Monday, May 19, 2025

ইওরোপে কটাদিন(ভিয়েনা পর্ব ১)

আমি যখন ভিয়েনা আসছি, ময়ূরাক্ষী তখন ব্রাতিস্লাভা ঘুরে  ভিয়েনা আসছে। কোলকাতা থেকে আসানসোল যাবার সময়ে আরেকটা দেশে চলে যাওয়া যায়। সকাল সকাল প্রাত:রাশ করে বেরোনো গেল। হরেকরকম পাঁউরুটি খেয়েছি বটে কিছু! আমাদের যেমন নানান রকম কচুরি, লুচি, রাধাবল্লবী, সিঙারা,নিমকি, ডালপুরী...এদের জ্যাম ভরা,  মাংসের পুর ভরা, চিজ দেওয়া, টমেটো দেওয়া তারপর বেক করা। প্রচুর মাখন, ময়দা, সোডিয়াম কিন্তু কত্তা খেতে ভালো জিনিস সব পুষ্টিতে  মন্দ আর সস্তাই হয়। আপাতত খেয়ে নিই, আরো বুড়ো হলে তো ত্যাগ দিতেই হবে। সুদীপ মৌসুমী খুব ভালো ভালো স্বাস্থ্যকর খাবার অফার করছিল খেজুর কলা, ওটস দুধ দিয়ে স্মুদি, দই ইত্যাদি। আগেকার দিনে কায়েতকে বামুন প্রনাম করবে বললে যেমন সরে যেত অমন করে সরে যাই। 


ইওরোপের ইতিহাস কিচ্ছু জানা নেই? এদিকে ঘুরতে চলে এসেছেন? আপনার রেডিমেড ছাত্রবন্ধু হল ওয়াকিং ট্যুর।  নানান রকম ওয়াকিং ট্যুর হয়, বেশীরভাগই ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর। ফ্রি মানে আগাম বুকিং করার ব্যপার নেই, নির্দিষ্ট টাকা দেবার ব্যপার নেই। শোনো,  ঘোরো, যেমন খুশী তেমন দাও৷ যেমন খুশীরও একটা মিনিমাম হয়। তো আমরা ইউকেতে স্যান্ডিম্যানের ওয়াকিং ট্যুরটা করে বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম বেশ, এবারেও তাই ওদের ট্যুরই বুক করা হয়েছিল।এই সব ওয়াকিং ট্যুর গুলোর গাইড সাধারণতঃ উইটি হয় বেশ সাথে ইতিহাস জানতে জানতে শহর দেখা যায়। সেটা না হলে সত্যি বলতে চারটে শুকনো বিল্ডিং দেখলে, "বাহ কি সুন্দর" এর বেশী আর কি হবে! রাজার নাম মনে রাখার দরকার নেই, কিন্তু প্লেগ থেকে বাঁচতে ঘড়িতে এঞ্জেল এর মূর্তি লাগানোর গল্পটা কিংবা  কোন বিল্ডিং এ বারান্দা না থাকায় উল্টোদিকের বিল্ডিং এর পর্দা টাঙিয়ে রাখার নিদান হয়েছিল এসব কিচ্ছুই জানা যায়না। সত্যি মিথ্যে মিলিয়ে হয়ত সেসব গল্প হয়, কিন্তু কোনটা যে আসল সত্যি এদ্দিন পর ঝুড়ি উলটে প্রমান করার বদলে গল্প শুনে নতুন শহর দেখা ঢের বেশী আকর্ষনীয়।ইহুদিদের অত্যাচারের গল্প অবশ্য ঠিক আকর্ষণীয় বলা যায় না, কিন্তু তাও জানতে হয় শুনতে হয় মনেও রাখতে হয়। সেরকম দিন আবার আসতে চলেছে হয়ত! আমাদের এবারের গাইড  বাই বার্থ জার্মান তবে চলে এসেছেন শিশু বয়সেই। ভদ্রলোকের কাছাকাছি ঘোরা একটু মুশকিল কারন তাহলে ছাতা নিয়ে দাঁড়াতে হয়, মানে কথা বললেই থুথুবৃষ্টি। এদিকে বয়স হয়েছে তাই খুব চেল্লামিল্লিও করতে পারছেন না। ছাতা ফুটিয়ে তো আর দাঁড়ানো যায়না, সকলেই পিছলে পিছলে সরে যাচ্ছে আর উনি ডাকাডাকি করছেন! অস্ট্রিয়ায় যুদ্ধ টুদ্ধ ভালোই হয়েছে, ওয়্যার ভার্সেস ফ্যাসিজম নিয়ে স্ট্যাচু ইত্যাদিও আছে কিন্তু সেসবের থেকে হাবসবুর্গ সাম্রাজ্য যারা কিনা প্রায় ছশো বছর মতো রাজত্ব করেছিল, তাদের প্রথম রাজা হওয়ার গল্পটা বেশ। মোটের উপর গল্পটা এরকম, একজন রাজা রাজত্ব করছিল, ভালোই করছিল, লোকজনও খুশী। কিন্তু সে যার সামন্ত রাজা ছিল (বা অন্য কোনো প্রভাবশালী)  সে ভাবলো এ তো মুশকিল, একে প্রজারা এত পছন্দ করলে আমার চলবে কীভাবে। নতুন রাজা লাও। লাও তো বটে পায় কোথায়? তা এই হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের পত্তনকারী সে সময় হেঁটে হেঁটে আসছিল কোথা থেকে। তাকে দেখে সেই প্রভাবশালী বলে বেশ এইই হবে রাজা। ডান। ছশো সাতশো বছরের ইতিহাস লেখা শুরু হয়ে গেল! আশ্চর্য এখানেই না,  যে রাজা রাজত্ব করছিল সে কী আর ছেড়ে দেবে? সে চলল যুদ্ধে। কঅপাল বটে এই নতুন রাজার,  সে যখন ঘোড়া থেকে পড়ে যায়, কেউ একজন ওই যুদ্ধক্ষেত্রেও তাকে রক্ষা করে সে সময়, তুলে ফের ঘোড়ায় বসিয়ে দেয়, নাহলে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে খুব একটা কেউ বাঁচে না। শালা এরকম কপাল তো আমার হলে পারতো। অফিস যাচ্ছি, ফস করে কেউ বলল, এই অফিস যাওয়া চলবে না, তুমি স্রেফ দেশ দেখে বেড়াবে! 


