Sunday, December 26, 2021
আনাচ কানাচ
Saturday, December 11, 2021
মহারাজ, একি সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে (পর্ব দুই)
ছেলের মন্দির (ঘটোৎকচ এর মন্দির । এরকম প্রাকৃতিক হওয়াই উচিত ছিল বটে ওরকম বীরের ) |
ঐ যে কালো মত মূর্তিটা বশিষ্ঠের(চুরি করে তোলা ছবি কিনা তাই এমন) |
মনু মন্দির |
Friday, November 26, 2021
মহারাজ, একি সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে
নষ্ট ব্যপারটা একেকজনের কাছে একেকরকম। মাস গেলে বিশাল বড় কোনো পদে থাকা লোকের কাছে এক সপ্তা কাজ না করর ঘুরে বেড়ানো হল সময় নষ্ট, কারোর কাছে গান শোনা সময় নষ্ট কারোর কাছে গান হীন দিন মানে নষ্ট। এত নষ্টের কথা এলো কারন, সেদিন শিমলা ম্যালে যেই না ঝুপ্পুস করে মেঘ নেমে এলো আর তারপর পরেই বৃষ্টি, কানে এলো, 'এরকম আবহাওয়া বেড়াতে এসে দিনটাই মাটি'। আমাদের অবশ্য মোটেও মনে হল না নষ্ট হল কিছু। দিব্যি মেঘে মেঘে ছেয়ে গেল চারপাশটা, তার ফাঁক দিয়ে দিয়ে সেই কতকালের পুরোনো সব স্থাপত্য উঁকি দিচ্ছে, একদুজন স্থানীয় লোক দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে,চারপাশটা বিলকুল ফাঁকা।জুতো ছেড়ে এখন আমার মোজা ভিজেছে টের পাচ্ছি, শীতে কাঁপছি তার মধ্যে ফূর্তিটা আসছে কোত্থেকে হ্যাঁ?
আসলেই আনন্দ ব্যপারটার জন্য কোনো উপকরণই পর্যাপ্ত না আবার অপর্যাপ্তও না। কতদিন হয়েছিল আমার মনের ভিতরটা কেমন ভেজা খড় হয়ে পড়েছিল। কিছুতেই লম্বা সময়ের আনন্দ আর হয় না। কিছুতেই আগুন জ্বলে না। তারপর ট্রেনের ভোর এলো, চা, নাস্তা- ব্রেড অমলেট, আলুপরোটার হাঁকডাক, চলন্ত গাছপালায় রোদ দেখতে দেখতে ভিতরের ভেজা খড়টা যে শুকোতে শুরু করেছে তা সত্যি বলতে খুব একটা টের পাইনি। মনের ব্যপার স্যপারই আলাদা মশাই, কখন পাক খেতে খেতে পাহাড়ের উপর আর কখন নীচে টের পাওয়াই যায় না! সে যাক বেড়ানোর গল্পে এসব অবান্তর কথা। তা অবশ্য সত্যি বলতে আমার লেখায় বাঁধ ছিলোও না কখনো তেমন, সাহিত্য না এ স্রেফ কিবোর্ডে টাইপ আর কি।
ট্রেনে করে বাংলা পার হয়েও কিন্তু মনে হচ্ছিলো না ভূ-প্রকৃতি খুব বদলেছে, জলাশয় কম চোখে পড়ছে বা পড়ছে না, তা বাদ দিলে সবুজ ক্ষেত খামার পুরোটাই সঙ্গ দিলো তো দিব্যি। আর আশ্চর্যের বিষয় দেখলাম ট্রেন যখন ব্রিজে ওঠে আর গুমগুম আওয়াজ হয় ঠিক ছোটবেলার মতই উত্তেজনা হয় নদী দেখার। বহু বহু দিন পর ট্রেনে এমন লম্বা জার্নি, অত সময় পাওয়াই যায় না এখন। মাঝে মাঝে যখন পুরোনো কারোর লেখা পড়ি তিন মাস হাওয়া বদলে কিংবা এক সপ্তাহ আগে থেকে বিয়ে বা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যেত, তাদের ক্ষতি তো কিছু হত না কাজে, আমরা স্ক্রাম স্ক্রাম খেলায় কিই যে মহৎ কাজ করে দিচ্ছি কে জানে!
