Monday, February 18, 2019

একদিন হঠাৎ

একটা কাজ ছিল আজ। জরুরী খুবই। তা বেরোনোর আগে,শীত ফুরোনোর রবিবারের সকালে পাতলা চাদরে পা ঢুকিয়ে, সব্যর আশ্চর্য ভ্রমন পড়ছিলাম। সান্দাকফুর রাস্তায় হাঁটছে তারা,  জলে ভিজছে, জ্যোৎস্না মাখছে, হাঁটছে হাঁটছে....আমার সব গোলমাল হয়ে গেল। বই নামিয়ে চানে ছুটলাম....চেয়ারে রাখা জামা জিন্স গলিয়ে হনহন করে গ্যারাজে। ততক্ষনে আমি জানি আমার আর ওই জরুরী কাজ করার উপায় নেই, আমায় বেরোতেই হবে। আলতো শীতের এই রোদ উপেক্ষা করে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে আমার রবিবার কাটতে পারবে না।

সাড়ে এগারোটা কোথাও যাওয়ার জন্যে বেশ দেরী। রোদ চড়া,  বেলাও অনেক। কোথায় যাব মাথায় আয়াছে না, মালঞ্চর রাস্তা ধরেই যাই। যদ্দুর যাওয়া যাবে যাব। ডেস্টিনেশন জেনে আর কবেই বা আমার কোন চলাটা হয়েছে। ঠিকাছে, চালাও পান্সি....

এই কিছুদিন আগেই শীতের শুরুতে এসেছিলাম যখন এ রাস্তাটা অন্যরকম ছিল। অনেক কটা গাছেই পাতা নেই আর এখন, পলাশ, সজনে ফুলে ছেয়ে আছে।  সজনে ফুল এক অদ্ভুত কম্বিনেশন দেয়। সাদাটে ফুলগুলো সবুজ গাছে যেন আলো জ্বালিয়ে রাখে। বাঁ পাশে খাল সংস্কার হচ্ছে মনে হয়, পাঁক তুলছে। উহ বেজায় গন্ধ। ডান দিকের জমিগুলোয় সর্ষেফুল আর নেই...ন্যাড়া জমি পড়ে আছে শুয়ে। 

বাবুরহাট বলে একটা জায়গার নাম শুনেছিলাম। দেখা যাক কেমন হয়! ভালো না লাগলে ব্যাক করবো। মীনাখাঁ থেকে বাবুরহাট সাত কিলোমিটা মত। সুতরাং চাপ নাই খারাপ লাগলেও চট করে চলে আসা যাবে ফের। তাছাড়া এমনিতেও জানিনা কোথায় যাব! মেন রাস্তার থেকে সরু খানিক, দুপাশে জমিতে ধান বুনছে।  এসময় ধান কেন? শীতের শেষে এ সময় ধান রুইতে হয় নাকি? আলু উঠে যায় তারপর কি হয় যেন চৈত্রের ফসল? মনে পড়ে না....চাট্টি হাবিজাবি জঞ্জালে মাথা ভরা, নিজের জমির হিসাব নাই....ফসল এর খবর রাখিনা ভাত জুটে যায়! 

স্যালোর জলে চান করছে কটা ছেলে।  দেখে আমারও ভারী সাধ হল অমন করে হুড়ুম হুড়ুম করে চান করবার। এহ একটা গামছাও যদি আনতাম! গাড়িটা সাইড করে আল ধরে ধরে হাঁটছি, ধান জমির মাঝে মাঝে শশা ক্ষেতও আছে। একটা ফিঙে তারে বসে দোল খাচ্ছে। কোথা থেকে উদাসী কোকিলের ডাক ভেসে আসছে একটা।  সব ঋতুর আলাদা আলাদা গন্ধ,  রঙ থাকে। হ্যাঁ আমাদের এই ঘোলাটে আকাশেও থাকে, আমি বুঝতে পারি। মানে শুধু তাপমাত্রা বা ফুল দিয়ে না, সবটা দিয়ে। গরমের দুপুরের রঙটা প্রায় এরকমই হবে খালি ধরো এক্সপোজারটা আরেকটু বেশী হবে, তুলিতে আরেকপোঁচ নির্জনতা আর উদাসী কুবো পাখীর ডাক শোনা যাবে। জমির কাছে এলেই এমন ভালোলাগে আমার। অবশ্য আমার অনেক কিছুতেই ভালো লাগে, আমার নীল আকাশ দেখলে ভালো লাগে, জল দেখলে ভালোলাগে, পাহাড়ে পাইন বনে হেঁটে যেতে ভালো লাগে, রোদ উঠলে ভালো লাগে, চমৎকার গান শুনলে ভালো লাগে, পছন্দের খানা মিললে ভালো লাগে....খারাপ লাগার লিস্টিও কম না যদিও তবে এমন ঝকঝকে দুপুরে খারাপ জিনিস কে মনে রাখে! 

