আমার মাথার মধ্যে একটা পোকা আছে যেটা কিনা প্রায়ই নড়ে ওঠে। খাচ্ছি , অফিস যাচ্ছি , আড্ডা মারছি , বই পড়ছি সব , ওই , দিনকতক কোথাও না বেড়াতে গেলেই কিরকম অস্থির অস্থির লাগে। আমারপক্ষিরাজ মানে আমার পালসারটাও আস্তাবল মানেগ্যারাজে বন্দী থাকলেক্ষেপে যায়। আর কেউ টের না পাক আমি পাই। তাই কোনো এক শনিবার না রবিবার দুম করে বেরিয়ে পরেছিলাম। মানে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে সিদ্ধান্ত ঘুরতে যাব , তো চালাও পানসি বেলঘরিয়া।
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় অবধি ঠিক ছিলো গাদিয়াড়া যাব ,কিনতু হটাৎ করেইমত বদলে টাকি। টাকিতে লোকে পিকনিক করতে যায় বা ভাসান দেখতে। আমার কিনতু টাকি যাওয়ার এক এবং একমাত্র কারণ ছিল ইছামতি। এমন সুন্দর নামের একটা নদী তাকে না দেখে থাকা কি ঠিক! নদীর বুঝি অভিমান হয়না।
বাইক এ তেল ভরা নেই --দূর দেখা যাবে , রাস্তায় কি আর কিছু পাবোনা। ...এহে ক্যামেরাটাও তো আমার কাছে নেই ---তাতে কি চোখের লেন্সটা তো আছে রে বাবা। উফফ বয়স্ক লোকেদের মতো করিস না তো , চল তো ,যা হবে দেখা যাবে। কিছু খেয়ে বেরোতে বলেছিলেন বটে বাবা কিনতু আমি এমনিতেই যথেষ্ট দেরী করে ফেলেছি এরপর দেরী করলে রোদ উঠে যাবে। এয়ারপোর্ট এর জ্যাম কাটিয়ে মধ্যমগ্রাম পৌঁছলাম , স্পীড ৬০-৬৫ এর বেশি ওঠেনি তেমন। মধ্যমগ্রাম থেকে ডানদিকের বাদু যাবার রাস্তা ধরে এগোলাম, বারাসাত দিয়ে না গিয়ে। রাস্তা মোটামুটি যেমন খারাপ হয় তেমনই , ভালো হবে এমন আশাও ছিল না। রাস্তা চিনিনা , এদিক সেদিক জিগ্গেস করে এগোচ্ছিলাম। তা হটাৎ একটা রাস্তা বেশ ভালো লেগে গেল. চারিদিকে প্রচুর গাছপালা রাস্তাটার , আর বেশ মসৃনও বটে।কিনতু ইনটুশ্যন বলছে এ রাস্তা ভুল। তবু ওই রাস্তা ধরেই এগোলাম। কিছুদূর গিয়ে আমার অনুভূতি সত্যি করে রাস্তাটা ভুল প্রমানিত হলো। আমায় ঠিক প্রমান করলো মানে মারাত্মক ভাবে ঠিক প্রমান করলো। রাস্তা বলে আর কিছু নেই। একধারে ভেড়ি আর অন্যপাশে ইঁট পাঁজা। আর আমার চমত্কার মসৃন রাস্তা একটা মাটির রাস্তায় পরিনত হয়েছে। অত্যন্ত অসমান। প্রচুর ধূলো উড়ছে। ভেড়ি দেখে আমায় থামতেই হলো। জল দেখলেই আমি আরস্থির থাকতে পারি না। একজন লোক মাছ ধরছে। "ও কাকা কি মাছ ধরছ?" , বেশ একটা "কুবের হে মাছ কিবা" স্টাইল নিয়ে জিগ্গেস করলাম। লোকটা আমায় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উদাসীন হয়ে মাছ ধরতে লাগলো , কয়েকটা ছেড়ে দিলো। ভাগ্যিস আসে পাশে কেউ নেই , এই বলে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে আমি নিজের মনে ভেড়ির জল , মাছেদের লাফালাফি , পাখিদের ওড়া উড়ি ,পোড়া ইঁটের গন্ধ নাকে নিয়ে দেখতে লাগলাম। আহা বড্ড ভালো লাগছে। টাকি অবধি যাওয়ার কি খুব দরকার আছে. এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি না কেন।
