Sunday, May 21, 2017

মাঠে ঘাটে বেলা কাটে

তীরকাঠি করার জন্য ফেলাকাকা কঞ্চি কাটতে গেছে, আমি যাচ্ছি ফেলাকাকাকে খুঁজতে। তীরকাঠি বানানো দেখবো, রাতে পূজোর জন্য চাই, কঞ্চির মাথা চারফালি করে তালপাতা গাঁথা হবে তারপর কাদার তালের মধ্যে গুঁজে দেওয়া হবে, তারপর সূতো জড়িয়ে মাধব(মা স্পেস ধ স্পেস বো এভাবে বলতে হবে) মানে আমাদের পুরোহিত, বিড়বিড় করে এটা সেটা বলে ঠাকুরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবে। ঠাকুরের প্রাণ ধরে রাখবে যে ভোমরা সে জিনিস কি সোজা নাকি?
এখন তিল,বাদাম,পটল, পাটের সময়, তিলফুলে প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে, একটা কাঠঠোকরা তালগাছে নক করছে "ঠক ঠক, কেউ আছেন? কই, পোকা টোকা কেউ আছো নাকি হে"। আমবাগান পেরোতে গিয়ে দেখি একটা গাছ পাকা আম মাটিতে পড়ে আছে। আমি তো আর বোকা মানুষগুলোর মতো না যে ভাববো,  বোঁটা শুকিয়ে পাকা আম খসে পড়েছে। আমি জানি এটা আমার গিফট, আম গাছটা দিয়েছে। গিফট দিলে নিতে হয় থ্যাংকুও বলতে হয়। "থ্যাংকু স্যার" বলেই জিভ কেটেছি। হাওড়া জেলার গাছকে বাংলায় বলা উচিত ছিলো, এ ভাষাটাই জানে নির্ঘাত। বাংলায় ফের বলতে গেলাম, দেখি সব কটা গাছ মুচকে মুচকে হাসছে। আররে তাই তো গাছেরা তো আমাদের থেকে এগিয়ে আছে,  অত কথা বলতে হয় নাকি। আমি একটা ছানা পাতাকে ছুঁয়ে দিলাম, অমনি পুরো ডালটা এগিয়ে এসে আমার চুল ঘেঁটে কপালে আদর করে দিলো।
ওইতো ফেলাকাকা, বাঁশঝাড় থেকে কঞ্চি কাটছে। 'আমায় দাও না কাঠারিটা আমি পারবো দেখো'। বাড়ির থেকে দূরে থাকা সব চেয়ে ছোট ছেলে হলে অনেক খাতির। এমনিতে দিতো না হয়ত, কিন্তু আজকে একচান্সেই দিয়ে দিলো, "কই কাট দেখি?"
আমার কোপ গুলো কিছুতেই একজায়গায় পড়েনা,  এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তবু মসৃন করে আনছি....প্রডাকশনে লাইভ হয়ে গেছে।
ঠাকুরের পূজোর শশা তুলতে যাচ্ছে সুজিতদাদা, আমি লেজ হয়ে গেছি। শশা তুলবো আমিও। আমি টান মারছি গুঁড়ি মেরে বসে মাচার নীচে, সুজিতদাদা শিখিয়ে দিচ্ছে, না পাইলট গাছ টানলে পুরো মাচা ভেঙে পড়বে; আমি পাক দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছি, সুজিতদাদা ফের নিষেধ করছে, পাক দিলে গাছের লাগে, ক্ষতি হয় গাছের, বোঁটার গোড়াটা ধরে ঠেলতে হয়। খানিকক্ষণের মধ্যেই দেখি কাদায় ঘামে আর ফুর্তিতে আমার ফতুয়া মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে।
ছানা পাতাটার কাছে ফের গেলাম, খুব মজায় আছে, জৈষ্ঠ মাসের গরমে আমেদের কষ্ট হচ্ছে হয়ত কিন্তু ছানা পাতার কিচ্ছু যায় আসছেনা। খানিক লাফালাফি করবেই হাওয়া দিলে। গাছটাও বুড়ো কাকা জ্যাঠার মতো প্রশ্রয় দিচ্ছে। বললাম কই এই অব্দি আয় দেখি,  এক লাফে চলে এসে নাক ছুঁয়ে দিলো। আচ্ছা বেশ আমিও মাথা দিয়ে ঢুঁসো দেবো। ওদিকে মেজদাদা ডাকছে ডাব খেতে আচ্ছা পরে হবে ফের।
আইস্ক্রীমওলা এসেছে, দুটাকার কাঠি আইস্ক্রীম, আগে চারানার ছিলো। ঘেমে গেছি বলে কাকা,  মেজদাদা সবাই মিলে চেঁচামেচি করে আর খেতে দিলোনা।
