Saturday, April 13, 2024

চৈত্রের দিন

চৈত্র মাস সেলের বাজার ছাড়া কেউ খবর রাখে না। আর আজকাল সারাবছরের সেলে চৈত্রসেলের তেমন দাম আছে কিনা কে জানে। কেনাকাটায় আমার তেমন আকর্ষন নেই বলেই সেলের সাথে আমার যোগাযোগ কম। চৈত্র আমার কাছে অবশ্য ফালতু হয়ে যায়নি। ফাল্গুন চৈত্র বৈশাখ...লোকে গরমে ভাজা ভাজা হয়ে রোদ্দুরকে গাল পাড়ে। ফেসবুকে ইভেন্ট হয়, যারা গরম ভালোবাসে বলেছে তাদের পে টা নো হবে,  চিতায় ছোঁড়া হবে। অবাক হয়ে দেখি! ভালোবাসতে হবে না, কিন্তু এরকম মারমুখী হতে হয় বুঝি? তামাশা করেও?! আমি সেই কতিপয় লোকের মধ্যেই যারা এই তীব্র দাবদাহ ভালোবাসে। বাংলা গরমের মাসগুলোর মতোই অর্বাচীন লোক। গোটা চৈত্র মাস আমি বেলার ঝাঁ ঝাঁ রোদে সাইকেল নিয়ে বাজার যাবার নামে বেরিয়েছি, রাস্তাঘাট বেবাক ফাঁকা, গোলাপী, বেগুনী, লাল, হলুদ, চড়া রঙের রোদের মতোই চড়া রঙের ফুল। গাছের নীচে ফুল বিছিয়ে জায়গাটা রঙীন জাজিমের মতো করে রেখেছে। রোদের ঝাঁঝ এসে লাগে, রোদের গন্ধও। বারান্দার গাছগুলোয় কবে এক পাখি খাওয়া বীজ থেকে নিম গাছ হয়েছিল। এ বছর গাছটার সব পাতা ঝরে গেছিলো, শুকনো কাঠের মতো ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সবার আড়ালে ফিসফিস করে বলতাম, বেঁচে যা ভাই। মরে গেলে দু:খ হবে খুব। সবার হবে, কারিপাতাটার, চন্দন গাছটার, জবাটার। আগের জবা গাছটার দু:খেই এরকম হল কিনা কে জানে। মালীটার জোর করে আগের জবা গাছটা মারলো। আজও আপশোষ হয়, কেন ওর কথা শুনলাম।  রাগ করিস না বাপ, সেরে ওঠ। তারপর, যেদিন দেখলাম, একটা দুটো করে পাতার আভাস দেখা যাচ্ছে সেও তো চৈত্রের একটা দিনই। ফূর্তির যে এমন কচি সবুজ রঙ হয় কে জানতো! গোলাপ গাছটা মরেই গেল। এই গোলাপ গাছটার সাথেও আমার কথা বার্তা হত এক সময়। বারান্দায় গেলেই, কোথাও কিচ্ছু নেই, হাওয়া দিত এক ঝলক, কেউ বিশ্বাস করবে না,  কিন্তু আমি জানি, গোলাপ গাছটাই বলতো হাওয়াকে। না হলে আশপাশের বাড়ির কোথাও গাছের পাতা নড়তো না কেন? 