হটাৎ লোকটার মনে হয় আমায় ন্যালাখ্যাপার মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মায়া হলো। আমার সাথে খানিক কথা বার্তা বললো। কথা থেকে আসছি কোথায় যাব। মানে সেই চিরন্তন বেসিক প্রশ্ন। আমি অবশ্য দার্শনিক জবাব দেওয়ার রিস্ক নিইনি , এ চত্বরে মেরে পুঁতে দিলে কেউ খবর পাবে না। যাইহোক সে চিংড়ি মাছ ধরছে সে খবর শোনার পর আমার চটকাটা ভেঙ্গে গেছিলো। আবার বাইক স্টার্ট করলাম। এহে বেজায় ধূলো। রাস্তা অতি খারাপ , আজ ফিরে পালসি কে চান করাতে হবে। এই সময় পুরো দুনিয়ার উপর রাগ হয়ে যায়। শালা বড্ড রোমান্টিসিজ্ম এর ভূত চেপেছিল না তোমার। নাও বোঝো এখন।
সাড়ে ১২টা পৌনে একটা নাগাদ পৌঁছলাম শেষমেষ।
আমার পালসি কে একধারে দাঁড় করিয়ে রেখে চক্কর কাটা শুরু করেছি, হটাৎ একটা ডাবওয়ালা কাম ভ্যানওয়ালা এসে আমায় খুব উত্সাহের সাথে জিগ্যেস করলো "কোথা থেকে আসছ , বর্ডার দেখতে যাবে? বাইক তো যাবে না -- তা কোনো ব্যাপার না। ক জন আছ তোমরা?"
-"আমি একা। "
- "একা তো ভাই একটু বেশি ভাড়া পরবে , তা তোমার থেকে বেশি নেব না তুমি আমায় ২০০ টাকা দিও। "
ধুস কোথায় ভাবলাম একাবোকা দেখে সাহায্য করতে এলো। বুঝলে হে সবই give এন্ড take . তাকে কাটিয়ে আমি এগোলাম খানিক। এদিক সেদিক জেনে বুঝলাম বাইক যায় বর্ডার কিংবা মিনিসুন্দরবন অবধি তবে আই -কার্ড লাগে , তা আমার তো ড্রাইভিং লাইসেন্স আছেই। মিনি সুন্দরবন আর কিছুই না কৃত্রিম ভাবে খানিকটা জায়গায় সুন্দরবন অঞ্চলের গাছপালা লাগানো হয়েছে। টাকির আসল রাজবাড়ি ভেঙ্গে গেছে আর একটা আছে তবে তা দেখতে আমি একটা উত্সাহী না। বস , বর্ডার মিনি সুন্দরবন সব হবে আমি আগে একটু ইছামতি দেখতে চাই. যার জন্যে আসা। গেলাম নদীর ধারটায়। ঘটে কেউ নেই , বসলাম। স্বপ্নের ইছামতির সাথে স্বাভাবিক ভাবেই মিললনা। না মিলুক। এই ইছামতি আলাদা থাকবে আর স্বপ্নেরটাও থাকবে। এক বুড়ো মাঝি দাঁড় বেয়ে চলেছে। খানিক আগেই শুনেছি , হাতেটানা নৌকো বন্ধ। চড়তে হলে ভটভটি চড়তে হবে , তাই দাঁড় টানা নৌকো দেখে খুব উত্সাহ নিয়ে ডাকলাম - "ও চাচাআআআ ,... নেবে একটু, একা আছি, কোনো ঝামেলা করব না। " কিনতু আবার সেই উদাসীনতা! আমাকে একটুও পাত্তা না দিয়ে বুড়ো মাঝি তার নৌকো নিয়ে চলে গেল। একটু নিলে কি এমন ক্ষতি হতো . দূর দূর। উঠে পড়লাম। যাই একটু মিনি সুন্দরবনই দেখে আসি। তার আগে এক কাপ চা পেলে মন্দ হয় না!