কালকা স্টেশনটা ভারী চমৎকার। খুব বড় কিছু না, কিন্তু ঝকঝকে। পুরোনো দিনের মত করে সাজানো টয় ট্রেনের সামনের স্টেশনের অংশ। এক গাদা পাখি শেষরাতের যাত্রী, হকার সবার মিলিত হাঁকডাকের সম্মিলিত প্রতিবাদ জানাতে লেগেছে। আরে আবার বৃষ্টি এলো দেখছি!এমনিতেই কোভিডের কারনে মা বাবাইকে নিয়ে বহুদিন বেরোইনা, তাছাড়া আমার বাবা পাহাড়ে একটু ভয় পায় তবু পাহাড়ে এসেছি। এর মধ্যে বৃষ্টি ভয় দেখায় খানিক। উত্তরাখন্ডে বিপর্যয় চলছে, আমরা যখন হিমাচলের দিকে পা বাড়িয়েছি, হালকা চিন্তা আছেই।তার মধ্যে বেরোনোর দিন সকালে মায়ের হাতে গায়ে ফুটন্ত জল পড়েছে। আর আশ্চর্য হয়ে দেখলাম এত চিন্তা সমেতও চিন্তা গুলো তেমন হুল ফোটাতে পারছে আনন্দে। মানে এই যে শিবালিক ছাড়ল, আমাদের পাশে পাহাড়ের দেওয়াল আর মায়েদের ওদিকে দিব্যি বিস্তীর্ণ এলাকা তাতেও কি দমলাম নাকি(অথচ আমরা আমাদের সিট ছেড়ে এসেছি ওদিকের)। ছেলেমানুষ হয়ে টাকমাথা টিটিকে বলা গেল সিট বদলাতে, সে ব্যাটা ঝিমুলো তবু শুনলো না, মানুষ এমতাবস্থায় কী করে? চুপ করে বসে থাকে আর যা পাওয়া যায় তাই দেখে কিংবা মন খারাপ করে তো? আমরা দুজন একটুও না দমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম চারপাশ, জানলায় নাক ঠেকিয়ে কিংবা দরজা খুলে দেখলাম কেমন টানেলে ঢুকছে ট্রেন বা পুলের উপর দিয়ে বাঁক নিচ্ছে! তারপর দেখি একজন লোক ভালো দিকের জানলায় বসে ঘুমোচ্ছে, তার সিটে বসতেই বাপ্রে কী ঘুম পেলো!!! মানে অবস্থাটা ভাবুন, আপনাকে বললাম দাদা আপনি ঘুমোচ্ছেন তাহলে আমি এখানে বসি? বসে আমি পাঁচমিনিটের মধ্যে ঢুলতে শুরু করলাম!! একে কাউকে সিট বদলাতে বলাই আমাদের কাছে দুঃসাহসিকতম কাজ তায় সেই সিটের মর্যাদা না রাখে ঘুমিয়ে পড়ায় লজ্জায় আমাদের আমাদের জন্য সীতার পাতালপ্রবেশ এর মতো কিছু প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তা কলিকালেও এসব আছে হে, অবিশ্বাসীর দল, না হলে ফস করে বারোগ স্টেশনটা চলে আসতো না। কালকা শিমলার এই যাত্রাপথের মাঝে মাঝেই ছবির মতো সুন্দর সব স্টেশন পড়ে। শিভালিক এক্সপ্রেস সব জায়গায় থামে না এই একটি স্টেশনেই থামে। বারগের আগে একটা স্টেশন দেখেছিলাম পাহাড়ের বাঁকে, ট্রি হাউস আছে একটা।ওখানে থেকে যাবার ইচ্ছে মনে আসতে আসতেই পরের টানেলে চলে গেছি। বারগে খাবার দাবার পাওয়া যায়। সেইইই কোন ভোরে উঠেছি, সিধে কালকা অব্দি জায়গা পাইনি বলে চন্ডিগড়ে নেমে কামরা বদলে আবার একই ট্রেনে উঠে আসা। খিদে পাবে না হ্যাঁ! আর এরকম একটা বৃষ্টি ধোয়া ঝকঝকে স্টেশনে যদি চা, ভেজ কাটলেট, (আসলে কাটলেটের আকারে আলু টিক্কি বলা যায়, যদিও খেতে চমৎকার) , চানা বাটোরা(সাত সকালে অম্বলের ভয় ছিল কিন্তু এ জিনিস আলাদা খানিক আমাদের এখানকার থেকে) ইত্যাদি মেলে তাকে না করলে পাপ লাগে। খামোখা পাপের পথে যাবার থেকে খাওয়াই ভালো।
তারপর তো টানেলের অন্ধকার, বনের পথের মধ্যে দিয়ে দিয়ে পৌঁছনো গেল আরেক ঝকঝকে সুন্দর স্টেশনে। আহাহা এমন সুন্দর করে রাখতে তো খুব পয়সা লাগে না, আমরা অসুন্দর করে রাখি কেন?
