Thursday, January 19, 2017

উপনিষদ মহারাজ

"আরে দেখে চলতে পারেন না নাকি, অদ্ভুত লোকজন সব, না মেয়ে দেখলেই ধাক্কা মারতে ইচ্ছে করে"। 

ঝাঁ ঝাঁ করে বাক্যবান উড়ে এলো। তাকিয়ে দেখলাম, অল্পবয়সী না, তবে তরুণী,  সুন্দরী না  তবে মিষ্টি, তন্বী না বরং ঈষৎ পৃথুলা। আমার বয়স এখন ত্রিশ, কিছু না হোক খান দুই জোরালো আর খান পাঁচেক খুচরো প্রেম করেছি।  এ বয়েসে এসে খামোখা কাউকে ধাক্কা মেরেছি এ অপবাদ সহ্য শুনব কেন। মেয়েদের অত ইয়ে করার কিছু নেই আমার মতে আসবে যাবে,  না থাকলে কবিতা আউরাবে কিছু ন্যাকা বাঙালি এই তো। আমি আধুনিক সন্ন্যাসী, এসবে কিছু যায় আসে না।  অত অবাক হবার কিছু নেই। আধুনিক কবিতায় 'তুমি কাঁসার থালার আর আমি গাড়ির স্টিয়ারিং শুনে যখন চমকাননা সন্ন্যাসী আধুনিক শুনেও অমন ইয়ে করার কিছু নেই। আজ্ঞে না আসারাম বাপু টাইপ না। আমার নাম মহারাজ  উপনিষদ। অবশ্যই বাপ্ মা এর দেওয়া নাম না।  সন্ন্যাসী মানেই কোনো নেশা করবে না নির্মোহ হবে এমন তো না রে ভাই, স্বয়ং বিবেকানন্দ চা সিগেরেটের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন আমারও প্রচুর শখ ইত্যাদি আছে বৈকি।

 হ্যাঁ যা বলছিলাম আপনাদের রোমান্টিক নায়কদের মতো ভ্যাগাবন্ড না আমি। গরীব পকেটে পয়সাহীন চেয়ে চিনতে খাওয়া সমাজের প্রতিভূও না। আমার একটা ফার্ম হাউস আছে, তিরিশ বিঘে জমি নিয়ে। ক্ষতিকারক সার ছাড়া অবলুপ্তপ্রায় ধান ফলাতে চেষ্টা করি। কেবল পুরোনো বইয়ে যে আমের দেখা পাওয়া যায় সে আম গাছ খুঁজে আনতে চেষ্টা করি। খরচা অনেক হয় তবে আরাম যেটা হয় তা হল হারিয়ে যাওয়া বীজ ফের চালু করতে পারলে। এসব জিনিস বাজারে প্রচুর দামে কেনার লোক আছে।  কিন্তু সেইই সব না, আবার এ আমার আশ্রমও ঠিক না আশেপাশের গ্রামের লোকেদের কাজ করার জায়গা কিন্তু গ্রামের লোক মানেই বুক ভরা মধু ভাবার কারন নেই তাছাড়া দাদা মামা কাকারা মেলা ঝামেলা  আছে সে সব সাম্লাতে আমার ভাল্লাগেনা। আমার এক পার্টনার আছে সেই এসব দেখে, আমায় কি করে যেন সহ্য করে নিয়েছে ব্যবসাতে। আসলে সেই কোন ছোট্ট বেলার বন্ধুত্ব , সহজে ছেঁড়া মুশকিল। মাঝে মাঝে আমি পালাই,  পালাই মানে এই না এক বস্ত্রে বা প্রচুর টাকাপয়সা নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায়। যখন যেমন ইচ্ছে করে তখন তেমন। কখনো ইচ্ছে হলে এএক বস্ত্রে কখনও রুক্স্যাক কাঁধে।এখন যেমন আমি বেরিয়েছি অনেকদূরের একটা ধোঁয়া ধোঁয়া গ্রামে যাবো বলে। গ্রামের নাম জানিনা, কোনোদিন দেখিনি কিন্তু কেমন জানি চোখে ভাসছে। প্রথমে কোলকাতা, এখানে কয়েকদিন এলোমেলো ঘুরব, ইচ্ছেমতন খরচা করব খেয়ে, কি কোলকাতা থেকে নৌকো ভাড়া করে সপ্তাহব্যাপী ঘুরব। নেশা আমার দাস, ইচ্ছে হলে মদ সিগারেট খাই ইচ্ছে না হহলে মাস বছর না খেয়েও থাকি।আমার নৌকো আমার আধিপত্য,  গড়গড়া থাকবে,  অম্বুরি তামাক থাকবে, বেকড রসগোল্লা থাকবে।  মানে জমিদারের মতন। তারপর হাতে যখন পয়সা তলানিতে ঠেকবে তারপর ভাবছি ট্রেনে টিকিট ফাঁকি দিয়ে ওই ধোঁয়া গ্রামখানায় যাবো। এবারের প্ল্যান এটাই তবে আমার মাথায় পোকা আছে তো তাই অন্যরকম হতেই পারে, প্ল্যান করে কিছু করব না এবারের ইচ্ছে এরম ঘোষনা হলো মাথার মধ্যে। যাই হোক এসবের আগে আমায় এরম অপবাদ দিচ্ছে কে তাকে একটু চমকানো যাক। আজ্ঞে হ্যাঁ আমি ইচ্ছে না হলে মেয়ে বলেই শিভালরি দেখাতে এক্সট্রা অ্যাডভান্টেজ দিইনা।  ইচ্ছে হলে দিই। এখন আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ আমার একটা পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে মোষের পিঠে চড়তে ইচ্ছে করছে তা না এই ভরা ধর্মতলায় আমি করে কাকে ধাক্কিয়েছি!!


