Saturday, April 13, 2024

চৈত্রের দিন

চৈত্র মাস সেলের বাজার ছাড়া কেউ খবর রাখে না। আর আজকাল সারাবছরের সেলে চৈত্রসেলের তেমন দাম আছে কিনা কে জানে। কেনাকাটায় আমার তেমন আকর্ষন নেই বলেই সেলের সাথে আমার যোগাযোগ কম। চৈত্র আমার কাছে অবশ্য ফালতু হয়ে যায়নি। ফাল্গুন চৈত্র বৈশাখ...লোকে গরমে ভাজা ভাজা হয়ে রোদ্দুরকে গাল পাড়ে। ফেসবুকে ইভেন্ট হয়, যারা গরম ভালোবাসে বলেছে তাদের পে টা নো হবে,  চিতায় ছোঁড়া হবে। অবাক হয়ে দেখি! ভালোবাসতে হবে না, কিন্তু এরকম মারমুখী হতে হয় বুঝি? তামাশা করেও?! আমি সেই কতিপয় লোকের মধ্যেই যারা এই তীব্র দাবদাহ ভালোবাসে। বাংলা গরমের মাসগুলোর মতোই অর্বাচীন লোক। গোটা চৈত্র মাস আমি বেলার ঝাঁ ঝাঁ রোদে সাইকেল নিয়ে বাজার যাবার নামে বেরিয়েছি, রাস্তাঘাট বেবাক ফাঁকা, গোলাপী, বেগুনী, লাল, হলুদ, চড়া রঙের রোদের মতোই চড়া রঙের ফুল। গাছের নীচে ফুল বিছিয়ে জায়গাটা রঙীন জাজিমের মতো করে রেখেছে। রোদের ঝাঁঝ এসে লাগে, রোদের গন্ধও। বারান্দার গাছগুলোয় কবে এক পাখি খাওয়া বীজ থেকে নিম গাছ হয়েছিল। এ বছর গাছটার সব পাতা ঝরে গেছিলো, শুকনো কাঠের মতো ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সবার আড়ালে ফিসফিস করে বলতাম, বেঁচে যা ভাই। মরে গেলে দু:খ হবে খুব। সবার হবে, কারিপাতাটার, চন্দন গাছটার, জবাটার। আগের জবা গাছটার দু:খেই এরকম হল কিনা কে জানে। মালীটার জোর করে আগের জবা গাছটা মারলো। আজও আপশোষ হয়, কেন ওর কথা শুনলাম।  রাগ করিস না বাপ, সেরে ওঠ। তারপর, যেদিন দেখলাম, একটা দুটো করে পাতার আভাস দেখা যাচ্ছে সেও তো চৈত্রের একটা দিনই। ফূর্তির যে এমন কচি সবুজ রঙ হয় কে জানতো! গোলাপ গাছটা মরেই গেল। এই গোলাপ গাছটার সাথেও আমার কথা বার্তা হত এক সময়। বারান্দায় গেলেই, কোথাও কিচ্ছু নেই, হাওয়া দিত এক ঝলক, কেউ বিশ্বাস করবে না,  কিন্তু আমি জানি, গোলাপ গাছটাই বলতো হাওয়াকে। না হলে আশপাশের বাড়ির কোথাও গাছের পাতা নড়তো না কেন? 

সেদিন ঈদের দিন সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছি।  আশপাশের দোকান সব বন্ধ, একটু এগোলেই  শহর শেষ। বাঁশবনের রাস্তায় দেখি একটা মেয়ে তার ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি যাচ্ছে মনে হয়। বাবার কাছেই হবে, না হলে মেয়েটার এমন কিশোরী বা বালিকার মতো খুশী মুখ হতোই না। আর সাথে ওই যে ব্যগে নির্ঘাত মিষ্টি কিংবা ঈদের উপহার। ঈদে কি মেয়েরা তার বাপের বাড়ি যায়? পুজোয় যেমন আসে? নাকি আমার বুঝতে ভুল হচ্ছে! কত কম জানি! এই যে চড়ক উপলক্ষে গ্রামের প্রায় সব মেয়ে পুরুষ নতুন গামছা, একটা নতুন পৈতে পরে বেরিয়ে পড়েছে। ভিক্ষে  চেয়ে, নিরামিষ খেয়ে, মাটিতে শুয়ে কৃচ্ছসাধন করে। এ আমি জানতাম তবে এরকম পাড়া জুড়ে সবাইকে করতে দেখিনি। অবশ্য আদতে  চড়ক তো বাবুলোকদের উৎসব ছিলোও না কখনো। 
কিছুদিন আগে,  একটা আশ্চর্য জায়গায় গিয়েছিলাম। নেটওয়ার্কহীন, শব্দহীন সে আশ্চর্য জায়গা। ভরদুপুরে হুট করে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে রোদের হলকা সয়ে গেলে সরসর করে পাতা পড়ার শব্দ ভিন্ন আর কিচ্ছু কানে আসবে না। মনে হিবে যেন কোন আদিম সময়ে একা দাঁড়িয়ে। রাত বাড়লে বাড়ি থেকে ঝগড়া করে পালিয়ে আসা কোনো ব্যঙ বসে থাকবে জলের কলের উপর, দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে। হাজার বললেও সে যাবে না কিছুতেই। তারপর ভোরবেলায়, মানুষেরা যখন ঘুমিয়ে পড়বে, তার মা তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে এক থালা পোকা ধরে দেবে। সন্ধ্যেবেলা মহুয়ায় মাতাল শবরীর সাথে ভোজ খেতে যাওয়া কুকুর ছানা মহুয়ার গন্ধে রাস্তা গোলমাল করে বেপাড়ায় হাজির হবে। তারপর?  তারপর এই মাতাল সেই সুস্থ এরকম নানান জনের সাথে ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরে সে কী গল্প! "জানো মা আজ না.....। "
মাঝে মাঝে কোলকাতার বাইরে থাকি।  এ জায়গাটাও রোদ গরমের জন্যে বিখ্যাত। আমার কিছু আসে যায় না অবশ্য।কোকিল গুলো সাত সকালে ক্যাচোরম্যাচোর লাগিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে সকালটা লম্বা করে দেয়। ব্যাটাদের সকাল থেকে প্রেম পায় দেখি। সেদিন বেলার দিকে সে কি লটাপটি ঝগড়া! দুটো কাক মারামারি করে গাছ থেকে পরেও ঝটাপটি করছে। সারা পাড়ার কাক চলে এসেছে  লড়াই দেখতে। আরে আরে, একটা কাঠবিড়ালি তুরতুর করে লাফাতে লাফাতে আমার সাইকেলের সামনে, ব্রেক কষতে কষতে সে হাওয়া। সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যে প্রতিটা সময়ের দিনের যে নিজস্ব গান তা শুনতে শুনতে নেশা ধরে। দুপুরের কুবো পাখিটার ডাক শুনতে পেলে আমার আর হিসেব নিকেশ মেলাতে ভাল্লাগেনা। মনে হয় এক্ষুনি সব ছেড়ে না বেরোলে যেন হবে না, কোথায় কোন দূরে যেতে হবে আমায়, সময় বয়ে যাচ্ছে।

এখানে অবাঙালী ভীড় খুব, হনুমান মন্দির হচ্ছে আরো বড় করে। মন্দিরটার দুপাশে দুটো বড় বড় গাছ ছিল, বট আর নিম। কেটে দিলো। মন্দির বড় হবে। সকাল বিকেল বেচারি হনুমানগুলো লাফ ঝাঁপ করে যায় ক্যাম্পাসের মধ্যেই তাই৷  
ধূ ধূ দুপুরের জনপ্রানীহীন বন প্রান্তর, শুনশান রাস্তা, রোদের তাতে নিস্তেজ হয়ে ছায়ার আরাম, কচি পাতার রঙের বাহারে জঙ্গলে রঙের আগুন লেগে যাওয়া বসন্ত, গ্রীষ্ম আমায় বুঁদ করে দেয় ভালোলাগায়। রোদ লেগে শরীর খারাপ হয়, বন্ধুরা তামাশা করে কিন্তু শরীর তো শরীরের নিয়মে চলবে ভালোবাসতে গেলে কী অত বেছে ভালোবাসা যায়!?

