কোনো কিছুর জন্যই নির্দিষ্ট অপেক্ষা ভারী চমৎকার হয়। মানে যে জিনিস আসবেই জানি বা হবেই জানি শিগগির সেরকম জিনিস এর অপেক্ষা। যেমন পূজোর মাস খানেক আগে থাকতে পূজোর অপেক্ষা। পূজো আসছে বলে আমার ছোটবেলার গল্পো মনে পড়ছে এবং শোনাতেও -_- ^_^ । আমার ছোটবেলা কেটেছে গাছপালা পুকুর মাঠ মানুষ জন দিয়ে। তাই বোধহয় এ সবকটা আমি আমি এখনো এত ভালোবাসি। হ্যাঁ ইনক্লুডিং মানুষ। আমি ক্যাবে উঠি কি ফেসবুকে বকবক করতে আমার আপত্তি নাই।জানতে শুনতে দেখতে আমার ভারী ভালোলাগে।
ছোটবেলার কথা বলছিলাম না। আমার ছিলো মস্ত যৌথ পরিবার। জ্যাঠা জ্যেঠী কাকা কাকি দাদা দিদি ভর্তি। আমার বেশ মনে আছে আমাদের পেল্লায় একটা হাঁড়ি ছিলো ভাতের। মাঠে কাজ করতে আসা বা এদিক সেদিক সব মিলিয়ে জনা ত্রিশ জনের রান্না হতো। শুনতে ভালো বোধ হলে কি হয় খানিক বড় হয়ে টের পেয়েছি সে কি ঝঞ্ঝট এর জিনিস। তবে সে এক মস্ত ব্যাপার বাপস। ভাতের ফ্যান গালার জন্য একটা নির্দিষ্ট উঁচু জায়গা থাকত, দুজন মিলে ওই মস্ত হাঁড়িটা নিয়ে হেলিয়ে দিতো কি এক কায়দায়। তারপর একটা জাঁতাও ছিলো আর শিলনোড়াটা একটা ফিক্সড জায়গায় বসানো থাকত। না দুটো শিলনোড়া থাকত একটা আমিষ মানে পিঁয়াজ রসুন বাটা হবে একটা নিরামিষ পোস্তো ফোস্তোর জন্য। আর আমাদের জেলে একজন নির্দিষ্ট ছিলো, মানে সবারই থাকত কিনা জানিনা তবে আমাদের বামুন, নাপিত আর জেলে নির্দিষ্ট ছিলো। নাপিত মানে হরেনকাকা আসত আমাদের ন্যাড়া করে দিতে -_- । তবে মাছধরাটা একটা বিরাট ব্যাপার ছিলো। ভোরবেলা শংকর জেলে মানে আমার শংকর কাকা আসত, হাঁক দিতো, গ্রামের দিকে সকাল তাড়াতাড়ি হয়। লোকজন সব জড়ো হতো। তারপর সেই মাছ ভাগ বাটোয়ারা করে কেটে ধুয়ে প্রত্যেকের জন্য ঠিক করা.... সে এক যজ্ঞ্যি!! ওই সময় মা জ্যেঠিমাদের কাছে গেলে কপালে দুক্ষু থাকত। মাছ ফাছ তাই মোটেও রোজ ধরা হতো না। ওই বিশেষ দিনেই। বাকি কেনা। ছোটবয়েসে অত কিছু বুঝতাম না অবশ্য। বাড়ির ছোট ছিলাম, আমার বড় জ্যেঠু ছিলেন আমার দাদুর মতন, মানে আমার বড় জ্যেঠতুতো দিদি আমার মা এর বয়েসি ফলে আমার ঠাকুমা ঠাকুর্দার অভাব আমার বড় জ্যঠু যাঁকে বাবুজি বলতাম তিনি আর বড় জ্যেঠিমা মেটাতেন। আমি ইশকুলে ভর্তি হবার আগে আমার বড় জ্যেঠিমার কাছে দুপুরে গপ্পো শুনতে যেতাম। সব রূপকথা আর ভূত। জানলার বাইরে একটা আতা গাছ ছিলো, সারা বছরে একটা বা দুটো আতা হয়ত ফলত আর পাশেই ছিলো একটা জামরুল গাছ। কি মিষ্টি জামরুল ফলত। পিছনের পুকুর জাম গাছ জামরুল গাছ আর কি কি সব গাছ ছিলো আর ওইটেই ছিলো আমার কল্পনার রাজত্ব। ওই পুকুরটায় ডুব দিলেই আমি জানতাম সেইই পাতালপুরি পৌঁছব। রাজকন্যার থেকে ও বয়েসে তলোয়ার বেশী ইন্টারেস্টিং ছিলো।আমাদের পাড়া মানে আমাদের জ্ঞাতিরাই। সেইরকম সম্পর্কিত এক দাদা আমায় ধনুক বানিয়ে দিতো। এক কাকা আমায় গুলতি ছোঁড়া শিখিয়েছিলেন সে অবশ্য অনেক পরে, আরও বড় হয়ে। শীতকালের সকালে আর সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়ির সামনে সবাই আগুন পোহাতো। আমিও যেতাম। আর বাবুজি আমায় নিয়ে মটরশুঁটি ক্ষেতে নিয়ে যেত আমিও তছনছ করতাম সারা মাঠ দাপিয়ে বেরিয়ে। আর ফেরার সময় একটা বাপুজি কেক বরাদ্দ ছিলো ^_^। কার কোলে পিঠে চড়ে থাকতাম সারাক্ষন কে জানে তবে মাকে আমার খালি রাতেরবেলা ঘুমোতে যাবার সময় ছাড়া লাগতই না।
আমাদের দক্ষিনবাড়ির যে মাঠটা, ওই যে তারপর যে খালটা দেখা যায় ওপাড় টা কত কি যে হতো! আমার খাল পেরোনো মানা ছিলো একা একা নইলে আমি জানি ওখানে সাপের মাথার মণি ঠিক পাওয়া যাবে খুঁজলে। আর সেই যে মধুসূদন দাদার ভাঁড় সেও কি এখানে এত মেলা লোকের মধ্যে মিলবে নাকি। ওখানেই পাওয়া যাবে।
