Thursday, February 14, 2019

ব্যাঙ আর প্রজাপতি

ভ্যালেন্টাইন্স ডে বলে মনেও পড়েনা আজকাল, বয়স হয়েছে কিনা৷ তবে ফেসবুক খুললে মনে পড়ে যায়। তা প্রেমের উচ্ছাস করছে অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে গুলো মন্দ কি। প্রেমের দিন  উপলক্ষে একটা প্রেমের গল্প হোক নাকি?

গল্পটা আসলে একটা ব্যাঙের আর একটা প্রজাপতির। অসম প্রেম। আজকেই একটা ছবি দেখলাম নেটে, সে দেখেই লেখা।

**********************************************

গাছের ডালে বসেছিল সে চুপটি করে। মন ভালো নেই তার।না হয় সে মোটাসোটা থলথলে, গায়ে বড় বড় আব, না হয় তা গলায় গান খেলেনা, না হয় বদমেজাজী বলেই জানে সবাই তাই বলেই অমন করে বলে দেবে সকলের সামনে? 

আজ এখানে উৎসবের দিন ছিল। এখানে মানে এই চত্বরে। বেশী কেউ থাকে না এখানে, কয়েকঘর  সোনা ব্যাঙ, একটা কোলা ব্যাঙ, কিছু প্রজাপতি, কিছু বট, অশ্বত্থ, পেঁপে, পেয়ারা, একটা পিঁপড়েদের ডেরা,  কিছু মৌমাছি, আর কিছু চড়াই, শালিখ, ফিঙে, দোয়েল, মাছরাঙা। ব্যাস। আগে আরো অনেকে মিলে থাকতো। সেবার আকাশ থেকে জ্বালা ধরা  বৃষ্টি নামলো, কত ঘাস গাছ, প্রাণী মরে গেলো। মানুষ গুলো এসে আরো গাছ কমিয়ে দিল, নোংরা ফেলে ডোবাটা ভরিয়ে ফেলল, ব্যাস যারা ছিল তারাও কমে গেল।  এখন খালি ওরাই আছে। 

সেদিন ওরা এক হয়ে উইকেন্ড পার্টি করছিল। সারা সপ্তাহ কাজ থাকে ওদের সবারই খুব, এই মধু জোগাড় করো কি এই পোকা ধরোরে। উইকেন্ড পার্টি মানে আড্ডা খাওয়া গান বাজনা এই আর কি। টুকটাক মনের কথা বলে কেউ কেউ। এই যেমন দেখোনা,  মিষ্টি হাসি নিয়ে ফিঙেটা কেমন দোয়েলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গান শুনছে। দুজনের দুজনকে ভালো লেগেছে বোঝাই যায়। এক ভাঁড় মধু নিয়ে ওদের আড্ডা এগোক আমরা বরং চারদিক ঘুরে দেখি। আকাশটা আজ ঝকঝকে নীল।  ওদের এই জমায়েতটা সকালেই হয়ে থাকে৷ অশ্বত্থ একটা ডাল নাড়িয়ে তাল দিচ্ছে।  মাথা নেড়ে গান গাইছে পেঁপে গাছটা। চারদিকে খুশী খুশী হাওয়া। 

ভাবছ বুঝি তাহলে প্রথমে কার কথা দিয়ে শুরু করেছি? সে কথায় আসছি। তাড়ার কি? ছুটির দিন, দিব্যি আরাম আরাম গন্ধ চারদিকে। কোনের বাড়ির সোনালী ব্যাঙ পরিবারের একটা মেয়ে আছে। ভারী সুন্দর গানের গলা, দেখতেও তেমনই মিষ্টি। আর নামটাও ভারী  চমৎকার, টুরিং। কিন্তু হলে কি হয় সে মেয়ে বড়ই খামখেয়ালী,  এই ভালো মনে আছে তো তোমায় নিয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে গেলো এই মেজাজ খারাপ তো তোমায় ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দিল। 