Friday, January 19, 2024

লন্ডন ডায়রি (তিন)

অফিসের পর বেরিয়েছি। যাই কোথাও টুক করে ঘুরে আসি। কাল শনিবার। একটু দেরী হলেও ক্ষতি নেই। ক্যাম্পডেন মার্কেটটা শুনেছিলাম বেশ। বেশ মানে কি আর আমি বিরাট কিনিয়ে কেউ। কিছুই না হরেক মানুষ, হরেক রকম দেখা যাবে এই আর কি। তায় মার্কেটটা যে জায়গায় সে জায়গাটাও সুন্দর। অবশ্য আমার প্রায় সবই ভালো লাগছে, নতুন জায়গায়। টিউব থেকে বেরোলে একটা অন্য রকম ভাইব চোখে পরবে। দোকান টোকান তো আছেই, কিন্তু চারিদিকে, বেশ একটা হল্লাগুল্লা পরিবেশ। ক্যাম্পডেন মার্কেটটা একটা খালের ধারে। বেশ অনেক কটা খাবারের দোকান আছে, চেইন রেস্তোরাঁ নয়। এমনি , ছোট ছোট ভ্যান টাইপ গাড়িতে আর কি। এখানের মার্কেটের দস্তুর অনুযায়ী দোকানের সামনে দিয়ে গেলে টেস্ট করায়। গোটা চার পাঁচ দোকানের চিকেন ভাজা, আর একটা দোকানের ফালাফেল খাওয়া গেলো। খাবার দাবার ছাড়াও, জামা,  হ্যানা ত্যানা নানান দোকান আছে। শপিং মলের মতো না কিন্তু। একটু তফাৎ আছে। শুক্রবারের বিকেল, পাব গুলো ভর্তি হতে শুরু করেছে। হরেক কিসিমের মানুষ। ভারতীয় প্রচুর।  এমনিতে লন্ডনে বাংলাদেশীও প্রচুর কিন্তু এখানে খুব একটা দেখলাম না। একটা তিলের তৈরী কিসব খাবার মিলছে দেখে ঢুঁ মারতে গিয়ে দেখি খুব টেস্ট করাচ্ছে। কোন দেশী হবে? যাই হোক বেড়ে খেতে কিছু ডেজার্ট পাওয়া গেল। যদিও যখন প্রায় কেউই কিনলো না, মেয়েটার মুখটা ম্লান হয়ে গেল দেখে একটু খারাপই লাগছিল , কিন্তু কিনলে আমার ম্লান মুখ হয়ে যাবে।













 আচ্ছা, খালের ধার ধরে সোজা হেঁটে গেলে কেমন হয়? ভাবতে ভাবতে হাঁটতে শুরু করি। একটু এগোলেই ক্যাম্পডেন মার্কেটের আওয়াজ ফিকে হয়ে আসে।খালের ধারের এই রাস্তা ধরে সোজা হাঁটতে থাকলে মাথার উপর রিজেন্ট পার্ক পড়বে। এই রিজেন্ট পার্কে পরে একদিন আসবো, ময়ূরাক্ষীর সময় হলে। রিজেন্ট পার্কটা বিরাট। তারপর আরো হাঁটলে একসময় পৌঁছে যাওয়া যাবে লিটল ভেনিস বলে একটা জায়গায়। খালে নৌকা করে ঘোরাঘুরি হয় সেই সুবাদেই নাম আর কি। কোথাও পৌঁছবো বলে হাঁটা শুরু করিনি।এমনিই হাঁটছিলাম। খানিক এগোতে চোখে পড়ে নৌকা বাঁধা আছে, সে নৌকাতেই কিছু মানুষ থাকে।  এদের অবস্থা যে খালের ঐ পারের চমৎকার সব বাড়িতে থাকা লোকের তুলনায় বেশ খারাপ তা বুঝতে বোঝদার না হলেও চলে ।কয়েকজন লোক গাঁজা বা ওই জাতীয় কিছু সেবন করছে। কেউ কেউ গল্প করছে বসে। খালের পাশে রাস্তা তারপর দেওয়াল। দেওয়ালে আঁকা গ্রাফিতি। আরো এগোলে রাস্তা নির্জন হয়ে আসে। মাঝে মাঝে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ,  কুকুর দৌড়ে যাচ্ছে। দূরে একটা ব্রিজ এদিক থেকে ওদিক গেছে। সবুজে ঢাকা চারপাশ। ব্রিজের নীচে রাজ্যের পায়রায় বাসা। কেউ কোথাও নেই। সন্ধ্যে নেমে এসেছে বেশ।  ব্রিজের উপর থেকে চারপাশটা কেমন অবাস্তব লাগে। লন্ডন শহরের মধ্যে বলে মনে হয়না যেন। 










ব্রিজএর পাশের সিঁড়ি দিয়ে রাস্তায় যাই, এ গলি সে রাস্তা দিয়ে এমনিই হেঁটে হেঁটে যাই। হাঁটতে হাঁটতে লিটিল ভেনিস পৌঁছে গেছি যখন দেখি চারপাশ অন্ধকার। হাঁটার নেশায় হেঁটেছি। এখন মনে হচ্ছে টিউব স্টেশনটা কই । যথারীতি একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করে করে চলেছি এবং সকলেই মোটামুটি খুব ভালোভাবে রাস্তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। লিটিল ভেনিসের কাছের যে টিউব স্টেশনটা ছিল, নামটা ভুলে গেছি,  একটু হাঁটতে হত।  এলাকাটা পুরো পাকিস্তানি দোকানে ভর্তি। কাবাব, ফল রুটি, বোরখায় ছয়লাপ। এখান থেকে দুবার ট্রেন বদলে পৌঁছবো হাউন্সলো সেন্ট্রাল। বেকারলু  লাইনের ট্রেনে প্রথম উঠলাম।  এটায় আবার মুখোমুখি সিট আছে চারজনের। আচ্ছা ইয়ে আমাদের দেশের মেট্রো গুলো গদি মোড়া করতে খরচ হবে খুব , না? ঝিম মেরে বসে থাকতে থাকতে দেখি বেকার স্ট্রিট এলো। এ স্টেশনের গায়ে সাইন দেওয়া থাকে শার্লক হোমসের।  একটা কাল্পনিক  চরিত্র কোন জায়গায় চলে যেতে পারে তাই না?