আমার মুখের মধ্যে মনে হয় একটা অজ্ঞানতার চাপ আছে। তাই আমায় বেশির ভাগ লোকেই জ্ঞান দিয়ে ওই অজ্ঞানতাটা মুছে দিতে চায়। এখানেও তার বিরূপ ঘটল না। চা দোকানি ভদ্রলোক বললেন - " কলকাতাআআ থেকে একা আসছ !এই বয়েসে বাইক চালাচ্ছ ! না না খুব রিস্কি , একা একা এতদূর আসা বাইক নিয়ে। " মনে মনে বললাম 'যতোটা ছোট ভাবছেন অতোটাও না , মেঘে মেঘে বেলা মন্দ হয়নি। ' মুখে বললাম " হ্যা কাকু এইতো চলে তো এলাম। "
- "কিসে পড় ?"
এটাও বাঁধা প্রশ্ন। ওই যে অজ্ঞানতার ছাপ তার ফল মনে হয়। একবার একজনকে মরিয়া হয়ে বলেছিলাম "পড়িনা , ক্লাস সেভেন পাস করে এদিক সেদিক হাতের কাজ করি। " চাকরি করি বললে উল্টোদিকের লোকজন হয় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মত করতে থাকে বা দর্জি হয়ে যায় , জুল জুল করে মাপতে থাকে , তাই আমি আজকাল আরবলিনা আমি কোনো এক বাতানুকূল অফিসের শ্রমিক , লোকে গালভরা নাম যাই দিয়ে থাক না কেন। বরং বলে দিই কিছু একটা যখন যেমন মনে আসে। বললাম "ফার্স্ট ইয়ার এ পড়ি। " মানুষটা খারাপ না , আমায় বললেন, " দেখো এদিক সেদিক ঘুরে। বর্ডার মিনি সুন্দরবন,ভটভটিতে চড়বে তো চড়ো। বনধুদের সাথে এলে আরো ভালো করতে।" একা এসেও যে আমি খারাপ করিনি সে কথা তাঁকে না বলে আমার পক্ষিরাজ কে বললাম "চল তোকে মিনিসুন্দরবন ঘুড়িয়ে আনি । সুন্দরবন তো মনে হয়না যাওয়া হবে তোকে নিয়ে। "
মিনিসুন্দরবন জায়গাটা ভালো। কৃত্রিম ভাবে তৈরী হলেও , ভারী চমত্কার জায়গা। সুন্দরী গাছ ,মাঝে মাঝে পাখিরা উড়ছে, ডাকাডাকি করছে। একটা জায়গায় ঝুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম খানিক। হাঁটাহাঁটি করতেও দিব্যি লাগছিল। স্থানীয় কিছু মহিলারা খেজুর গুড় , রস আর কি কি যেন সব বিক্রি করছিল। অনেকবার ধরে ডাকাডাকি করার পর দাঁড়িয়ে পরে বললাম " না গো দিদি , আমি খেজুর রস খাইনা , আর এখন এই চড়া রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে খেজুর গুড় খাওয়ার ইচ্ছাও নেই (এটা অবশ্য মনে মনে বলেছি )।"
-"নিয়ে যাও খেজুর গুড় বাড়ির জন্য।"
তাতেও আমি ঘাড় নেড়ে উদাস গলায় বললাম নাহ। কি জানি কেন আমি কিছু না নিলেও তার আমাকে বেশ পছন্দ হয়েছিলো , হতে পারে আমি তার গুড়ের খাঁটিত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলিনি বলে কিংবা আমায় দেখে তার যাদবপুর পড়তে যাওয়া ভাই এর কথা পরে গেছিল সেই জন্যে।
-"গুড় তুমি বানিয়েছ দিদি?"
-"নাহ তোমার জামাইবাবু , ও এইসব বানায় আমি খালি বিক্রি করি। "
-"কখনও বাংলাদেশ গেছো ?"