ইওরোপের স্থাপত্য চমৎকার,  তেমনি সুন্দর ভাবে এরা মেইন্টেইনও করেছে। কিছু গল্প শুনছিলাম,  কিছু নয়। অত মন দিয়ে স্কুল কলেজ আপিসই করিনি/করিনা! আমার ভালো লাগছিলো চমৎকার নীল আকাশের নীচে একঝাঁক ভীনদেশী লোকের সাথে ঘুরে ঘুরে সম্পূর্ণ অজানা সব রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে। মাঝে মাঝে শুনছিলাম মেরি থেরেসার কথা, এই হাবসবুর্গের খুব বিখ্যাত রানী। প্রচুর বাচ্ছার জন্ম দিতেন, আর তাদের বিয়ে দিয়ে দিয়ে রাজত্ব মজবুত করতেন। এই একলাইন লিখলে আসলে সঠিক বলা হয়না ভদ্রমহিলার সম্পর্কে।  ভদ্রমহিলা অসম্ভব ভালো কূটনীতিক ছিলেন। এর আগে কেউ মহিলা শাসক হয়নি, বাপ বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে সবার থেকে চুক্তি করে রেখেছিলেন, অবশ্যই মোটা অর্থের বিনিময়ে,  যেন সে মরলে তার মেয়েই রাজত্ব পায়। এবং রাজা মরে যাবার পরেই সবাই সেই চুক্তি ভুলে গেল। আরে ফাঁকা রাজ্য ফাঁকা রাজ্য চল দখল করি বলে ফ্রান্স, প্রুশিয়া, বাভারিয়া সব দেশ নেচে নেচে এসেছে।  সাত বছর ধরে মহিলা যুদ্ধ করেছেন, রাজত্বের  বেশীরভাগ অংশ রক্ষা করেছেন, দেশের জন্যেও কিছু কাজ করেছেন এবিং অবশ্যই মস্তিতে জীবন কাটিয়েছেন। ওদিকে এদের আজ পঞ্চাশ বছরের কীসের যেন সেলিব্রেশন আছে। প্যারেড করে করে সেনার দল হাইফাই বাসে করে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যুধাস্ত্র বিদেশের অনেক ভালো আছে, কিন্তু খট করে চোখে লাগে যেটা সেটা হল এদের বাসটা। ভারী চমৎকার আধুনিক শীততাপনিয়নন্ত্রিত।  দুদিকে মুখ করে বসে আমাদের সেনাদের যেতে তো দেখাই যায়। যেদিন দেশে ফিরি, অপারেশন সিন্দুর এর শুরু ছিল। দিল্লী এয়ারপোর্টে  সাজো সাজো রব। প্রচুর সেনা, তাদের রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে জম্মুতে কিন্তু ফ্লাইট সব ক্যান্সেল। হয়তো বাসে যাবে,  জানিনা সঠিক। কিন্তু  এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আমাদের মতোই ইন্টার টার্মিনাল বাসে গাদাগাদি করে চলল, ইউনুফর্ম পরেই। 


অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত খাবার হল, স্নেটজেল, অ্যাপেল স্ট্রুডেল আর সাখেটর্টে।  প্রথমটি হল চিকেন কাটলেট টাইপ। তবে আসল স্নেটজেল কচি বাছুরের মাংসের হয়। অ্যাপেল স্ট্রুডেল হল আপেল স্ট্রুডেল হল আপেলের পুর দিয়ে বেক করা জিনিস। আর সাখেটর্টে হল চকলেট স্পঞ্জ কেক যার ভিতরের লেয়ারে অ্যাপ্রিকট জ্যাম থাকে। টর্টে মানে জার্মান ভাষায় কেক। স্পঞ্জকেক আমরা খাইনি খুব বিখ্যাত জিনিস হলেও। কিন্তু এর জন্যে দীর্ঘদিন আইনি লড়াইও হয়েছে। শেষে এক হোটেল বিক্রি করার অধিকার পেয়েছে, অরিজিনাল সাখেটর্টে আর এক হোটেল সম্ভবতঃ বেস্ট সাখেটর্টে বলে বিক্রি করে! খুব জয় লাভ হয়েছে! অ্যাপেল স্ট্রুডেল আমাদের অতটা ভালো লাগেনি, হয়তো প্রপার দোকান পাইনি, কিন্তু খুব একেবারে আহামরি কিছু না। আর স্নেটজেল আমাদের সুদীপ মৌসুমী বানিয়ে খাইয়েছে। কিসের মাংসের তা জানিনা। গরু ছাগল শুয়োর মুরগী এর মধ্যে কিছু হবে, এর মধ্যে কিছু না হতেও পারে। আমাদের কিছু যায় আসেনা। গাইড আমাদের ওই সাখেটর্টে নিয়ে খুব গল্প শোনালো। একদম শেষে যখন আমরা সেইন্ট স্টিফেন গীর্জার সামনে এক ভারতীয় ছাত্রীর সাথে আলাপ হল। সুইজারল্যান্ডে পড়াশোনা করে, কলেজের আরেক ছাত্রী সম্ভবতঃ চীনা, দুজনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জায়গাটা ভিয়েনার একদম সেন্টারেই বলা যায়, রবিবারের বাজার, নারী পুরুষ রেস্তোরাঁয় বসে নিজের মতো করে খাচ্ছে,  পান করছে, গল্প করছে। একটা জায়গায় গেলাম,  একটা মার্কেট।  স্থানীয় মার্কেট দেখতে বেশ লাগে। অবশ্য বন্ধ ছিল আজ রবিবার বলে। তাও দু চারটি দোকান খোলাই ছিল। এক ভদ্রলোক খুব পরিচ্ছন্ন জামা টামা পরে অ্যাকর্ডিয়ান বাজাচ্ছেন, আর টুপিতে টাকা তুলছেন আরেকজন,  সেও খুব ফিটবাবুটি। আশেপাশে রেস্তোরাঁ গুলো দামী। তাতে বাইরের চেয়ার টেবিলে সুবেশী নারী পুরুষ খাবার, পানীয় নিয়ে বসে। চমৎকার রোদ,  ঝকঝকে আকাশ। একা বা দোকা মহিলা একটা ওয়াইন গ্লাস নিয়ে আয়েস করে বসে আছে কোথাও। 