আরেকদিন গিয়েছিলাম বরো মার্কেটে। সেও এখানকার এক বাজার। এত বাজারে ঘুরছি মানে আমি বিরাট বাজারু তা না।ভালো কথা, লন্ডনের অনেক জায়গার খোঁজই আমি পেয়েছিলাম সুদীপের ব্লগ থেকে। ব্লগ থেমে গেলে, ব্যক্তিগত মেসেজ করে। ময়ূরাক্ষীও অনেক কটা জায়গা নানান জায়গা থেকে বের করেছিল। যাই হোক, যা বলছিলাম, এক মাসের এই ছোট্ট সফরে চেয়েছিলাম বিখ্যাত দ্রষ্ট্রব্য যা পারি দেখবো ঠিক আছে কিন্তু লন্ডন  শহরের হইচই, মানুষ, এসব গুলোও পারলে ঢুঁ মেরে যাবো। সবচেয়ে অবাক লেগেছে, বা আপশোষ হয়েছে, বিশ্বযুদ্ধে এদের বহু বিখ্যাত পুরোনো বাড়িই বোমায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওরা ওল্ড সিটি চার্মটা কেমন আবার গড়ে তুলেছে! আর আমরা কেমন নির্দ্বিধায় সবটা নষ্ট করছি। অবশ্য একটা কারন হতে পারে, আমাদের সে পাঁচ হাজার বছর থেকে কত রাজা গজা এলো গেলো, কত সৌধ কত চৈত্য, মন্দির, মসজিদ ভেঙেছে তার উপর শহর গড়েছে, সামান্য একশো দুশো বছর আমাদের কাছে আর তেমন কিছুই না!  অযাচিত বেশী পেলে যা হয় আর কি।  কোথা থেকে কোথায় চলে গেলাম, ছিলাম বরো মার্কেটে। বরো মার্কেট আবার ক্যাম্পডেন মার্কেটের থেকে খানিক আলাদা ধাঁচ। আর ভীড় কী ভয়ানক রে বাবা। যেন সপ্তমীর রাতের দুর্গাপুজোর ভীড়। অবশ্যই খাবারের দোকানের সামনে আর পাবের সামনে। আর কত সব আজব খাবার দাবার। ঝিনুকের সম্ভার নিয়ে বসেছে একজন। একজনের সামনে খুব ভীড়, মাংসের খিচুড়ি টাইপ কিছু বানাচ্ছে, তার মধ্যে ঝিনুক টিনুক দিয়েছে! ওইদিকে জার্মান বেকারি, পাঁউরুটি নিয়ে হাজির। রিসাত্তোর দোকানেও বেজায় ভীড়। আহাহা বেজায় প্রাণ কাড়া গন্ধ আসছে কোথা থেকে? ওহো, ফিশ এন্ড চিপ্স। ভীড়টা এখানেও জব্বর। ওইদিকে হোমমেড  চকলেটের দোকান তো, অন্যদিকে টার্কিশ কফি। পাশের গলিতে আবার ব্রিটিশ হোম মেড পাই। ব্রিটিশরা আলুসেদ্ধ ছাড়া পাই টাই বানাতে জানে! ফলের দোকানও খুব বসেছে। হরেক ফল,  সবজি। 
পুরো জায়গাটায় কাদা আর থুতু বাদ দিলে আমাদের বাজারের সাথে তফাৎ হল দামাদামি হয়না, বা হলেও আমি জানিনা। ওহো আরেকটা তফাৎ, চলে এলে কেউ হাঁক দেবে না, আরে শুনে যান না, বলে। 










বরো মার্কেট থেকে বেরিয়ে, টেমসের ধার ধরে হাঁটছিলাম। এদিকে লন্ডন ব্রিজ থেকে ওই পারে টাওয়ার ব্রিজ। টেমসের পারের রেস্তোরাঁ গুলো বেজায় দামী, বেশ কেতা ওয়ালা লোকজন বসে বসে খাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে দেখতে যাচ্ছি, ও বাবা আমার গলায় ক্যামেরা দেখে এক মাতালের পাল্লায় পড়েছি। বলে, "আমার একটা ছবি তুলে দাও"।  দেওয়া গেল। কিন্তু তার স্বাভাবিক বুদ্ধি তো গেলাসে ভেসে গেছে। ক্যামেরায় তার ছবি দেখানো হল, তাতে আরো পোজ দিয়ে আমায় ছবি তোলালো একটা। এইবার আমি এগোবো ও বাবা বলে আরো তোলো এই ভাবে। মহা জ্বালা তো,  " আর একটাও তুলে তো দেবোই না, এ গুলোও ডিলিট হবে, যত্তসব গেঁড়ি গুগলির ঝাঁক",  বলে এগোনো গেল। লন্ডনের লোকেরা ফ্রেন্ডলি বলেছি আগে তাই না? আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টাওয়ার ব্রিজ খোলা তারপর আবার ভাঁজ হওয়া দেখছি, এমন সময় স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে এক মহিলা বলল,  "তুমি কি একটা ছবি তুলতে চাও? আমি তুলে দেবো তোমার?"। হুঁ হুঁ বলেছি না আমি মানুষটাই দেবদূত টাইপ ভালো হে। 

টিউবের এ গলি ও গলি হাঁটা চলার ফাঁকে চোখে পড়ে গাইয়ে ভিখারি৷ মানে ভিখারি বলা ঠিক না, পারফর্মার। আমাদের দেশে যেমন স্টেশনে,  বা ট্রেনে গান গেয়ে টাকা চায়, তেমনই এরাওদিব্যি পাটি পেতে, বাজনা টাজনা বসিয়ে গান বাজনা করে, আন্ডারগ্রাউন্ডে। কেউ কেউ পাউন্ডও দেয় বটে। একটা স্টেশনে  দু পাশে ইকুয়ালিটি নিয়ে পোস্টার। জেন্ডার ইকুয়ালিটিই মূলতঃ।  একা মা,  দুজন পুরুষ, সমকামী, বিষমকামী, ট্রান্স সবার ইনক্লুশন নিয়ে সুন্দর সুন্দর বক্তব্য দিয়ে।  বেশ লাগলো। কোনো কোনো টিউব স্টেশনে নাটক ইত্যাদির বিজ্ঞাপন থাকে। নাটক আমাদের একটাও দেখা হয়নি, যদিও ব্রিটিশ থিয়েটার মাস্ট ভিজিটসব জায়গায় লেখা ছিল। বেজায় দাম ছিল এক একটা টিকিটের। না হলে হ্যারি পটার এন্ড কার্সড চাইল্ডটা দেখার খুবই ইচ্ছে ছিল। 











সৌরভ আসার পর একদিন গেলাম শার্লক হোমস মিউজিয়ামটায়। সৌরভের সাথে আমাদের লন্ডন ঘোরা লিমিটেড , এক সপ্তাহ ও থাকার পরেই আমরা স্কটল্যান্ড চলে যাবো । এক সপ্তাহে কমন ছুটি দেখে কিছু জায়গা একসাথে ঘোরার প্ল্যানে রেখেছিলাম। হোমস মিউজিয়ামে তো যেতেই হত। মানছি ওসব খুবই সাজানো ব্যপার আর " সহী" ট্যুরিস্টরা ওসব সাজানো জায়গায় যায় না। কিন্তু আমরা না হয় "ঝুটা" ট্যুরিস্টই হলাম। এ এক দেখার জিনিস হে।একটা বাড়ি কিনে মিউজিয়াম বানাবো বললেই হল না। তাকে ভালোওবাসতে হবে তবেই তুমি ছোট ছোট জিনিসগুলো মাথায় রাখতে পারবে। শার্লকের ঘরের প্রতিটা ডিটেইলস রয়েছে। পিস্তল ছুঁড়ে  বানানো দেওয়ালে অক্ষরটা অব্দি। একটা জাবদা খাতায়,  দেশ বিদেশ থেকে আসা চিঠি সাজানো আছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও পাঠানো চিঠি আছে। এরা সবাই বিশ্বাস করেছে শার্লক হোমস বলে নির্ঘাত কেউ আছে। ওয়াটসনের ডাক্তারির জিনিস থেকে সেফটি রেজার অব্দি আছে। একটা নকল টয়লেট অব্দি বানানো আছে সিঁড়ির উপরে। তাতে টাওয়েল থেকে সব কিছু পরিপাটি করে রাখা। বিখ্যাত কিছু ক্রাইম এর দৃশ্য, শার্লকের হাফ গার্লফ্রেন্ড আইরিন আডলার, মরিয়ার্টি, শার্লকের বেহালা, সব রয়েছে। একজন বিশদে বলে বলে যাচ্ছে, কোনটার কী রেফারেন্স। এবং সেও কিন্তু আধুনিক পোশাকে না। বেচতেও জানতে হয়।  টুপিটার গল্প অব্দি বলছে। ভীড়টা কমে গেলে হুট করে মনে হতেই পারে, কোনো এক কালে সত্যিই হয়তো এখানে শার্লক আর জন থাকতো। 