গরমকাল আমার বড্ড ভাল্লাগে। খাওয়ার পর সারা বাড়ি নিঃঝুম,  আমাদের বাড়ির কলতলায় সিমেন্টের খোবলা উঠে গেছে একেক জায়গায়।সেখানে জল জমে থাকে আর বাকি সব জায়গাটা রোদে শুকনো। আমি সেই ছোটবেলার গরমের ছুটির দুপুর এর মতো জল দিয়ে গর্তটা ভর্তি করে দিচ্ছি। একটা গর্ত শ্যাওলা ভরা টলটলে জল আরেকটা গর্ত সোঁ করে ফুরিয়ে যাওয়া। ওইটার নীচে চোরাবালি আছে নাকি? কিংবা সেইই পাতালপুরীতে যাচ্ছে হয়ত। গুপ্তধনও থাকতে পারে। নইলে ওখানটা অমন ফাঁপা কেন?
কিসের যেন একটা হট্টগোল হচ্ছে, এক দৌড়ে গেলাম। হনুমান এসেছে আম খেতে, তনুদা তাড়া দিচ্ছে, চলে গেছে। তাড়া দিতে গেলো নাকি আম খেয়ে টক লেগেছে বলে গেলো কে জানে। বোকা আছে কিন্তু, কাঁচা আম কেউ খায়!! হনুমান না গরু কে জানে!
মাঠ চড়তে বেড়িয়েছি। জবাব দিতে দিতে হাঁটছি, কাদের বাড়ির ছেলে, কবে এসেছি, দিদিরা আসেনি কেন, রোগা হয়ে গেছি, এখনো বাইক চালাই কিনা, কোন 'ফ্যাক্টরি' তে কাজ করি, মা কেমন আছে,বাবা কেমন আছে এইসব। মাঠে সেকেন্ড শিফটের কাজ চলছে, ডিপ টিউবওয়েল থেকে জল নিয়ে নিয়ে পটল, বাদাম জমিতে জল যাচ্ছে। পাট ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে, পৃথিবীর যে কোনো সেরা পাখার থেকে জোর হাওয়া আর সেরা এসির থেকে ঠান্ডা আরামের হাওয়া। জল নালা দিয়ে ছপছপ করতে করতে এগিয়ে গিয়ে খুরপিটা দাও না কাকা বলে আল কাটছি,  আল বাঁধছি। ফিরে এসে ফের ডিপটিউওয়েলের পাশে বসেছি। আরে একপাল মা বিছে তার ছানা পোনা নিয়ে ইভনিং ওয়াক করতে বেরিয়েছে দেখি। আরে আরে একটা গেলো জলে।হারাধনের দশটি ছেলে কেস।
বেলা পড়ে আসছে, একজন লোক কোদাল নিয়ে হাত পা মুখ ধুয়ে গেলো ডিপটিউওয়েলের জলে। একজন তার ঘোলা জলের বোতলটা ভরে নিলো। একটা বাচ্ছা মেয়ে নেংটি পরে ছুটতে ছুটতে বাবার পিছনে পিছনে বাড়ি যাচ্ছে, বাবা একহাতে গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আরেক হাতে কোদাল নিয়ে যাচ্ছে।
দূর থেকে আমাদের বাড়ির থেকে ঝাঁঝ কাসর ঘন্টা ঢাক এর সম্মিলিত আওয়াজ ভেসে আসছে। ক্রমে অন্ধকার হয়ে এলো। তারা নেই চাঁদ ওঠেনি এখনো তবু আকাশের আলো আছে,  জোনাকিরা গান ধরেছে। গাছপালা গুলো শিল্যুট ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে।
সারারাত্তির পূজো দেখার এনার্জি আমার নাই, ছোটবেলায় ছিল কিন্তু ছোটবেলায় মা জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিতো। কৈশোরসুলভ নিজেদের বড় প্রমান করার প্রচেষ্টায় একবার আমি ছোড়দি অরিত বুয়া রিমাদি মিলে সারারাত জেগেছিলাম বটে, ওই একবারই। ভোরবেলায় মা যেই বলেছে মাছ ধরা দেখবি যে,  তড়াক করে উঠে চোখ হাফ বুঝেই পুকুরপাড়ে। এদিকে চশমা ফেলে এসেছি, তাও দেখতে পাচ্ছি বটে জামগাছে হেলান দিয়ে, জেলেরা মাছ বেছে বেছে হাঁড়িতে ফেলছে আর নয়ত জলে ফেলে দিচ্ছে।
পুকুরে জল কমে কাদা কাদা হয়ে গেছে, একটা বক বাবাজি ট্রাই করছে কাদা ঘেঁটে কিছু পাওয়ার। একটা মাছরাঙা সাঁ করে ডাইভ মেরে একটা মাছ নিয়ে পালালো। আমি ফের মাঠে দিকে হাঁটা দিয়েছি।
বাদাম জমিতে সাপ থাকে কাল আমাদের এক চাষী বলছিলো, সে আমায় কিছুতেই তার জমিতে নামতে দিতে চায়নি, ও জল নাকি ভালো না। আমার সাথে পারবে কেন,  বললাম কই তোমার তো কিছু হচ্ছে না কাকা। বলে আমাদের অভ্যেস আছে, আমিও নাছোড়বান্দা, প্রথমদিনে হয়েছিল কিছু?