বলছিলাম না ও পাড়ায় এক মাত্র একটা কোলা ব্যাং থাকে? তাকে দেখতে যেমন খারাপ, মেজাজও তার তেমন খারাপ আর নামটা? সেও ততটাই খারাপ, অন্তত তার তো তাই মনে হয়। কালো কোলা থপথপে আবওয়ালা সেই ব্যাং এর নাম  বুরুৎ। শুরুতে এই বুরুৎ এর কথাই বলছিলাম। 

কোনো একদিন এরকম  একআনন্দ খুশীর দিনেই টুরিং কে দেখে মন মজে যায় বুরুৎ এর। টুরিং তখন একটা কচুপাতায় চড়ে দোল খাচ্ছিল আর গান গাইছিল। সেই গানের সুরে হাওয়ায়,  পুকুরের জলে আর বুরুৎ এর মনে লেগেছিল কাঁপন। বুরুৎ  গুটি গুটি এগিয়ে গেছিল গানের দিকে। তারপর? তারপর আবার কি যেমন হয়, টুরিং আর বুরুৎকে প্রায়ই এদিক সেদিক একসাথে দেখা যায়। পাতার প্লেটে পোকা রেখে দুজন দুদিক থেকে খায়, টুরিং গান পাঠায় বুরুৎ শোনে। বুরুৎ চিঠি লেখে গাছের ছালে, টুরিং লজ্জা পায়। বুড়ো বট খুশী হয়ে হয়ে ঘাড় নাড়ে। 

সব ঠিক চলতে চলতেই হঠাৎ করে বাধলো গোলমাল। কাটা গেলো আরো একটা বট, মারা পড়লো আরো অনেক কটা পাখি, পোকাদের চলাফেরার জায়গা গেল কমে। ফলে ওদের পাড়ায় এলো খাবারের কষ্ট। কাজ নেই, সারাদিন বসে বসে একটা পোকাও মেলেনা, সাপ্তাহিক আড্ডা তেমন জমে না আর। কজনই বা আছে পড়ে।  অসময়ে ভালোবাসা টিকতে গেলে যে জোর লাগে তা মনে হয় ছিল না বুরুৎ আর টুরিং এর গল্পে। ফলে হল কি, পোকা না পেয়ে পেয়ে দুজনেই বিরক্ত হয়ে গলা ফুলিয়ে ফুলিয়ে খালি ঝগড়া করে গেল। করতে করতে বিরক্ত হয়ে একদিন দুজনেই অন্য জায়গায় চলে গেল পোকার খোঁজে। 

তারপর অনেক শীত বসন্ত বর্ষা  পার হয়ে ক্রমে ক্রমে জায়গাটায় একটা দুটো নতুন গাছ দেখা গেল, একদুটো নতুন পোকার দেখা মিলল, নতুন দু চারটে পাখিও দেখা গেল, দেখা গেল নতুন নতুন ব্যাঙাচি, ডোবায় নতুন পদ্মফুল, তাতে পদ্মমধু। আবার এক দুই করে মৌমাছি, বোলতা, প্রজাপতি স, মাছরাঙারা আড্ডা জমাতে শুরু করলো। মেজাজ ভালো হল টুরিং এর। মজলিশে এলো সোনালী ব্যাঙেদের পরিবার। খালি সবাই ভুলে গেলো বুরুৎ এর কথা। বুরুৎকে তো আলাদা করে মনে রাখারও কিছু নেই কারন বুরুৎ তো কিছুই পারে না তেমন, না পারে গাইতে না পারে বাজাতে বা পারে মজলিশ জমিয়ে তুলতে। তাছাড়া ও পাড়ায় কোলাব্যাঙ আর একটাও ছিল না, তাই মনেও পড়েনি কারো।