বাইরে খুব বেশী খাবোনা ঠিক করেছিলাম, কিন্তু তাই বলেই একেবারে খাবোনা তাও তো না। খুঁজে খুঁজে একটা আশ্চর্য পাব খুঁজে পেয়েছিলাম যেখানে আনলিমিটেড কফি/চা/হট চকলেট মাত্র ১.১৯ পাউন্ডে। খুঁজে পেয়ে আমাদের সে কি আপশোষ , আগে কেন পাইনি তোমার দেখা টাইপ। কেন কে জানে , ওখানে এত সস্তা ছিল কফি , হয়তো বারে আমাদের মতো হাঁদাটে লোক ছাড়া কেউ কফি খেতে যায় না! এখানকার পাব কিন্তু বেশ জমকালো একটা জায়গা। একবার লন্ডনের একটা পুরোনো পাবে গিয়েছিলাম হিসি করতে। মানে রাস্তায় রাস্তায় সুলভ শৌচাগার নেই , তো সারাদিনের জন্যে বেরোই। হার্বিকে মনে আছে তো? হার্বিইই বলেছিল, যে কোনো পাবে ঢুকে যাবে , বিয়্যর খেলে লোকে হিসি তো করবেই , আর পাবে কে পান করছে আর কে টয়লেট সে নিয়ে অত কারোর মাথাব্যথা নেই। তো সেই পাবটায় ঢুকে মনে হচ্ছে আমি বুঝি দুশো বছরের পুরোনো কালে চলে গেছি , তুমুল হল্লাগুল্লা চলছে, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় একাকার চারদিক। কেউ কারোর দিকে তাকিয়েও দেখছেনা। এই বড় বড় পিপে সাজানো আছে , যদিও মদটা ওর থেকে দিচ্ছে না। অবশ্য প্রাচীন কাল না, তা এক একটা টেবিল স্রেফ মেয়েদের দখলে আছে দেখে টের পাওয়া যায়। সৌরভ আসার পর একদিন যাওয়া হল এখানকার একটা পুরোনো পাবে। পকেটে রেস্তোঁ নেই বিশেষ। সত্যি বলতে খুব বেশী পাবে যাইনিও, বিদেশে বা দেশে। বিয়ারের ব্র‍্যান্ড চিনিনা, তেতো লাগে বলে হুইস্কিই প্রেফার করি, না হলে ভদকা। তা সন্ধ্যেবেলা বন্ধুবান্ধব সমেত ইংলিশ পাবে গিয়ে বিয়ার পান করার ব্যপারটাই বেশী আগ্রহ জাগিয়েছিল। হরেক রকম নল, ফ্রি টেস্ট করে সিলেক্ট করা যায় যে কোনো ব্র‍্যান্ড। সচরাচর ক্রাফট বিয়ার বেটার হয় গ্লিসারিন কম থাকে বলে। কিন্তু কী নেবো? ইংলিশ এল না ক্রাফট না সিডার? শেষে বার টেন্ডারের সহায়তা নিতে হল। তুমিই বলো ভাই। সে  এক দুটো টেস্ট করানোর পর একটু কনফিউজড। তার বুড়ো সহকর্মীকে বলছে এরা তো ফার্স্ট টাইম এল খেলো আর গিনেসও খায়নি। বুড়ো বলছে ফার্স্ট টাইম আহাহা, আই উইশ আই অ্যাম ইউ।
পাবে আবার এক মাতালের পাল্লায় পড়েছিলাম। সে আরেক গল্প।আমার গোঁফের খুব প্রশংসা করে, তারপর বলল  আমি কিন্তু মাতাল না। মাতাল চেনার উপায় হল এই ডায়লগটা। দেশে অল্পবয়সী ছেলে ছোকরারা যখন পিকনিক করে একটা দুটো ছেলে থাকবে, "ভাই আমি নিট মারবো, বলে খুব কেত নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে মাতাল হবে, তারপর বলবে, কে মাতাল, কোনো নেশা ফেশা হয়নি ভাই, আমি ঠিক আছি।এবং অবধারিত ভাবে বমি করে ছড়াবে বা বমি না করে ছড়াবে। এ মাতালটা তারপর তার ঝাঁপি খুলে বসেছে, ব্রাদার হ্যাভ কিড। আই হ্যাভ টু ওয়াইভস, থ্রি কিডস। হাউ মেনি ওয়াইভস ডু ইউ হ্যাভ? হোয়াই আর ইউ লাফিং, আই অ্যাম নট ড্রাংক।আমি বাংলায় বিড়বিড় করছি,  "ভালো মাতালের পাল্লায় পড়েছি"। বাকিরা হাসছে, মাতালের ভারী মানে লেগেছে। ব্রাদার, হোয়াই আর ইউ লাফিং আই অ্যাম নট লায়িং, সি দিস ইজ মাই ফার্স্ট ওয়াইফ,  দিস ইজ মাই সেকেন্ড। আই অ্যাম ফ্রম সোমালিয়া,  নো নো কেনিয়া অ্যাকচুয়ালি, ইউ নো,  আই অ্যাম ফ্রম হিয়ার অনলি। কোনো ক্রমে সে বিশ্বনাগরিকের থেকে ছাড় পেয়েছিলাম সেবার। 


(ক্রমশঃ)

Monday, January 1, 2024

নতুন বছরে বছর শেষের কথা

সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। এ লেখাটা গতকাল লিখেছিলাম, পোস্ট করতে করতে আজ হয়ে গেল। অবশ্য ক্ষতি খুব নেই, শেষের রেশ ধরেই নতুনের শুরু...তাই দিয়েই দিলাম

বছরের শেষদিন। আজকের তারিখটা ভালো লেগেছে ১২৩১২৩।  একটু কায়দা করে লিখতে হল বটে। আমি কেন জানিনা চুলদাড়ি কাটতে এরকম বাঘা বাঘা দিনেই যাই। দেড়টায় গিয়ে তন্নতন্ন করে চারপাঁচটা দোকান ঘুরে শেষমেশ বুঝলাম, আজ কপালে অপেক্ষা আছে। তা সত্যি বলতে তেমন তেমন জায়গায় কান উঁচিয়ে অপেক্ষা করতে অত মন্দ লাগে না। বট গাছের নীচে একটা ছোট্ট সেলুন। একেবারে ইটালিয়ান না, কিন্তু বাহুল্যও নেই। তা দুটো অল্পবয়সী ছেলে চুল কাটছে তখন। একজন বলছে ভাই কাল নিউইয়ার আজ বাঁ গলা অব্দি মদ খাবো। আরেকজন তখন চুলে কামানো কাট দিচ্ছে, দিতে দিতেই সমর্থন। এই কোনো উৎসব যাপন মানেই মদ বা বেড়াতে গিয়ে মদ এ ব্যপারটা আমি ভালো বুঝিনা। যাই হোক পরেরজন এলো, আমার পরে কিন্তু তাকে আমিই আগে ছাড়লাম। বাংলার একটা বোতল আর প্লাস্টিকের গ্লাস নিয়ে এসেছে। বলছে জল টল পড়েনি, চড়চড় করছে।বলতে বলতেই দু প্লাস গলায় ঢাললো জল খাওয়ার মতো করেই। ওস্তাদ মানুষ, তাকে না ছেড়ে যাই কোথায়। তাছাড়া সে খুব তাড়ায় ছিল।ভাত খাবে গিয়েই, তাই তার দাড়ি কাটার পরেও আমার চুল দাড়ি কাটা, মাথা মালিশ হয়ে গেল, তারপরে আরেকজন বসে গেল কিন্তু সে তখনো ডিয়ার লটারি থেকে মেট্রো রেল সর্বত্র ঘুরছে। শীতের বেলা ওদিকে তখন পড়েই এসেছে প্রায়। বোতল শেষ না হলে উঠবে বলে মনে হচ্ছে না।