সাপ এর ভয় পাচ্ছি একটু,  তিলগাছ গুলো খসখসে,  একটা কি পোকা কামড়াচ্ছে পায়ে এদিকে নিচুও হতে পারছি না,  পায়ে সাপ কামড়ালে হাত দিয়ে বাঁধন দেয়, হাতে কামড়ালে পা দিয়ে তো আর বাঁধন দিতে পারবো না। এদিকে ওদিকটা দিয়ে ঘুরে কালকের রাস্তাটা ধরার উপায় নেই, একটা জাঁদরেল গরু শিং বাগিয়ে বসে আছে।
কালকের সেই ফ্রেন্ডলি আমগাছটার কাছে গিয়ে দেখি,  একদিনেই ছানা পাতাটা খানিক বেড়ে গেছে। আজ কেউ মাথাও দোলাচ্ছে না কিচ্ছু না।  সাধারণত গাছেরা রিজার্ভ প্রকৃতির হয়, মানে তুমি ছায়া নাও ফল নাও পাতা ছেঁড়ো কিছুইতেই কিছু রিয়্যাকশন দেয়না। আসলে গাছেরা একটা অন্য লেভেলে বাস করে, মানে চাষের গাছ গুলো অতটা না তবে বৃক্ষ টাইপ প্রাচীন গাছ গুলো। কি করে কমিউনিকেট করব ভাবছি, কার তো ছানা পাতাটা নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছিলো। দাঁড়িয়ে আছি, টুকটাক কথা বলছি, শেষে মনে হলো কালকের আমটা কেমন ছিল জানাইনি কিনা তাই হয়ত একটু গোঁসা হয়েছে। তা মশাই আমার সাথে করলে আমারও হতো। স্বীকার করলুম খাইনি এখনো বিকেলে খেয়ে জানাবো। এরপর যা ঘটলো তা এমনি মানুষেরা হয়ত বিশ্বাস করবে না কিন্তু তাই বলেই তো সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যায়না। এতোক্ষণ হাওয়া দেয়নি, কথাটা বলার পর হাওয়া দিলো আর ডাল আর পাতা গুলো আমার মুখ নাক ছুঁয়ে, আচ্ছা আচ্ছা, মোগাম্বো খুশ হুয়া বলে গেলো।
আসিরে ব্যাটা বিকেলে আসবোখন জানাতে। বলে ফের সেই বাদামবন,  তিলজমি। 'আমগাছ আমার বন্ধু হে, রাস্তা ছাড়ো দিকি' বলে টলে যাহোক পেরিয়ে আসা গেলো।
ঝাঁ ঝাঁ করছে জৈষ্ঠ্য মাসের রোদ্দুর, একটা ছাতারে পাখি ছ্যা ছ্যা করে গেলো আমি এরম রোদ্দুরে মাঠে মাঠে ঘুরছি বলে। মাধব আমাদের রোয়াকেই গামছা মাথায় ঘুমোচ্ছে। ঢাকি ঢুলি তাদের ঢাক রেখে গামছার বিঁড়ে করে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে। রাস্তায় একটাও লোক নেই। অজা পাল কাদায় নেমে ল্যাটা কই শিঙ্গি মাছ ধরছে। "নিয়ে যা না রে দুটো" কে কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমি কিচ্ছু নিতে চাই না তো, এদের বোঝায় কে। গাছের ধারে বসে আছি, এ রোদ্দুরে আর হাঁটাও যাবে না ফেরাও যাবে না।
টেঁপিদিদির মা আমাদের বাড়িতে কবে থেকে কাজ করে কে জানে, আসল নামটা সে নিজেও ভুলে গেছে বোধায়, দাঁত ফোকলা সাদা শাড়ি আর সাদা চুলের বুড়িটা এখন আর পারে না কাজ করতে খালি আমরা এলেই চলে আসে। "হ্যাঁ বাপ, তোমাদের গরমের ছুটি নাই আর কটা দিন থাকলে হতোনা?" এরম সরল প্রশ্নের কি কোনো উত্তর হয়, বললাম না গো জ্যেঠিমা নেই।
বাড়িতে ঢোকার মুখে ঠাকুর দালানের পাশে একটা নারকেল গাছ ছিলো, আগে খেয়াল  করিনি, দেখলাম গাছটা আর নেই, মস্ত শিকড়টা পড়ে আছে।

4 comments:

  1. এই লেখাটা ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ সুন্দর হয়েছে, প্রদীপ্ত। "গাছেরা তো আমাদের থেকে এগিয়ে আছে, অত কথা বলতে হয় নাকি।" কত উঁচু হাই ফাইভ, বলে বোঝাতে পারব না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংকু থ্যাংকু... আমি বুঝেছি, দুদিন গাছেদের সাথে একটু মেলামেশা বেশী হয়েছে তো, না বললেও টের পাচ্ছি 😊।

      Delete
  2. এই লেখাটা নিয়ে কোন কথা হবে না। মন ছুঁয়ে গেল।

    ReplyDelete