- নাহ আমাদের কেউ তো ওখানে নেই খামোখা যাব কেন। "
তার সাথে আরও খানিক গল্প হলো। তার ভাই যাদবপুরে পড়ে। সবসময় তো লোক আসে না , এইবার গরম পরে গেছে আর রসও হবে না লোকও হবে না। আমায় বললো "মুখটা তো শুকিয়ে গেছে একেবারে, খাওয়া দাওয়া করেছ কিছু? চট করে মিথ্যে আমি বলতে পারিনা , বিশেষ করে এমন মায়া নিয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে মিথ্যে আদৌ বলা যায় কিনা আমি জানিনা , তাই সত্যিটাই বললাম , এখানে তো খাওয়ার দোকান তেমন নেই , ফেরার পথে খেয়ে নেবো কিছু। বললো " চলো আমাদের বাড়ি কাছেই , ওখানে যাহোক দুটো মুখে দেবে।" সামান্য একটা জিনিসও কিনিনি আমি তার থেকে , তবু কে ভাবতে পেরেছিলো এমন অচেনা একজন মানুষ তার মায়ার আঁচল বিছিয়ে দেবে। আমি আমার জীবনে এরকম কত মানুষের কাছে যে ঋণী আমি জানি না। একবার কলেজে পড়ি তখন। প্রচন্ড এক গরমের দুপুরে কলেজ এর ক্লাস না করে মাঠে মাঠে ঘুরতে বেড়িয়ে ছিলাম। রাস্তা ভুল করে তেষ্টায় যখন ধুঁকছি , আমাদের হোস্টেল এ কাজ করতো এমন একজন আমায় ডেকে তার বাড়ি নিয়ে নিয়ে ঝকঝকে ঘটি ভরে ঠান্ডা জল দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে খেতে নিষেধ করেছিল , এবং জলের সঙ্গে খানকতক বাতাসা দিয়েছিল , শুধু জল খেতে নেই। আমি এদের ভালবাসা কক্ষনো ফিরিয়ে দিতে যাইনি কারণ আমার সে ক্ষমতা কোথায়। খালি বুকের মধ্যে যখন অনেকটা ফাঁক হয়ে যায় , বেড়িয়ে পরি আমি জানি পথে ঘাটে সে ফাঁক বুজিয়ে দেওয়ার লোক আছে। (ক্রমশ)
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় অবধি ঠিক ছিলো গাদিয়াড়া যাব ,কিনতু হটাৎ করেইমত বদলে টাকি। টাকিতে লোকে পিকনিক করতে যায় বা ভাসান দেখতে। আমার কিনতু টাকি যাওয়ার এক এবং একমাত্র কারণ ছিল ইছামতি। এমন সুন্দর নামের একটা নদী তাকে না দেখে থাকা কি ঠিক! নদীর বুঝি অভিমান হয়না।
বাইক এ তেল ভরা নেই --দূর দেখা যাবে , রাস্তায় কি আর কিছু পাবোনা। ...এহে ক্যামেরাটাও তো আমার কাছে নেই ---তাতে কি চোখের লেন্সটা তো আছে রে বাবা। উফফ বয়স্ক লোকেদের মতো করিস না তো , চল তো ,যা হবে দেখা যাবে। কিছু খেয়ে বেরোতে বলেছিলেন বটে বাবা কিনতু আমি এমনিতেই যথেষ্ট দেরী করে ফেলেছি এরপর দেরী করলে রোদ উঠে যাবে। এয়ারপোর্ট এর জ্যাম কাটিয়ে মধ্যমগ্রাম পৌঁছলাম , স্পীড ৬০-৬৫ এর বেশি ওঠেনি তেমন। মধ্যমগ্রাম থেকে ডানদিকের বাদু যাবার রাস্তা ধরে এগোলাম, বারাসাত দিয়ে না গিয়ে। রাস্তা মোটামুটি যেমন খারাপ হয় তেমনই , ভালো হবে এমন আশাও ছিল না। রাস্তা চিনিনা , এদিক সেদিক জিগ্গেস করে এগোচ্ছিলাম। তা হটাৎ একটা রাস্তা বেশ ভালো লেগে গেল. চারিদিকে প্রচুর গাছপালা রাস্তাটার , আর বেশ মসৃনও বটে।