Friday, February 16, 2018

একদিন দলবেঁধে কজনে মিলে

ঠান্ডা পাথরটায় চিৎ হয়ে শুয়েছিলাম। পাহাড়ের নীচের স্পিকারের আওয়াজ এখানে পৌঁছয়না। পাখির ডাক, হাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। শাল একটু গম্ভীর গাছ তাই বেশী কথা বলে না এ জঙ্গল। শুশুনিয়া পাহাড়ের চড়াই খুব বেশী হয়তো না, ফিট লোকেদের কাছে, কিন্তু অনভ্যস্ত শরীর ঘামে ভেজা, পাথরের ঠান্ডাতে, গাছের হাওয়ায় ভালো লাগা ছড়াচ্ছে শরীর জুড়ে।



শুশুনিয়া এতো কাছে তবু যাওয়া হয়নি এতোদিনেও। সুতরাং চল যাওয়া যাক। দল তৈরী হলো এরকম, আমি আমার এক বন্ধু, আমার বন্ধুর এক বন্ধু, বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু। বসুধৈব কুটুম্বকম। কে কার পূর্বপরিচিত তার দিয়ে কাজ কি, সাত পা এক সাথে হাঁটলেই তো বন্ধু হয়ে যায় সেখানে একসাথে এতোটা রাস্তা যাবো। অবশ্য সত্যি বলতে আমি এতো কিছু ভাবিইনি, এই বন্ধুর বন্ধু দলটায় এক মাত্র একজনই মেয়ে যাচ্ছে, তার একটু ইয়ে ভাব তো হবেই স্বাভাবিক। আর আমাদের দেশে দুজন ছেলে মেয়ে, প্রেমিক প্রেমিকা ছাড়া অন্য কোনো সম্পর্ক হতে পারে এমন ভাবতেই হোঁচট খায় যেখানে সেখানে তিন তিন খানা ছেলে ও একখানা মেয়ে, তায় আবার সে কারোর প্রেমিকা না স্রেফ বন্ধু। যাক সে সব বাধা অতিক্রম করে আমরা চার জন প্ল্যান করা শুরু করলাম।



বেড়ানো দুরকম হয়, হুট করে আর প্ল্যান করে। আমি দুরকমই ভালোবাসি যদি না আমায় কিছু দায়িত্ব নিয়ে কাজ কম্মো করতে হয়। মানে হোটেল বুক, হ্যানা ত্যানা। তা সৌভাগ্য ক্রমে দলে দু দুখানা দায়িত্ববান ও দায়িত্ববতী পাওয়া গেছে। অমিতা হোটেল বুক করেছে প্রিন্ট আউট নিয়েছে, জলের বোতল নিয়েছে(দুটো নিয়েছে, আমি যথারীতি নিইনি), কেক বিস্কুট নিয়েছে, এমনকি সকালে চান অব্দি করে বেরিয়েছে। ওদিকে আমাদের সৌরভও কম যায় না, হ্যান্ডস্যানিটাইজার থেকে ফ্লাস্কে কফি সব নিয়েছে। আমি ড্রাইভার, তাই গাড়ীতে তেল ভরা আর হাওয়া চেক করার কাজটা করেছি। সাতটায় শুরু করার কথা, তা শুরুতেই বাবু শ্রীল শ্রীযুক্ত অমিতেশ দেরী করলেন। চা বিস্কুট খাওয়া হয়ে গেলো দু রাউন্ড রাস্তায় দাঁড়িয়ে, তারপর উনি গার্ল্ফ্রেন্ড কাঁধে মানে ইয়ে ওনার ডিএসএলার কাঁধে এলেন।



আমি পথে বিশ্বাসী, গন্তব্য তো আছেই কিন্তু যে পথ দিয়ে চললাম তাকে উপেক্ষা করে না। আর গাড়ি চালাতেও ভালোবাসি। ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে আমার বাহন আড়মোড়া ভেঙে ছুটছে, স্পীড বাড়ছে কমছে, সামনে ট্রাক, দুধারে গাছ কাটিয়ে এগোচ্ছে, রাস্তা পুরো মাখন। শক্তিগড়ের ল্যাংচা নাকি ভয়ানক খারাপ আসলে, মানে কোয়ালিটিতে, বাসী মাল দেয় ইত্যাদি কিন্তু তাও আমরা নিজের মুখে ঝাল থুড়ি মিষ্টি খেতেই পছন্দ করি কিনা তাই শক্তিগড়ে জমিয়ে খেলাম। সত্যি বলতে কি আমাদের ভালোই লেগেছে।