"কেন আপনাকে খামোখা ধাক্কা দেব কেন? আপনার কাঁধ বেশ শক্তপোক্ত,  আরেকটু হলে আমার মোবাইল পড়ে যেত আমার কি দায় পড়েছে আমার মোবাইল কত হার্ড সে টেস্ট করার না,  মোবাইলখানা মাটিতে পড়ে গেলে কি থুতুর মধ্যে, আপনার ধারনা সেটা খুব উপভোগ্য আমার জন্য? "
মেয়েটা একটা মন্তব্য করেই এগিয়ে গেছিলো, কেউ তাকে ডেকে এরকম কথা বলবে আশা করেনি বুঝি।  আর এখনকার মেয়েদের যেমন ধারা, খান দুই ইংরেজি গুঁজে দিয়ে মুখে বিরক্তি, বিস্ময় রাগ এর ঝাল্মুড়ি বানিয়ে "হোয়াটস রঙ উইথ য়ু, এক তো অসভ্যের মতো না দেখে চলেন আবার ঝগড়া করেন"?
 খুব গম্ভীর হয়ে বললাম " দেখুন মহাশয়া,  আপনি যবন বাক্যে কি বললেন আমি বুঝতে পারিনি, বাকি কথার এক এক করে উত্তর দিচ্ছি, আমি দেখেই চলছিলাম আপনিই মোবাইল দেখে চলছিলেন।  দুই আমি ঝগড়া করছি এমন যদি বলেন আপনি ঝগড়াঝাঁটি করছেন"।
 মেয়েটার মুখে খুব দ্রুত একটা ভয়ের ছায়া খেলে গেলো, পাগলদের দেখলে  ভরা রাস্তাতেও যেরম ভয় নিয়ে রাস্তা ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। এবার কি হবে আমি জানি,  খুব দ্রুত হাঁটবে মেয়েটা আর বাড়ি গিয়ে বলবে কি অসভ্য একটা।লোকের পাল্লায় পরেছিলো। সে সুযোগ না দিয়েই আমি বেশ সন্ন্যাসী সুলভ একখান হাসি যাতে হালকা তাচ্ছিল্য হালকা কয়টুক ইত্যাদি মেশানো থাকে না সেরকম ছুঁড়ে এবাউট টার্ন করে নিলাম।আরো ঘাবড়াক খামোখা লোককে কটু কথা বলবে না আজ।

