Sunday, January 15, 2023

নবান্ন

একেকটা শব্দ থাকে বড় মোলায়েম হয়, হাত বোলানোর মতো নরম। আবার একেকটা শব্দ কেমন রেশ রেখে যাওয়ার মতো হয়। নতুন সুর,  নতুন শব্দ যারা তৈরী করতে পারেন তাদের আমার জাদুকর মনে হয়। বিপন্ন বিস্ময় শব্দটা যতবার শুনি কেমন যেন লাগে। বহু ব্যবহারে ধুলো পড়ে গেছে হয়ত কিংবা যারা কবি বা সাহিত্যিক বা ভালো পাঠক তাদের শুনে নির্ঘাত হাসি পাবে ওহ এতক্ষন ধরে এত কথা বলে সেই বিপন্ন বিস্ময়ের কথা বলা!  কিন্তু শব্দটা এত জ্যান্ত! নাকি শব্দবন্ধটা এত জ্যান্ত বলাটা ঠিক হত? ট্রেনে করে ফিরছিলাম, ধান কাটা হয়ে গেছে,পৌষ মাসের শেষ। নবান্ন কাল।মাঠের উপর একটা ধোঁয়ার স্থির রেখা চলে গেছে দিগন্ত জুড়ে, বিকেল ক্রমে সন্ধ্যের দিকে এগোচ্ছে। কারোর বিস্ময় নেই কেন? আশ্চর্য লাগে না, রোজ এক জিনিস এমন নতুন করে হয় কী করে। একবার ট্রেনের মধ্যে চোখ বোলালাম, ফোনের নিমগ্নতা, নয়ত ক্লান্ত চোখ বুজিয়ে ঘুম। বহুদূর থেকে আসছে এ ট্রেন তাই হয়ত আর বিস্ময় অবশিষ্ট নেই।তার মধ্যে দেরীতে চলছে,বাড়ি ফেরবার তাড়াটাই বেশী। বাড়ি তো যেতেই হবে,  আজ থেকে তিনদিন পিঠের উৎসব, মা ফোন করেছিল, পিঠে বানাচ্ছে, নলেন গুড় আর পিঠের সুবাস যেন এই ধান কাটা হয়ে যাওয়া মাঠের হাওয়ায় ভেসে আসছে। কিন্তু,রাস্তার আকর্ষনও তো কম নয়! ওই সূর্যটা আরেকটু লাল হল, আরো দূরে গেল, এখন স্রেফ লালচে আভা, তারও কত রকম শেড!তারপর ঝুপ করে অন্ধকার। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলেও আবছা গাছপালা দেখি। বিশেষ করে কী আছে বলতে বললে বলব দেখার কিছুই নেই, ফি হপ্তাতেই আমার এ পথ দিয়ে যাওয়া,  তবুও এই আবছায়া,  এই আলো আঁধারি, এই বিকেল, গোধুলিতে বড় অবাক ভাব জন্ম নেয়, কেমন যেন আশ্চর্য লাগে। আর পালাতে ইচ্ছে করে কোথাও।
পালানোর বদলে অবশ্য নলেন গুড়ের বাটিতেই ঝাঁপ মারি, হাসতেই পারো,  মোল্লার দৌড় ফেসবুকের স্ট্যাটাস বলে। কিন্তু এ বোধহয় তবু ভালো একটুও বিস্ময় না থাকার থেকে। সব অবাক হওয়া ফুরিয়ে গেলে আমার নতুন অন্নের আনন্দও যে ফুরিয়ে যাবে! 

3 comments:

  1. এই পোস্টটা পড়ে বাবামায়ের মুখার্জিদার কথা মনে পড়ল, যাঁর কুমারঢুবির বাড়িতে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হিন্দমোটর আর কোন্নগর স্টেশনের মাঝখানে রেললাইনের পশ্চিমপাড়ে একটা বিস্তৃত জলাভূমি মতো আছে। স্কুল যাতায়াতের পথে রোজই পেরোতাম। বাবামাও পেরোতেন, মুখার্জিদাও পেরোতেন। ওঁর বাড়িতে নানা গল্পের সঙ্গে কী করে কথাটা উঠল, মুখার্জিদা বললেন, আমি বাকিদের (বাকি ডেলিপ্যাসেঞ্জারদের) বলি, যে আর কোথাও চাই না, শুধু ওই জায়গাটা আমাকে যদি জানালার পাশটা ছেড়ে দাও, বাকি রাস্তাটা (তিন ঘণ্টার ওপর, উনি বোধহয় বর্ধমান না কোথায় নামতেন) দাঁড়িয়ে গেলেও ক্ষতি নেই। মুখার্জিদাকে রকমসকম কেউই বুঝত না কিন্তু সকলেই ভালোবাসত এবং সকলেই ওই সময়টার জন্য হেঁকেডেকে তাঁকে জানালার পাশে এনে বসাত। তিনি তখন তাঁর সারাদিনের চব্বিশঘণ্টার সাড়ে পনেরো সেকেন্ড ওই জলাভূমির ওপারের সূর্যাস্তের আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যয় করতেন। আজকাল অবশ্য বুঝতে পারি, সারাদিনে আরও অনেক পনেরো সেকেন্ড বার করে নিতেন মুখার্জিদা, নিজের মতো করে খরচ করার জন্য, যে সেকেন্ডগুলো আমরা বোর হয়ে, বিরক্ত হয়ে, ল্যাজেগোবরে হয়ে কাটিয়ে দিই।

    খুব ভালো লেগেছে পোস্টটা, বুঝতেই পেরেছ, না হলে এত কথা মনে পড়ত না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. মুখার্জিদার* রকমসকম

      Delete
    2. খুব ভালো লাগলো কুন্তলাদি। এরকম করে এদিক সেদিক খামচা মারা পনেরো সেকেন্ড দিয়ে কত পনেরোশো সেকেন্ড সামাল দিতে হয়!
      -প্রদীপ্ত

      Delete