কিনতু ইনটুশ্যন বলছে এ রাস্তা ভুল। তবু ওই রাস্তা ধরেই এগোলাম। কিছুদূর গিয়ে আমার অনুভূতি সত্যি করে রাস্তাটা ভুল প্রমানিত হলো। আমায় ঠিক প্রমান করলো মানে মারাত্মক ভাবে ঠিক প্রমান করলো। রাস্তা বলে আর কিছু নেই। একধারে ভেড়ি আর অন্যপাশে ইঁট পাঁজা। আর আমার চমত্কার মসৃন রাস্তা একটা মাটির রাস্তায় পরিনত হয়েছে। অত্যন্ত অসমান। প্রচুর ধূলো উড়ছে। ভেড়ি দেখে আমায় থামতেই হলো। জল দেখলেই আমি আরস্থির থাকতে পারি না। একজন লোক মাছ ধরছে। "ও কাকা কি মাছ ধরছ?" , বেশ একটা "কুবের হে মাছ কিবা" স্টাইল নিয়ে জিগ্গেস করলাম। লোকটা আমায় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উদাসীন হয়ে মাছ ধরতে লাগলো , কয়েকটা ছেড়ে দিলো। ভাগ্যিস আসে পাশে কেউ নেই , এই বলে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে আমি নিজের মনে ভেড়ির জল , মাছেদের লাফালাফি , পাখিদের ওড়া উড়ি ,পোড়া ইঁটের গন্ধ নাকে নিয়ে দেখতে লাগলাম। আহা বড্ড ভালো লাগছে। টাকি অবধি যাওয়ার কি খুব দরকার আছে. এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি না কেন।
হটাৎ লোকটার মনে হয় আমায় ন্যালাখ্যাপার মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মায়া হলো। আমার সাথে খানিক কথা বার্তা বললো। কথা থেকে আসছি কোথায় যাব। মানে সেই চিরন্তন বেসিক প্রশ্ন। আমি অবশ্য দার্শনিক জবাব দেওয়ার রিস্ক নিইনি , এ চত্বরে মেরে পুঁতে দিলে কেউ খবর পাবে না। যাইহোক সে চিংড়ি মাছ ধরছে সে খবর শোনার পর আমার চটকাটা ভেঙ্গে গেছিলো। আবার বাইক স্টার্ট করলাম। এহে বেজায় ধূলো। রাস্তা অতি খারাপ , আজ ফিরে পালসি কে চান করাতে হবে। এই সময় পুরো দুনিয়ার উপর রাগ হয়ে যায়। শালা বড্ড রোমান্টিসিজ্ম এর ভূত চেপেছিল না তোমার। নাও বোঝো এখন।
সাড়ে ১২টা পৌনে একটা নাগাদ পৌঁছলাম শেষমেষ।
আমার পালসি কে একধারে দাঁড় করিয়ে রেখে চক্কর কাটা শুরু করেছি, হটাৎ একটা ডাবওয়ালা কাম ভ্যানওয়ালা এসে আমায় খুব উত্সাহের সাথে জিগ্যেস করলো "কোথা থেকে আসছ , বর্ডার দেখতে যাবে? বাইক তো যাবে না -- তা কোনো ব্যাপার না। ক জন আছ তোমরা?"
