Saturday, February 9, 2019

সরস্বতী পুজোয়

"আরে আমি তো দু বছর দুবাইতে বিল্ডিং এর কাজ করেছি। তারপর এই খানে। "
- ফিরলে কেন? এখানে মাইনে তো আর দুবাই এর মতো হবে না।
- মাইনে বাড়াচ্ছিলো না, তারপর আরো সমস্যা...

পাড়ার ওষুধের দোকানের ছেলেটার সাথে কথা হচ্ছিল। হাসীখুশী ছেলেটা আমায় ব্যথা না দিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। আজ দোকান ফাঁকা গল্প করছিলাম তাই। গল্প করতে করতেই খেয়াল করছিলাম, ছেলেটা যা কথাই বলছে তাতে কিন্তু অভিযোগ নেই, হতাশা নেই। দিব্যি হাসিমুখে বলছিল তার ঠিকাদার কেমন নিয়ে গেছিলো এক কাজে লাগিয়েছিল অন্য কাজে, পাসপোর্ট জমা রেখে দিয়েছিল কিনা তাই সুযোগ থাকতেও অন্য জায়গায় চাকরি করা হল না। বোকা সোকা মানুষ বোঝাই যায়। পাসপোর্ট জমা রাখাটাই তো ঠিক না, কে বলবে! কত শত শ্রমিক ওই ভাবে বন্ডেড লেবার হয়ে কাজ করে৷ আর এই হাসিমুখে, তুড়ি মেরে সব, বাঁচাটাই এদের মূলধন হয়ত, না হলে এমন ঝকঝকে হাসিমুখে বাঁচে কেমন করে? কেমন করে দু হাজার টাকায় নিজের খরচা চালিয়ে সব বাড়িতে পাঠিয়েও ফের সে জায়গায় যেতে চায়!

"এখানে মাইনে কম পাই, জমে না কিছু, তাই ভাবছিলাম আবার চলে যাব কিনা। এখানে থাকলে মেয়েটাকে দেখতে পাই রোজ, এটাতেই সব মেকাপ হয়ে যায় বুঝলে। ওখানে থাকতে তো মেয়েকে দেখতেই পাইনি দু বচ্ছর। "

কার সুখ যে কিসে লুকিয়ে থাকে। ছেলেটার দোলাচল বুঝি৷ টাকার টান, অপত্যের টান.....এ দড়ি টানাটানি সব জায়গায়তেই ভায়া। মুখে বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ দেখো যেখানে ভালো লাগবে। তার বেশী বলার অধিকার তো আমার নেই। আমি ওর জীবন জানিনা, ওর ভালো থাকা খারাপ থাকা জানিনা, ওর সুখ অসুখ না বুঝে পরামর্শ দেবার আমি কে!

সুখের মতই সত্যি জিনিসটাও বড়ই গোলমেলে৷ ধরা যাক বিদেশী কেউ, যে কোলকাতাকে বোঝেইনি, বলল, কোলকাতায় কোনো সুস্থ মানুষ বাস করে নাকি! এতো ধোঁয়া, অসভ্যতা, কাজ নেই, পরিষ্কার জল নেই, গিজগিজে মানুষ.... এখানে যারা থাকে তারা সবাই খুব খারাপ থাকতে বাধ্য। কথাটা খানিক ঠিক কিন্তু খানিক ভুল। এতো লোক খারাপ থাকলে এমন ঝকঝকে হাসতে পারে?

তার থেকেই সাইকেল নিয়ে মিষ্টি কিনতে যাচ্ছি। কতদিন পর সাইকেল চড়লাম, লগবগ করতে করতে প্যাডেল ঘোরাচ্ছি। এ সাইকেলে আবার বেল নেই, ও কাকা সাইড করে সাইড করে....লগবগ করতে করতেই ব্যালেন্স হয়ে যায়। জ্যাম কাটিয়ে একটা গলিতে ঢুকলাম, অনেএএক দিন আগে কিশোরবেলায় ঘুরতাম এ গলিতে, লুকিয়ে সিগারেট খাবার জন্যে। একবার উত্তেজনায় পিছনের পকেটে রেখে দিয়েই টিউশন ক্লাসে চলে গেছিলাম। কেমিস্ট্রি টিউশন ছিলো মাটিতে বসে, এক টাকাটা পঁচিশ পয়সার ফ্লেক দুমড়ে যাওয়ায় সেকিইই দুঃখ।

এখন এ গলিটা বদলে গেছে, বিস্তর ফ্ল্যাট উঠে গেছে। তাও এখানে বাতাস এখনো একটু পাতলা...একটু ভীতু। 
সরস্বতী পুজোয় রাস্তা জুড়ে জ্যান্ত সরস্বতী ঘুরে বেড়াচ্ছে। কালো শাড়ী পরা এক সরস্বতী ফোনের ওপারে বিশেষ কাউকে বলছে, "গাধাটা, মা এর গলা আমার গলা চিনিস না! "

কাকে হেগে একেবারে যাতা করেছে গাড়িটায়। কন্সটিপেশনের রুগী কাক। শক্ত ইঁট হয়ে গেছে। ভেজা লাল কাপড় দিয়ে ঘষছি, গাড়িটাকে বিড়বিড় করে বলছি, "আমি নিজেও তো খানিক গোছানো খানিক অগোছালো বল, মানিয়ে গুছিয়ে নে একটু। দুবছর এর উপর ঘর করছিস, না হয় কদিন পরিষ্কার করিনি অমন উদাস হয়ে যাবার কি! তাই জন্যেই তো কাল কাপড় বাঁধা ডাকাতনী তোকে আঁচড় কেটে বেড়িয়ে গেল। দুঃখ হয় তো বল?"

"ও ভাই, আমার গাড়িটা ধুয়ে দিবি? কত নিবি?"

আমার উস্কো খুস্কো চুল, বিড়বিড় বকা, গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ছাদ সাফ করা দেখে আমায় গাড়ি ধোয়ার ছেলেটা ভেবেছে নির্ঘাত! এহ ডিমোশন হলো। আগে মোটর মেকানিক ভাবত। অবশ্য দোষ দেওয়া যায়না। কারন আমায় দেখতে অমনই লাগে....কিন্তু দুঃখ তাতে না, দুঃখ হল পাশ দিয়ে তখনই একটা বেশ মানে বেশ ভালো আর কি, তরুণী যাচ্ছিলেন, যাকে আমি গাড়ি ধোয়ার ফাঁকে একটু ওই আর কি যাকে বলে তাকাচ্ছিলাম। কে যাচ্ছে না যাচ্ছে খোঁজ রাখা দরকার কিনা!

সবই মায়া হে...যাক যা গেছে তা যাক। বিকেলে আজ রাস্তা ফাঁকাই। সরস্বতী পুজো আজ না কাল? যেদিনই হোক আজ দিনটা সব মিলিয়ে মন্দ না, ওই যে একটা গাছে পলাশ ধরেছে, একজন সার্জেন্ট হাত দেখিয়ে গাড়ির স্রোত থামিয়ে দুটো বাচ্ছাকে রাস্তা পার করে দিচ্ছে, একটা পাঞ্জাবী পরা আর একটা হলুদ শাড়ি পরা। এইসব সুখ গুলো লুকিয়ে থাকে বলেই আমার এই শহর ছেড়ে পালানো হয়না, ওই ওষুধ দোকানে ছেলেটার মত যে ঠিকাদারের বন্ডেড লেবার হয়ে বেশী মাইনের চাকরির মায়া কাটিয়ে রয়ে যায়, মেয়েটাকে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুমোতে যাবে বলে।

No comments:

Post a Comment