Sunday, April 20, 2025

গান ভালোবেসে গান

কদিন আগের কথা। নববর্ষ উপলক্ষ্যে মেলা হচ্ছিলো। মেলা মানে ঠিক টিপিক্যাল মেলা না, বিভিন্ন কোম্পানি স্পনসর করেছিল, খাবারের দোকান, জামাকাপড়ের স্টল, দু চারটে হাতেরকাজের দোকান,  গাড়ি,  বাইক ইত্যাদি। আর হচ্ছিলো গান। আমরা যখন স্কুলের শেষের দিকে, কলেজ বা সদ্য চাকরিতে ঢুকেছি তখন বাংলা ব্যান্ড নিয়ে বিস্তর মাতামাতি হত। বন্ধুবান্ধব বা ভাইবোনদের আড্ডায় কোন ব্যান্ডের কী গান, কে কীভাবে গায় সেসব নিয়ে তুমুল আলোচনা হত।  স্কুলবয়সে ভালো ছেলের দল যখন এক্সট্রা কষতো, আমি হয়তো একলা ঘর শুনতাম এফেম এর চ্যানেলে। সলিটায়ার এর সুর বুঝতাম না, ভালোও লাগতো না, ভেক্টর মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে...রাতের বেলা এফেমে হাসনুহানা শুনছি। বাংলামিডিয়ম স্কুল, সেখানে বন্ধুদের কাছে 'এক ইংলিশ মিডিয়ম স্কুল..',  রিকশাওয়ালা গেয়ে খুব এলেমদার হচ্ছি। কলেজে সিনিয়দের আড়ালে গাইছি "দাদাদিদি হাত ধরে সিঁড়িতেই বসে পড়ে"। বারান্দায় রোদ্দুর এর প্রায় থিম সং হয়ে যাওয়া তো সবাই জানে। কিন্তু ভূমির কম পরিচিত কিছু গানও খুব পছন্দের ছিল আমার, যেমন জানলা খোলা সন্ধ্যেবেলা এলোমেলো শীত। হলুদ পাখি, বঁধুরে, আমি শুধু চেয়েছি তোমায় এরা সব আমাদের মুখে মুখে ঘুরতো। ভালোবাসা মানে ধোঁয়া ছাড়ার প্রতিশ্রুতি শুনে মনে করতাম আমাদেরই গান। না সবাই ব্যান্ড ভক্ত ছিল না। সেসব ব্যান্ড ভার্সেস একক নিয়ে খুব তর্কও হত। কিন্তু যেটা বলার আমাদের কৈশোর এবং যৌবনের শুরুর সময়ে ব্যান্ড একটা বিশাল জায়গা নিয়ে আছে। প্রেমে পড়া, ধাক্কা খাওয়া, ফের প্রেমে পড়ার পুরো লুপ জুড়েই ফসিলস, চন্দ্রবিন্দু, ক্যাকটাস, পরশপাথর, ভূমি। কখনো "না হয় পকেটে খুচরো পাথর রাখতাম", কখনো " তোর হয়তো জানা নেই...তোকে ধ্বংস করতে আসছে নেমেসিস", কখনো "যেন উড়বোই..", কখনো,  " মনেতে খুশীর বান চোখেতে জল ঝরে"। 
তারপর যা হয়, ফসিলস ক্যাকটাস আর শোনাই হয়না।চন্দ্রবিন্দু প্লেলিস্ট জুড়ে থাকে। আরো বয়স বাড়লে হয়তো আরো কিছু পরিবর্তন হবে। ছোটবেলার উন্মাদনার সময়েও আমি একটা ব্যান্ডেরও পারফরম্যান্স দেখিনি। কলেজে একবার ফসিলস আসবার কথা ছিল, তারপর মারামারি ইত্যাদিতে পারফর্ম করেনি। অনেকের বিভিন্ন কলেজে বন্ধুবান্ধব থাকে, অবশ্য আমার সেসব কিচ্ছু ছিলনা, তাই কলেজে কলেজে ঘুরে ফেস্ট ইত্যাদি এসব হয়নি। তারপর পৃথিবী আরো একটু বুড়ো হল, ব্যান্ডগুলো ভাঙলো, ব্যান্ড নিয়ে উন্মাদনা কমল। মাঝে ভূমির একটা শো দেখেছিলাম, কিন্তু সুরজিৎ বেরিয়ে গেছে তখন, সেরকম আনন্দ হল কই আর! আরো কিছু বছর পার হতে যখন একসাথে খুব চন্দ্রবিন্দু শুনি কতবার ঠিক করেছি চন্দ্রবিন্দু শুনতে যাব, তা কিছুতেই আর চোরে কামারে দেখা হয় না। এই মেলায় এক বন্ধুর দৌলতে পাস মিলেছিল। এবার একটা ব্যপার আছে, যারা চন্দ্রবিন্দু শোনে কেবল, তারা অল্প নাঁকুচু মতো হয়, "এহ চন্দ্রবিন্দু উইটি, ফসিলস মানে চিৎকার খালি" এরকম ভাব। এদিকে একা একা ফসিলস শুনতে যেতে কেমন লাগে। কিন্তু, সাধু সন্ন্যাসীদের ইচ্ছে অপূর্ণ রাখে এমন সাধ্যি কই! গিয়ে দেখি আমাদের মতো বয়সী লোকজনও আছে এখনো বেশ। চারপাশে কচিকাঁচাদেরই ভীড় যদিও। মাথা ঝাঁকিয়ে গান গাইছে তারা ফসিলসের সাথে। একের পর এক, এতটা পথ পেরিয়ে, অ্যাসিড, এই একলা ঘর...