একটা শশা তোলার ইচ্ছে হচ্ছিল খুব। কিন্তু কেউ তো নেই, না বলে ঋকানন্দর নিতে বাধে, আমাদের গ্রামে আমি জমিতে গেলে কেউ না  কেউ এমনিই দিত, "একটা  খা না শশা, ভালো রে"।  কিন্তু 'রাখতে যদি আপন ঘরে বিশ্ব ঘরে পেতাম না ঠাঁই '।   সুতরাং গা ঝেড়ে উঠে পড়া গেল। বাবুর হাটে খান দুই রিসর্ট আছে। একটায় আঁ আঁ আঁ আঁখ মারে হচ্ছে উদ্দাম বেগে  আরেকটায় একটা ছোট পুলে জাঙ্গিয়া পরা একদল মুশকো লোক জলকেলি করছে।  কিছু লোক বিয়ারের বোতল হাতে বসে চিকেন পকোড়া সাঁটাচ্ছে। আমি যেন বুক করব এরকম একটা ভাব নিয়ে মালিকের সাথে কথা টথা বলে চা পেয়ে গেলাম এক কাপ। এমন হুল্লোড়ে  দোষ নেই কিছু তবে আমার এমন হুল্লোড়ে আরাম নাই৷ তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বেরিয়ে ফের মীনাখাঁ এসে মালঞ্চ। আর একটু এগোলে একদিকে ধামাখালি, আরেকদিকে বাসন্তি,ক্যানিং ঝড়খালি।  চিকেন পকোড়ার গন্ধে খিদে খিদে পাচ্ছিল। রবিবারের দুপুরে মালঞ্চ বাজার ফাঁকাই। একটা লোক গরম গরম কাঠি ভাজা করছে, পেয়ারা জামরুম নিয়ে বসে একজন। হাবিজাবি মিষ্টির ঠেলা নিয়ে একজন। কাঠিভাজা খেতে খেতে মিষ্টির ঠেলার সামনে গেছি। আজ তো আমার দিন, সারাদিন উল্টোপাল্টা অখাদ্য খাবো।
 " কাকা ওই গোল গোল খাজা গুলো কত করে? একটা দাও তো।" 
আরে হেব্বি খেতে তো। রসে টুপটুপে, পুরীর লম্বাটে খাজাগুলোকে দশ গোল দেবে। জিলিপিও আছে, গুড়কাঠিও আছে, নিকুতি এরা যাকে খেজুর বলছে, আর মালপো। কোনটা খাই? উমম গুড়কাঠিই খাব। 
-কাকা আরেকটা খাজা আর একশো গুড়কাঠি দাও দেখি৷ 

খেতে খেতেই গল্প হয়। তার বাড়ি কোথায় আমার বাড়ি কোথায়। আমার বাড়িতে কে আছে,  এ মিষ্টি কে বানায়....আমার চলার রাস্তায়, গাঁয়ে, হাটে বাজারে পথের আলাপ ছড়িয়ে আছে এমন কত। আগের বার ধামাখালী গেছিলাম, এবার বাসন্তীর দিকে যাই। ক্যানিং গেলে নদী কাছে পাব, ঝড়খালি তো দূর হবে, অন্যদিন আসবো খন, এই ভেবে মাতলা দেখতে চলা শুরু ফের। ক্যানিং এ ব্রিজ হয়ে গেছে, ফেরী নৌকা চলে না,  নদীতে জলও নেই। মন ভরল কই! এক লোক বুদ্ধি দিল, চারটে বাজে, ঝড়খালি চলে যাও, আসতে যেতে দু ঘন্টা লাগবে। 