বিকেলে বৃষ্টি এলো যখন, তখনই শুনছিলাম আশপাশ থেকে হা হুতাশ। কারো কারো নষ্ট হল আর আমাদের মতো কারো কারো মেঘ জড়িয়ে হাঁটা হল। শিমলা ম্যালে সবাইই গেছে মনে হয়, ইনফ্যাক্ট সকলেই আমায় বলেছিল শিমলায় না যেতে কিছুই নেই। আমি এখনো হাঁ করা টাইপ গেঁয়ো ভূত বলেই হয়ত আমার খারাপ কিছু লাগেনি। দিব্যি ঝকঝকে তকতকে ম্যালের রাস্তা, বেকারি, পুরোনো স্থাপত্য পাশে পাশে। বৃষ্টিতে মেঘেতে লোকজন কম ছিল সেটা একটা আহ্লাদের ব্যপার ছিল তবে আমার পরের দিন বিকেলে ফের গিয়েও দিব্যি লেগেছে। চার্চের মাথায় শেষ বিকেলের আলো,কিংবা সন্ধ্যের মুখে ঝুপঝুপ করে জ্বলে ওঠা স্ট্রীট লাইট, অন্য স্বাদের বেকারি, ছোট্ট ক্যাফের বাইরে বসে চায়ে চুমুক মন্দ লাগার অপশনই নেই।
হিমাচল ট্যুরিজম এর ব্যবহার, সার্ভিস, হোটেলের মেইন্টেন্যান্স সব কিছু এত চমৎকার লেগেছে বলার না। আর হিমাচলি থালিটার কথা না লিখলে খুব খারাপ হবে। কুমড়ো যদি এত ভালো করে বানানো যায় তবে এরম বিশ্রী করে খাওয়ানো হয় কেন এরকম একটা প্রতিবাদী প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে। আর ওয়ালনাট পাইটার কথা বলিনি বুঝি? থাক বলে বেশী কষ্ট টস্ট দিয়ে লাভ নেই। একখান ছবি দিয়ে যাই বরং।
শিমলা থেকে মানালির রাস্তাটা এইই লম্বা। পাহাড়ে আমার গা গুলোয়, কিন্তু মান্ডি পেরোনোর পর থেকে যেই রাস্তার পাশ দিয়ে বিয়াস দেখতে পেলাম অমনি রাস্তা সারাই এর ধূলো উপেক্ষা করে কাচ নামিয়েছি আর অমনিই আমাদের ড্রাইভার যোগীন্দরজি বিড় বিড় করে জানালো ক্লাচ কাজ করছে না! বোঝো! কিন্তু ওই যে খড়টা শুকোতে শুরু করেছে বলেই হয়ত, তেমন কিছু বিরক্তি হল না। গাড়ি খারাপ হতেই পারে, আমাদের আজ মনিকরন ঘুরে যাবার কথা ছিল তা হবে না আর সত্যি বলতে কি ভালোই হয়েছে। এত লম্বা পথ একদিনে পাড়ি দিয়ে আবার এদিক সেদিক ঘোরা কষ্টকর হয় তাছাড়া অমন করে আর যাই হোক পাহাড়, তাও আবার হিমালয়ের মত পাহাড় ঠিক উপভোগ করা যায় না। যে জায়গায় গাড়ি খারাপ হয়েছিল, রাস্তার কি সব কাজ চলছিল, সে কি ভয়ানক ধূলো। তাও আমার হাঁচি টাঁচি শুরু হল না কিচ্ছু। বিয়াস উচ্ছল কিশোরীর মত বইছে। আকাশটা কি নীল!