সেদিন ফিরছিলাম শহরের বাইরের থেকে। ট্রেনের অপ্রতুলতার কারনে স্লিপারের টিকিট কেটেই উঠতে হয়েছিল, দূরত্বটা লোকাল ট্রেনের মতো হলেও।  হরেক রকম হকার ওঠে বটে স্লিপারে। যারা টাকা পয়সা বাঁচাতে ভাববে স্লিপারে উঠে যাবে খেতেই তো সব ফুরিয়ে যাবে অ্যাঁ। নাকি আমিই এমন হ্যাংলা?  প্রথমে উঠলো, সেদ্ধ চানা মাখা। কেউ কেউ খেলো, আমারও ইচ্ছে হল কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, ছোটবেলাতেও যেমন এ চানা খেতে পাইনি এখনো পেলাম না। তারপর চা। চা খাওয়া গেল। তারপর গুড় কাঠি। তাকেও বঞ্চিত করা হল না। তারপর পেন। ও দিয়ে স্রেফ পিঠ চুলকানো যায়, শীতে এমনিই চামড়া ফেটেফুটে আছে চুলকোলে রক্তারক্তি হবে! ক্রমে আরো কারা কারা যেন উঠলো। পাশের খোপে একটা আড়াইজনের পরিবার। ছেলেটার মুখটা অকারণ কঠিন,অথচ বাচ্ছাটার সাথে খেলার সময় সেই মুখ আশ্চর্য ভাবে বদলে নরম হয়ে যাচ্ছে। এরা খুব একটা রিল পরিবার না।মানে মোবাইলে ব্যস্ত না।নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলছে না হলে বাচ্ছাটাকে নিয়ে ব্যস্ত। আপারে একজন লোক এই ভর দুপুরেও টানটান হয়ে ঘুমোচ্ছে। পাশেই আরেকটা যে পরিবার তারা অনেকজন। নিজেদের মধ্যে গল্পও করছেনা, ঝিমুচ্ছে সব।
তালতলার কেকের দোকানে যাবো বলে বেরিয়েছি।এই জায়গাটা কসমোপলিটান এর হদ্দমুদ্দ যাকে বলে। মসজিদ, যীশুবাবার চার্চ, গাছের নীচে ঠাকুরে দিব্যি ফুল বেলপাতা চড়ানো। গলির মধ্যে ফেল্লায় ফ্ল্যাট আর সস্তার বস্তি দুইই আছে। গলিরা যেমন হয়, তেমনই একটা ঠেলাওয়ালা, একটা ইস্ত্রির দোকান, দুটো বেপরোয়া বাইক। বস্তির ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে প্লাস্টিকের বালতি, দরজার সামনে কয়লার উনুন, একটা দুটো রোলের দোকান। হাঁটতে হাঁটতেই সন্ধ্যে নামে।
মেট্রোতে উঠলে গল্প দেখি চারিদিকে। শিয়ালদার মেট্রো এমনিতে ফাঁকাই থাকে। পাশেই এক জোড়া অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে। আজকালকার সেল্ফি আর রীল সর্বস্ব না। অবশ্য নিজেদের মধ্যে গল্পে বুঁদ বলেও হতে পারে। সেই একই গল্প, যা বহুদিন ধরে হয়ে এসেছে, হয়ে চলেছে, হবেও। হলেই ভালো অবশ্য মানুষ টিকে যবে যদ্দিন এ গন্তব্যহীন ভালোবাসার গল্প চালু থাকে। সামনের সীটে বসেছে একটা দাড়ি কামানো, তাগড়া গোঁফওয়ালা বলিষ্ঠ চেহারার লোক। ভিতরে ভিতরে খুবই নড়বড়ে তাই হাবভাবে খুব আত্মবিশ্বাসী। চারিদিকে এসব তুচ্ছ জিনিস দেখে মুখের গুটখাকেই প্রায়োরিটি দিচ্ছে,  একটা তাচ্ছিল্য  মার্কা হাসি ঝুলিয়ে। পাশের লোকটা বংশদবদ হবার জন্যেই জন্মেছে যেন। কিছু একটা বলছে মন জোগানো মত ভাব মুখে, আর গুটখা চিবুতে চিবুতে লোকটা শুনছে। এরকম লোক আমি দেখেছি খুব।মেট্রো থেকে নেমে দুটো খিস্তি দেবে, পচাৎ করে পিক ফেলে তারপর খুব অদ্ভুত কোনো এক রসিকতা করবে।
কোলকাতা থেকে চলে আসার পথটাও কম আকর্ষক না। গাড়িতে এলে রাস্তায় হুট করে থামি কোনো ছোট্ট দোকানে। ফুড ব্লগার কিংবা ট্রাভেল ভ্লগারদের ফোনের বাইরে। ছোট্ট দোকান, মুটে মজুর গোছের একজন হামহাম করে মুড়ি ঘুগনি খাচ্ছে স্টীলের কাঁসি মতো জিনিসে। দোকানের বাইরের চৌকিতে একটা বেশ হৃষ্টপুষ্ট দেশী কুকুরছানা জামা গায়ে শুয়ে আছে। দুটো চা খোর ছাগল খুব ঘুরঘুর করছে। পারলে আমাদের চায়ের ভাঁড়টাই কেড়ে নেয়।
কখনো চায়ের দোকানে দাঁড়ালে জানতে পারি, নতুন দোকান খুলেছে। আগে ভাই দোকান দিতো। ভাই দিয়েছে পাশাপাশি দোকান কি আর দেওয়া যায়, তাই এতদিন দেয়নি সে। তারপর একদিন জানতে পারে যে জমিটার টাকা ভাইকে দিয়েছিল কেনার জন্যে, ভাই নিজের নামেই কিনেছে সবটা। চায়ের ভাঁড়ে মিশে যায়, "একই মায়ের পেটের থেকে বেরিয়েছি আমরা, এরকম করল?"
মফস্বলের দিনগুলোও কাটে মন্দ না। সকালে কিংবা বেলার দিকে বারান্দায় দাঁড়ালে দেখি তুরতুর করে কাঠবিড়ালি ঘুরছে। ইলেক্ট্রিকের তারে একটা বুলবুলি এসে বসল। পড়াশোনা নেই দিব্যি আছে। শীমূল গাছে একটা কাঠঠোকরা বাসা করার চেষ্টায় আছে, সামনে বিয়ে মনে হয়! সেদিন খুব হনুমান এসেছিল। মাঝে মাঝেই আসে। জানলার পাশেই একটা সজনে গাছ আছে, আরাম করে লেজ ঝুলিয়ে বসে সজনে পাতা খেলো খুব। ওদিকে দেখি একটা খুব ছোট ছানা গাছে উঠতে গিয়ে ধপ্পাস! ও বাবা ফের লাফ দিয়ে উঠে পড়েছে খুব। আরেকটা কেমন উদাস মুখে নিমগাছের ডালে বসে দেখো! একগাদা কাজ থাকলে আমিও অমন মুখেই বসি অবশ্য।
আর ছোট কুকুরটা আর তার মা বাবাটার কথা বলিনি বুঝি? ও বাবা তারা আরেক! ছোট কুকুরটা এসেছে সেদিন আমার গায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলবে বলে! পালিয়ে বাঁচি কোনোরকমে। ছোট কুকুর অবশ্য দুটো। একটা খুবই দুবলা। মরেই যবে মনে হয়। সেদিন দেখি সকালে দুটোয় খুব গররগরর করে খেলে টেলে ওদের মায়ে কাছে গিয়ে খুব দুধ খেলো। শেষে বিরক্ত হয়ে মা'টা রোদে হাঁটু মুড়ে বসেছে একটু অমনি একটা ছানা গিয়ে খুব আদিখ্যেতা করতে গেছে। "এই তো খেলি আবার জ্বালাসনি, একটু শান্তিতে বসতেও দেবে না" ভাব নিয়ে মা কুকুরটা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসল।
এরকম হাবিজাবি ফুত্তিতেই ২০২৩ ফুরোলো।নটে গাছ তো মুড়োয় না, আজকের দিনে সুতো ধরে কাল থেকে নতুন হাবিজাবি হবে আবার।

