যে কোনো সমস্যা, যে কোনো ভয় যতক্ষণ না নিজের সাথে রিলেট করা যায় সেই ভয়, সেই সমস্যা আসলে সমস্যা হয়না, সেই ভয় আসলে ভয় না, আনন্দদায়ক উত্তেজনা। যে কারণে মারামারি কাটাকাটি সিরিজ, ভয়ের সিরিজ এত বিকোয়। ভয় দেখে আনন্দ পেতে, সে আনন্দ অবশ্য সে নিজেও স্বীকার করেনা, কিন্তু ভয়টাই সে উপভোগ করে। পেহেলগাঁও এর ইসলাম ধর্মালম্বী সন্ত্রাসবাদীদের হিন্দু ধর্মের লোক কিনা দেখে তার পর মেরেছে। যারা মারা গেছে তাদের উপর আক্রোশের কারণ কিছু হবারই না, এমনিই ইচ্ছে হল মেরে দিলাম। আবার অন্য দিক থেকে ভাবতে গেলে খুব কারণ আছে, কাশ্মীরে গত বছর দুই তিন ধরে ট্যুরিস্ট আনাগোনা বিপুল ভাবে বেড়েছে। একটা ডেটা দেখছিলাম, সম্ভবতঃ লাস্ট দুবছরের পর্যটক সর্বাধিক। মানুষ তো বিভিন্ন রকম হয়, কেউ মরা দেখলে মনে করে বাহ বাহ আজ একটা খাবারের পয়সা জুটে গেল, কেউ মরা দেখলে ভাবে এর সাথে গেলে পয়সা পাওয়া যাবে, আবার কেউ মরা দেখলে ভাবে আহা কাদের বাড়ি খালি হয়ে গেল। বহুদিন আগে, এক দাড়িওয়ালা বুড়ো মানুষ বলেছিলেন, 'পশ্চাতে রেখেছ যাকে সে তোমারে টানিছে পশ্চাতে'। কাশ্মীরের লোক ভালো না থাকলে, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভারতবর্ষকে নিজের বলে ভাববে কেন? কেউ ভাবে? যারা কাজ না পেয়ে বিদেশে থিতু হচ্ছে, ক্রমে সেই দেশের সিটিজেনশিপ নিচ্ছে, কেন? বিজেপি ভালো বিজেপি খারাপ, কংগ্রেস ভালো কংগ্রেস খারাপ এসব না ভেবে ডেটা দিয়ে যদি দেখি কাশ্মীরে এরকম স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ আগে দেখিনি। অর্থাৎ কাশ্মীর ভালো থাকছিল। তাই জন্যেই একটা বড় অংশ, তারা চায় শান্তি, স্বস্তি, স্থিতিশীলতা। তাহলে সে জায়গার স্থিতিশীলতা নাড়াতে চাইলে তাদের রোজগারের সোর্সে আঘাত করো, সোজা ট্যুরিস্টকে মারো। এবং অবশ্যই বাইনারি তৈরী করে দাও। ভারতের বহুত্ববাদে আঘাত করো। যে মুসলমান হিন্দু মারে, সে হিন্দু, ইহুদি, খ্রীশ্চান ফুরোলে শিয়া/সুন্নি মারে, সেটা না পেলে পাঁচবারের জায়গায় চারবার নামাজ পড়ছে যে তাকে মারে, সেটা ফুরোলে পায়ের গোড়ালি দেখা গেলে মারে। কিন্তু সেসব তো পরে, আগে ঘৃনার চাষ বুনে দাও। লড়াই করে নিজেরা মরে যাক। এ কে ফর্টিসেভেনের খরচা কমুক। এবং তাই হয়েছে।
পেহেলগাঁও ম্যাসাকারের পরে আমি ফেসবুক, রেডিট, আশপাশের প্রতিবেশী, অফিস এরকম জায়গায় শুনছিলাম, দেখছিলাম। পার্স্পেক্টিভ থেকে বয়ান কেমন বদলে যায় তাও দেখা যাচ্ছিল। রেডিটে একটা পাকিস্তানের থ্রেড দেখছিলাম, দুরকম আছে, একদল একদম হুবহু আমাদের ভারতবাসীর মতোই, জাস্ট মিরর ইমেজ। "এসব ভারতের কাজ, ইচ্ছে করে করেছে যাতে পাকিস্তানকে আরো ছোট দেখানো যায়", " এসব ফলস রেড ফ্ল্যাগ", " জল বন্ধ করবে, ভারতকে ম্যাপ থেকে মুছে দেওয়া যাক", "টিট ফর ট্যাট আমরাও দেখিয়েছি", " কাশ্মীরিদের উপর অত্যাচারের ফল ইত্যাদি", আরেকদল বলছে, "ভাই যুদ্ধ! সবাই কি পাগল হয়ে গেল!", " এসব কিছুই হবে না, দুদেশেই জানে অলআউট যুদ্ধ মানে কী পরিস্থিতি হতে পারে"। বাংলাদেশ এর লোকজন, কিছু লোকের বক্তব্য মুসলমানদের হেয় করতেই এসব করা হচ্ছে, নিজেদের লোককে বাঁচাতে পারেনা বাংলাদেশ নিয়ে বক্তব্য দেয়। কিছু লোকের বক্তব্য যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে।কমেন্ট গুলো চেনা চেনা লাগছে না? একটু দেশ আর ধর্ম রিপ্লেস মেরে দেখলে?