ইয়ুথ হস্টেলে গাড়ি রেখে, ঝটাপট প্ল্যান করে নেওয়া গেলো। রুমে ঢোকার দরকার নেই, খেয়ে সোজা পাহাড়ে ওঠা যাবে। আমি খেয়ে পাহাড় চড়ার থেকে বিছানা বালিশে ধ্যান করতে পছন্দ করবো বেশী জানি তাই স্রেফ মাছ ভাজার উপর রইলাম। আলুপোস্তটা ব্যাপক করেছিলো তাও খাইনি। বাকি তিনটে আমার কথা শুনলো না, 'যা যা তুই খেতে পারিস না তাই অমন করছিস।' আচ্ছারে ব্যাটা, বেশ বুঝবি। দুধারে সারা বছরের মেলা বসেছে। খাজা, জিলিপি, আলুর চপ, চা, পাথর খোদাই করে তৈরী জিনিস হরেকমাল। এসব কাটিয়ে এগোতেই, দেখি ভাঙাচোরা খাড়াই রাস্তা উঠে গেছে পাহাড়ে। ধুলো খুব। সেই খাড়াই খানিক ভাঙার পরেই, অমিতা আর অমিতেশ হাত তুলে দিলো। যা ভাই তোরা যা আমরা এখানেই পাহাড় এর ফিল নিই।







সৌরভ আর আমি হুহুমনা হুহুমনা করে চল্লুম। রাস্তায় দেখি একটা শুঁড়িপথ জঙ্গলে ঢুকে গেছে, নীচে পাহাড়ের স্পিকারের আওয়াজ, লোকজনের ক্যালোরব্যালোর এড়িয়ে আমরা জঙ্গল এর শান্ত চাইছিলাম, তাই অমোঘ আকর্ষনে দুজনে মূল রাস্তা ছেড়ে এগিয়ে গেলাম। বেশীদূর যেতে হলো না, যে পাখির ডাক এতোক্ষণ শুনিনি সেই পাখির আওয়াজ (খুব কম তাও আছে )। খানিক্ষন চুপ করে বসে থেকে আবার মূল রাস্তায় ফিরে পাহাড় চড়া, খাড়া   পাহাড়, আনফিট শরীর, রোদে ঘেমে, লেবু জল খেয়ে খেয়ে যখন বড়চূড়াটা পৌঁছলাম সে অদ্ভুত ভালোলাগা।চিৎপাত হয়ে শুয়ে শুয়ে যখন মন শরীর দুইই চাঙ্গা হয়ে গেলো আমরা রোদপড়া বিকেলে নামতে লাগলাম। এদিকে খুব বেশী লোক আসেনি, ছোট চূড়াটা অব্দিই লোকে পৌঁছেছে। তাই রাস্তাঘাট ফাঁকা। আশেপাশে প্রচুর বিন বানানো আছে তাও লোকে রাস্তায় প্লাস্টিক, প্যাকেট ফেলে গেছে। আমাদের স্বভাব! ভালো রাখবোনা আমাদের চারপাশ! হলুদ আলোয় চারপাশটা ভারী বড় সুন্দর লাগছে। এই আলোকে বলে কনে দেখা আলো, আচ্ছা গাছেরা কনে দেখা আলোয় কনে গাছ দেখে? ওদের হয়তো, প্রপোজ করতে গেলে হাওয়া দিয়ে ভাসিয়ে দিতে হয়। ও ছোট শাল গাছ তুমি আমার গাছিনী হবে?






অন্ধকার দেখতে হলে গ্রামে আসতে হয়। ইয়ুথ হস্টেলের বাইরের রাস্তায় চা খেতে বেরিয়ে দেখি চারজনের টর্চ জ্বেলেও খুব বেশী কিছু চোখে পড়ছে না। দুপাশে শালের জঙ্গল, অন্ধকার রাস্তা, চারটে ছেলে মেয়ে অন্ধকার ভেঙ্গে হাহাহিহি করতে করতে চলেছে। শালগাছেদের সাথে ভাব জমেনি তেমন, তাই তারা আমাদের ফাজলামিতে আমোদ পাচ্ছিলো না বিরক্ত হচ্ছিলো বুঝিনি। অন্ধকার রাস্তায় আমরা অবশ্য এসব দর্শন না আমরা চলেছিলাম একে অন্যের ঠ্যাং টানতে টানতে।


ইয়ুথ হস্টেলের বাথরুম বর্ষার কলেজস্ট্রীট। বাথ্রুমে কেউ গেলো মানে সে জলমগ্ন হয়ে পড়ে। একটা কম্বল চাপা দিয়ে শুতে শুতে অমিতেশের আপশোষ শোনা গেলো, এহ একটা ক্রেট তুলে আনা উচিৎ ছিলো মাইরি। সকালে গীজার দেখি কাজ করছে না, সুতরাং ডিওই ভরসা। এই জানুয়ারিরর ঠান্ডায় পুরুলিয়ার হেদুয়া বাথ্রুমে স্নান করার কোনো ইচ্ছে নেই। অমিতাকে না বললেই হলো, কাঁইকিচির লাগাবে, বনমানুষ ইত্যাদি বলে।