Wednesday, December 27, 2023

চড়ুইভাতি

কাল তুমুল আনন্দে কেটেছে দিন। কেন আনন্দ যদি বলো তাহলে আমি বলব নেশায় ছিলাম বলে।
মদ, গাঁজা, তামাকজাত বস্তু, কোকেন এসবের বাইরে সে নেশা। এতই তূরীয় সে আনন্দ, রাত দুটো অব্দি অর্থহীন আনন্দে ডুবে সাড়ে নটায় খোঁয়ারি কেটেছে। ও হ্যাঁ কী যেন বলছিলাম, আনন্দ। তা সে আনন্দ যজ্ঞের উপাদানে খুব বিজ্ঞাপিত কিছু ছিল না তেমন। আমবাগানে চট, পুরোনো শতরঞ্চি, ছাতা পরা মাদুরে থেবড়ে বসে রাধাবল্লভী আর আলুরদম, বাড়ির বানানো মাফিন, কফি চা খাওয়া।  পিকনিক বাস্কেটে সকাল সকাল সব কিছু গুছিয়ে তুলছে কেউ, মজা পুকুরের পাশে কাঠপিঁপড়ের কামড় খেয়ে ঘুমোচ্ছে কেউ। রোদ পড়া মাঠটায় শুকনো গোবরের পাশে অত্যন্ত অদক্ষ চারজন মিলে ব্যডমিন্টন খেলা। এবং ফের অকারন হাসিতে লুটোপুটি খাওয়া।
আমাদের ইস্কুল কলেজে লাইফ স্কিল শেখায় না। তাই আনাড়ি হাতে পাতা, ঘুঁটে কাঠ ঠেসে দিই উনুনে। উনুন নিভে যায়। পরিত্রাতা হয়ে আসে রান্নামাসী যার বাড়ি এখানেই। উনুনের ধোঁয়ায় চোখ থেকে জল বেরিয়ে যায়, তারপরেও মহানিন্দে আগুনে কাবাব ঝলসাই, সসেজ সেঁকি। সসেজ, কাবাবের কেউ কেউ উনুনে পড়ে যায়, ছাইমাখা সে মাংসও জলে ধুয়ে ফের সেঁকে খাওয়া হয়। ধুলোয় ধোঁয়ায় এলার্জির কথা মনেও পড়েনা। মনে পড়েনা, স্বাস্থ্যবিধির কথাও। তারপর আগুন নিভু নিভু হয়ে এলে রসুন, কাঁচালংকা ঠাসা বেগুন পোড়ানো হয়। টমেটোও। শীতের পড়ন্ত বেলায়, কলাপাতায় ধোঁয়াওঠা ভাত, বেগুন পোড়া  মুরগীর মাংস আর চাটনি। 
তারপরেও অদ্ভুত চড়ুইভাতি, অদ্ভুত দিন শেষ হয়না। বয়সের হিসেবে তাদের এত অকিঞ্চিকর জিনিসে খুশী হবার কথাই না। কিন্তু তারা হয়তো বড় হয়নি। না হলে রোদ নেমে যাওয়া বিকেলে অমন করে হাসিতে লুটোপুটি খেতে খেতে কান ফিসফিসের মতো বালখিল্য খেলায় মজবে কেন! যাই বলো কান ফিসফিস বড় মজার খেলা। আম আঁটির ভেপু হয়ে যায় কাঠবেবুন। আয়না ভরা দিন হয়ে যায় আয়নায় অশরীরী।  স্বপ্নে পাওয়া দিন হয়ে যায় স্বপ্নাদেশে ঠাকুর পোষা।
ক্রমে গাছতলার আশ্রয় ছেড়ে ঘরে ফিরি। কয়েকজন তখনও নেশায় টইটম্বুর।কম্বল কাড়াকাড়ি করে তারা বই পড়ে, বা সবাই মিলে ফের আইস এজ দেখতে বসে। তারপর নাইন্টিজের যত অদ্ভুত গানের ভিডিও দেখতে দেখতে ফের অর্থহীন মানেহীন হুল্লোড়। নেশায় ছিলাম বলেই মনে হয়। এ নেশায় বুঁদ হতে কী যে লাগে তাও জানিনা, যে পারে সে পারে আর কি। ওই ফিরতি পথে ভাতের হোটেলটার মতো। সে ভাতের হোটেলটা অদ্ভুত। একটা কুকুর একটা বিড়াল একটা মানুষ বুড়ো একটা মানুষ বুড়ি। কুকুর বেড়াল কেউই পোষা না। কিন্তু তাদের মেজাজেই বুড়ো বুড়ি অস্থির। আমাদের খুব নালিশ করল, বেড়ালটার দুধে জল মেশালে বেড়াল আর সে দুধ খাবে না, আর ভাত ফুরিয়ে গেলে যদি অন্য হোটেল থেকে ভাত এনে দেওয়া হয়, তাহলে আর কুকুরটা সে ভাত খাবে না! নালিশ করতে করতেই কুকুর বিড়াল দুজনকেই ডেকে বিস্কুট খাওনো হল।
বলছিলাম না আনন্দের নেশায় কী যে লাগে কেউ জানে না, খুঁজে পেলে মানিক পেলে না পেলে নাই।













Saturday, December 9, 2023

লন্ডন ডায়রি (দুই)


যে বাড়িতে আছি,  ফাউস্তো বলে একটা কুকুর আছে। আমি কুকুর ভালোবাসিনা। তা এ কুকুরটা খুবই ভালো। তেড়ে আসেনা, হাঁকডাক লাফ ঝাঁপ কিচ্ছু করে না। বাবুরাম সাপুড়ের কাছে ট্রেনিং নেওয়া কিনা জানিনা। অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড। এর মালিক একজন স্প্যানিশ ভদ্রলোক, আপাতত দেশে গেছে। সে এতদিন স্প্যানিশ খাবার খেয়েছে। এখন বাঙালী খাবার খেয়ে খেয়ে হেংলু হয়ে গেছে রীতিমতো।  শুরুতে এসেছিলাম যখন, বেশী কাছে আসতো না, একদুদিন যেতে এখন খুব ঘুর ঘুর করে। আমি ঘরে বসে কাজ করি দরজা দিয়ে উঁকি মারে।তারপর যেই ছবিবতুলতে ফোন তাক করি তুরতুর করে পালায়। আবার দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে। আর আছে একটা ছোট ছেলে, তার এখনো সব দাঁত বেরোয়নি, ফোকলা দাঁতে হয় হাসে না হয় চ্যাঁ চ্যাঁ করে চেঁচায়। আর  সিঁড়ির রেলিং এ ঝুলে ঝুলে চেঁচায়,  "পাস্তো, পাস্তো"। এরা দীর্ঘদিনের প্রবাসী বাঙালী। ফলে বাঙালী সুলভ সু ও কু দুই অভ্যাসই কিঞ্চিৎ কম। এরা পরিশ্রমী, উদ্যমী এবং রিস্ক নিতে পারে। আবার একই সাথে দৈনন্দিন বাঁচার মধ্যে টিপিক্যাল রিগ্রেসিভ আচরণ, চিন্তা। মানে দশজন অতিথি ডাকলে একজন গুরুত্বপূর্ণর জন্যে আলাদা খাতির করে আলাদা ব্যবস্থা করা,  বা নিজেদের মধ্যে কোয়ালিটি টাইম কাটানোর বিষয়ে উদাসীন। বাড়ির কর্তা ভয়াবহ সব কন্সপিরেসি থিওরি বিশ্বাস করে।যেমন মনমোহন সিং পাকিস্তানে গিয়ে সমস্ত অফিসারদের ডিটেল দিয়ে এসেছিল। বাড়ির গিন্নি অনসাইটে এসেছিল, সেই সূত্রে কর্তাও এসেছে, এবং চাকরির চেষ্টায় থেকেছে বেশ খানিক দিন। তারপর চাকরি পেয়ে, এক গাদা লোন নিয়ে ফস করে বাড়ি কিনে ফেলেছে, তাই ভাড়া দিয়ে খানিক সুরাহার চেষ্টায় আছে আরকি। এরাও আমাদের মতোই গুরুদ্বোয়ারায় খেতে যায় খুব। টাকা পয়সা বাঁচে তাতে। অবশ্য মুখে বলে পাঠ শুনতে যাই। 