-"আমি একা। "
- "একা তো ভাই একটু বেশি ভাড়া পরবে , তা তোমার থেকে বেশি নেব না তুমি আমায় ২০০ টাকা দিও। "
ধুস কোথায় ভাবলাম একাবোকা দেখে সাহায্য করতে এলো। বুঝলে হে সবই give এন্ড take . তাকে কাটিয়ে আমি এগোলাম খানিক। এদিক সেদিক জেনে বুঝলাম বাইক যায় বর্ডার কিংবা মিনিসুন্দরবন অবধি তবে আই -কার্ড লাগে , তা আমার তো ড্রাইভিং লাইসেন্স আছেই। মিনি সুন্দরবন আর কিছুই না কৃত্রিম ভাবে খানিকটা জায়গায় সুন্দরবন অঞ্চলের গাছপালা লাগানো হয়েছে। টাকির আসল রাজবাড়ি ভেঙ্গে গেছে আর একটা আছে তবে তা দেখতে আমি একটা উত্সাহী না। বস , বর্ডার মিনি সুন্দরবন সব হবে আমি আগে একটু ইছামতি দেখতে চাই. যার জন্যে আসা। গেলাম নদীর ধারটায়। ঘটে কেউ নেই , বসলাম। স্বপ্নের ইছামতির সাথে স্বাভাবিক ভাবেই মিললনা। না মিলুক। এই ইছামতি আলাদা থাকবে আর স্বপ্নেরটাও থাকবে। এক বুড়ো মাঝি দাঁড় বেয়ে চলেছে। খানিক আগেই শুনেছি , হাতেটানা নৌকো বন্ধ। চড়তে হলে ভটভটি চড়তে হবে , তাই দাঁড় টানা নৌকো দেখে খুব উত্সাহ নিয়ে ডাকলাম - "ও চাচাআআআ ,... নেবে একটু, একা আছি, কোনো ঝামেলা করব না। " কিনতু আবার সেই উদাসীনতা! আমাকে একটুও পাত্তা না দিয়ে বুড়ো মাঝি তার নৌকো নিয়ে চলে গেল। একটু নিলে কি এমন ক্ষতি হতো . দূর দূর। উঠে পড়লাম। যাই একটু মিনি সুন্দরবনই দেখে আসি। তার আগে এক কাপ চা পেলে মন্দ হয় না!
আমার মুখের মধ্যে মনে হয় একটা অজ্ঞানতার চাপ আছে। তাই আমায় বেশির ভাগ লোকেই জ্ঞান দিয়ে ওই অজ্ঞানতাটা মুছে দিতে চায়। এখানেও তার বিরূপ ঘটল না। চা দোকানি ভদ্রলোক বললেন - " কলকাতাআআ থেকে একা আসছ !এই বয়েসে বাইক চালাচ্ছ ! না না খুব রিস্কি , একা একা এতদূর আসা বাইক নিয়ে। " মনে মনে বললাম 'যতোটা ছোট ভাবছেন অতোটাও না , মেঘে মেঘে বেলা মন্দ হয়নি। ' মুখে বললাম " হ্যা কাকু এইতো চলে তো এলাম। "
- "কিসে পড় ?"
এটাও বাঁধা প্রশ্ন। ওই যে অজ্ঞানতার ছাপ তার ফল মনে হয়। একবার একজনকে মরিয়া হয়ে বলেছিলাম "পড়িনা , ক্লাস সেভেন পাস করে এদিক সেদিক হাতের কাজ করি। " চাকরি করি বললে উল্টোদিকের লোকজন হয় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মত করতে থাকে বা দর্জি হয়ে যায় , জুল জুল করে মাপতে থাকে , তাই আমি আজকাল আরবলিনা আমি কোনো এক বাতানুকূল অফিসের শ্রমিক , লোকে গালভরা নাম যাই দিয়ে থাক না কেন। বরং বলে দিই কিছু একটা যখন যেমন মনে আসে। বললাম "ফার্স্ট ইয়ার এ পড়ি। " মানুষটা খারাপ না , আমায় বললেন, " দেখো এদিক সেদিক ঘুরে। বর্ডার মিনি সুন্দরবন,ভটভটিতে চড়বে তো চড়ো। বনধুদের সাথে এলে আরো ভালো করতে।" একা এসেও যে আমি খারাপ করিনি সে কথা তাঁকে না বলে আমার পক্ষিরাজ কে বললাম "চল তোকে মিনিসুন্দরবন ঘুড়িয়ে আনি । সুন্দরবন তো মনে হয়না যাওয়া হবে তোকে নিয়ে। "
মিনিসুন্দরবন জায়গাটা ভালো। কৃত্রিম ভাবে তৈরী হলেও , ভারী চমত্কার জায়গা। সুন্দরী গাছ ,মাঝে মাঝে পাখিরা উড়ছে, ডাকাডাকি করছে। একটা জায়গায় ঝুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম খানিক। হাঁটাহাঁটি করতেও দিব্যি লাগছিল। স্থানীয় কিছু মহিলারা খেজুর গুড় , রস আর কি কি যেন সব বিক্রি করছিল। অনেকবার ধরে ডাকাডাকি করার পর দাঁড়িয়ে পরে বললাম " না গো দিদি , আমি খেজুর রস খাইনা , আর এখন এই চড়া রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে খেজুর গুড় খাওয়ার ইচ্ছাও নেই (এটা অবশ্য মনে মনে বলেছি )।"
-"নিয়ে যাও খেজুর গুড় বাড়ির জন্য।"
তাতেও আমি ঘাড় নেড়ে উদাস গলায় বললাম নাহ। কি জানি কেন আমি কিছু না নিলেও তার আমাকে বেশ পছন্দ হয়েছিলো , হতে পারে আমি তার গুড়ের খাঁটিত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলিনি বলে কিংবা আমায় দেখে তার যাদবপুর পড়তে যাওয়া ভাই এর কথা পরে গেছিল সেই জন্যে।
-"গুড় তুমি বানিয়েছ দিদি?"
