Thursday, February 22, 2018

গুটুল আর বিল্বপত্রের অভিযান

মাঠাংবুরুর মন ভালো নেই, গল্প শুনতে গেছিলাম, রাবড়ির ভাঁড় নিয়ে, রাবড়িটা চুকচুক খেয়ে খ্যাঁকম্যাক করে উঠলো। মন ভালো না থাকলেই ব্যাটা এমন খিটখিটে হয়ে যায়। তাই আর ঘাঁটালাম না, কি জানি হয়তো কাজ করেনি বলে হোমরা চোমরা পিঁপড়েদের থেকে ঝাড় খেয়েছে কিংবা হয়তো পিঁপড়েনি পাত্তা দেয়নি....জানিনা, মন ভালো হলে, যদি গল্প শোনায় শোনাবো আবার। তবতককে লিয়ে বিল্বপত্র কে মনে আছে তো আর গুটুলকে? মনে না থাকলেও সমস্যা নেই, লিংক পেলে দিয়ে দেবো কমেন্টে। তার একটা গল্প দিলাম

****************************
বিল্বপত্র আর গুটুলের বন্ধুত্ব বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে গুটুলকে সাঁই করে বিরাট লম্বা কোনো বিল্ডিংএর টঙে উঠিয়ে নিয়ে যায় বিল্বপত্র। কার্নিশে আরাম করে বসে গুটুলের আনা আইস্ক্রীম খায় দুজনে। এমনিতে গুটুল খুবই ভীতু, এত বড় বাড়ির ছাদের কার্ণিশে বসা তো তো দূর ভাবতে গেলেই সে অজ্ঞান হয়ে যাবে, নেহাত ভুতুড়ে শক্তি ছিলো তাই। ওদিকে ভূতেরা আবার এই সব কাবাব, তন্দুরি এসবের স্বাদ জানে না, লুচি সন্দেশ যৎসামান্য জানে, আইস্ক্রীম জানেনা আবার। জানবে কি করে ভূত হয়, কিছু মরে বা দুজন ভূতের বিয়ে হয়ে বাচ্ছা হয়ে। তা কাবাব তো মুরগি ইত্যাদি মরেই হয়, তারা তাই আর ভূত হয়না, সোজা কাবাব জন্ম নেয়। তা দুজন বসে বসে খুব খানিক সুখ দুঃখের কথা হয়, বাড়িতে তো সব সময় পড়াশোনা করতে বলা, না খেলা ইত্যাদি তো আছেই। আজকাল গুটুলকে ভূত বলে আর বিল্বপত্র কে মানুষ বললে ওরা রেগে যাচ্ছেনা তাই ওদের বাবা মা দের রাগ বেড়ে যাচ্ছে। একথা কে না জানে, কাউকে রাগানোর সহজ উপায় তার রাগের কথায় রাগ না করা। মারামারিও হয় মাঝে মাঝে, ভূত ভালো না মানুষ সে নিয়ে। কিন্তু সে নেহাতি মাঝে মাঝে, ঝগড়া হয় মারামারি হয় আবার ফের দুজন গলায়গলায় হয়ে খেলে গল্প করে নানান রকম জিনিস নিয়ে পরীক্ষা করে। এই যেমন মশাদের শীত করে কিনা এটা তো খুবই দরকারী প্রশ্ন।

