Tuesday, March 14, 2017

উপনিষদ মহারাজ - আগের বারের পর

রাধা কৃষ্ণ নিয়ে বোধহয় কয়েকশ বা কয়েককোটি লেখালেখি হয়ে গেছে। দোলের সময় বলে আসলে মনে এলো,  নইলে আমি সেই সমুদ্রে আর কিই বা জল ঢালবো। রাধা কৃষ্ণ কে অ্যাক্সেপ্ট করার মধ্যে  তৎকালীন সমাজের একটা দিক অন্তত বোঝা যায় ( মানে ওই নামে কেউ থাক বা না থাক,  গল্পটা আছে যখন আর সেটা চলছে যখন) তা হলো,  তুমি যদি শারীরিক ভাবে সক্ষম হও তবে তুমি যা চাও তাই পাবে সমাজ গল্প সাজিয়ে দেবে, ঈশ্বর বানিয়ে দেবে। আর তুমি যদি অক্ষম হও তবে গল্পে কাব্যে জীবনে তোমার ঠাঁই নেই। আমি জানিনা এ গল্প কতটা সত্যি, আয়ান ঘোষকে নপুংসক বানানো হয়েছিলো কৃষ্ণ কে ঈশ্বর বানাতে কিনা, আমি জানিনা এ কাহিনী কোনো বিক্ষিপ্ত রাখাল ছেলের কিনা আমি জানিনা এ গল্প কোনো বিরহিণী নিজেই বানিয়েছে কিনা,  কিন্তু মাঝে মাঝে ভাবতে চেষ্টা করি যে সমাজে জরু গরু এক পদবাচ্য করা করা সে সমাজে বউ চোখের সামনে অন্য পুরুষে আসক্ত,  এ তথ্য জেনেও কিছু বলতে পারেনি তা কি শারীরিক দুর্বলতায় না সুগভীর উদাসীনতায় বা ঘৃনায়? হয়ত আয়ান ঘোষ সেই সময়ের থেকে একটু অন্যভাবে ভাবত,  যে আমার না, তাকে জোর করে কি পাওয়া যায়, সেই টুকু বোধ ছিলো আর তাই হয়ত ভারতীয় সমাজ তাকে নপুংসক আখ্যা দিয়েছে। আসলে আমরা বোধহয় সবাই বড় বেশী কৃষ্ণ সিন্ড্রোমে আক্রান্ত, একা মেয়ে নদী পেরোতে গেলেই ঝাঁপিয়ে পরা যায়, একা মেয়ে স্নানে গেলে তার সাথে অসভ্যতা করা যায় তাকে লজ্জায় ফেলা যায়, কেউ রিফিউজ করলে তাই তার মুখে অ্যাসিড ছোঁড়া যায়, ধর্ষণ তো জলভাত।
আয়ান ঘোষের উদারতা শেখা আমাদের কর্ম না বোধহয়।
এইসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে রাস্তা পেরোচ্ছিলাম। এইদিককার কোলকাতা টা যেন অন্যরকম, এত গাছ এত পাখি ঠিক কোলকাতার সাথে যেন যায় না। আবার যায়ও। নইলে ধর্মতলার এই ইউরিনালের গন্ধেও পলাশ ফোটে কি করে। রাজভবন দেখলেই আমার কেমন মনে হয় আমরা প্রজা হয়ে থাকতেই ভালোবাসি, নইলে রাজভবন নাম রেখে দেওয়ার কি মানে কে জানে। অবশ্য নাম বদলাতে গেলেও মুশকিল, পূর্ব দিকে থেকেও পশ্চিমবঙ্গ নাম কেন বদলে বাংলা বা বঙ্গ হবে না সে নিয়েও গোছা গোছা প্রতিবাদ নেমে যায় আজকাল। মাঝে মাঝে আমি ভাবি,  ভাগ্যিস কাগজ কলমে লিখতে হয়না, তাহলে বোধহয় আর একটাও গাছ বাঁচত না যে পরিমান লেখালেখি হয়। খারাপ বলছি না তবে মাঝে মাঝে মনে হয় শব্দরা আজকাল স্যোশাল মিডিয়া ছেড়ে জ্যান্ত হয়ে পড়ছে, ধেয়ে আসছে, কোনোদিন হয়ত এই শব্দবানেই মারা যাবো।

এমনিতেই সবাই বলে পালানো খারাপ, কিন্তু আমি জানি পালানো ভালো মাঝে মাঝে। তাই যথারীতি পালিয়ে ছিলাম পূর্নিমায়।