-"নাহ তোমার জামাইবাবু , ও এইসব বানায় আমি খালি বিক্রি করি। "
-"কখনও বাংলাদেশ গেছো ?"
- নাহ আমাদের কেউ তো ওখানে নেই খামোখা যাব কেন। "
তার সাথে আরও খানিক গল্প হলো। তার ভাই যাদবপুরে পড়ে। সবসময় তো লোক আসে না , এইবার গরম পরে গেছে আর রসও হবে না লোকও হবে না। আমায় বললো "মুখটা তো শুকিয়ে গেছে একেবারে, খাওয়া দাওয়া করেছ কিছু? চট করে মিথ্যে আমি বলতে পারিনা , বিশেষ করে এমন মায়া নিয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে মিথ্যে আদৌ বলা যায় কিনা আমি জানিনা , তাই সত্যিটাই বললাম , এখানে তো খাওয়ার দোকান তেমন নেই , ফেরার পথে খেয়ে নেবো কিছু। বললো " চলো আমাদের বাড়ি কাছেই , ওখানে যাহোক দুটো মুখে দেবে।" সামান্য একটা জিনিসও কিনিনি আমি তার থেকে , তবু কে ভাবতে পেরেছিলো এমন অচেনা একজন মানুষ তার মায়ার আঁচল বিছিয়ে দেবে। আমি আমার জীবনে এরকম কত মানুষের কাছে যে ঋণী আমি জানি না। একবার কলেজে পড়ি তখন। প্রচন্ড এক গরমের দুপুরে কলেজ এর ক্লাস না করে মাঠে মাঠে ঘুরতে বেড়িয়ে ছিলাম। রাস্তা ভুল করে তেষ্টায় যখন ধুঁকছি , আমাদের হোস্টেল এ কাজ করতো এমন একজন আমায় ডেকে তার বাড়ি নিয়ে নিয়ে ঝকঝকে ঘটি ভরে ঠান্ডা জল দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে খেতে নিষেধ করেছিল , এবং জলের সঙ্গে খানকতক বাতাসা দিয়েছিল , শুধু জল খেতে নেই। আমি এদের ভালবাসা কক্ষনো ফিরিয়ে দিতে যাইনি কারণ আমার সে ক্ষমতা কোথায়। খালি বুকের মধ্যে যখন অনেকটা ফাঁক হয়ে যায় , বেড়িয়ে পরি আমি জানি পথে ঘাটে সে ফাঁক বুজিয়ে দেওয়ার লোক আছে। (ক্রমশ)
খুব ভালো লাগল, প্রদীপ্ত। আবার দুঃখও হল একটু একটু। আমি নিজে কখনও এরকম বেড়াতে যেতে পারব না বলে। তুমি সাড়াজীবন এরকমই থাক এই কামনা করি।
ReplyDeleteথ্যাঙ্কু কুন্তলাদি :) । আহা দুঃখ পেওনা , সবাই বাউন্ডুলে হয়ে গেলে জল বাতাসা দেবে কে :)
DeleteJak Taki Bhromon lekhata holo sesh porjonto! Amio Ei Pradipta k chini Aar Ei Pradipta k dekhte chai! Khub sundor hoyeche lekhata!
ReplyDeleteথ্যাঙ্কউ অর্নবদা :)
Delete