যাতায়াত ভিয়েনাতে ভয়ানক সুবিধেজনক। ওই যে কাল আমরা ৭২ ঘন্টার পাস কিনে নিয়েছি, ওতেই ট্রাম, বাস,  মেট্রো বদলে বদলে জায়গায় জায়গায় চলে যাচ্ছি। আর প্রায় প্রতি গলি, রাস্তা সবেতে বাস ট্রাম। তিন চার মিনিট অন্তর বাস বা ট্রাম আসবে, ডিস্প্লে বোর্ডের দেখানো সময়েই আসবে। ম্যাক্সিমাম এক দুই মিনিট দেরী। আমাদের মধ্যে যে নিয়ম ভাঙার প্রবনতা আছে এদের ঠিক উল্টোটা। রাস্তা ফাঁকা, কিন্তু সিগ্ন্যাল না হলে সচরাচর কেউ রাস্তা পার হয়না, এ ওর লেনে ঢুকে যাওয়া তো নেই ফলে জ্যাম জটও হয়না। লোকজন কম বলে অবশ্যই সুবিধে আছে, কিন্তু একই সাথে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট খুব বেশী হওয়ায় রাস্তায় গাড়ির চাপও কম। রাত সাড়ে নটায় লাস্ট মেট্রো, বা একটা জায়গায় যাবার জন্যে একটাই বাস, তাও চল্লিশ মিনিট ছাড়া এমনটা নয়। 
এখানের পার্ক গুলো হয় চমৎকার। অনেক বড় বড়, পরিষ্কার ঘাস, গাছপালায় ভর্তি।  কেউ রীল বানাচ্ছেনা,  কেউ চিপ্সের প্যাকেট, চায়ের কাপ, কিংবা থার্মোকলের প্লেট ফেলে নোংরা করে চলে যাচ্ছেনা৷ দুজন ঘুরতে ঘুরতে একটা পার্কে ঢুকে মোলায়েম ঘাসে শুয়ে পড়ি। আশেপাশে প্রচুর মহিলা পুরুষ নিজের মতো শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। অনেকে দল বেঁধে এসেছে, তারা গল্প আড্ডা মারছে। মৌমাছির গুঞ্জনের মতো আওয়াজ আসছে তাদের থেকে তার বেশী জোরে না। এদেশে তুর্কী অনেক বেশী হয়েছে আজকাল। দেখলে চেনা যায়। তারা আসে পরিপাটি  গুছিয়ে খাবার নিয়ে, অনেক রকম বাক্স নিয়ে।  



শুধু হাওয়া খেলে তো পেট ভরে না কত্তা। খানা পিনা লাগে। মানছি, বেশ কটা ক্রোঁসা,  ইত্যাদি খেয়েছি কিন্তু হেঁটেও চলেছি কত সেইটাও তো দেখতে হবে। সুদীপদের সাথে প্ল্যান করাই ছিল, গুরুদ্বারাতে খেতে যাব। বিদেশে ফ্রিতে খাবার এই আদর্শ জায়গা। পরিচ্ছন্ন, এবং আনলিমিটেড। ।  আমার জন্যে একটু অসুবিধের, খাবার দাবার নিরামিষ। তবে বেড়াতে বেরোলে সব ঠিক আছে। তাছাড়া আজ রবিবার নাকি জিলিপি দেয়। 'স্রেফ কাঁকড়া খেয়ে থুড়ি জিলিপি খেয়েই কাটিয়ে দেব ' না হয়। মাথায় ফেট্টি বেঁধে পেট পুরে খাবার দাবার খেয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসেছি। এক বুড়ি,  এক মনে বোর্ডে লেখা বাসের নাম্বার দেখছিল, দেখে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। এখানের বুড়োবুড়িরা বেশ আত্মনির্ভরশীল।  আমাদের দেশেও অনেক বুড়ো বুড়ি তাই বটে, তবে বেশীরভাগ যেন দায়ে পড়ে করেন। এরাও দায়ে পড়ে করেন কিনা জানিনা, তবে মুখে চোখে কোনো ক্লিষ্টতা নেই। রাস্তাঘাটে পার্কে দেখলাম প্রচুর বুড়োবুড়ি আমার চেয়েও বেশী ফিট, দৌড়ে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ নাতি নাতনীদের সাইকেলে ঝুড়িতে বসিয়ে বেড়াচ্ছে। 