আসতে যেতে দু ঘন্টা মানে রাত হবে ফিরতে। বুদ্ধিমান লোক হলে কখনোই যেত না। কিন্তু আমার যে চলাতেই আনন্দ, এক্সট্রা চল্লিশ বিয়াল্লিশ কিলোমিটার মানে আশী পঁচাশী কিলোমিটার  তো, টেনে দেব খন। কিন্তু এদিকের রাস্তা তো হাইওয়ে না, আর রাস্তাও বেশ প্যাঁচালো, ফেরার সময় অন্ধকারে তো স্পীড তুলতে পারবো না সেসব খেয়াল করিনি। মাথায় যদি পোকা নড়ে তাহলে আর উপায় কি। সাঁই সাঁই রাস্তা, গোল গোল  টার্ণ, হাপুসহুপুস করে ঝড়খালি পৌঁছলাম যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। এই একটা দৃশ্য কত শতবার দেখেও পুরোনো হয়না। জলের মধ্যে রঙ তুলি ধুয়ে নিয়ে সূর্য বাড়ি ফিরলো আমিও এক কাপ চা খেয়ে আড়মোড়া ভেঙে ফিরতি পথ ধরলাম। ব্যাঘ্রপ্রকল্প দেখা হল না, বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য দেখবার তাড়া নিয়ে আসিওনি। অনেক লোক সুন্দরবন ঘুরে ফিরছে। আমি আলগোছে একবার বোট ভাড়া কিরকম খোঁজ নিয়ে নিলাম,  বলা যায় না হয়ত কোনদিন শখ হবে রাতে আর না ফিরে থেকেই গেলাম! 

এ রাস্তায় স্ট্রীট লাইট নেই, হুশহাস গাড়ির আলো খালি। বাসন্তী হাইওয়ে উঠে গাড়ির স্পীড বাড়িয়েছি এমন সময় হঠাৎ দেখি চাঁদ উঠে গেছে অনেক্ষন। আজ বুঝি ত্রয়োদশী,  চারদিকে ভেড়ির জল চাঁদের আলোয় চকচক করছে। গাড়ি সাইড করে আলো নিভিয়ে বাইরে এলাম।  আমি জানি এসব অঞ্চল সেফ না মোটেও। খুন, রাহাজানি লেগেই থাকে। কিন্তু এ চারিদিকে আদিগন্ত ভেড়ির মাঝে ফাঁকা রাস্তায় চাঁদের আলোয় সে এমন দৃশ্যপট তৈরী হয়েছে তাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। সে দৃশ্যের বর্ণনা করতে পারি এমন সাধ্য আমার নেই, এ সৌন্দর্যের আনন্দ প্রকাশ করতে পারি তেমন ভাষাও নেই। চাঁদের আলোর নেশা বড় তীব্র,  যে একবার সেই নেশায় বুঁদ হয়েছে তার আর কিছু নেশা লাগে না, মদ না গাঁজা না,  রাজনীতি না, যশ না কিচ্ছু না। 

ফিরতে ইচ্ছে করে না তবু ফিরতেই হয়। এক বুক চাঁদের আলো নিয়ে ফের চলা শুরু।  সায়েন্স সিটির কাছাকাছি তখন, চারদিক ধোঁয়াশায়, মিটমিটে আলোয় আরেক ছবি তৈরী হয়েছে। মাঠের উপর জমাট ধোঁয়াশা, চারদিক শুনশান।  আরেকবার থামতেই হল। চাঁদের আলোয় ভেড়ির জল একরকম আর এই ধোঁয়াশা মাখা মাঠ আরেকরকম। নিস্তব্ধ ভুতুড়ে। ভুতুড়েই কারন এ তো সত্যিই অতীত।  আর একটু পরেই আলো জ্বলা শহরে ঢুকে যাব,  এ সব অলীক ছবি হয়ে থাকবে খালি। তারপর একদিন ঘোর ভেঙে যাবে,  এই সব আলো, হিসেব নিকেশ আসলে বেকার জিনিস, ওই ধোঁয়াশা মাখা ঝুপ্সি মাঠ, সাদা সাদা ফুলের আলো জ্বলা সজনে গাছ, চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া ভেড়ির জল, টুপ করে ডুবে যাওয়া সূর্য,  ঘেমো কপাল গলার গামছায় মুছে কাগজে মুড়ে দেওয়া খাবার.....এসবই আসলে সত্যি টের পেয়ে আবার বেরিয়ে পড়তে হবে একদিন।


No comments:

Post a Comment