বিল্বপত্রদের পাড়ায় খুব একটা মশা ভূত নেই। ওরা মশাভূতদের আলাদা একটা জায়গা করে দিয়েছে আর সেখানে একটা জায়ান্ট স্ক্রীনে সব সময় কার্টুন চলে, এক্স বক্স আছে গেমস এর জন্য। আর খাবার দাবার হিসেবে রক্তের বদলে কচুপাতার রস এর ব্যাবস্থা করা আছে। কার্টুন আর গেমসে ডুবে থাকায় মশা ভূতেরা খেয়ালই করেনা কচুপাতার রস খাচ্ছে না রক্ত। ফলে ভূতেদের মশার বিনবিন সইতে হয়না। কিন্তু গুটুল কে করতে হয় আর বেঁচে থাকা অবস্থায় মশা গুলো অমন ভদ্র মোটেও না, কচুপাতার রস ছুঁয়েও দেখবে না। যাই হোক তা সেদিন তারা দেখতে চাইছিলো মশার শীত করে কিনা। তা পরীক্ষা করতে গেলে একটু আশেপাশে বাবা মা দাদা দিদিদের সাহায্য লাগে। গুটুলের বাড়ির লোক এসব যুগান্তকারী জিনিস তো বুঝবেই না উলটে বিল্বপত্রকে দেখতে না পেয়ে ভাব্বে গুটুল বেশি কার্টুন দেখে দেখে হয়ত পাগল হয়ে গেছে। ধরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে নয়ত অংক করতে বসিয়ে দেবে। তাই সেদিন রাত্তিরে সবাই ঘুমানোর পর একটা আইস কিউব বের করে গ্লাসে নিয়ে, কয়েলের ধোঁয়ার নেতিয়ে পরা সন্ধ্যেবেলা ধরে রাখা মশাটাকে যেটাকে সে না মেরে রেখে দিয়েছিলো সে মশাটার সাথে রাখলো। দেখা যাক সর্দি লাগে কিনা, হাঁচি হয় কিনা। তা সাথে সাথে তো হবে না এদিকে বরফ হলে জল হয়ে গেলে মশা আবার জলে ডুবে মরবে। উপায়? গ্লাসের উপর একটা ছাঁকনিতে আইস কিউব আর তার পাশে একটা কাগজের টুকরোয় মশাটা রেখে দিলো। আইস কিউবে শোয়ালে এম্নিই মরে যাবে, মর্গ এ এভাবেই মানুষ কে রাখে গুটুল দেখেছে টিভিতে। তা এই সব ব্যবস্থা করে গ্লাসটা খাটের তলায় রেখে দিয়েছিলো। বিল্বপত্রকে বলা ছিলো খেয়াল রাখতে। তা রাতে কোনো ঝামেলা হয়নি, মশাটা খুব বেশী জ্বালায়ওনি। সক্কালবেলা গৌরীমাসী ঘর মুছতে গিয়ে নিজেই না দেখে সব উল্টালো, গ্লাস ভাঙলো উলটে এমন চেঁচামেচি করলো যেন সব দোষ গুটুলের। গুটুলের নাকি যত আজেবাজে দিকে বুদ্দি, ও নাকি বড় হয়ে গরু হবে, নাহলে চা এর দোকানের বয় হবে। হবে তো হবে গরু হওয়া কি এমন খারাপ, ঘাস খেতে খারাপ অবশ্য কিন্তু পড়াশোনা করতে হয়না কেমন, বকুনি দেয় না কেউ। আর চায়ের দোকানের বয় হলে তো সবচে ভালো, যত ইচ্ছে চা খাওয়া যাবে, মা তো ওকে খালি এক ফোঁটা চা দেয় তাও এক কাপ দুধের মধ্যে। সেদিন বিকেলে খেলতে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে একটা গাছের ডালে শুয়ে শুয়ে বিল্বপত্রের সাথে এই সব দুঃখের কথাই হচ্ছিলো। 'নাহঃ এ পরাধীন জীবন আর ভাল্লাগেনা, চল বিল্বপত্র পালিয়ে যাই যাবি? '