এগিয়ে গেলাম প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে।  নৌকা গুলো সব ডিঙি নৌকা টাইপ। আমাদের সব ভালো জিনিস শখের জিনিস আয়েসের জিনিস শেষ করে দেবার এ প্রবৃত্তি কেন কে জানে। একটা বাজরা পাওয়া যায়না একটা ঘোড়া পাওয়া যায়না ধুস। একাবোকা দেখেই বোধায় কেউ গা করছেনা।  হুঁ হুঁ যখন জানবে আমি পুরো সাতদিনের জন্য নৌকা ভাড়া করব তাহলে আর এরকম নির্লিপ্ত ভাব স্রেফ কর্পূর হয়ে যাবে। একজন বুড়ো মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম কাকা ভাড়া যাবে নাকি। আমায় অবাক করে হাত নেড়ে বলল না ভাড়া নাই। বোঝো!! মাথা এরপরেও গরম হয়নি সে স্রেফ ওই যোগবলের কারনে। অন্য জায়গায় যেতেই পারতাম, কিন্তু আমি তো সন্ন্যাসী মানুষ আমার ধৈর্য থাকা উচিত। বেশ মোলায়েম করে জিজ্ঞাসা করলাম কেন কাকা,  আজ বুঝি কাকিকে নৌকা চড়ানোর আছে, তা আমায় দাও না আমি না হয় হাল টেনে দেবো। যথারীতি রেগে টগবগ করতে লাগলো, এই ভাই তুই যা তো এখান থেকে,  ফোট। খুব মানে লাগলো জানেন। খুব মানে খুব,  বেশ শাপ টাপ দেওয়া যেত, নৌকা ডুবে যাবে আর আমায় গিয়ে উদ্ধার করতে হবে তাহলেই ঠিক হত। কিন্তু সন্ন্যাসী হলেও আমার সে তেজ নাই। তাই বললাম,  কাকা,  ফোট মানে? আমায় কি তুমি ফুলের কুঁড়ি বা বোম ভাবছ? আমি তোমার নৌকায় ফোটার ইচ্ছা প্রকাশ করিনি সত্যি, স্রেফ ঘুরব ভাবছিলাম। সে আর সময় ব্যয় না করে এগিয়ে গেলো। আমিও এদিক সেদিক দেখে একটা অল্পবয়সী ছেলেকে পাকড়ালাম। সন্দ সন্দ মুখ করে রাজি হলো।

 আমার একটা সমস্যা আছে পরিচিত লোকেদের সামনে আমার সংকোচ হয়, আমায় ভদ্রতা করতে হয় হেঁ হেঁ হাসি দিতে হয়। আজকাল ফেসবুক এসে অনে সুরাহা হয়েছে,  যেমন কেউ বলল,  "আমার ঠাকুমা পঁচানব্বই বছর বয়েসে চলে গেলেন আমাদের শিশুপ্রান কে অনাথ করে, যদিও উনি শেষে দু বছর বিছানা ছেড়ে ওঠেননি তাও ওনার স্নেহাশীষ  থেকে বঞ্চিত হইনি"..ইত্যাদি। সাথে শেষশয্যায় শায়িত ঠাকুমার সাথে সেল্ফি। আমার ঠিক জানা কত বছর অব্দি ঠাকুমাকে উনি এক্সপেক্ট করেছিলেন। মায়াদয়া থাকলে সন্ন্যাসী হওয়া যায়না। তাই আমার মায়াদয়া এমনিতেই কম,  রাস্তায় কুকুর এর পাল কে আদর দিলে আমার ইচ্ছেহয় ওদের বাড়িতে একপাল ছেড়ে দিয়ে আসতে।  পঁচানব্বই বছর বয়েসের একজন মারা যাওয়ায় যখন কেউ শিশু প্রাণে ককিয়ে ওঠে তাকে দেখলে আমার  অটোমেটিকালি শ্রদ্ধা হয়, আহা পারলে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতাম মশাই। লোকসমাজে ভদ্রতা করে বলা  যায়না, কিন্তু ফেসবুক সমাজে যায়। সে মশাই এক অদ্ভুত জগৎ যে যা পারছে করছে। এক পাল লোক একটা খেলনা পেয়েছে, যেখানে প্রেম, চুমু, সেক্স পলিটিক্স, খিস্তি আঁতলামি সব চলে।  ভাটবকা তো বটেই।  আমি খিস্তি দিইনা সুড়সুড়ি দিই, তাই তো তাই তো মশাই, কি করে এ কচি বয়েসে (বয়েস কিছু না হোক চল্লিশ হবে) এ শোক সইবেন এরকম আরকি।

মাঝি ছেলেটা বেশ চটপটে, অম্বুরি তামাক গড়্গড়া আমিই এনেছিলাম, দেখে বলল স্টিক লাগবে কিনা। গাঁজার গন্ধ আমার পোষায়না আর গাঁজ টেনেও আমি সজ্ঞানে ছিলাম তাই আমার গাঁজার দরকার নেই বললাম।  তাকে বলাই ছিলো আগামি সাতদিন আমি এখানেই থাকবো। অবাক হয়েছিলো কিন্তু রাজিও হয়ে গেছিলো অ্যাডভান্স দিতে।
ধুঁকতে থাকা ট্রাফিক, ঘাম পেরিয়ে ছেলেটা পৌঁছয় অবশেষে। ভিড় দেখে গাছের পাতাগুলোও থমকে গেছে।  হাওয়াহীন সে শহরও শীতল হয়ে যায়। গঙ্গার বুকে সন্ধ্যে নেমে গেছে কখন। নৌকোয় টিমটিম করে হ্যারিকেন জ্বলে। মাঝিদের খাবারের গন্ধ নাকে ঝাপটা মারে। ছেলেটা বোধহয় অন্ধকারে নৌকোয়য় ভাসতে চায়,  মেয়েটা বোধহয় ভয় পায়। বাতাসে গুমোট ভাব বেড়ে যায়। দূরে ভোঁ শোনা যায়। অলস ট্যাক্সি শেষ সওয়ারির জন্য বসে।বাদামওলার আর বিক্রির চেষ্টা নেই। ট্রাফিক পুলিশও খানিক নিশ্চিন্ত। চা এর দোকানে ভিড় মরে গেছে।  মেয়েটার বাস ছেড়ে দেয়। ছেলেটা দৌড়ে বাসের পাদানিতে। গুমোট কেটে হঠাৎ ছাতিমের গন্ধ ছড়িয়ে যায়। ছেলেটার ফাঁকা শহর,  ছাতিম ফুলের গন্ধ আর হঠাৎ নামা বৃষ্টি সংগে নিয়ে হাঁটা দেয়।
আমি মহারাজ উপনিষদ যার প্রেম সয় না সেও খানিক থমকে দাঁড়াই তারপর আমার মাঝিকে বলি নৌকা ছাড়তে। 
গঙ্গায় আজকাল আর স্রোত কই। হেলতে দুলতে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। প্রায় খাল হয়ে যাওয়া নদীর দুপাড়ে এলোমেলো দৃশ্য। একমনে নাক খুঁটছে একজন, একজন ঘাটের ধারে উদাস। আমার হঠাৎ ভারী ক্লান্ত বোধ হতে লাগলো। সাতদিন বোধহয় কাটাতে পারব না।
(কেমন লাগছে প্লিজ জানাবেন কেউ যদি পড়েন, এটা সিরিজ করন কিনা ভাবছি)

4 comments:

  1. দারুণ লাগছে, সিরিজ হোক।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংকইউ কুন্তলাদি।সাহস পাচ্ছি :)

      Delete
  2. Replies
    1. পরের পার্ট আসবে,আমি ঠিক ভরসা পাচ্ছিলাম না কিনা, অনেক ধন্যবাদ 😊

      Delete