গুপী বাঘার ক্যাসেট বাজতো ছুটির দিন দুপুরে শুনতে শুনতে বা আনন্দমেলা কি অন্য কোনো বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়তাম বা জেগে থাকতাম।বিকেলবেলা ফুটবল ম্যাচ থাকত। রোদ না পড়লে বেরোনোর অনুমতি ছিলো না, মা এর নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে টের পেলে এক পা এক পা করে বেরোতে গেলেই মা উঠে পড়ত আর আমি বাথরুম যাচ্ছি বলতাম। ঝাঁ ঝাঁ দুপুরের প্রতি টান কি তখন থেকেই কি জানি। আমাদের টিউবওয়েল এর হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতাম, খিড়কির দরজা বন্ধ থাকত তাই পিছনের পুকুরের দিকে যেতে পারতাম না। কিন্তু আমাদের বাড়ির পিছোনে আর একটা দরজা ছিলো, গরু গুলো কে ওই রাস্তা দিয়ে বের করা হত তা সবাই আমায় গরু বলত বলেই বুঝি ওই দরজার প্রতি টান ছিলো, ওখান থেকে বেরিয়েই আমতলা, গরুগুলো ওখানে বাঁধা থাকতো, ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ফেলত। ওদের মধ্যে একটা একটু শিং নেড়ে তাড়া করত বাকি সবকটা শান্ত মনে জাবর কাটত। আমতলা পেরোলেই ইঁটপাঁজা, ওইখানে সাপের খোলস মিলত কিন্তু ওই ছায়া ছায় জায়গাটা আমার ভারী পছন্দ। ওইটে ছিলো আমার রাজপ্রাসাদ, আর খড়ের গাদাটা আমার দরবার। ভারি কুটকুটে আমার সিংহাসন কিন্তু সিংহাসন তো বটে।
রথের দিন আমাদের ঠাকুরের কাঠামো পূজো হত। তারপরেই সেই ম্যাজিক অপেক্ষা। রোজ রোজ ইশকুল যেতাম আর দেখতাম খড়ের ঠাকুরের গায়ের মাটি পড়লো, মুণ্ডু আলাদা করে হবে। দো মেটে হবে এবার। আকশের রঙ এর খেয়াল করিনি তবে মেঘ গুলো বেজায় ফূর্তি করতো। আমিও গাড়ি দাদা নিতে আসার আগে এক কলি হিন্দি গান গেয়ে নিতাম। আমাদের বাড়িতে হিন্দি গান গাওয়ার অর্থ ছিলো সে বখে গেছে। মেজদাদা জানলে তো হয়ে গেলো, স্কেল দিয়ে দেবে হাতের মধ্যে। হ্যাঁ মারধোর করার অনুমতি নিতে হতনা কারোর থেকে তবে মারলেই কাকা(আসলে জ্যাঠা আমি কেন জানিনা কাকা বলি) বা কাকি বা ফুলদিদি বা খুকুদিদি বা কেউ না কেউ এসে বকে দিতো আর মেজজ্যাঠা গুড়কাঠি কিনে দিত। গুড়কাঠি কি ভালো খেতে ^_^।
তারপর একদিন প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হতো। আমি ইশকুল থেকে ফেরার পর খেলতে যাওয়া ফেলে ঠাকুর গড়া আর প্যান্ডেল গড়া দেখতাম। তারপর চব্বিশ বাইশ করতে করতে মহালয়া চলে আসত। তারপর...
এই লেখাটা খুব ভালো লাগল, প্রদীপ্ত। তোমার ছোটবেলাটা দারুণ ইন্টারেস্টিং। এটা কোন জায়গার কথা জানতে চাইলে কি কিছু মনে করবে?
ReplyDeleteপুনশ্চঃ আমি অনেক কেক চেখে দেখেছি, বাপুজির মতো ভালো আর একটিও পাইনি।
থ্যানকু থ্যানকু। মনে করব কেনো এত আমাফ দেশের বাড়ি হাওড়া উদয়নারায়নপুর ^_^
Deleteবাপুজি হলো লোকনাথের কেক ভার্শন, রনে বনে জলে জংগলে আপিসে ট্রেনে যেখানেই ক্ষুধিত হইবে বাপুজির স্মরণ লইয়ো তিনি উদ্ধার করিবেন।
puro mone holo lila majumdarer goppo porchi. erom aktukro lekha hothat peye gele, apni akta hashi thnoter konae eshe basha bnedhe nyae baki dintar jonno. :)
ReplyDeleteলীলা মজুমদার এর গল্প মনে পড়ছে আমার লেখা পড়তে গিয়ে --এ বিশাল কমপ্লিমেন্ট তো !! অনেক ধন্যবাদ
DeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteআমি খুব আগ্রহী গ্রাম থেকে শহরে এসে স্কুলে ভর্তি হওয়ার গল্পটা জানতে। তবে তাঁর আগে, পুজোর আগের গল্পটা চটপট লিখে ফ্যালো। কলকাতা ফিরলে পুরনো সন্দেশ থেকে সলিল চট্টোপাধ্যায়ের লেখা পুজোর আগের গল্প নামে একটা দুর্দান্ত উপন্যাস পড়াব।
ReplyDeleteবেশ বেশ , শোনাবো আর পড়বো। থ্যাংকু সৌগতদা :)
Delete