একটা জায়গা আছে এখানে,  স্থানীয় লোকেই বেশী যায়। সুদীপ-মৌসুমীদের কল্যানে আমাদেরও যাওয়া হল। বিশাল ইতিহাস সমৃদ্ধ জায়গা না। এমনিই পার্ক গোছের, সাথে ছোট মতো চিড়িয়াখানা।  তাতে নানান পেঁচা, রঙ বেরঙের পাখি থেকে বিচিত্র দর্শন সাপ, ব্যাঙ, ওদেশীয় কাঠবিড়ালি রাখা আছে। কোনো দেশ ঘুরতে গেলে তার প্রাকৃতিক পরিবেশ, স্থাপত্য এসব ছাড়াও মানুষ না দেখলে ঠিক মন ভরে না। ছুটির দিন আর সামারের শুরু, এদের আর পায় কে! ছোট বাচ্ছাদের নিয়ে সব চলে এসেছে, বাচ্ছা ছাড়াও এসেছে।মোদ্দা কথা বাড়িতে যা লোক বা শহরের মধ্যে, পার্ক গুলোতে অনেক বেশী। একদিকে আবার স্থানীয় বাজার বসেছে, সেখানে খাবারদাবার, মদ, জ্যাম ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। টিউলিপ এর সকয় শেষ হতে হতেও হয়নি, এখনোনবেশ কিছু জায়গায় রয়ে গেছে। একটা মেজ বানানো আছে, চাইলে হারিয়ে যাও, নকশাটা ঢোকার মুখেই আঁকা আছে, মনে করে বেরোতে পারলে ভালো, না হলে পাম খেয়ে খেয়ে বেরোও। এক একটা ভুল গলিতে ঢুকছি আর চারজনে বোকা হয়েছি বুঝে হেসে ইউটার্ণ নিচ্ছি। এমন চমৎকার দিন গুলো বেশ আঁকা রয়ে যায় মনের মধ্যে।






ভিয়েনার ওল্ড টাউন সকালে ঘুরেছি বটে কিন্তু আরো কিছু জায়গা ঘোরার জন্যে হোক, বা ছবি তুলতে চাইলে হোক সভ চেয়ে ভালো উপায় দু নাম্বার ট্রামে উঠে পড়ো, তারপর স্টিফেনপ্লাটজে  নেমে ফের এক নাম্বারে ওঠো। মোটামুটি তাহলেই ওল্ড টাউন চক্কর দিতে পারবে।  ট্রামে উঠি,  ইচ্ছে মতো জায়গায় নামি, এদিক সেদিক চক্কর কাটি। ফের উঠি। ভিয়েনার কাছেই একটা জায়গা আছে, কাহলেনবার্গ বলে। ছোট্ট পাহাড়। বাস পাহাড় অব্দিই যায়। যাওয়ার রাস্তাটাও ভারী সুন্দর। জঙ্গল মতো। বেশী লোকে যায় না। পপুলার ট্যুরিস্ট প্লেস তো না। আমাদের সাথে নামলো কজন ছাত্রছাত্রী। পাহাড়ের মাথায় একটা ছোট্ট ইউনিভার্সিটি, একটা চার্চ,  একজনের সমাধি আর একটা রেস্তোরাঁ। এখান থেকে অনেক ছোট ছোট ট্রেইল বেরিয়েছে,  আশেপাশে হাইক করার জন্যে। আমরা অবশ্য হাইক করব না। আমরা এসেছি সুর্যাস্ত দেখতে। দানিয়ূব নদী সহ পুরো ভিয়েনা শহরটার উপর সূর্য ডোবার সময় একটা স্পটলাইট ফেলে যায়। এমনিতেই এই সোনা রঙের আলোটা এত নরম যা দেখি তাইই বড় সুন্দর লাগে। তখন সোনালী রঙের শুরু হয়েছে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, বসে বসে হাঁ করে পাহাড়, নদী, শহর দেখি। পিছনের ব্যাকগ্রাউন্ডে এক ভিখারী বাজনা বাজিয়ে চলেছে, পাশের চার্চের ঘন্টার আওয়াজ। সব মিলিয়ে মনটা কেমন ডুবে যায়। পাশাপাশি চুপচাপ বসে থাকি, মনের মধ্যে আঁকা হয়ে যায় পুরো ছবিটা, আলোর গন্ধ আর আবহসংগীত সমেত। এরকমসব অনেকগুলো ছবি জল হয়ে শান্ত টলটলে একটা দিঘী হয়ে যাবে। তারপর খুব গরমের দিনে, কিংবা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ার পর, ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপট বুলিয়ে দেবে।