শুনতে শুনতে আমি টুকটুক করে টাইমট্রাভেল করছিলাম। একাবোকা ছেলেটা নিজেকে যে খুব বড় হয়ে গেছি মনে করে তাকে নিয়ে এসে শোনাচ্ছিলাম, নিজে নির্লিপ্ত হয়ে দেখছিলাম। নাহ তার তুচ্ছ দু:খ দেখে হাসি পায়না মোটেও, আবার দু:খবোধও হয়না সেসব সময়ের জন্যে। গান, পারফর্ম্যান্স সবই তুমুল উপভোগ করছিলাম, আবার একই সাথে যেন আমি না অন্য কেউ উপভোগ করছে। ভালো বোঝাতে পারবোনা। খানিক স্কুবা করার মতো ব্যপার। জলের নীচেই আছি, কিন্তু জলের লোক নই। একটা জায়ান্ট স্ক্রীনে রূপমকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখছিলাম, আমার তো মনে হল না ভদ্রলোক গাঁজা, মদ খেয়ে আছেন, মানে যেমন রটনা হয় আর কি৷ তাছাড়া ধূমপায়ীদের অত দম থাকে? কী জানি, আমি টাকলা সাধু কিনা, গাঁজা খাইনা৷ 
পরের দিন ছিল চন্দ্রবিন্দুর, তবে আরেকবার যেতে হবে। অল্প সময় ছিল। পাশে একটা বাচ্ছা ছেলে খুব উত্তেজিত,  ওদিকে একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা গান শুনছে খুব ভালোবেসে। চন্দ্রবিন্দুর পর ছিল ক্যাকটাস। সিধুকে দেখে বুঝছি কত বয়স হয়েছে আমার! বাপরে বাপ কী ভয়ানক মোটা হয়েছে! গান গাইতে গাইতে জামা টেনে নামাতে হচ্ছে, ভুঁড়ি ঢাকতে। পটা ক্যাকটাসে ফিরে এসেছে আবার। মাঝে সিধু ভিআইপি জোন আর এমনি জোনের ব্যারিয়ার তুলে দিতে বলায় একটা ছেলে দৌড়ে দৌড়ে দৌড়ে এলো, চোখে চোখ পড়তেই একমুখ হাসি। হাসিটা যে কী ভালো কী বলব! মন ভালো হয়ে যায়। কত বয়স? কলেজে ঢুকেছে বা সদ্য কলেজ পাশ করেছে। এমন অনাবিল স্বচ্ছ হাসি স্রেফ এইটুকু পাওয়াতেই, যাই বলো কত্তা মন তাজা না থাকলে এ জিনিস হয়না। 
মেলার মাঠ থেকে রাস্তা পার হওয়া সহজ না। আমাদের রাজ্যে পুলিশ গার্ড রেল গার্ড রেল খেলতে ভালোবাসে।বাড়িতে হয়তো ভিডিও কল করেছে, ছেলে-মেয়ে হয়তো বায়না করেছে বাবা আজ অন্য জায়গায় গার্ড রেল বসাও প্লিজ, কাল অব্দি তো এখানেই দেখলাম। বা বৌ এর মান ভাঙায় হয়তো, "এই একটা মজা দেখবে? ব্রিজের ওঠার ঠিক মুখে একটা সরু জায়গা আছেনা? ওইখানটা দুটো গার্ড রেল বসাবো, কেমন গাড়িগুলোকে হুড়ুৎ করে ব্রেক কষে ছোটবেলার ভিডিও গেম খেলতে হয় দেখবে লাইভ"। তো এসব অসুবিধে গুলো সেদিন আর তেমন অত ছুঁতে পারছিলোনা। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে ব্রেক, অ্যাকসিলেটর, ডান বাঁ, লুকিং গ্লাস...কিন্তু আমিটা তখনো সেই অস্থির, একা, মেলাংকলিক ছেলেটার পাশে পাশে হাঁটছে। যে মন খারাপ করতো, একা একা মাঠ জঙ্গলে ঘুরতো বা নদীর ধারে গিয়ে বসত সেই গান গুলো গাইতে গাইতে,  কিংবা আনন্দে বাথরুমে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গাইতো। সে জানেনা সেই গান সে সামনে থেকে শুনতে পাবে একদিন। জীবনের ওয়ার্মহোলটা বেশ মজার, কার সঙ্গে কখন দেখা হবে কেউ জানেনা, কিন্তু হওয়াটা অমোঘ।

No comments:

Post a Comment