"বাবু , রাত্তিরে জঙ্গলে না যাওয়াই ভালো" । জঙ্গলে না যাওয়াই ভালো! বলে কি? আরে এরকম পূর্নিমার রাতে জঙ্গলে যাব বলেই তো এত কাঠখড় পুড়িয়ে এলাম নাকি? কেওনঝাড়ের এক জঙ্গলে এসেছি, অখ্যাত জঙ্গল । এই ঝাঁ ঝাঁ বৈশাখে খুব এক্টাকেউ এ তল্লাটে আসে না । তবুও , আমার টিকিট কাটা ছিলো না বলে, কাল অব্দি আসার ঠিক ছিলো না । তারপর হঠাৎ করে তৎকাল এ টিকিট পাওয়া এবং কপাল জোরে ডাকবাংলো ফাঁকা পাওয়া । না পেলে কি হত জানি না , কারন এখানে থেকে ফেরার ট্রেন নেই বিকেলে কোনো । আর স্টেশনের যা ছিরি দেখলাম আসার পথে তাতে রাতে ওখানে থাকা আর গাছতলায় থাকায় খুব তফাৎ কিছু হতো না ।
যখন নামলাম স্টেশন থেকে, কড়া রোদে চারদিক ঝকঝক করছে । লু বইছেই বলা ভালো । তবে আমার আবার এরকম ঝাঁ ঝাঁ রোদ বেশ লাগে । ঘাম হওয়া রোদ না , এরকম খাঁ খাঁ রোদ । জানিনা এখানে কি আছে দেখার মতো । জঙ্গল আছে এটুকুই জানি খালি, আর সেই শুনেই বেড়িয়ে পরেছি । স্টেশন এ নেমেই বুক শুকিয়ে গেলো , গাড়ি নেই । ট্রেন একটু দেরী করে এসেছে বটে তবে সেটা কারন না মনে হয় । যাকগে কারন নিয়ে মাথা ঘামালে আমার চলবে না । দেখি আর কি উপায় হয় ।
একটা গাড়ি পাওয়া গেছে শেষমেশ । এক রাত থাকবো খালি বেশী ঝামেলার দরকার নেই , কিছু চাল ডাল আর ডিম কিনে চললাম । বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা , চারদিক শুনশান । একটু একটু গা ছম ছম করে বইকি , একদম একা ঘুরতে গেছি অনেক জায়গায় কিন্তু বনের মধ্যে আসা হয়নি কখনও । টাওয়ার আছে এখনো তবে নেট নেই । ভালোই হয়েছে। খেয়ে দেয়ে একটু চরকি পাক লাগাতে লাগাতেই বিকেল ঘনিয়ে এলো । চারিদিকটা কি অস্বাভাবিক নিরিবিলি। তারপর আসতে আসতে চাঁদ উঠতেই যেই না আমি জঙ্গলে যাব বলে পা বাড়িয়েছি অমনি , কেয়ারটেকার সনাতন এর সাবধানবানী, ,"বাবু, রাত্তিরে জঙ্গলে না যাওয়াই ভালো "।
এমন চমৎকার চাঁদ উঠেছে , হাওয়া দিচ্ছে , আশপাশে না গিয়ে বসে থাকিই বা কি করে , তাই বললাম আরে এই তো আশেপাশেই আছি । একটু পরেই তো রাতের খাওয়ার ব্যাপার আছে আর কাল তো চলেই যাবো , একটু ঘুরে নিই। সনাতন আর কিছু বলল না আমিও এগিয়ে গেলাম । বাংলোর পাশ দিয়ে একটা শুঁড়ি পথ জঙ্গলে ঢুকেছে , খানিকটা এগিয়ে দিয়ে ওই পায়ে চলা রাস্তাটা আবার দু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে একটা গেছে নদীর দিকে আর একটা জঙ্গলের দিকে। শালের জঙ্গল তাই ফাঁকাই মোটামুটি , খুব গভীর না । জ্যোৎস্নার আলোয় সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে । মায়া মায়া লাগছে সব । ইচ্ছে করেই নেট অফ রেখেছি , যাতে টাওয়ার থাকলেও আমি এ বনভূমি থেকে বিচ্যুত না হই । অনেক অনেক ক্ষন এলো মেলো ঘোরার পর যখন , ভালো লাগছে ,ভালো লাগছে ভাবে টইটম্বুর বাংলোর দিকে ফের রওনা দিলাম।
এখানে খাওয়া দাওয়া জলদি হয়ে যায় । খেতে খেতে যথারীতি ভুতের গল্পও শোনা হয়ে গেলো । পুরনো বাংলো আর ভূতের গল্প থাকবে না তাইই কি হয় । তা ভূতের গল্পে রসভঙ্গ করতে নেই , আমি তাই বিস্ময় ভাব নিয়ে সব কটাই শুনে গেলাম ।  তারপর সব চুপচাপ হতেই আমিও বেড়িয়ে পড়লাম । ইচ্ছে ছিলো নদীর ধারে যাওয়ার । জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এই রাতে নদীতে যেতে চমৎকার লাগবে । তবে অনর্থক রিস্ক নেওয়ার ইচ্ছে আমার নেই , তাই সাথে ফোন টা নিয়ে বেরিয়েছি , অন্তত টর্চ হিসেবে কাজে দেবে।
ঝিম ধরা রাত, অনেক্ষন জ্যোৎস্নায় থাকতে থাকতে গাছ গুলোরও যেন নেশা ধর গেছে। কি অদ্ভুত যে লাগছে কি বলব । নদীর দিকটা তূলনামূলক ভাবে ফাঁকা । নদীর পাড়ে বসে রইলাম অনেক অনেকক্ষন । তারপর একসময় ফেরার জন্য হাঁটা দিলাম । খুব একটা দূরে না বন বাংলো গান গাইতে গাইতে হাঁটছি এলোমেলো ভাবতে ভাবতে। হঠাৎ খেয়াল হলো , অনেক্ষন হাঁটছি । এতোক্ষনে রাস্তা যেখানে ভাগ হয়েছিলো সেখানে না পৌছনোর কিছু নেই। বুকের মধ্যে একটা ঢেউ খেলে গেলো । এ জঙ্গল কত বড় নিরাপদ কিনা ইত্যাদি খুব বেশী ডিটেইলস আমার জানা নেই , তার থেকেও বড় কথা আমার মনে এলো , এরকম শুখা জায়গায় বিষাক্ত সাপের আনাগোনা অস্বাভাবিক না ।