ফাউস্তো বা পাস্তো

লন্ডন শহরের টিউব যতটা সুসংবদ্ধ,  পরিষ্কার ভাবে ডিরেকশন দেওয়া বাসটা আমার মনে হয়েছে একটু কম তার তুলনায়। টিউবে চাইলেও হারানো যাবে না এতটাই ক্লিয়ার করে বোঝানো। সেখানে একটা বাস স্টপ খুঁজতে গেলে মনে হয় যেন নিজেকে লিভিংস্টোন।  সিটিম্যাপার বলে একটা অ্যাপ হয় যেটা খুবই কার্যকরী এখানে। কোথাও থেকে কোথাও যাওয়ার জন্যে, সময়, ভাড়া,  পিকাডেলি বা বেকারলু, সেটার নর্থবাউন্ড না সাউথবাউন্ড সব বলে দেওয়া থাকে। বাসের ক্ষেত্রে সাম হাউ ব্যাটা ভালো লোকেট করতে পারেনা। ময়ূরাক্ষীর স্কলারশিপের ফান্ডটা তোলার জন্যে আমাদের ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন যেতে হত। সে জিনিস আকছাড় আছে এদিকে আমরা ম্যাপে খুঁজে যেটায় যেতে চাইতাম ভারী ঘুরপাক খেতে হল। সিঙ্গাপুরে সিঙ্গাপুর আই,  মাদাম ত্যুসো দেখেছি আগে। ইউএসেও মাদাম তুসো ঘোরা। হপ অন হপ অফ বাসেও আমার চড়া ছিল।  তা সত্ত্বেও একসাথে ঘুরবো বলে এখানে ফের আমিও টিকিট কেটেছিলাম।  তা দুজন মিলে যে হপ অন হপ অফে চড়ে এমন চড়কি পাক খেলাম, এ মনে হয়না আর কারোর সাথে হয়। ভুল বাসে স্টপেজে নেমে (এটায় পুরোটা আমাদের দোষ ছিল না অবশ্য),  প্রায় মিনিট চল্লিশেক হেঁটে মাদাম ত্যুসোয় পৌঁছেছি। হাঁটা তো না,  হাঁটা ছোটা মিলিয়ে একরকম বলা যায়। মাঝে শর্টকাট করছিলাম এক পার্ক দিয়ে, এক ভদ্রলোক খুবই সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন কোনটা দিয়ে যেতে হবে। যদিও আমরা ভালো বুঝিনি। আরো খানিক গিয়ে আবার কাউকে জিজ্ঞেস করেছি। লোকজন হেল্পফুল। আমার ধারনা ছিল ইংরেজরা নাক উঁচু হয় হয়তো। তা তো দেখলাম না তেমন? রাস্তা ঘাট চেনে না এমন লোক প্রচুর আছে তবে কেউই কিন্তু দুর্ব্যবহার করেনি। আমি এই ২০২৩ এ দাঁড়িয়েও মানুষকে বেশী ভরসা করি অ্যাপের থেকে তাই অনেক সময়েই হয়েছে, টিউবে যে চেঞ্জটা সিটিম্যাপার করতে বলছে আমার নিজের মনে হয়েছে অন্য স্টেশন থেকে করলে বেটারা হবে, এবং লোককে জিজ্ঞেস করে দেখেছি তারাও সেটাই বলছে। বাসে আবার মাঝে মাঝে ড্রাইভারদের ডিউটি শেষ হয়ে গেলেবাস ওখানেই থেমে যায়। মানে এখানে লেবার ল খুব স্ট্রং।ফলে ওভারটাইম করাটা খুব চালু ব্যপার না। ফলে ধরা যাক নিউটাউন থেকে বাস ছেড়েছে ,রুবি তে গিয়ে তার আট ঘন্টা  কাজ শেষ হয়ে গেল। আর বাসটা হয়তো যাবার কথা কসবা অব্দি তাও রুবিতে বাস থেমে যাবে।  অন্য ড্রাইভার আসবে এই ড্রাইভার ওখানেই থেমে অপেক্ষা করবে ,প্যাসেঞ্জারদের বলবে আপনারা অন্য বাসদেখে নিন! মানে সব কিছুরই দুটো দিক থাকে আর কি ।ওহ বলিনি না?এখানকার বাস ট্রেন মেট্রো সব জায়গায় একই কার্ড কাজ করে।সুবিধেটা ভাবো , বর্ধমান থেকে লোকালে এসে সেক্টর ফাইভ মেট্রো যাবার জন্যে আবার অন্য টিকিট কাটার দরকার নেই। 




হুড খোলা দোতলা বাস থেকে

আই অ্যাম গ্রুট

লন্ডনের বিখ্যাত লাল বাস

লন্ডন আই


ইন্ডিয়ান টাইমে অফিস করি। অফিসে ম্যানেজার ছাড়া আর কাউকে বলিনি বাইরে এসেছি। অফিস শুরু হয় ভোর সাড়ে পাঁচটায়। দিন দুই পরেই আবহাওয়া বদলে গেল। ঠান্ডা,  বৃষ্টি ভেজা আবহাওয়া। অফিসের পর একদিন বেরিয়েছি। র‍্যান্ডম হাঁটতে হাঁটতে একটা কবরখানায় পৌঁছলাম। পঞ্চাশ একশো বছর আগের সব কবর। মেঘলা দিনে,  বড় বড় গাছের নীচে শুয়ে আছে সব, কারোর ছেলে কারোর মেয়ে, কারোর বাবা কারোর মা, কারোর স্বামী কারোর স্ত্রী কিংবা কারোর কেউ না...।এরকম জায়গায় শেষ শোওয়াটা মন্দ না। আচ্ছা মরায় মানুষের ভয় কি পার্থিব সুখ ছাড়ার জন্যে নাকি এমন একা একা বিষন্ন বিকেল কাটাবার জন্যে? একা হয়তো আমরা ভাবি ,ওখানে হয়তো একাকীত্বটাই বেশী চাহিদার! কবরখানায় এরপর আরো গেছি অনেক জায়গায়, কিন্তু এই দিনেরটা যেন বেশী মনে দাগ রেখে গেছে। মেঘলা দিনের জন্যেই নাকি কে জানে!




বাড়ির কাছেই একটা পার্ক আছে, আগের পর্বতেই বলেছিলাম পার্ক মানে চৌকোনো উঠোন নয়। কোনোকোনোদিন ওখানে যাই হাঁটতে । এই পাড়াটা দেশীয় লোক বেশী বলেইকিনা কেজানে , মাঠ গুলো বা রাস্তা গুলো তুলনামূলক ভাবে একটু কম পরিষ্কার ।মানে বাকি জায়গাগুলোর তুলনায় আর কি। এখানেও ঘেটো ব্যপারটা চলে কিন্তু খুব। মানে বাংলাদেশী পাড়া , পাকিস্তানি পাড়া , ভারতীয় পাড়া ।ভারতীয়দের মধ্যে পাঞ্জাবীদের সংখ্যা সব চেয়ে বেশী।এই একটা জাতি , মাটি কামড়ে লড়াই জানে বটে। পার্কের কথা বলছিলাম্না, সেদিন হাইড পার্কে ভারী চমৎকার একটা দৃশ্য দেখলাম। লাইভ মিউজিক হচ্ছিল স্টেজে। তা বুড়ো বুড়ো কাপলরা দিব্যিকাপল ডান্স করল।আমাদের তো ভালোবাসা দেখানোই অন্যায় , আরসারা জীবনন্যের জন্যে বলি দিয়ে বুড়ো বয়স ফ্রাস্ট্রেশন মেটানোর বা আপশোষ করার বয়স ,তাই অন্যরকম কিছু দেখে ভারী ভালো লাগলো। 


 