কদ্দিন থাকবে এসব কে জানে! মানুষ যেভাবে পাহাড় কেটে চার লেনের রাস্তা বানাতে শুরু করেছে তাতে মনে সন্দেহ লাগে। পাহাড় কাটলে আমার ভারী দুঃখ হয়। কত শিকড় পাথর ,পোকামাকড় মরছে বলে শুধু না, পাহাড় নিজেই ভীষন জ্যান্ত একটা জিনিস। তাকে কেটে কুটে মিলিয়ে দিলে মায়া লাগে, দুঃখ হয়। একটা লোক খুব চানা বিক্রী করছিল। ধূলোমাখা চানার আলাদা স্বাদ হত অবশ্যই কিন্তু অজানা ধরনের মোয়াও তো বিক্রী হচ্ছিল। জিনিসটা তোফা খেতে কিন্তু কী দিয়ে তৈরী জানতে পারলাম না। যোগিন্দরজি হঠাৎ ডেকে বলে দেখ দেখি কেমন ফের কাজ করছে ক্লাচ!বোঝো! এ গাড়ি না প্রডাকশন সার্ভার একবার কাজ করে একবার না! শেষে তার মালিক অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দিল, ফের উজিয়ে মান্ডি গিয়ে নতুন গাড়িতে করে নতুন রাস্তা ধরা গেল। নতুন রাস্তা কারন এই নতুন ড্রাইভার শৌখিন মানুষ, ধুলোভরা রাস্তার থেকে ঘুরে যাওয়া তার পছন্দের। লম্বা লম্বা পাহাড় পেরিয়ে যেতে যেত চোখে পড়ে আইআইটির মস্ত ক্যাম্পাস নদীর ধারে। সন্ধ্যে নামার মুখে এক পাল ভেড়া আমাদের সামনেই ঘরে ফেরে।
কুল্লু উপত্যকায় নদীর আওয়াজ শুনতে পেলাম দেখার উপায় নেই, সন্ধ্যে নেমে গেছে, দেখতে পাবো কাল। উফফ সে যা সুন্দরী দর্শনেই প্রেম হবে কিন্তু সে সব তো পরে। এখন অন্ধকারে একটা বিশাল রাজবাড়ির সামনে নামিয়ে দিল। অল্প আলোয় হোটেলের বিশাল কাঠের দরজা পেরিয়ে পেরিয়ে একটা একটা মহল পেরিয়ে আমাদের ঘরে পৌঁছনো গেল। মস্ত ঘর, দোতলা ঘর,ঝোলাবারান্দা, পাথরের বাথরুম। সব মিলিয়ে রাজকীয় ব্যপার বটে। তবে রাজার মেজাজ টের পেয়েছিলাম পরের দিন সকালে।(ক্রমশ)
Monday, August 9, 2021
হাওয়াবদল
আকাশী রঙের প্রজাপতিটা আজকেও এসেছে। রোজই এই সময়টা ওড়াউড়ি করে।ছোট কাঠবিড়ালিটা আজ আসেনি দেখছি। ট্রেনের হুইশেলের আওয়াজ শুনতে শুনতে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দিতে সকাল দেখছি। সুভাষবাবু দাঁতন হাতে উল্টোদিকের সুনীলবাবুর সাথে গল্প জুড়েছেন। মার্টিনবাবু লুঙি পরে দাঁত মাজছে বারান্দায়, দুটো মেয়ে দু পাশে দাঁড়িয়ে,বউটা পাশে দাঁড়িয়ে দুধ নিচ্ছে গোয়ালার থেকে। ছোট গেটের পাহারাদারকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না৷ দূর থেকে মাছওয়ালার আওয়াজ আসছে, "মাআআছ, বড় বড় মাছ"। একটা কেন্নো আপনমনে হেঁটে যাচ্ছে বারান্দা দিয়ে।
দিন কতক হল হল রাণীগঞ্জে এসে থাকছি। হাওয়াবদল আর কি। কোনো জায়গায় থেকেছি মানে, প্রতিটা ঋতু সেখানে অনুভব করেছি, তা না হলে স্রেফ গেছি বলা যায়, থাকা বলা যায় না। আমার হাতে অফুরন্ত যৌবন, টাকা আর সময় থাকলে আমি হয়তো সব পাহাড়, সব জঙ্গল সব দ্বীপে একটা বছর কাটাতে চাইতাম। যদিও চাইনা খুব একটা অত অনন্ত কিছুর লোভ নেই, সত্যি বলতে লাভও নেই। খুব কিছু বেশী থাকলে তার