ভারত বলেছে সিন্ধু চুক্তি বাতিল। রাতারাতি ওরকম নদীর জল বন্ধ করে দেওয়ার মতো ইনফ্রা ভারতের নেই। ওদিকে পাকিস্তান বলেছে শিমলা চুক্তি বাতিল, পাকিস্তানের আকাশ ব্যবহার করতে দেবেনা। এদিকে পাকিস্তানের কোন এক মন্ত্রী বলেও ফেলেছে, ওরা আমেরিকা ব্রিটিশদের মদতে টেররিজম ফান্ডিং এন্ড সাপোর্ট করে এসেছে। ফলে বুঝতেই পারছেন, আগামী কিছুদিন এরকম চলবে, তারপর যতদূর মনে হয় দুদেশই সমঝোতা করে নেবে। বা নিতে বাধ্য হবে। কাশ্মীর সমস্যা রয়েই যাবে। আর যে লোকগুলো এমনি এমনি, স্রেফ বেড়াতে গিয়েছিল বলে মরে গেল, যে লোকটা তার ট্যুরিস্টকে মারতে দেবেনা বলে মরে গেল, যে লোকটা পাকিস্তানের সেনার সাথে লড়াই করতে গিয়ে মরে গেল তারা এমনিইই মরে গেল আর কি। আরও একটা কাজ অবশ্য করেছে। বেশ কিছু পোস্টে দেখছি লেখা, পাশের লোকটাকে দেখুন, মুসলমান হলে ডিল করবেন না। মানে তার থেকে কেনাবেচা করবেন না। কিছু ভিডিও বলছে, মুসলমান? তোকে মেরেই ফেলব। ঠিক এই কাজটাই কি করতে চায়নি? এদের যুক্তি নেই, ভালোবাসা নেই। এরা একদিক থেকে বলছে ভারতীয় সেনা আমাদের গর্বের, হিন্দু মুসলমান আনবেন না সেখানে। কিন্তু সে মুসলমান সেনার বাপ, মা, কাকা, ভাই, বোনও তো মুসলমান। তাহলে সেনাতে জয়েন করলে সে মুসলমানের আত্মীয়দের সাথে ডিল করা যাবে?
একটা গল্প বলি। ইতিহাসের গল্প। এ গল্প ব্রিটিশদের, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সে সময় লন্ডন শহরে বোমা পড়ছে যখন তখন। প্রায়ই কোনো বাড়ি নেই হয়ে যাচ্ছে, সাইরেন রোজকার সঙ্গী। এরকমই একটা সময় সাইরেন বেজেছে, সবাই শেল্টার নিয়েছে। আশেপাশের অনেক মানুষ। তা সেখানেই তারা বসে ঠাট্টা তামাশা করছে, গানবাজনা করছে। একজন সেদিন নতুন গেছে, বলছে একি! এরকম সিরিয়াস অবস্থায় এরকম করতে ইচ্ছে করছে! তাতে, একজন বলছে তাকে, 'ওই যে মানুষটা দেখছ গান গাইছে ওর বাড়ি উড়ে গেছে কাল। কিন্তু জানোতো জার্মানি ঠিক এটাই চায়। আমাদের মরালিটি ভেঙে দিতে, আমাদের আনন্দ, স্ফূর্তি, গান শেষ করে দিতে। আর আমরা সেটা কখনই হতে দেবনা।'
যুদ্ধ হবে কিনা জানা নেই, স্রেফ মগজধোলাই করা কিছু লোক যদি এত সহজে ঘেন্নার পার্থেনিয়াম বুনে দেয়, যুদ্ধ হলে কী করবেন?
No comments:
Post a Comment