Friday, December 4, 2020

পথ চলতি

 এই রাস্তাটায় আর কোনো গাড়ি দেখিনি অনেক্ষন। মাঝে মাঝেই ঘন শালের জঙ্গল, ফাঁকে ফাঁকে উঁচুনিচু অসমান ভূপ্রকৃতি,ইতিউতি খেজুর গাছ।  মুকুটমনিপুর থেকে বেরিয়েছি অনেক্ষন আগে, এখন ভরদুপুর তাই হয়তো দু চারটে যা পুকুর দেখছি  সেখান থেকে ভিজে কাপড় কোমরে গুঁজে বুড়ি দেখা যাচ্ছে। বাংলার রাস্তায় তিন কিসিমের মহিলা সমস্ত অঞ্চলেই দেখা যায়। এই কোমরে শাড়ির মুড়ো গোঁজা শীর্ণ বুড়ি, মাথায় কাঠকুটোর বোঝা নেওয়া গতযৌবনা,  আর ন্যাংটা (শীতকালে হাফ ন্যাংটা) ছেলে কাঁখে বৌ। হাওড়া, হুগলী,বর্ধমান, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, দুই চব্বিশপরগনা,  মানে জোলো , শুকনো কিংবা শস্য শ্যামলা বাংলা সবেতেই এরা থাকেই থাকে। সেই একইরকম ভঙ্গী, একই রকম অবয়ব, পুরোনো বাড়ির বটগাছের মতো। 


শীতের দুপুর দেখতে ভারী ভালো লাগে, মাঝে মাঝে গুড়ের গন্ধ ভেসে আসলে চোখে পড়ে মস্ত জায়গায় গুড় জ্বাল দেওয়া হচ্ছে, হঠাৎ করে জঙ্গলের মধ্যে থেমে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দাঁড়ালে নিজের কানের মধ্যেকার রক্তচলাচলের আওয়াজ নিয়ে ঘিরে ধরে শালের জঙ্গল। তারপর নাম না জানা কোনো পাখির ডাক ভেসে আসে, তাতে খানিক প্রাণ পায় যেন চরাচর। চটকা ভেঙে যায়। চলা শুরু হয়। এই যে আজ দুম করে মুকুটমনিপুর গেলাম, ফের সোজা পথে না গিয়ে ঘুর পথে চলেছি ফিরে,  রাস্তা দেখবো বলে, পথের বাঁকে হঠাৎ করে আসা গরুর গাড়ি ক্রমে বদলে বাইক, টোটো হয়ে যায় সেই বদলটা মজা লাগে। হাইওয়ে দিয়ে চললে স্পীড মেলে বটে কিন্তু এই যে পথের বাঁকে অজানা গ্রাম, তাদের জীবনের এক ঝলক,  কিংবা এই নিস্তব্ধতা সেসব খুব মেলেনা। মুকুটমনিপুরের ড্যাম এর নীল জলের পাশে দাঁড়িয়ে সকালে চমৎকার লাগছিলো, নিঃসন্দেহে খুবই ভালো ভাবে মেইন্টেইন করা হয়েছে সমস্তটা। পাহাড় ঘেরা হ্রদের ধারে ছুটির দিন নয় বলেই হয়তো ভীড় তেমন ছিলো না। পরেশনাথের মন্দিরের কাছে কিছু জটলা ছিলো।  ওখান থেকে সমস্ত অঞ্চলটা দেখা যায় সেটাও কারন। ভীড় থেকে সরে নামতে গিয়ে দেখি একটা মহাবীরের পুরোনো মূর্তি এমনিই মাটিতে শুয়ে লম্বা হয়ে, বেদী নেই, তেল সিঁদুর, সিক্কা, ভীড় কিচ্ছু নেই। খালি জন্মপোশাকে আরাম করে মহাবীর শুয়ে, পায়ের কাছে ড্যাম আর পাহাড়। একটা গিরগিটি পায়ের কাছে বসে খবর নিচ্ছে, দু চারটে বুনো ফুল ঝরে পড়েছে। আহ এর চেয়ে আরামের শয়ান আর কিই বা হয়৷ আমি নিশ্চিত, মহাবীর সমাধি এটাই যদি হত এরকম ভাবে গাছ পালা পাহাড় গিরগিটি প্রজাপতিদের সাথে  উনি   তাইই চাইতেন। 


চলার পথে অবশ্য শুধু অবিরাম নির্জনতা কিংবা জঙ্গলের ছায়াই থাকে না, আচম্বিতে শুরু হওয়া পথ অবরোধ,  বাজারের মধ্যের রাস্তা সবই থাকে। ক্রমে ক্রমে আলো কমে আসে। বাঁকুড়া থেকে হুগলী ঢুকে গেছি গাছপালা আর জমির চেহারা বদলে গেছে। অনেকদিন পর এতোটা খোলা আকাশ জুড়ে গোলাপী সুর্যাস্ত দেখতে পেলাম। দাঁড়াতেই হয়। চায়ের দোকানও জুটে যায়। অল্পবয়সী এক বউ দোকানদার। হাসিমুখে বায়নাক্কা সয়ে চা সিঙারা দেয়। দূরের মাঠে আগুন জ্বালিয়ে ধানের গোড়া পোড়ানো হচ্ছে আর একটু একটু করে রাত নামছে তখন মস্ত একটা লাল পূর্ণিমার চাঁদ নিয়ে, সেই আলো মেখে ঘর ছাড়ার আমন্ত্রণ নিয়ে ঘরের অভিমুখে চলতে থাকি...



No comments:

Post a Comment