সকালগুলো ভারী সুন্দর হয় কিন্তু এসব দিকে। শীতের রোদ মাখা নরম পাকের সকাল, ইতিউতি পাখি ডাকছে। এক চক্কর হেঁটে ফিরে জয়চন্ডীর দিকে যাচ্ছি হঠাৎ ফাঁকা জঙ্গুলে রাস্তায় হঠাৎ দেখি গুড়ের জ্বাল দিচ্ছে। কাল থেকে খেজুর গুড় করে করে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। এমন মাটি ফুঁড়ে সে মিলবে কে ভেবেছিলো। একটা টিনের ছাউনিতে লোকটা থাকে, আজ সংক্রান্তি, তাই এক বুড়ি এসেছে খালি বোতল হাতে, দর কষাকষি চলছে। আমাদের অনেকটা করে গুড় খেতে দিলো, বোতল নেই শুনে জায়গা মেজে দিলো। তারপর খেজুর রস খাবো বলে গাছ থেকে হাঁড়ি নামিয়ে দিলো। রস জমেনি বেশী। সকালেই সবটা নিয়ে গুড় জ্বাল দিতে বসে গেছে। তাও যেটুকু ছিলো দিয়ে দিলো। 


আমি আগেও বলেছি না? আমাদের চারপাশে ভালো লোক বেশী, কাগজে যাই লেখা থাক না কেন। এই যে কাল আমরা যখন রাস্তা খুঁজছি, মাইলস্টোনে ভরসা রাখা যাচ্ছে না, জিপিসেও না তখন একজন "না না ওদিকে রাস্তা ভালো না, এদিকে ভালো" এসব বলে যে ডিরেকশন দিলো কি দায়?




জয়চণ্ডী পাহাড়ে একটা ছেলে পাকামো মেরে একটা খাড়া পাথরে চড়ে বসেছে। আর নামতে পারছে না ব্যাটা। তার বাড়ির লোকে উৎকণ্ঠিত হয়ে দেখছে, অবশেষে একজন হাত বাড়ালো, সে হাঁচোরপাঁচোর করে নেমে এলো। আমরাও হাঁফ ছাড়লাম, ওখান থেকে পড়লে আর দেখতে হতো না।




গড়পঞ্চকোট ঘুরে আমরা ফিরতি পথে আর শোভা দেখতে দেখতে না, হোটেল দেখতে দেখতে আসছি। কিছুই পছন্দ হয় না শেষ অব্দি হাইওয়েতে ধাবায় খাবো ঠিক হলো। খেয়েই কেসটা খেলাম।
ঘুম পাচ্ছে বেজায়। কোনো গানই আর ভালো লাগছে না। বাকিরা (অমিতেশ বাদে, সে ব্যাটা ঘুমোচ্ছে) চেষ্টা করছে পছন্দের কোনো গান চালাতে, সৌরভ হলো জিপিএস কিং, সে জিপিএস এর বাইরে অন্য কিছুকে ভারী ইয়ের চোখে দেখে সেও দেখি জিপিএস ছেড়ে ঘুম দেবার ফিকির ভাঁজছে। ক্রমে সূর্যদেব আপিসের কাজ সেরে ফেসবুক করতে গেলেন, আমরা শক্তিগড় পৌঁছলাম।




জানিনা কী যে গেরো চা এ লেগেছে যা চা খাচ্ছি তাইই খারাপ। অমিতেশ কফি খাবে আমরা চা, তাতে লোকটা চাফি বানিয়ে দিলো!! রাগের চোটে গড়গড় করতে করতে মিষ্টিই খেয়ে নিলাম গোটা কতক। যদিও দুপুরের রুটি মাংস পেটে তাঁবু গেড়ে বসেছে তাও।


রাতের বেলা গাড়ি চালানোর আলাদা রকম ব্যাপার। পুরো ফোকাসটা দিতে হয় রাস্তায়, গাড়িতে। চারদিকে ঘোঁত ঘোঁত করে গাড়ি ছুটবে তারমধ্যে বিচলিত না হয়ে গাড়ি চালাতে হবে। তবে গাড়িতে ইয়ার্কি মেরে উড়িয়ে দেবার বন্ধু বান্ধব থাকলে সে চ্যালেঞ্জ মজার, সব চ্যালেঞ্জ এর মতোই। গান, ইয়ার্কি, হাসি, আর হুশ হাশ করে পেরিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক গাড়ির মাঝে.....এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না ।









2 comments:

  1. আমি ক্লাস সেভেনে শুশুনিয়া গিয়েছিলাম, তোমার লেখা পড়ে মনে পড়ে গেল, প্রদীপ্ত। এই ছোটছোট বেড়ানোগুলোর চার্মই আলাদা হয়। কেরালার গল্পের অপেক্ষায় আছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক বলেছ। এহ আমার বাড়ির কাছে যদি জঙ্গল হতো, প্রতি হপ্তায় পালাতাম।
      কেরালার গল্প লিখবো শিগগির 😊

      Delete