অজ্ঞতা একপ্রকার আশীর্বাদ , কিন্তু সবক্ষেত্রে না । যতক্ষন সাপের কথা মনে পড়েনি একরকম ছিলো , মনে পড়ে থেকে অবস্থা শোচনীয় । যতদূর মনে পড়ছে কেলোটা করেছি নদীর ধার থেকে ফেরার পর জঙ্গলে ঢকার সময় , অন্য কোনো শুঁড়ি পথে ঢুকে গেছি । রাত্তির বারোটা বাজে , এ সময় জঙ্গলে এরকম আবোলতাবোল ঘোরা বিপজ্জনক । মাথা খারাপ করে লাভ নেই । শান্ত হয়ে ভাবলাম , আমি রাস্তায় কোনো টার্ন নিইনি , মানে কোনো গলিতে ঢুকিনি , তারমানে উলটো রাস্তায় হাঁটলে আমি নদীর পাড়ে পৌঁছতে পারবো। একবার নদীর পাড়ে পৌঁছে গেলে যে জায়গাটায় বসে ছিলাম সেখানে গিয়ে ফের ফেরার চেষ্টা করা ভালো । জ্যোৎস্নাতে ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক না সুতরাং রোমান্টিসিজম বেশী না করে টর্চ জ্বালিয়ে সতর্ক ভাবে দেখে নেওয়াই ভালো ।
সত্যি বলতে কি ভয় করছেনা এটা বলব না ।বেশ ভয় করছে কিন্তু ভালোও লাগছে । এই মাঝরাত্তিরে , ফটফটে জ্যোৎস্নায় ঘুমিয়ে থাকা বোকামো না পথ হারানো?
নদীর পাড়ে এলাম , এদিক ওদিক একটু মন দিয়ে দেখতেই রাস্তাও খুঁজে পাওয়া গেলো । বাংলোর কাছাকাছি প্রায় তখন , সড়সড় করে কি যেন চলে গেলো আমার কাছ দিয়েই । আমি জঙ্গল অভিজ্ঞ লোক না , আমি জানিনা কিসের শব্দ কতদূর দিয়ে গেলো । আমি জানি ওই মুহুর্তে আমি স্রেফ জমে কুলফি হয়ে গেছিলাম । নড়তে পারার অবস্থায় আসার পরেই প্রায় দৌড় লাগিয়ে বাংলোয় ।
আমরা আমায় ভিতু বলতে পারেন কিন্তু ওই অবস্থায় না পড়লে ঠিক বোঝাতে পারবো না। নিস্তব্ধ জঙ্গল , জ্যোৎস্নায় সব অপার্থিব লাগছে সেই সময় যে কোনো শব্দই অন্য রূপ নিয়ে আসে। পরে ভেবেছি বোকার মতো পালিয়ে না এলে ঠিক পরীদের দেখা যেত, এরকম রাতেই তো তারা নামে।
পরের দিন সকালে আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক গতরাতের কথা মনে করে একটু হেসে রওনা দিলাম, ডেরায় ফিরবো বলে।

2 comments:

  1. খুব ভালো লাগল চাঁদনিরাতে জঙ্গলের বর্ণনা পড়তে, প্রদীপ্ত। কবে যে আমি/আমরা যাব।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংকু 😊 এটা ইয়ে একটু বানানো, মানে চাঁদনী রাতে ভারতবর্ষের কোনো জঙ্গলে কাটানোর সৌভাগ্য আমার হয়নি :(

      Delete