বুরুৎ তো এমনিতেই বদমেজাজী।  তার মেজাজ গেল আরও খারাপ হয়ে। মন খারাপটা রাগে বদলে গিয়ে চেঁচামেচি করতে লাগল ওখানে গিয়ে৷ চারদিকে কেউ কেউ বলল, ওরে থাম থাম, ভুলে গেছি তো কি হয়েছে। এখানে তো আমরা সবাই বন্ধু চলে আয় তো। তাতেও বুরুৎ এর মেজাজ ঠিক হয়না। টুরিং এর কাছে গিয়ে সে বলল, "তুমি তো আমায় ডাকতে পারতে?"
টুরিং তার সোনালী রঙের থ্যাবড়া নাকের ফুটোটা বাঁকিয়ে বলল, উফ ফের তুমি! তোমায় কত খারাপ দেখতে তুমি জানো? তুমি কেমন বদ্মেজাজি জানো? তাছাড়া তোমার কোনো নিজের ছাতাও নেই তবে তোমায় আমি ডাকবো কেন? 
বুরুৎ এর রাগটা মন খারাপে ফিরে গেছে তখন। মুখটা নামিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, "তবে আগে ডাকতে কেন?" 
-অত বলতে পারিনে বাপু। তুমি এখন যাও দেখি,  এদিকে মজলিশ ভণ্ডুল হবে আমার তোমার জন্যে। ওই দেখো মাছরাঙা কেমন ম্যাজিক দেখাচ্ছে।

তারপরেই বুরুৎ গাছের ডালে বসেছিল মন খারাপ করে। তা সত্যি বলতে মন খারাপ হয়েছে ঠিকই কিন্তু ভুলও তো কিছু বলেনি। তোমারই বা অমন হুড়মুড় করার কি ছিল। ভুলে গেছে ডাকতে যখন মনে করিয়ে দাও।  এ তো আর মানুষ না তুমি যে ডাকতে ভুলে গেছে বলে সে নিয়ে দক্ষযজ্ঞ করবে!  তাও এমন আনন্দের দিনে কেউ একজনেও মন খারাপ করলে খারাপ লাগে বৈকি। হোক না সে বদমেজাজি৷ 

মন খারাপ করে বসে ছিল বলেই বুরুৎ খেয়াল করেনি একটা পোকা তার নাকের ফুটোর মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেল। হঠাৎ চমক ভাঙলো, খিলখিল করে একটা হাসি শুনে। কে হাসে? 
একটা হলুদ শাড়ি পরা প্রজাপতি। 
বুরুৎ হেঁড়ে গলায় হাঁক দিয়ে বলল, "এইয়ো কী ব্যাপার? হাসছ কেন?"

-হাসবোনা? ব্যাঙের নাকের ভিতর দিয়ে পোকা ঘুরে চলে যায় আর ব্যাঙ ছেতরে পড়ে থাকে এ দৃশ্য দেখেও হাসবোনা? খ্যা খ্যা খ্যা।

-অ্যাই মেয়ে ফের? দেবো থাবা মেরে বুঝবে। নেহাৎ আমার মন ভালো নেই তাই নাহলে না...

- না হলে কি? সত্যি মারতে? বাচ্ছা মেয়েকে মারবে বলে ভয় দেখাও, কেমন বীরব্যাঙ বোঝাই যাচ্ছে!

- বাচ্ছা! কে তুমি? তুমি হলে ধানী লংকা একটা। যাওনা যাও ওদিকে তো মজলিশ হচ্ছে, এখানে কেন।

- সে আমি যেখানে খুশীই যেতে পারি। কিন্তু তুমি এমন ছ্যাতরাব্যাতরা হয়ে শুয়ে কেন?

- এমনি।

-বেশ তাহলে এমনি এমনি চলো দেখি মজলিশে। 

-না না আমি যাব না৷ তুমি যাও।

- কেন তোমার পেট খারাপ হয়েছে বুঝি?

- সে আবার কি! পেট খারাপ হবে কেন। আশ্চর্য মেয়ে তো!

- তুমিও কম আশ্চর্য নাকি! আমায় তো কই বললে না এই হলুদ শাড়ি পরে আমায় কেমন লাগছে? মা এর থেকে চেয়ে নিয়ে পরেছি।

- আজব তো! আমি বলতে যাবই বা কেন! তোমার ইচ্ছে হয়েছে পরেছ, যাও মজলিশে অনেকে কম্পলিমেন্ট দেবে।

ও কি মন খারাপ করে বসে পড়লে কেন!

- আমায় নিশ্চয়ই বাজে লাগছে। 

- না না খুবই মিষ্টি লাগছে তো!

- সে তো এখন আমায় ভোলাতে বলছ। না হলে এতক্ষন তো খারাপ বলছিলে।

- খারাপ আবার কখন বললাম। উফফ মেয়েটা পাগল করে দেবে তো। আমি মরছি আমার জ্বালায়! 

