট দিয়ে তুমি চেনা খোঁজো, আর দেশের বাইরে গেলে দেশ দিয়ে তেমনি আর কি। তা তুমি কোথায় থাকছ? আমার বন্ধুর বাড়ি থেকে যেতে পারো। টাকা পয়সা লাগবে না কিচ্ছু। আমার বন্ধু মানে তোমারো বন্ধু আবার কি।
- না না ওখ্রে মঠে আমার থাকার কথা আছে। না গেলে ওনারা ভাববেন হয়ত।
আপন করে নেওয়াই সহজ আসলে, সভ্য উন্নত সন্দেহবাতিক মন তাই যে কোনো সহজ কে জটিল করে তুলি। দেশের বাইরে গেলে দেশ দিয়ে পরিচয় খোঁজার মতো সত্যি আর কিই আছে। বাইরে থাকতে দেশী না দেশী না এইটুকুই তো প্রথম কথা হতো। হয়ত একদিন পৃথিবী ছেড়ে মানুষ দূর নক্ষত্রে পাড়ি দেবে তখন মানুষ দিয়ে মানুষ এর চেনা বেরোবে। 

ফের এগোতে লাগলাম টুকটুক করে, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তাও বৃষ্টিতে পাহাড়ে হাঁটতে ভালো লাগছে।
পৌঁছতেই দিদি আদা দেওয়া চা দিলো, চান টান করে ঝুম হয়ে কাঠের আঁচের উনুনের পাশে বসে চা খেতে খেতে হাত পা জ্যাকেট সব শুকিয়ে নিলাম। তারপর পা কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে, বেশী হাঁটা না, তোর কষ্ট হলেই ফিরে আসবো ইত্যাদি স্তোক দিয়ে বেরোলাম ফের।


পাহাড়ি দিদি :)
 পাহাড়ে ধাপ কেটে কেটে চাষ, মানুষের বাস। গরু, শুয়োর বাঁধা রাস্তার পাশে। কুয়াশা কেটে এগোচ্ছি দেখি দুই ভাই বোন বেরিয়েছে তাদের ছোট বোনের এক এক হাত ধরে ঝোলাতে ঝোলাতে। দাদাটি একটু বড়, আমার কোমরের কাছে হবে তাই একটু রাশভারী। সব চেয়ে মজার ক্ষুদেটা, দাদা দিদি মিলে ঝোলাচ্ছে তাতে এক্টুই কান্নাকাটি নেই বরং দিব্যি মজা পাচ্ছে।


 একটা গাড়ি এসে থামলো। মা একরাশ জিনিস নিয়ে আর ছানাকে স্কুল থেকে নিয়ে নামলো। পাহাড় বেয়ে অত জিনিস নিয়ে একা উঠবেই বা কি করে, ছানার ব্যাগটা ঝাঁকিয়ে দেখে নিলো কত ভারী, তারপর তাকে একটা মাদুর বা কার্পেট টাইপ কিছু একটা রোল করা জিনিস ধরিয়ে নিজে দু খানা মস্ত ভারী ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে চলল। ভুট্টা ক্ষেতের কাজ শেষে পিঠে ঝুড়ি বেঁধে মেয়েরা ফিরছে, কাস্তের মতো দেখতে একটা জিনিস হাতে। ক্রমে আলো কমতে লাগলো, কুয়াশা বাড়তে লাগলো। গুম্ফা থেকে ভ্রোঁম বুম বুম আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো। কাল পরীক্ষা আছে বাচ্ছা লামাদের। আজ তাই প্রার্থনায়, সময় কম কিন্তু ভক্তি বেশী দেখলাম। কালো কুকুরটার সাথে কোনো লামাই খেলছে না। দুজন বাচ্ছা লামা খুব মন দিয়ে পড়া মুখস্থ করছে। একটা পোকা দেখে বই সাইড হয়ে গেলো। পোকাটা উলটে পালটে খানিক পড়ার সময় কমানো গেলো। তারপর যেই না ছুঁড়ে মাটিতে ফেলেছে কুকুরটা লাফিয়ে লাফিয়ে খেতে ছুটেছে। ছাগল ভাব সম্পন্ন কুকুর আর কি। তারপর কুকুরকে নিরস্ত করতে গিয়ে পরীক্ষা দূরে চলে গেলো। ক্রমে রাত বাড়লো, লামারা নিজেরা খেয়ে কুকুরকে খাইয়ে শুতে গেলো। আমরাও খেয়ে নিলাম। আগেরদিন খাওয়ার পর রডোয়াইন খাইয়েছিলো আজ খাওয়ালো স্ট্রবেরী ওয়াইন। বাড়ির তৈরী। জাতীয় সড়ক অবরোধ হয়েছে নাকি। ধ্যের কাল ভাববো।