দাম অতটা থাকে না। এর আগে শীতে এসেছি, বসন্তে এসেছি এখানে, গরমে আসা হয়নি নিজেই কোভিডাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। শুনেছি গরম এখানে নাকি খুবই কষ্টের, তবু সে গরমের রৌদ্র রূপও আমার পছন্দের। খাঁ খাঁ করা প্রকৃতি আমার খারাপ কিছু লাগে না। ভালো লাগে বরং৷ যেমন এখন বর্ষায় চারদিক সবুজ দেখতে চোখের আরাম হয়। বর্ষাকালে গাছ পালাদের এই স্ফূর্তিটা কোলকাতায় বসে স্রেফ বোঝা যায়না। আমাদের বারান্দা গেলে টবের গাছগুলোকে দেখলে একটু বোঝা যায় তবে শিকড় মেলতে না পারা গাছগুলোর আনন্দের প্রকাশ তো এরকম হবে না, একটু আটকানো হবেই।
ঘুম ভাঙে অজস্র পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে। পাশেই একটা অশ্বত্থ গাছ আছে, তাতে প্রচুর পাখি সাত সকালে আড্ডা জমায়। কিংবা বাজারহাট করে কিংবা পড়াশোনা করে। একটা টুনটুনি দোল খায় মাঝে মাঝে কলাগাছের উপর। যদিও চড়াই,ঘুঘু, ছাতারেই বেশী, তাও দোয়েল টুনটুনি কিংবা ফিঙের দেখাও মেলে। বারান্দায় আয়েস করে বসে বসে চা জলখাবার খেয়ে আমরা কাজে বসি, পুব দিকের বারান্দায় বসে প্রচুর মিষ্টি দেওয়া চা খায় শিবানি। এখন শ্রাবন মাস চলছে কিনা, সোমবার করে প্রচুর গান বাজনা ভেসে আসে রাত অব্দি। মসজিদের দিক থেকে আজানের আওয়াজ ভেসে আসে।
ছুটির দিনে বাজার যাই আসলে ফুডওয়াক করতে। এ অঞ্চলে লস্যি, রাবড়ি, কালাকাঁদ, কচুরি, জিলিপি,চাট এসব খুব মেলে। খেতেও তেমন হয়। আমরা চারটে কাজ নিয়ে বাজারে গেলে পাঁঁচবার থামি, কোনো দোকানে হয়তো টাটকা প্যাঁড়া, কোনো দোকানে, লস্যি, কোনো দোকানে জিলিপি কচুরি,কোথাও এক ভাঁড় রাবড়ি। বাজারটা জমজমাট, শতকরা নব্বই ভাগ দোকানই অবশ্য অবাঙালীদের হাতে। ফলের দোকান, তালাচাবি বানানোর জায়গা, মশলার গন্ধ, টোটোওয়ালাদের হাঁকডাক সব মিলিয়ে বেশীরভাগ সময়ই জমজমাট। মুচির দোকানের সামনে অকাজের লোক উবু হয়ে বসে, মিষ্টির দোকানে ছেলের হাতে দই এর ভাঁড় ধরিয়ে মা মুখময় আনন্দ নিয়ে বসে। মাংসের দোকান বেশীরভাগ মুসলমানদের চালিত। ছোট জায়গা মোটামুটি পরিচিতি তৈরী হয়ে যায়। রাত হলেই ম্যাজিকের মতো সব শান্ত। একেকদিন সন্ধ্যে পার করে বেরোলে দেখি, বেশীরভাগ দোকান বন্ধ, শুধু খাবারের ঠেলা গুলোর সামনে ভীড়, পুরোনো বড় বড় বাড়ি গুলো সকালে ভীড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এখন স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে এইই বড় দেউড়ি, কারুকাজ করা থাম। কোনো সিঁড়িতে বসে মাতাল। ভিখারীটা কম এখানে। তারা মূলতঃ দোকান থেকেই ভিক্ষে আদায় করে খেয়াল করেছি।