হলুদ শাড়ি পরা প্রজাপতিটা দৌড়ে গিয়ে ব্যাঙের কাছে গিয়ে বলল, "কই দেখি দেখি, কোথায়, দাঁড়াও আমার কাছে ভালো একটা ফুলের রেনু আছে লাগালেই সেরে যাবে। "

- আরে কী আশ্চর্য!  সত্যিকারের পোড় নাকি! এ অন্য পোড়া, তুমি বুঝবে না।

- বোঝাও।

- না। 

- না বোঝালে তোমার নাকে কিন্তু পরাগ গুঁজে দেব।

- আহ মহা ঝামেলা তো! সে অনেক বড় গল্প।

- হ্যাঁ আমি কি ছোট করতে বলেছি নাকি। তুমি যা ক্যাবলা নির্ঘাত তাহলে ঘেঁটে ফেলবে সব।

- কী আমি ক্যাবলা! যাও আমি কিছুই বলব না আর।

- আচ্ছা আচ্ছা  রাগ করেনা.....

.......কথায় কথায় রাত নামে কখন।  বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে যায় তাদের। পরদিন সকালে বুরুৎ দেখে তার মন খারাপটা চলে গেছে, বুকের মধ্যে কেমন যেন উচাটন ভাব। এই যাঃ কাল তো মেয়েটার নাম জানা হয়নি তবে? আর কি দেখা হবে না? দুরুদুরু বুকে ব্যাঙ চলে যায় কালকের সেই গাছের ডালে। কই কেউ নেই। বেলা গড়ায়, মৌমাছির গুনগুন,  পাখিদের হুল্লোড় সব শোনা যায়, কিন্তু সেই হলুদ শাড়ি পরা প্রজাপতি কোথায়? দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে, বুরুৎ কিছুই খায়নি সারক্ষন।  পেটের মধ্যে গুড়্গুড় আওয়াজ হচ্ছে।  মনের মধ্যে একশো মন ভারী বস্তা যেন! এমন সময় কানের মধ্যে কে যেন সুড়সুড়ি দিল।

"কে রে?" 

তাকিয়ে দেখে কালকের সেই মেয়েটা। আজকে একটা সোনালী আর সবুজ বুটিদার শাড়ি পরেছে।  দেখেই তো বুরুৎ এর উলটানো জিভ সোজা হয়ে যায় প্রায়! 

-এতক্ষণ আসোনি যে?

- বা রে তুমি তো বলোনি আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। আমি তো এমনিই এলাম।

- না বললে জানতে নেই? 

- না নেই।তোমার নাম কি?

-বুরুৎ। তোমার?

- পুপাকি। তোমার নামটা ভারী মিষ্টি। তুমিও ভারী ভালো।

বুরুৎ তো অবাক। ওকে আবার ভালো বলছে! ওর নামটা ভালো বলছে! এ কেমন মেয়ে। আচ্ছা পাগলি তো। 

বুরুৎ হঠাৎ বলে, " একটা কথা বলব "?

-হুঁ।

-আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সেই সকাল থেকে...কালকে পরশু রোজ রোজ অপেক্ষা করবো...

- হিহিহি। তাহলে কাজ করবে কখন?

- তাহলে তুমি আমার সাথে চলো। অপেক্ষা না করিয়ে।

- চিনিনা জানিনা যাব কেন? কোথায় রাখবে আমায়?

- উমম...চিনে না হয় নেবে। আর আপাতত এই যে মাথায় বসো আরাম করে আমি তাহলে গল্প করতে করতে চলে যাওয়া যাবে। 

-কোথায় যাবে?

-চলোই না,  যদ্দুর যাওয়া যায় একসাথে।

.....তারপর দেখা যায় কালো থপথপে ব্যাঙ মুখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বালিয়ে মাথায় করে একটা প্রজাপতি নিয়ে পথ চলেছে।

2 comments:

  1. বাহ, চমৎকার প্রেমের গল্প। খুব ভালো হয়েছে, প্রদীপ্ত।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ কুন্তলাদি। 😊

      Delete