সকালে তাড়াতাড়ি খেয়ে বেরিয়ে গেলাম, না হলে শিলিগুড়ির গাড়ি না পেলে চাপ হয়ে যাবে। নুন চা বলে বস্তুটা খেতে কি অদ্ভুত মাইরি। সন্ধ্যেবেলা ট্রেন। এ দুদিন নেট অন করার চাপই নিইনি। কুয়াশায় মাখা মঠ, নীল ফুল, সবুজ পাহাড় পিছনে রেখে পিডিভাই এর গাড়িতে। নানান কিসিমের লোক ফের উঠলো নামলো, গল্প গুজব বাজারের দরদাম ঠাট্টা তামাশা করতে করতে জোড়থাং।

একটাও গাড়ি নেই শিলিগুড়ি যাবে। একজন বলল বাস যাচ্ছে। জোড়থাং এর বাস টার্মিনাসটা বেড়ে। চারতলা, লাস্ট ফ্লোর থেকে বাস ছাড়ে। বাসের জন্য লম্বা লাইন। একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করতে বলে তুমি একা কেন? বাড়ির লোক কই? আমি যত বলি আমি একাই এসেছি কিছুতে বিশ্বাস করেনা, বন্ধু বান্ধব নিদেনপক্ষে? না রে বাবা একাই এসেছি। সারা ট্রিপেই এই অবস্থা বহুবার ঘটেছে আমি তাই হাসি হাসি মুখে খালি জানাচ্ছি একা রাগ করছিনা। শেষে বিশ্বাস করলো, তারপর বলল আচ্ছা ওই যে বাসের লাইন ওখানে দাঁড়াও আপাতত। গাড়ি ছাড়ছে তবে একটা গ্রুপ করে গাড়ি ঠিক করতে হবে। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি দেখি দুটো বাঙালি পুরুষ মহিলা, আরে এদিকে এসো না তাড়াতাড়ি বলে দৌড়োদৌড়ি করে নীচে যাচ্ছে। আমি দোনোমনা করে পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা গাড়ি কি ছাড়ছে? সে তো আমায় দেখে হাঁ হাঁ করে উঠলো, আরে তুমি যাওনি, আচ্ছা দাঁড়াও। একজন লোককে ডেকে আমায় তার হাতে দিয়ে পাঠালো গাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তারপর দেখি সে নিজেই ফের হাজির হয়েছে, ড্রাইভারকে বলছে এ একা আছে একে নিয়ে যাও। সব্বার ভাড়া চারশো করে নিলেও আমার জন্য কম ভাড়ায় সামনের সিটে ব্যবস্থা করে সে ফিরে গেলো ফের।

এই যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম হঠাৎ, ভার্চুয়াল টু রিয়েল কত মানুষ এ এরম অযাচিত ভালোবাসায় ভরে দিয়েছে আমায়। চারদিকে এতো ঝামেলা লড়াই তাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছেই করেনা আমার। কি জানি আমি হয়ত হ্যাপ্পি প্রিন্সের মতো দেখতে পাচ্ছিনা তবু বলব চারদিকে ভালোটাই বেশী বোধহয়, সে ভালোরা রুট বাতলে দেয়, টিকিট এর ব্যাবস্থা করে দেয়, গাড়ি ঠিক করে দেয়, থাকতে দেয়, মাঝরাতে আলোর জ্বালিয়ে দেয়, বৃষ্টিতে ভিজে এলে গরম পানীয় দেয় আর মন খারাপ সরিয়ে দেওয়ার জন্য গাছ পালা দিয়ে সাজিয়ে দেয় প্রকৃতি, মেঘ দিয়ে আদর করে দেয়, বৃষ্টি দিয়ে ধুয়ে দেয়। খারাপ যেটুকু সেটুকু ভ্রম সেটুকু ইলিউশান। সেই ইলিউশান মন ছাইলে ফের পালাতে হবে তদ্দিন আমার মুঠো ভরা ভালোটুকু থাক।

8 comments:

  1. ওরে বাবা, আমি অত হাঁটতে পারতাম না। সশ্রদ্ধ সেলাম তোমাকে, প্রদীপ্ত। খুব, খুব ভালো লাগল বেড়ানোর গল্প।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হুঁ আমি হাঁটতে খুব পারি বটে :D । লেগেছে শুনে খুব ভালো লাগলো ^_^

      Delete
  2. Khub bhalo laglo re

    ReplyDelete
  3. মনখারাপ বড্ড ছোঁয়াছে, আমার এখন বড্ড মনখারাপ করছে, বড্ড ভাল লিখেছিস এটা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এহে মন খারাপ করিয়ে দেওয়া কাজের কথা মোটেও না 😞

      Delete