অনেকটা জুড়ে ক্যাম্পাস, মেইন্টেন্যান্স নেই বলে চারিদিকে ফাটাফুটো। এই বর্ষায় সেইসব ঢেকে দিয়েছে শ্যাওলা আর ফার্ণ এর পোশাক। আমাদের কোয়ার্টারের সামনেই একটা লেবু আর জুঁই ফুলের গাছ আছে, ফুলের গালিচা বিছিয়ে রাখে ঢোকার মুখে আর লেবু পাতার গন্ধ আনে বিকেলের বাতাস। অপুকে হরিহর বলেছিল না হাঁ করা ছেলে, আমি অমন হাঁ করা খানিক। এখনো পর্যন্ত আমার বিস্ময় কাটেই না ওই যে পাশের বাড়ির ভাঙা কার্ণিশে মোটা মোটা রোঁয়া নিয়ে শ্লথ গতিতে হেঁটে চলেছে শুঁয়োপোকাটা, ছোটবেলায় যেটাকে কতবার কাঠিতে জড়িয়ে জ্যান্ত কবর দিয়েছি (কবর দিয়ে আবার একটা ক্রশ বানাতাম, চিতা টিতা জ্বালানো শক্ত আর ঝামেলার কিনা, তার থেকে খ্রীষ্টান হওয়া সোজা। মুসলমানেরা ক্রশ দেয় না, ফলে তেমন সহজ জমকালো পারলৌকিক করার উপায় থাকে না কিনা) সেটা নাকি ওই আকাশ নীল প্রজাপতিটার ছোটবেলা!! ভাবা যায় না এইবারের বর্ষায় এসে দেখছি দেবদারু গাছ গুলো বেড়ে গিয়ে পাঁচিলের মতো হয়ে গেছে পিছনের দিকটায়। বেলা পড়লে পুবের বারান্দাটা ভারী অন্যরকম হয়ে যায়। দেবদারু গাছ গুলো নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকে, দু চারটে কাক, ছাতারে অশ্বত্থের ডালে কিংবা নারকেল গাছে বসে৷ পায়রাগুলো একটু মানুষ ঘেঁষা তাই কার্নিশেই বেশী বসে। এই বারে এসে একটাও হনুমান দেখলাম না। চারিদিকটা একদম নিশ্চুপ। বিকেল গড়িয়ে গেলে নিজের কানের সোঁ সোঁ শব্দও শোনা যায় যদি সেদিন ঝিঁঝিঁ কিংবা ব্যাঙ না ডাকে। ইতোয়ারি মোড়ের মশলাপট্টির গন্ধ, বাজারের হাঁকডাক, টোটোওয়ালাদের ধমকানি মিলিয়ে যে ঘূর্ণিটা ওঠে সেটা পেরোলেই ষাঁড়ের গোবর, শুয়োরের নোংরা, ইজের আর ধুকধুকি পরা বাচ্চাদের এলাকা। এর মাঝেই মাছিওড়া ফুচকা কিংবা জিলিপি কিংবা চাট বসে আছে। সেসব পেরিয়ে চোখ বোলালেই দেখা যায় ঘন সবুজ শ্যাওলার বুনোটে প্রাচীরটার একটা অংশ ঢেকে গেছে।
একদিন গেলাম ভাটিন্দা ফলস আর তোপচাঁচি। বর্ষাকাল পিকনিক পার্টির ভীড় নেই। রাস্তাটায় আগে গেছি মাইথন যাবার সময়, এত সবুজ ছিল না, বরং রুক্ষই ছিল। এবারে যেতে গিয়ে দেখি ঝাড়খন্ডে ঢোকার অনেক আগে থেকেই চারদিকের ভূপ্রকৃতি অনেক সবুজ, সতেজ। ধানবাদ শহরের ভিতরে ঢোকার পর অবশ্য সেই ত্রাহিমাম অবস্থা, বিশেষ করে বীরসা মুন্ডা মোড়ের কাছে। গাড়ি এক ইঞ্চিও নড়ে না, অজস্র ট্রেকার, গাড়ি, বাইক, দরজা খুলে কেউ কেউ গুটখার পিক ফেলছে, আর উদাস চোখে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে৷ বলাই বাহুল্য মাস্ক এখানে দুর্লভ, কাউকেই দেখিনি। হতাশ হয়ে বলব ভাবছি, "চলো আজ এই হোটেল ব্লুমুনে যাই ঘন্টা হিসেবে ঘর চাইবো ট্রাফিক খুললে ফের আসা যাবে খন। পানু শ্যুট হবে কিংবা রেইড, সে আর কী করা যাবে"! হাপ ইঞ্চি করে করে এগিয়ে খানিক দূর যাবার পর দেখি, এক জায়গায় এক দল যুবক এক মাইল লম্বা ট্রাফিক দেখে কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে খুব হাসছে! আমি মাইরি অবাক হয়েছি খুব। মানে কতটা কাজের বা আনন্দের অভাব হলে একদল কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক দেখে আনন্দ পায়! শনিবারের সকাল, ঘুরতে যা, না হলে আড্ডা মার জমিয়ে কিংবা খেলতে যা না হলে বই কিচ্ছু আনন্দের উপাদান নেই! কী জানি যার যাতে মজে মন। অবশেষে কোনো এক সময়ে এই বিষ্ণুর শয়ানের মতো লম্বা ট্রাফিক জ্যামের শেষ হয়৷ গুগলের উপর পুরো ভরসা করিনা তাই মাঝে এক জায়গায় একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ভাটিন্দা ফলস এর ডিরেকশন। তার তো কান্ডজ্ঞানের ভয়ানক অভাব! গাড়ির মধ্যে মাথা গলিয়ে মুখের কাছে এসে ডিরেকশন দিতে আসে। পরের অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, " ও ঝরোয়া হ্যায় না জাঁহা? হাঁ হাঁ আগলা মোড়ওয়া সে লেফট লেকে চলে যানা"। বেশ বাবা বেশ, মোড়ওয়া থেকে ঝরোয়া যাবো খন। মোড় থেকে বাঁয়ে নিয়ে খানিক গেলে অবশ্য পাহাড় দেখা যায়। প্রায় শহরের বুক থেকে পাহাড় দেখতে পেলে আলাদা আনন্দ হয় কিন্তু। ওই ট্রাফিক জ্যাম দেখে ওদের যেমন আনন্দ হয়েছিল তেমনই প্রায়। তারপর অনেক মানুষে খাওয়া পাহাড়, ছোট ছোট জনপদ পেরিয়ে পেরিয়ে চলা গেল। এদিকে বেশ কটা অশ্লীল নামওয়ালা জায়গা দেখছি তো! পুঁটকি, মুন্ডি ও আবার কি!! যাকগে আমি সাধু সন্ন্যাসী মানুষ, পা থুড়ি অ্যাক্সিলেটর চালাই বাবা। পুঁটকি থেকে বাঁয়ে নিলে যে রাস্তা সেটা একটা গ্রামের মধ্যে দিয়ে গেছে। বেশ খানিকক্ষন গেলে হঠাৎ করে আসে হয়তো একটা পরিত্যক্ত অফিস কিংবা বাড়ি, আবার একটা ঢাউস বাড়ি যার সামনে গোয়ালঘর। আবার খানিক গেলে দুপাশে গাছ গাছলা, তারপর আবার কটা দেহাতি ঘরদোর। এদের ঘরের সামনেই গোয়াল। সে অবশ্য আমি বাংলার গাঁয়েও ওরকম দেখেছি অনেক জায়গায়। কিছু কিছু আদি অধিবাসীদের মুখের দেখা পাওয়া যায় পথ চলতি, টাটা স্টীলের দেওয়া সোলার লাইট। হুট করে পথে পরে একটা বট গাছ, বন্ধ কারখানা, কটা ছোট ছোট চা, ভাত, কোল্ড ড্রিংক্সের দোকান। আশ্চর্য শান্ত নিরিবিলি পুরো জায়গাটা। দোকানের খাবার জিনিস খুব একটা লোভ না দেওয়াই ভালো। কটা সাত পুরোবো বাসী গজা, বালুসাই এর বারকোশ।
ভাটিন্ডা ফলসটা অন্য সময় লোকে লোকারণ্য থাকে, এখন দুজন দেহাতি লোক মাছ ধরছে আর এক দুটো এলোমেলো পরিবার। আজকে আবার কেন জানিনা লোক নেই গেটে তাই বন্ধ! তবে তাতে অসুবিধে হয়নি আসতে, পাঁচিল ভাঙা, আরামেই আসা যায়।জলের স্রোত খুব, পা রাখা যায়না এমন শ্যাওলা। দানবীয় শক্তির অধিকারী হলে বেশ শ্যাওলা, জলের স্রোত উপেক্ষা করে উপরে উঠে যেতাম! এক বুড়ি এসেছে ছাগল চড়াতে। বুড়ির ছাতায় দেখি রাশি রাশি পাতা, ছোট ছাগলটার জন্য সঞ্চয়! আমাদের দেখে এক গাল হেসে বুড়ি খুব গল্প শুরু করলো। দুটো ছেলে নাকি ভেসে গেছে ছবি তুলতে গিয়ে। তারপর কোন রাজা নাকি নীচে পুজো বন্ধ করে দিয়েছিল উপরে চালু করেছিল এরকমই একবার ভুলে গেছিলো খরগ আনতে তারপর জল বেড়ে গেছিল। সব কথা ভালো