Friday, June 28, 2019

হারিয়ে গেল যারা

পিন্টুকাকুর দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।
এর দোকান ও নিয়ে সে বিক্রী করে দেবে এরকম কিসব গোলমাল হয়েছিল নাকি। সঠিক জানিনা। খালি একদিন থেকে দেখি দোকান বন্ধ। পিন্টু কাকু একটু তোতলা, স্যান্ডো গেঞ্জি পরে দোকানে বসে থাকতো। খুবই খারাপ খারাপ সব মিষ্টি থাকত দোকানে। তাও আমি যেতাম,  নিকুতি, বোঁদে কিনতাম। সকালে অফিস যাবার সময় হোক কি হরিনঘাটার মাংস কেনার সময় হোক, হেসে হেসে জিজ্ঞেস করতো আমি ভালো আছি কিনা।
ডিরেকশন দিতে হলেও পিন্টুকাকুর দোকানের নাম বলেই দেওয়া।
মানুষ মনে হয় সব চেয়ে নিষ্ঠুর জাত। পিন্টু কাকু কি খাচ্ছে, কেমন আছে কি জানি! এসব বেফালতু ইমোশনের দাম হয় না। রোজ খাচ্ছি অফিস যাচ্ছি হুট করে একদিন থেকে নেই হয়ে গেলেও কারো কিচ্ছু যায় আসে না। পিন্টু কাকু মরে যায়নি কিন্তু, তাও আমি বাজারে দেখিনা, জল ভরতে দেখিনা রাস্তার কলে, টাইমকলের জলে চান করতেও দেখিনা। দুম করে কারোর খোঁজে বাড়ি চলে যাব সেও পারিনা, কিন্তু রাস্তায় নামলেই চঙমঙ করি, পৈতে জড়ানো গোলগাল লোকটাকে। কিভাবে চলছে পিন্টুকাকুর?

বাপীদার দোকানটাও হাত বদল হয়ে গেছে। অন্য একজন লোক আর তার বউ চালায়। দিব্যি ভালোমানুষ দুজনেই, ভারী যত্ন করে চা দেয়, প্লাস্টিকের টুলে বসতে দেয়, সে তুলনায় বাপীদা ছিল নির্লিপ্ত ধরনের মানুষ। হাসতো না, কথা বলত না। বিশু না থাকলেই বাপীদার দোকানে যাই। বিশু আবার মাসের টাকা তুলে ফেল্লেই ডুব দেয় টুক করে৷ তাই বাপীদার দোকানে যেতেই হয়। তাছাড়া ডাবল ডিমের অমলেট বিশু করে না। বিশু হল যোগী টাইপ, ভালো পাতার লিকার চা, দুধ চা,  কফি ব্যাস। এই করে যা হবে হবে, দুদিন ছুটি পেলে বেড়াতে যাওয়া যাবে। নতুন লোকটার নাম জানিনা এখনো, জিজ্ঞেস করা হয়নি। ভারী আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করছিল, "দাদা লিকার চা ভালো হয়নি? " তবু আমার বাপীদার কথা মনে পড়ে। কোথায় গেল?  শরীর খারাপ হল? নতুন দোকান?

জিমে বিজয় বলে একটা ছেলে আসতো, ট্রেনার। আজকাল আর আসেনা। বোকাটে মত দেখতে, সেইই উত্তরপাড়া থেকে রোজ আসতো। একটা গোলাপী জামা, ঢলঢলে আদ্যিকালের প্লিট দেওয়া প্যান্ট, সস্তার জুতো। এসে জুতো খুলে বোকাটে ভীতু হেসে বলত সেই সকাল  সাতটায় বেরোই আর রাত এগারোটায় ঢুকি, জুতো খোলার সুযোগ হয় না।  এখানে একটু খুলছি। "দাদা ভালো প্যাক্টিশ হচ্ছে? হবে হবে, নিয়ম করে করো"। চেহারা বানিয়ে বগল উঁচু করে উল্কি এঁকে ঘোরা আমার জন্যে না, তবে বসে থেকে থেকে ঘাড় পিঠ জবাব দিচ্ছিলো তাই যাওয়া।  ছেলেটা আমার ফাঁকিবাজি " প্র‍্যাক্টিশে"ও উৎসাহ দিত। জামা প্যান্ট বদলাবার জায়গায় তাড়াহুড়ো করে ঠান্ডা পরোটা আর ঘুগনি খেত, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাদা ফিনফিনে প্লাস্টিক থেকে। কি জানি এখন কোথায় জুতো খুলে আরাম দেয় পা গুলোকে!

সেদিন পোলার বেয়ারের ভিডিওটা দেখছিলাম, না খেতে পাওয়া রোগাটে শ্বেত ভল্লুকটা না। ছানা ভাই বোন মিলে সিল মাছ শিকার শেখার ভিডিওটা। ভাইটা পড়ায় ফাঁকি দিয়ে স্নো বল বানাচ্ছে, আর বোনটা যথারীতি ভালো মেয়ে, মায়ের ঠ্যাঙ আঁকড়ে সিল মাছের অপেক্ষা করছে। তারপর দুম করে ভাই শ্বেত ভল্লুককে চমকে দিয়ে সিল বাবাজি টুকি মেরেছে। ভাই তো কুপোকাত, তা দিন দুপুরে অমন ইয়ার্কির নামে ঠাট্টা ভাল্লাগেনা মশাই। তারপর তো শুনলাম এরাও হারিয়ে গেছে। হয়তো একশো মাইল দূরে গিয়ে টের পেয়েছে তার পায়ের তলার বরফ সরে গেছে।

দুর্বল সবাই হারিয়ে যাবে এইই নিয়ম....কিন্তু সবল মানেই জিতে যাবে এমনও না। সবলেরও দুর্বলতা আছে,  সেই ফাঁক দিয়ে কালনাগিনী জায়গা পেয়ে যায় ঠিক....চিন্তা করিনা আমি,  যা রবার সেটাই রবে। কত বলশালীই তো ইঁট পাথর হয়ে পড়ে রইলো স্রেফ.... খালি ওই পায়ের নীচের বরফ চলে যাওয়া বাচ্ছা সমেত মা, আর পিন্টু কাকু হয়ত না খেয়ে আছে এই ভাবনা বড় উত্যক্ত করে। জল শেষ হয়ে যাচ্ছে,  হোটেল বন্ধ করে দিচ্ছে ভালোবাসার অপরাধে এসবের মত বড় কিছু না হয়তো পিন্টুকাকু....তাও.....

No comments:

Post a Comment