ছুটির দিন গুলো ব্যাগে স্যান্ডউইচ, কেক, বিস্কুট, মুড়ি, চিপ্স জলের বোতল ছাতা, হুডি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ফিরে দেখি কোনোদিন বারো তো কোনোদিন পনেরো কিলোমিটার হাঁটা হয়েছে। নিজেরই বিশ্বাস হয়না। হ্যাট আমি এত হেঁটেছি! টিউবে পাউন্ড বেশী লাগে সময় কম, আর বাসে সময় বেশী পাউন্ড কম। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে বেরোলে বাস মন্দ না মাঝে মাঝে। দোতলা লাল বাসের সামনের সিট দখল  করে বসো, সামনের মসৃন হর্ণ বিহীন রাস্তা, পাতা ঝরা রাস্তা, ছবির মতো বাড়ি দেখতে দেখতে যাও। বাসে হোক কি টিউবে দুই জায়গাতেই মানুষ প্রচুর দেখা যায়। নানান ভাষাভাষী। কান পেতে বোঝার চেষ্টা করি কোন ভাষী। এ আমার এক নিজস্ব খেলা। দু চারটে জার্মান শব্দ জানি টুকটাক, musse, brauche শুনে আন্দাজ করি জার্মান। সেদিন এক হেব্বি সুন্দরী মহিলা উঠেছিল টিউবে। মাখনের মতো পা, টিকালো নাক, কালো চোখ। ভাবছি ইজিপশিয়ান বা তুর্কি কিনা। সাও শব্দটা শোনা গেলো তারপর তার ইংরেজির টানটা খানিক শুনে আন্দাজ করলাম স্পেনীয়। আরেকদিন,  বাসে এক বুড়ি উঠলো। তারপরের স্টপ থেকেই এক বুড়ো।সে একেবারে গপ্পোবাজ বুড়ো। আর কথা বলে এরকম ভাবে, " হ্যালো জন, হাউ আর ইউ জন?ওহ হোয়াট আ লাভলি ওয়েদার, রাইট জন? " যাইহোক, বুড়ির নাম অ্যাঞ্জেলিনা, গপ্পোবাজ জনের আরেক পরিচিতও ছিল, তার নামও জন। অ্যাঞ্জেলিনাকে শোনানোর জন্যই কিনা কে জানে, অন্য জনকে খুব গল্প শোনালো, ওর অল্প বয়সের, আরো কত বকবক করলো। এদিকে বুড়ি দেখি বেশ মিচকি মিচকি হাসছে সামনের সিটে বসে। 


সারাদিন অফিস করে, তারপর ঘুরে ফের এসে রান্না করে খেতেও তো কই অসুবিধে হয়না? এর কারন কি? মনে হয় আবহাওয়া একটা কারন।  আরেকটা কারন কি দৈনন্দিন অস্থিরতা কম? মানে আমি জানি অমুক ট্রেন বা অমুক বাস এতটার সময়েই আসবে। কখন বাস আসবে বা কখন ট্রেন তার অনন্ত অপেক্ষায় থাকার দরকার নেই। কি জানি?! হর্ণ নেই বলে শব্দদূষণ কম সেটাও এফেক্ট ফেলতে পারে। বক্তব্যটা বাড়াবাড়ি মিনে হতে পারে কিন্তু কিছুদিন আগে দেখছিলাম এটা নিয়ে গবেষণা হয়েছে এবিং আমার বক্তব্যের সমর্থনেই রিপোর্ট এসেছে। শব্দদূষণ আমাদের মানসিক ভাবে অস্থিতিশীল করে তোলে।

সোনালীদির ছেলে লন্ডনের ডাক্তার।  একদিন অফিসের দিনেই সকালে গিয়েছিলাম। ভারী সুভদ্রলোক। আমারই বয়সী হবে কিন্তু আমার মতো ন্যালাক্ষেপা ক্যাবলা না, ঝকঝকে একই সাথে বিনয়ী। ডাক্তার মানুষ ,তাও তার ব্যস্ত সময়ের মাঝে কফি খাওয়া হল এক কাপ করে। যারা যত বড় হয় তারা তত কম এবং অখাদ্য খায়। সত্যি! দুটূকরো শসা কি এক বাটি দই দিয়ে লাঞ্চ সারে কেউ, বা তেল মশলা হীন সেদ্ধ মতো খাবার। এদিকে আমার মতো অলম্বুষরা খায় বেশ ময়দার লুচি, রাবড়ি, ক্ষীর। ফলে আশিকভায়া খেলো দুধ চিনি ছাড়া এক কাপ কালো কফি বা সংক্ষেপে কাক, আর আমি দুধ চিনি দেওয়া ল্যাটে। আশিকের হাসপাতাল থেকে টিউবের রাস্তাটা ভারী চমৎকার।  আসলে হাসপাতালটা  হ্যামস্টেড হিথের কাছেই।এখানে আসবো আমরা একদিন।  চড়াই-উৎরাই রাস্তা, পাশে অনেক পুরোনো জমকালো এক গির্জা। রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় বেঞ্চ। অফিসের দিন বলে আমার সাথে ল্যাপটপ ছিল। বেঞ্চে বসে খানিক্ষন কাজ করলাম। রাস্তায় কোলাহল নেই তাই কাজের অসুবিধেও নেই। 






হ্যামস্টেড হিথ জায়গাটা একটা ছোটখাটো টিলা বলা যায়। দূরে লন্ডন শহরের স্কাইলাইন দেখা যায়৷ কিটসের বাড়ি এই হ্যামস্টেড হিথেই।  বিকেল বেলা দুজন পৌঁছলাম যখন প্রচুর নানান বয়সী মানুষ, কুকুর জড়ো হয়েছে, যদিও কোনো হট্টগোল নেই।নিজেদের মধ্যে কথা বলছে অন্যকে বিরক্ত না করে। কুকুর ভারতেও আজকাল বহু মানুষ পোষে কিন্তু এরকম দায়িত্ব নিয়ে যথারীতি না বেশীরভাগ সময়েই। এরা প্রতিদিন, কুকুরকে দৌড় করায়, পটি করলে তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে। আর কুকুরগুলোও ভারী সুশিক্ষিত। অন্যকে তেড়ে যাওয়া নেই, অবাধ্যতা নেই।গাছপালা, জলাশয় দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একিটা ট্রেইল পৌঁছে দেয় টিলার চুড়োয়। এরকম জায়গায় থাকলে রোমান্টিক কবি হবে স্বাভাবিক মনে হয়। আমরা টিলার উপর সবুজ ঘাসে বসে রইলাম। আমাদের পেটেন্ট খাবার, পাঁউরুটি, ডিম আর চিজ  খাবার পর এক বাক্স নিমকি বের করেছি। অমনি একটা নীল সাদা পাখি এসে হাজির৷ পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সচরাচর বুনোদের মানুষের খাবার দিতে নেই৷ নিমকি মানুষের জন্যেই এত খারাপ এমন সুন্দর পাখিটাকে দেবো যদি পালক ঝরে যায়! ভাবতে ভাবতে একটা ছোট টুকরো দিয়েছি।ওবাবা সে তো তার বেজায় ভালো লেগেছে। তুরতুর করে নেচে নেচে হাঁটছে আর তাকাচ্ছে। আর একটা কি দেবে না? একটা ছোট টুকরোই স্রেফ! আরো একটা দেওয়া গেল। ফূর্তি তার দেখে কে। আর কোথাও যাচ্ছেই না। গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। ভাবখানা,  আর না যদি দেয় আমিও যাবো না দেখি কতক্ষন না দিয়ে পারে। আরো দুটো দেওয়া হল। একদম পাশটিতে বসে নেচে নেচে খেয়ে তারপর সে গেল,  অন্য পাড়ায় মাধুকরী করতে। এদিকে আমাদের মতো তো সবাই না, খেয়ালও করেনি, বুঝতেও পারেনি যে ও কি চায়। এদিক ওদিক ঘুরে উড়াল দিলো।



ক্রমে আলো কমে গেল, হাওয়ার জোর বাড়লো,  লন্ডন শহরের সব আলো জ্বলে উঠলো। সন্ধ্যের  আলো আর অন্ধকারের অবাস্তবতা নিয়ে আমরাও উঠলাম।