 
ক্রমে হু হু করে হাওয়ার ঝাপট বাড়ে, রেস্তোরাঁর বাইরের চেয়ার তোলার কাজ শুরু হয়, লোকজন কমতে থাকে।পিঠে দুটো ব্যাকব্যাক নিয়ে সেই সকাল থেকে থেকে বেরিয়ে হেঁটেছি, বসেছি, ঘুরেছি...তাও ক্লান্ত হইনা যেন, বসেই থাকি আমরা। এমন সময় একদল লোক এলো। জনা ছয়েক হবে, ট্র‍্যাডিশনাল জার্মান/অস্ট্রিয়ান পোশাক পরনে। এরা ওটাকে বলে ট্রাখটেন। কোনো বিশেষ দিন, বা মেনস ডে আউট এসব কোনো দিনে পরে।  ফুল মোজা, কাজ করা হাফপ্যান্ট, জ্যাকেট বা গলাবন্ধ কোট, মাথায় হ্যাট। বেশ মজা লাগছিল, ওদের দেখতে। কেউই অল্পবয়সী না, স্যান্ডউইচ, ওয়াইনের বোতল নিয়ে ওয়াহ ওয়াহ, উন্ডারবার (ওয়ান্ডারফুল)করতে করতে হাজির হয়েই ঝটাপট হাতে হাতে স্যান্ডউইচ নিয়ে খাওয়া শুরু।কেউ ক্যামেরায় ছবি তুলে নিল এর ফাঁকে। ক্রমে আলো আরো কমে এলো, হাওয়ার দাপট বাড়লো, পিছনের ভিখারিটাও বাজনা গুটিয়ে ফেলল। আমরাও টুকটুক করে রওনা দিলাম। বাসে বসে আছি জানলায় নাক ঠেকিয়ে হঠাৎ একটা বিপুল বদখত গন্ধে প্রাণ ককিয়ে উঠল। সামনের মুখোমুখি সীটে দুই হিপিনি টাইপ মেয়ে উঠেছে। সাথে তাদের কুকুর। পোষ্য না মালকিন কার গায়ে বেশী গন্ধ বুঝছিলাম না। ওরে বাবা রে বাবা, জামা পেন্টুল মনে হয় একশো বছর কাচেনি, চান তো ছেড়েই দিলাম। কোথায় সুন্দরী মহিলা সামনের মুখোমুখি সীটে, ভালো আনন্দদায়ক যাত্রা হবে আর কপাল দেখো! ত্রাহিমাম ত্রাহিমাম করতে হচ্চে!! মুচ্ছো যাওয়ার মুহূর্তে বাস থামলো! একটা টার্কিশ দোকানের সামনে গিয়ে শোঁক শোঁক করে কাবাবের গন্ধ নিয়ে তবে প্রাণ ফিরলো! 
(চলবে)

2 comments:

  1. ওরেবাবা সে কী গন্ধগোকুল রে বাবা। যাইহোক। চমৎকার এগোচ্ছে।

    ReplyDelete
  2. চরৈবতী

    ReplyDelete