তা বিল্বপত্রও খুব ভালো নেই, ভূতের মতো ভূত হতে হবে সারাক্ষণ এ নিয়ে শুনতে শুনতে ও বিরক্ত। কি হবে ভালো ভূত হয়ে? মানুষদের মধ্যে লড়াই লাগাতে হবে, নইলে ভুল বিশ্বাস চালিয়ে দিতে হবে এই তো? সব মানুষ কি খারাপ? যদি লড়াই এ তার বন্ধু গুটুলও মারা যায়? না না সে খুব খারাপ হবে, মরে গেলেই তো আর ভূত হবেই এমন নিশ্চয়তা নেই, তাছাড়া ওদের অঞ্চলেই আসবে তারও মানে নেই। হতেই পারে গুটুল মরে গিয়ে কোন দূর পাহাড়ের নীল ঘাসফুল হলো তাহলে সে কার সাথে খেলবে কার সাথে গল্প করবে কার থেকে গল্প শুনবে। না না লড়াই ভালো না, সে ভালো ভূত হতে চায়না।
বিল্বপত্র এসব ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলো। 
'কিরে যাবিনা' - গুটুলের কথায় চমক ভাঙলো। 'হ্যাঁ রে যাবো, চল চলেই যাই। কোথায় যাওয়া যায় বলত? আমার ইচ্ছে বেশ মানস সরোবর যাবো, নীল জল আছে শুনেছি, যাবি'?
'মানস সরোবর? কোথায় সেটা? তিব্বতে হলে সোজা আমি বইতে পড়েছি, রাণাঘাট তারপরেই তিব্বত। চল কালকেই যাই।'
ব্যাস যাই মানে যাই। নেবার মতো অনেক জিনিস আছে বটে কিন্তু সব নিয়ে তো আর পালানো যায় না, তাই গুটুল একটা কাগজ কাটার ছুরি, জলের বোতল, আর জমানো একশো টাকা নিয়ে বেরিয়ে পরলো। বিল্বপত্র মানুষ এর মতো সেজে থাকে যাতে বেশী কথা না ওঠে। আসলে অদৃশ্য হওয়া অবস্থায় গুটুলের সাথে গল্প করলে আবার লোকের মাথা খারাপ হবার জোগার হবে কিনা। সত্যি বলতে কি গুটুলের একটু একটু মন খারাপ করছিলো মায়ের জন্য কিন্তু নাহ এই ভাবে সে আর থাকবে না। ঘুরে বেরিয়েই দিন কাটাবে। বিল্বপত্র ভাবছিলো তাকে না দেখে বাকি ভূতেদের কি অবস্থা হবে। আসলে ভূতেরা ভারী নিয়মনিষ্ঠ হয়, খুব নিয়ম মেনে চলে বলেই মাঝে মাঝে কোনো কোনো মানুষ এর সাথে ভূতেদের গোলমাল হয়ে যায়। তাই কাউকে কিছু না বলে এরকম নেই হয়ে যাওয়াটা ভূত সমাজে আলোড়ন ফেলবে। ভেবেই বিল্বপত্রের হাসি পাচ্ছিলো। 
-হ্যাঁ রে কোন ট্রেনে উঠবো? নাকি হেঁটে হেঁটেই যাবো? 
- চল না ওই যে ঝিলটা দেখেছিলাম না সেই যে রে সেবার তোকে নিয়ে গেলাম বট গাছের ডালে, মনে পড়েছে? ওই ঝিলের ধারে যাই চল। ওখানে বটগাছকাকাকে জিজ্ঞেস করে দেখা যাবে। কিছু জানে কিনা।
দুজন হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলো। গুটুলের এর মধ্যেই খিদে পেয়ে গেছে। 
- হ্যাঁ রে এই পুকুর থেকে একটা মাছ ধরতে পারবি না তুই?
- না রে ধরতে পারবো না, তবে তুই ধরলে আমি গ্রিল্ড ফিশ বানাবার ব্যাবস্থা করে দিতে পারি। 
- কেন ভূতেদের মাছ ধরা মানা? 
আহা তা না, কিন্তু জানিসই তো ভূতেরা খালি মাছ ভূতই ধরতে পারে, তুই কি আর মাছ ভূত খাবি? উদাস মুখে একটা কলকে ফুলের মধু খেতে খেতে বলল বিল্বপত্র।
'হ্যাঁ হ্যাঁ তোর যত্ত বাহানা, আসলে ঘেঁচুর মাথা পারিস তুই।' খিদেতে গুটুলের মেজাজ ভয়ানক খারাপ হয়ে গেছে তখন। লড়াই এবার লাগলো প্রায়। কিন্তু বিল্বপত্র খুবই ঠান্ডা খুলির ভূত। এদ্দিনের বন্ধুত্ব তো, ও জানে গুটুল একটু পরে নিজেই সরি বলবে শুধুশুধু রাগমাগ করার জন্য। সত্যিই বিল্বপত্র কিই বা করতে পারে, ভূতেরা যদি নিজেদের ইচ্ছেমতো জ্যান্ত মানুষ, প্রাণী, জিনিস ভূত সমাজে আনতে পারতো তাহলে তো ওর গুটুলের সাথে বন্ধুত্ব হবার সেই ঘটনাটাই ঘটতো না।

গুটুল আরো খানিক রাগ করে চেঁচিয়ে নিলো। আসলে খিদে পেলে ও আর কিচ্ছু ভাবতে পারেনা, বাড়ি থেকে চলে আসাটাও মনে হচ্ছে ভুলই করেছে। শেষে খানিক থুম হয়ে বসে একটু জল টল খেয়ে মাথা ঠান্ডা হলো। 
-অ্যাইই বিল্বপত্র, সরি রে আসলে খিদে পেয়েছিলো কিনা খুব। প্লিজ রাগ করিসনা ভাই, আচ্ছা, তোকে আমার রিমোট কন্ট্রোল্ড হেলিকপ্টারটা দিয়ে দেবো। 
-নাহ আমার চাইনা, তুই নে তোর হেলিকপ্টার, আর চল ফিরে যাই, তুই তোর বাড়ি আমি আমার।
-রাগ করিস না রে আর, সত্যিই খুব খিদে পেয়েছে।
-হুঁ আমারো কি আর পায়নি, তাই বলেই তো আর আমি অমন করিনি।
-ভুল হয়ে গেছে ভাই, আর রাগ করিস না। জিজ্ঞেস করনা রে বটকাকাকে কিভাবে যাবো সেসব। 
-হুঁ, জিজ্ঞেস করে নিই দাঁড়া। ও বটকাকা, আমরা মানস সরোবর যাবো। ওখানে নীল পদ্ম ফোটে, সাদা সাদা হাঁস চড়ে বেড়ায়, কস্তুরী হরিণের গন্ধ ভেসে আসে, আমরা ওখানে যাবো। আমাদের এখানে কেউ ভালোবাসেনা, কেউ বোঝে না, ও বটদাদা আমাদের রাস্তাটা বলে দেবে প্লিজ? এই যে আমার বন্ধু গুটুল, ও গুগল করে দেখতে গেছিলো কিন্তু সে ভারী ভজঘট ব্যাপার তুমি সোজা রাস্তা বলে দাও না বটদাদা।