বুঝছিলাম না, ভাষা বাংলা হলেও ডায়লেক্ট আলাদা, তায় বুড়ি একেবারে ফোকলা। আরো খানিক গল্প হল, তার চোখ আর্ধেক কাটানো হয়েছে, পরের বার গিয়ে পুরো কাটাবে। সত্যিই বুড়ির ছানিটা খুবই পড়েছে। যারা মাছ ধরছিল তারা বুড়ির বুড়ো আর লাতি। খুব গর্ব করে বলছিল। যেই বলেছি, তোমার বুড়ো তো জোয়ান আছে তোমার থেকে, বলে 'না না, কই বুড়া হই গেছে'। দূরে পাথরের আড়ালে এক জোড়া যুবক যুবতী ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, অবিশ্রান্ত জলের আওয়াজ, জঙ্গলের গন্ধ, সময়ে কেটে যাচ্ছিলো কেমন অদ্ভুত শান্তভাবে। তাড়া নেই, না পাওয়া নেই, চিন্তা নেই।
ফেরার সময় টের পেলাম জঙ্গল কেমন গ্রাস করে নেয় তার হারানো জমি। একটা পরিত্যক্ত ঘর ভাটিন্ডা ফলসের গেটের মুখেই, মোটামোটা শিকড় চলে গেছে সেই রূপকথার গল্পের ডাইনির পা এর মতো। যদিও গাছ য়ার শিকড় কোনোদিনই আমার কাছে ডাইনি বুড়ি হবে না। তারপর ফের চলা শুরু হয়, এদিক সেদিক করে চলতে চলতে তোপচাঁচি। মাঝে গুগল ফের ছড়িয়েছিল, তা লোকে তোপচাঁচি লেক বললে চিনতে না পারলেও, ' তোপচাঁচি মে ওয়াটার বডি হ্যায় না', বলতে চিনিয়ে দিলো। তোপচাঁচি যাবার রাস্তাটা দারুণ সুন্দর। বড় বড় মোটামোটা গাছে ঢাকা, সবুজ শামিয়ানা দিয়ে চলেছি মনে হয়। তোপচাঁচিও ফাঁকা মোটামুটি, লোকজন নেই তেমন, পিকনিক পার্টির অত্যাচার নেই ভেবেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে আহা। শীতে এলে এখানে এতক্ষন উব উব উব ডিজে মিক্স চলত। তোপচাঁচি আসলে পাহাড় ঘেরা বড় হ্রদ। হ্রদের পাশ দিয়ে রাস্তা, তারপর জঙ্গল। একটা গাছ দেখি সারা গায়ে ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উই না কী কে জানে! আহারে। কথা বলতে চেষ্টা করলুম একবার, কিছু না স্রেফ কষ্টটা সেরে যাক এইটুকুই বলার। সে উলটে ঠান্ডা হাওয়া দিয়ে আমায় জুড়িয়ে দিলে, নিজের কষ্টের কথা পাত্তাই দিলো না।হ্রদের ওই পাশটায় জঙ্গল বেশী ঘন বেঞ্চগুলোও লতানে গাছে ঢেকে গেছে এই বর্ষায়। তিনটে কাঠকুড়ানি ছেলে মেয়ে শুকনো জ্বালানি কুড়োচ্ছিল। সব চেয়ে ছোত দুটো মিচিক করে হেসে দিলো। ছেঁড়া জামায় হাসি তো আর আটকায় না।
ফেরার পথে খুব খাওয়া দাওয়া হল। পশ্চিমবঙ্গের থেকে সস্তা সেটা কথা না, ভারী আপ্যায়ন করে খেতে দিচ্ছিলো। মানে আজকাল মোটামুটি পপুলার ধাবা গুলো কে এলো কে গেলো পাত্তাও দেয় না, এদের তা দেখলাম না। বেরিয়ে দেখি তুমুল মেঘ করেছে। দূরের পাহাড়ে মেঘ নেমে এসেছে। এখানেও নামলো বলে। নীল পাহাড় কালো মেঘ সবুজ মাঠ নিয়ে ছুটতে ছুটতেই নামলো সে। প্রথমে আস্তে তারপর দিগবিদিক হারিয়ে পাগলের মতো, চারদিক সাদা হয়ে। শ্রাবন মাসে এটুকু পাগলামী তো হক তার। কিংবা হয়তো আমাদের বলছিল, আরেকটু থেকে যাওয়ার জন্য,যেমন সেই ছোটবেলায় কেউ এলে বলতাম কিংবা বলত 'আবার এসো '?