সেদিন ঈদের দিন সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছি।  আশপাশের দোকান সব বন্ধ, একটু এগোলেই  শহর শেষ। বাঁশবনের রাস্তায় দেখি একটা মেয়ে তার ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি যাচ্ছে মনে হয়। বাবার কাছেই হবে, না হলে মেয়েটার এমন কিশোরী বা বালিকার মতো খুশী মুখ হতোই না। আর সাথে ওই যে ব্যগে নির্ঘাত মিষ্টি কিংবা ঈদের উপহার। ঈদে কি মেয়েরা তার বাপের বাড়ি যায়? পুজোয় যেমন আসে? নাকি আমার বুঝতে ভুল হচ্ছে! কত কম জানি! এই যে চড়ক উপলক্ষে গ্রামের প্রায় সব মেয়ে পুরুষ নতুন গামছা, একটা নতুন পৈতে পরে বেরিয়ে পড়েছে। ভিক্ষে  চেয়ে, নিরামিষ খেয়ে, মাটিতে শুয়ে কৃচ্ছসাধন করে। এ আমি জানতাম তবে এরকম পাড়া জুড়ে সবাইকে করতে দেখিনি। অবশ্য আদতে  চড়ক তো বাবুলোকদের উৎসব ছিলোও না কখনো। 
কিছুদিন আগে,  একটা আশ্চর্য জায়গায় গিয়েছিলাম। নেটওয়ার্কহীন, শব্দহীন সে আশ্চর্য জায়গা। ভরদুপুরে হুট করে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে রোদের হলকা সয়ে গেলে সরসর করে পাতা পড়ার শব্দ ভিন্ন আর কিচ্ছু কানে আসবে না। মনে হিবে যেন কোন আদিম সময়ে একা দাঁড়িয়ে। রাত বাড়লে বাড়ি থেকে ঝগড়া করে পালিয়ে আসা কোনো ব্যঙ বসে থাকবে জলের কলের উপর, দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে। হাজার বললেও সে যাবে না কিছুতেই। তারপর ভোরবেলায়, মানুষেরা যখন ঘুমিয়ে পড়বে, তার মা তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে এক থালা পোকা ধরে দেবে। সন্ধ্যেবেলা মহুয়ায় মাতাল শবরীর সাথে ভোজ খেতে যাওয়া কুকুর ছানা মহুয়ার গন্ধে রাস্তা গোলমাল করে বেপাড়ায় হাজির হবে। তারপর?  তারপর এই মাতাল সেই সুস্থ এরকম নানান জনের সাথে ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরে সে কী গল্প! "জানো মা আজ না.....। "
মাঝে মাঝে কোলকাতার বাইরে থাকি।  এ জায়গাটাও রোদ গরমের জন্যে বিখ্যাত। আমার কিছু আসে যায় না অবশ্য।কোকিল গুলো সাত সকালে ক্যাচোরম্যাচোর লাগিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে সকালটা লম্বা করে দেয়। ব্যাটাদের সকাল থেকে প্রেম পায় দেখি। সেদিন বেলার দিকে সে কি লটাপটি ঝগড়া! দুটো কাক মারামারি করে গাছ থেকে পরেও ঝটাপটি করছে। সারা পাড়ার কাক চলে এসেছে  লড়াই দেখতে। আরে আরে, একটা কাঠবিড়ালি তুরতুর করে লাফাতে লাফাতে আমার সাইকেলের সামনে, ব্রেক কষতে কষতে সে হাওয়া। সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যে প্রতিটা সময়ের দিনের যে নিজস্ব গান তা শুনতে শুনতে নেশা ধরে। দুপুরের কুবো পাখিটার ডাক শুনতে পেলে আমার আর হিসেব নিকেশ মেলাতে ভাল্লাগেনা। মনে হয় এক্ষুনি সব ছেড়ে না বেরোলে যেন হবে না, কোথায় কোন দূরে যেতে হবে আমায়, সময় বয়ে যাচ্ছে।

এখানে অবাঙালী ভীড় খুব, হনুমান মন্দির হচ্ছে আরো বড় করে। মন্দিরটার দুপাশে দুটো বড় বড় গাছ ছিল, বট আর নিম। কেটে দিলো। মন্দির বড় হবে। সকাল বিকেল বেচারি হনুমানগুলো লাফ ঝাঁপ করে যায় ক্যাম্পাসের মধ্যেই তাই৷  
ধূ ধূ দুপুরের জনপ্রানীহীন বন প্রান্তর, শুনশান রাস্তা, রোদের তাতে নিস্তেজ হয়ে ছায়ার আরাম, কচি পাতার রঙের বাহারে জঙ্গলে রঙের আগুন লেগে যাওয়া বসন্ত, গ্রীষ্ম আমায় বুঁদ করে দেয় ভালোলাগায়। রোদ লেগে শরীর খারাপ হয়, বন্ধুরা তামাশা করে কিন্তু শরীর তো শরীরের নিয়মে চলবে ভালোবাসতে গেলে কী অত বেছে ভালোবাসা যায়!?

No comments:

Post a Comment