খুব খানিক থম মেরে রইলো চারদিক প্রথমে। তারপর বট হাওয়া হয়ে ওদের দুজনের গায়ে মাথায় বুলিয়ে গেলো, বলল 'যাওয়া তো অনেক ভাবেই যায়,চলতে শুরু করলেই পথ তৈরী হয়ে যায়। বিল্বপত্র ভেসে ভেসেই যেতে পারিস, কিন্তু তাহলে গুটুল যেতে পারবে না, আর দুজন একসাথে যেতে গেলে সহজে যেতে পারবিনা।' 
গুটুল বিল্বপত্র একসাথে বলে উঠলো না বটদাদা আমরা একসাথে যেতে চাই। তা সে যত কষ্ট হোক। 
ফের বটের ঠান্ডা পরশ ভেসে এলো। 'বেশ, তাহলে শোন কঠিন পথ চলতে যাওয়ার আগে নিজেদের তৈরী হতে হতে হয়। এই ধর আমি এতদিন ধরে রয়েছি তা কি এমনি? এই যে আমার শিকড় এতো দূর ছড়িয়ে গেছে এরাই আমায় ধরে রেখেছে। কিন্তু শিকড়টা তো ছড়াতে হয়েছে নাকি? এখন তোদের নিজেদের মধ্যে, পরিবারের মধ্যে শিকড় ছড়ানোর সময়, প্রস্তুতির সময়। নীল পদ্ম, কস্তুরির গন্ধ, সাদা হাঁস, সব তোলা থাকবে। তাছাড়া কি জানিস তো তোদের দেখতে না পেয়ে তোদের বাপ মা এরও কষ্ট হচ্ছে কিন্তু। বড়রা তো বোকা হয় জানিসই, এম্নিতে তোদের অমন করলে কি হবে তোদের না দেখে অস্থির হয়ে পড়েছে এদিকে। তোরা ফিরলে মার খাবি হয়ত কিন্তু এই দেখ আমি দেখাচ্ছি কিরকম কান্নাকাটি করছে সব। 
বটের গায়ে ছবি ফুটে উঠলো, গুটুলের বাবার উদভ্রান্তের মতো অবস্থা, মা এর চোখ কেঁদে কেঁদে ফুলে গেছে। বিল্বপথের বাবার চকচকে সাদা মাথায় কালো কালো চুলের ছাপ দেখা যাচ্ছে, ওর মা এর চোখের লালচে ভাবটা কমে গেছে একদিনে কেমন ফ্যাকাসে মার্কা দেখতে হয়েছে বদলে। দুজনেরই বুকের মধ্যে পাক দিলো। বাড়িতে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে এক্ষুনি। বটগাছ মুচকি হেসে ছবি বন্ধ করে বলল, যা বললাম মনে রাখিস। ফিরে মার খেলেই এদের বোকামিটা টের পাবি, যারা ভালোবাসাই বোঝাতে পারেনা তাদের উপর রাগ করে আর কি করবি, যা আমি তোদের খেয়াল রাখবো। তোদের মানস সরোবারের ব্যবস্থা ঠিক হবে।

বট কি করে খেয়াল রাখবে তা আর গুটুল জিজ্ঞেস করেনি, ওকে বিল্বপত্র এসব আগেই বলে দিয়েছে, গাছেদের সুপার নেটওয়ার্ক এর কথা। আশেপাশের গাছেরা রিলে করে খবর নিয়ে খবর পাঠাবে। বাড়ির দিকে পা চালালো দ্রুত দুজনে। গুটুলের বাড়ির কাছাকাছি এসে বিল্বপত্র নিজের বাড়ির দিকে গেলো।
ফিরে অবশ্য খুব মার খায়নি, অল্পই বলা যায় সে গুটুল বা বিল্বপত্র কেউই পাত্তা দেয়নি। ওরা বুকের মধ্যে খানিক জায়গা করে নীল পদ্মের গাছ বসিয়েছে, মানস সরোবর যাবার আগে অব্দি ওগুলো ওদের সাথে থাকবে, শিকড় গজিয়ে শক্তপোক্ত হয়েই যাবে ওরা একদিন। যাবেই।

2 comments: